এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সংহতির রাজনীতি – গাজা থেকে আইসিস

    Garga Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৯ আগস্ট ২০১৫ | ১৬৩৭ বার পঠিত
  • গণহত্যার ফলে যখন মানুষ মারা যায়, তখন ‘সন্তান মোর মার’ গোছের ভাবনার একটা দাম আছে। কিন্তু কত মানুষ মরলো, সেই সংখ্যার বিচার-ও একদম ফেলনা নয়। তাই তো চোরাগোপ্তা হাজারো হত্যার মাঝেও জ্বলজ্বল করে কলকাতা ৪৬, নোয়াখালি ৪৬, পাঞ্জাব ৪৭, বরিশাল ৫০, দিল্লী ৮৪, গুজরাট ২০০২। গণহত্যা বা জেনোসাইড কথাটিও ঠিক যত্রতত্র ব্যবহারের জিনিস নয়। পৃথিবীর বুকে থাকার অধিকার আছে সকলের। একটি বিশেষ জনগোষ্ঠী নিকেষ হবার উপক্রম হলে শুধু কটা মানুষ হারিয়ে যায় না। হারিয়ে যায়ে পৃথিবীকে ও জীবনকে দেখার একটি প্রণালী। হারিয়ে যায়ে মানুষ হবার নানা বিকল্প পথের একটা। ফলে আমরা সকলে একটি মোক্ষম চেতনার একটা অংশ হারায়। সেটা হলো – নানা ভাবে মানুষ হওয়া যায়ে। এই যুগে যখন জামা-কাপড়-খাওয়া-দাওয়া-শিল্প-সংস্কৃতি-কথন-বলন সবই যখন বিশ্বজুড়ে একরকম হয়ে আসছে, এই চেতনাটি খুব দামি। মানব জীবনের বৈচিত্র ওই ‘বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য’-র মত ছেলেভোলানো সরকারী স্লোগান না। এটা মানব জাতির ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে বিস্তৃত করে।

    এজিদী-রা সংখ্যায় খুব বেশি নয়। ব্রিগেডে বড় মিছিলের দিন নেতা-নেত্রীরা কত লোক এসছে, তার যে করেন , তার মতই সংখ্যা হবে তাদের। ইরাকে তাদের মূল নিবাস। এরা ক্রিষ্ঠান বা মসলমান নন – এদের ধর্ম অতি প্রাচীন। সম্প্রতি ইরাক ও সিরিয়া-তে ইসলামিক স্টেট নামক জল্লাদতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়েছে। রক্তের হোলি খেলা এই সন্ত্রাসী আন্দোলনের নাপসন্দ যে তাদের অধীকৃত এলাকায়ে বিধর্মী-রা বেঁচে-বর্তে থাকবেন। তাই শুরু হয়েছে ঢালাও জবাই। এজিদী-দের, ক্রিস্টান-দের, এবং ইসলামিক স্টেট-এর সংজ্ঞায় যারা মোসলমান হয়েও ‘সহি’ মোসলমান নন, তাদের। তাদের হত্যা-লীলায়ে মৃতের সংখ্যা বেশ কয়েক হাজার। এবং এজিদী-দের কে তারা যেমন করে নিকেশ করছে, তা গনহত্যারই সামিল। কিন্তু এই গণহত্যার প্রতিবাদে অকাদেমি অফ ফাইন আর্টস-এর সামনে কোনো মোমবাতি, কোনো সহমর্মিতা, কোনো ধিক্কার, কোনো দরদ ফুটে ওঠে নি। লাল-তেরঙ্গা নানা দলের গাজায়ে ইস্রাইলি আগ্রাসনের বিরোধিতা করা হুড়োহুড়ি দেখে মনে চিন্তা জন্মায়ে। অন্য সকল ব্যাপারে এমন নিস্তব্ধতা কেন? কোনো কোনো মৃত শিশুর ছবি কি বেশি কান্নার উদ্রেক করে? যদি তাই হয়, তবে কি সেই বেশি দুঃক্ষ ও বেশি সহমর্মিতার মাপকাঠি ?

    হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন আমি ছাত্র ছিলাম, তখন পালেস্তাইন সংহতি আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে আমাকে নানা ভাবে হেনস্থা করা হয়। সে হেনস্থার কারণে আমার সংহতি আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্য একটুও আমার একটুও খেদ নেই। অনেকে এর চেয়ে অনেক, অনেক বেশি দাম চুকিয়েছেন। কিন্তু পালেস্তাইন সংহতির নাম তার বিশাল বপুতে কি কি লুকিয়ে থাকে, তার খোজ নেওয়া প্রয়োজন। যদি কোনো সংহতি আন্দোলন ব্যক্তিগত জাতি, ভাষা, ধর্ম উদ্বুদ্ধ হয় কিন্তু তা প্রকাশ্যে মানবতাবাদের নাম চালানো হয়, তখন সেই ফাঁকিটা বোঝা দরকার। ফেইসবুক বা টুইটার-এর কল্যাণে আমার নিরীহ অনেক পালেস্তিনীয় শিশুর বীভত্স মৃতদেহের ছবি দেখেছি। দেখেছি ইসরাইলী হানায়ে ছিন্ন-ভিন্ন সাধারণ মানুষের ছবি, অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের একাধিক সদস্যের। কিন্তু কোথায় নাইজেরিয়া-র বোকো হারাম বা ইরাক-সিরিয়ার ইসলামিক স্টেট-এর ততোধিক নৃশংসতার ছবি? এই একচোখামী-র একটা মানে আছে। এতে কিছু ধরনের মৃত মানুষের প্রতি সহমর্মিতা আদায় হয়, কিছু হানাদারের প্রতি ঘৃণা উদ্রেক করানো হয় এবং কিছু ধরনের হানাদারের ব্যাপারে নিশ্চুপ থাকা হয়। এই চুপ থাকা অনেক কিছু বয়ান করে।

    মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার হবার সময় এই বাছাবাছি, এই চিত্কার ও নিশ্চুপ থাকার আলো-আধারি খেলার তলার খেলাটা কী? তাহলে বলতেই হয়, এই মৃতের প্রতি সমমর্মিতার ব্যাপারটি ভুয়ো। যা সত্য, তা হলো হানাদারকে আমি কতটা ঘৃণা করি সেটা প্রকাশ করতে আক্রান্ত ও মৃত-কে ব্যবহার করে। সেই সংহতির রাজনীতি ন্যক্কারজনক। হানাদারের ধর্মীয়/জাতিগত/শ্রেণীগত পরিচয় দিয়ে যদি গণহত্যার জন্য কাঁদবো কি কাঁদবো না, পথে নামবো কি নামবো না, সেসব ঠিক হয়, তাহলে সমস্যা বড় ভয়ানক। আক্রান্তের ধর্মপরিচয় , আততায়ীর ধর্মপরিচয় – এগুলি দেখে সহমর্মিতার ভঙ্গি, তা যতই সততার সঙ্গে করা হোক, অন্য ভেজালে তা ভুরভুর করে। ছত্তিস্গরে যখন হিন্দু গ্রামবাসীরা মূলতঃ হিন্দু মিলিটারী দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন হিন্দুত্বের ঠিকাদার-দার মুখে যায়ে না কোনো প্রতিবাদ। পাকিস্থান,আফ্ঘানিস্থান, সিরিয়া, ইরাক – এসকল জায়েগায়ে গত এক বছরে প্রায় এক লক্ষ্ মোসলমান মারা গেছেন মোসলমানের হাতে সন্ত্রাসী কায়্দায়ে। তখন হয় না মিছিল। হত্যালীলা যখন চালায় মূলতঃ ইহুদী ইসরাইল রাষ্ট্র-শক্তি, তখন মাথা চাড়া দেয় মানবাধিকার, সংহতি, ইত্যাদি। এই দুনম্বরিকে পষ্টাপষ্টি দুনম্বরী বলা প্রয়োজন।

    গাজায়ে ঘটে যাওয়া হত্যালীলায়ে আমরা ব্যথিত। আমরা সকলে জানি গাজার গল্প। আমরা মন থেকেই এই আগ্রাসনকে ঘেন্না করি। কিন্তু আমাদের এই ঘেন্না করার লিষ্টি-তে কার অগ্রাধিকার , সেটা কিন্তু ঠিক হয় অন্য কোথাও। আমরা জাগি ঘুম থেকে, কিন্তু ঘড়ির অ্যালার্ম দেওয়া হয় অন্য কোথাও। কিসের থেকে কি ‘বেশি’ গুরুত্বপূর্ণ, তা ঠিক করে দেয় যে বিশ্বকল্প, তা কি স্রেফ মানবতাবাদের ভিত্তিতে তৈরী? কোন মৃত্যু হয় হেডলাইন আর কোন মৃত্যু হয় সাইডলাইন? তাই ন্যুয়র্ক, লন্ডন, কলকাতা, প্যারিস – সকলে যখন জানায়ে ধিক্কার ও সমবেদনা, তলিয়ে ভাবা দরকার – কেন শুধু এদেরকে ধিক্কার? কেন আরো বিস্তৃত নয় সমবেদনা ? পালেস্তাইন-এর মুক্তি চাই, মার্কিন সমর্থনে ইস্রাইলি আগ্রাসন মানছি না, ইত্যাদি বলা সহজ। কঠিন হলো মানুষ হিসেবে গাজার পাশে দাড়ানোর অধিকার অর্জন করা। ২০১৪-তেই যেসব বৃহত্তর গণহত্যার জন্য বাংলায়ে একটি মিছিল-ও হয় নি, সেই গণহত্যার শিকার যে মানুষ, তারা সেই অধিকার অর্জনের পরীক্ষা নেবে। আমরা তৈরী তো ?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৯ আগস্ট ২০১৫ | ১৬৩৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ranjan roy | 24.97.167.226 (*) | ১০ আগস্ট ২০১৫ ০৩:২২67548
  • এই "নির্বাচিত" সহমর্মিতা বা "সাইলেন্স" কে এড়িয়ে যাওয়া উচিত হবে না। কথা বলার সময় এসে্ছে।
    তবে 'এজিদ" জনগোষ্ঠীর সম্বন্ধে বোধহয় ইনফর্মেশনের অভাবও ওদের ভয়াবহ পরিণতির খবরের সঙ্গে আম পাবলিক রিলেট না করতে পারার একটা কারণ।
  • 0 | 132.176.27.175 (*) | ১০ আগস্ট ২০১৫ ১০:৩০67546
  • "The ultimate tragedy is not the oppression and cruelty by the bad people but the silence over that by the good people."
    "Injustice anywhere is a threat to justice everywhere."

    -- Martin Luther King, Jr.
  • azad | 24.99.138.25 (*) | ১০ আগস্ট ২০১৫ ১১:০৪67547
  • সত্যি ই তো , একদম ঠিক ধরেছেন লেখক ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন