এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ভুখা বাংলাঃ '৪৩-এর মন্বন্তর (পর্ব ২)

    I লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ | ১০০৪ বার পঠিত
  • আসন্ন জাপানী আক্রমণের হাত থেকে ভারতকে বাঁচাবার কোনো বন্দোবস্ত ব্রিটিশ সরকার অন্ততঃ ১৯৪১এর শেষদিক অবধি করে উঠতে পারে নি। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তখন ১০ লাখ সৈন্য, কিন্তু অধিকাংশই আনপড়; অস্ত্রশস্ত্রের অবস্থাও তথৈবচ। সেরা সাতটি ভারতীয় ডিভিশন তখন ভূমধ্যসাগরের উপকূলে অক্ষশক্তির সঙ্গে প্রাণপণ লড়াইয়ে ব্যস্ত। এদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের "দ্বিতীয়" শহর কলকাতা প্রায় অরক্ষিত। কোনো অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান, এয়ার রেইড ফ্লাড লাইট বা রাডার সেট নেই; নেই কোনো আধুনিক ট্যাঙ্ক বা ফাইটার প্লেন। জেনারেল অকিনলেক ওয়ার ক্যাবিনেটের কাছে গোটা ভারতের জন্য নিদেনপক্ষে একটিমাত্র সাঁজোয়াবাহিনী চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন। "কিন্তু জেনারেল, আপনি কি করে জানলেন যে ওগুলি আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হবে না?'' এই ছিল চার্চিলের উত্তর। (1)

    চার্চিল ভারতের সুরক্ষাবলয় শক্তিশালী করায় বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর মনে সদাই ভয় ছিল, ভারতীয় সেনাবাহিনীতে উন্নতমানের প্রশিক্ষণ বা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে ভারতীয় সৈন্যরা কোনদিন তাই দিয়ে উল্টে আর একটি মহাবিদ্রোহ শুরু করে দেবে, যেমনটা হয়েছিল ১৮৫৭তে। তাছাড়া সিঙ্গাপুরের দুর্ভেদ্যতার উপর চার্চিলের বিশ্বাস ছিল অটল।

    জাপানী সৈন্যরা অবশ্য অন্যরকম ভেবেছিল। সিঙ্গাপুরের দক্ষিণ তটরেখা বরাবর কংক্রীটে গাঁথা সারি সারি অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট গান, তাদের পেরিয়ে জাপানী বাহিনীর ক্ষমতা নেই সিঙ্গাপুরের কেশাগ্র স্পর্শ করে। উত্তরে দুর্ভেদ্য পাহাড়-জঙ্গল, সেখানে ট্যাংক তো দূরস্থান, নিদেনপক্ষে একটা আর্মি জিপও ঢোকা সম্ভব না; বাহুল্য বিবেচনা করে ব্রিটিশ সৈন্য সেদিকে পাহারা দেয় না। জাপানী সৈন্যরা স্রেফ বাইসাইকেলে করে সেই গভীর জঙ্গল পেরিয়ে সিঙ্গাপুরের ব্যুহ ভেদ করে ফেলল। প্রায় বিনাযুদ্ধে কর্নেল হান্ট তাঁর ৬০০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পন করলেন।দক্ষিণ তটরেখার অ্যান্টি এয়ারক্র্যাফট গানগুলি যেমন ছিল, তেমনই রইল, একটিও গোলা ছোঁড়া হল না।

    '৪২ এর ১৫ই ফেব্রুয়ারি সিঙ্গাপুরের পতন হয়। ৭ই মার্চ রেঙ্গুন। দলে দলে ইউরোপীয়রা যাবতীয় সামরিক-অসামরিক যানবাহন দখল করে বার্মা ছেড়ে পালায়। বার্মার স্থানীয় মানুষজন/ভারতীয় সৈন্য/অভিবাসী ভারতীয়-কারো দিকে তারা ফিরেও থাকায় নি। প্রায় ৬ লাখ ভারতীয় রিফিউজি সম্পূর্ণ নিজেদের চেষ্টায় নানান পথ ধরে ভারতে এসে পৌঁছয়। এদের মধ্যে ৪ লাখ মানুষ ৬০০ মাইল পথ পাহাড়-জঙ্গলের মধ্য দিয়ে কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো খচ্চর-টানা গাড়িতে করে ঘোর পাহাড়ী বৃষ্টিতে ভিজে, খাদ্যহীন-আশ্রয়হীন-ওষুধপথ্যহীন অবস্থায় পাড়ি দেয়। ভারত সরকার এদের সামান্যতম সাহায্যও করে নি। রাস্তাতেই প্রায় ৮০০০০ মানুষ মারা যায়। এদের একটা বড় অংশ ছিল বাঙালী; পথের বিভীষিকা কাদা-জঙ্গল-জোঁক-বন্যজন্তু, সাথীদের মৃত্যু, অনাহার-ম্যালেরিয়া-আন্ত্রিক-গুটি বসন্ত-সব মিলিয়ে এই মানুষদের আধমরা করে ফেলেছিল; সেই অবস্থাতেই ধুঁকতে ধুঁকতে তারা বাংলার গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে; হাটে-বাজারে ভিক্ষে করে খায়, জাপানী-অত্যাচার-ব্রিটিশ অসহযোগিতা আর নিজেদের দুর্দশার কথা বলতে বলতে নিজেরাই শিউরে ওঠে। তাদের প্রলাপ-জড়ানো কথার মধ্য থেকে সত্যিটুকু ছেঁকে বের করা কঠিন।

    রেঙ্গুনের পতনের সাথে সাথে কলকাতা হয়ে দাঁড়ায় পূর্ব রণাঙ্গনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শেষ শিল্পনগরী। ১৮ই ডিসেম্বর কলকাতা ও তার শহরতলীগুলিকে সরকারের পক্ষ থেকে "বিপজ্জনক এলাকা " বলে ঘোষণা করা হয়। কলকাতার স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব তখন বিশাল- যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে করেই হোক এই শহরকে সচল রাখতে হবে।কলকারখানাগুলিকে চালু রাখতে হবে, যুদ্ধসামগ্রী ও রসদ উৎপাদনে যেন এতটুকুও ভাঁটা না পড়ে। কিন্তু দলে দলে পরিযায়ী শ্রমিকরা কারখানা ছেড়ে মুলুকে পাড়ি দিতে থাকে, অর্ডিন্যান্স-জেল-জরিমানার তোয়াক্কা না করে।মারোয়ারী ব্যবসায়ীরা ব্যবসাপত্তর গুটিয়ে নিয়ে মধ্য ও উত্তর ভারতের দিকে রওনা হয়ে যায়। বাঙালী সঙ্গতিবান মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরা রওনা হয়ে যায় শহর ছেড়ে বাংলার গ্রামগুলির পথে। কলকাতা তখন এক ভুতুড়ে নগরী, প্রতি রাত্রেই ব্ল্যাক আউট আর এয়ার রেইডের গুজব; হাওয়ায় ভাসছে আসন্ন ব্রিটিশ -পরাজয়ের কথা।

    যুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন ভারত খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বাবলম্বী নয়। বার্মা আর থাইল্যান্ড থেকে প্রতি বছর এক থেকে দু মিলিয়ন টন চাল না আনলে ভারতের চলে না। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় জাপান আস্তানা গেড়ে বসার সাথে সাথে সেই চালের আমদানি বন্ধ হয়ে গেল। এদিকে সেই সময় থেকেই যুদ্ধের জন্য ভারত খাদ্যশস্য আমদানির বদলে উল্টে রপ্তানী করা শুরু করেছে (2)। ১৯৪২-এর এপ্রিল মাসে ভারত থেকে রেকর্ড ৬৬০০০ টন চাল বিদেশে রপ্তানি হয়; যদিও তখন তাকেই কে খাওয়াবে তার ঠিক নেই। (3)

    যুদ্ধ শুরুর আগে বাংলায় চালের দাম ছিল মণপ্রতি ৯ টাকা। '৪২ -এর মার্চ মাস নাগাদ কোনো কোনো জেলায় সে দর ঠেলে উঠল ১০০ টাকা প্রতি মণ (4)। 'অশনি সংকেত'-এ গঙ্গাচরণ হাট থেকে ফিরে এসে অনঙ্গ বৌ-কে বলেছিল-"আজ একটি আশ্চর্যি কান্ড দেখলাম-.. পয়সা হোলেও জিনিস মেলে না এই প্রথম দেখলাম... চালও কিনে রাখতে হবে নাকি।" কিন্তু তখনো তাদের আরো অনেক কিছু দেখা বাকি। খুব শিগগিরই তারা দেখতে পাবে দুবেলা চাল কিনে খেতে পারে, এত পয়সাওলা মানুষ মেলাও মুশকিল। গ্রামে তখন গিজগিজ করছে কলকাতা থেকে পালিয়ে আসা শহুরে বাবুদের দঙ্গল। পয়সার লড়াইয়ে তাদের হারিয়ে চাল-ডাল কিনে খায়, এত ট্যাঁকের জোর গাঁয়ের মানুষের নেই।

    '৪২ এর ৬ই ফেব্রুয়ারি ভাইসরয়ের ডাকে দিল্লীতে চতুর্থ প্রাইস কন্ট্রোল কনফারেন্স বসল (এর আগের তিনটি কনফারেন্স অশ্বডিম্ব প্রসব করে মারা যায়)। দ্রব্যমূল্য বেঁধে দেওয়ার বদলে কমিটি উল্টে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে সওয়াল করল। প্রদেশগুলিকে বলা হল পণ্যের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার কথা; ভাবা হল, প্রদেশগুলির মধ্যে খাদ্যসামগ্রীর অবাধ বাণিজ্য চালু হলেই অভাবী প্রদেশগুলিতে খাদ্যশস্যের দাম কমে আসবে। মার্চ মাসে ভারত সরকার বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সকে ডেকে জানালেন, নিজেদের কারখানার শ্রমিকদের খাওয়ানোর ভার নিজেদেরই কাঁধে নিতে হবে; সরকার কোনোরকম সহযোগিতা করতে পারবেন না- ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফার্মগুলি যেন আগামী তিন মাসের প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য মজুদ করে রাখে (5) । সরকার নিজেই এহেন সাবধানবাণী শোনালে বাজারের ওপর তার প্রতিক্রিয়া কী হয় তা সহজেই অনুমেয়। শিল্পপতি, ধান্দাবাজ ব্যবসায়ী, সাধারণ মানুষ সবাই মিলে পাগলের মত খাদ্যসামগ্রী মজুদ করতে শুরু করল। জুন মাসে চালের দাম আরো ৩০% বেড়ে গেল।

    '৪১-এর নভেম্বর মাসেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল কলোনির পরাজয়সম্ভব এলাকাগুলিতে নির্দয়ভাবে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করবার ওপর জোর দেন। ভারতমহাসাগর সংলগ্ন এলাকাগুলির জন্য এই সতর্কবার্তা বিশেষভাবে প্রযোজ্য বলে ওয়ার অফিস বার্তা পাঠায়। ঠিক হয়, সেনা বাহিনী কল-কারখানা, সেনাঘাঁটি ও রাস্তাঘাট ধ্বংস করবার ব্যবস্থা করবে। অসামরিক কর্তৃপক্ষ স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য ন্যূনতম ব্যবস্থা রেখে বাকি খাদ্যসামগ্রী হয় সরিয়ে আনবে, নয়তো কোনোভাবে নষ্ট করে দেবে (জলে ফেলে কিংবা পুড়িয়ে)।

    মার্চের শেষদিকে বাংলার গভর্নর হার্বার্ট সেইমত উপকূলবর্তী বাংলার জন্য একটি পোড়ামাটি নীতি প্রণয়ন করেন। বিখ্যাত ব্রিটিশ ইউফেমিজমের রীতি মেনে এর পোষাকী নাম দেওয়া হয় 'ডিনায়াল'।মন্ত্রীসভার কারো সঙ্গে কোনো কথা না বলে গভর্নর হার্বার্ট তাঁর বিশেষ ক্ষমতাবলে ভাইসরয়ের ব্যক্তিগত সচিব এল জে পিনেলকে বাংলায় ডিনায়াল অপারেশন কার্যকরী করবার দায়িত্ব দেন । বাংলার বিধানসভার অধিবেশন তখন ইস্টারের ছুটি উপলক্ষে স্থগিত, অতএব নির্বাচিত বিধায়্করা এর আগামাথা কিছুই জানতে পারলেন না। সামরিক প্ল্যানাররা কলকাতার কমবেশী কুড়ি মাইল দক্ষিণে ম্যাপের ওপর পুব থেকে পশ্চিম অবধি একটি লাইন টেনে দিলেন; এর বাইরের এলাকাগুলিতে পুরোদস্তুর ডিনায়াল কার্যকরী হবে। জরুরী ফাইলপত্তর ও শ্বেতাঙ্গ মহিলাদের এইসব এলাকা থেকে সরিয়ে আনা হল।

    ডিনায়াল ঠিক কবে থেকে চালু হয়েছিল, তা নিয়ে বিভ্রান্তি আছে। আই সি এস অশোক মিত্র তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন, ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকেই তিনি জানতে পারেন, পুলিশ গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাল বাজেয়াপ্ত করছে। সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত দাবী করেন, পূর্ব বঙ্গের তিনটি নদী বন্দরে মজুত কয়েক হাজার টন চাল নদীতে ফেলে দেওয়া হয় (6)।

    বাংলার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক পরে অভিযোগ করেছিলেন (এবং সে অভিযোগের যথেষ্ট সারবত্তা আছে), গভর্নর হার্বার্ট জনৈক অফিসারকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে বাংলার তিনটি জেলা-মেদিনীপুর, খুলনা ও বরিশাল থেকে বাড়তি চাল সরিয়ে ফেলবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আলোচ্য অফিসারটি হলেন শ্রম ও বাণিজ্য দপ্তরের জয়েন্ট সেক্রেটারি এম কে কৃপালনী। তিনি হিসাব করে দেখেছিলেন, এই তিন জেলায় মোটামুটি ১,২৩,০০০ টন 'উদ্বৃত্ত' চাল রয়েছে। এবং এই বিপুল পরিমাণ চাল এত অল্প সময়ে বাজার থেকে বাজেয়াপ্ত করা প্রশাসনের কম্মো নয়। অগত্যা তিনি চালের বাজারের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যবসায়ী ইস্পাহানীকে ধরলেন। এদিকে ইস্পাহানী মুসলিম লীগের নেতা, এবং তাঁকে এই ভার দিলে ফ্জলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ ও কংগ্রেসের নেতারা রেগে আগুন হয়ে যাবেন। ইস্পাহানী নিজেও তা আঁচ করে তাঁর নিজের নামের বদলে তাঁরই এজেন্ট মির্জা আলি আকবরের নামে এই এজেন্সি বরাদ্দ করতে বললেন। নিরুপায় কৃপালনী সেই মুহূর্তে রাজী হয়ে খরচাবাবদ ইস্পাহানীকে আগাম ২০ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করলেন। (7)

    কিন্তু খবর চাউর হতে দেরী হল না। বিধানসভা খোলার সঙ্গে সঙ্গে এই নিয়ে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। অগত্যা প্রশাসনের তরফ থেকে আরো চার জন এজেন্টকে নিয়োগ করা হল, এঁদের একজন হিন্দু মহাসভার নেতা, একজন শিডিউল্ড কাস্ট মন্ত্রীর প্রস্তাবিত সদস্য, একজন কংগ্রেসী মুসলিম ও অন্যজন এক বড় ব্যবসায়ী। মজার কথা এঁদের অনেকেরই এই কাজে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না।তদুপরি নানান জন নানান বিরোধী রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত, কাজেই এঁদের মধ্যে বোঝাপড়া বলে কিছু নেই।

    বাংলায় তিনধরণের চাষের মধ্যে (আউশ, আমন, বোরো) আমন ধানের চাষই প্রধান; মোট ধান চাষের প্রায় ৭৫ % উৎপাদনই ছিল আমন ধান। আমন ফসল তোলার পরের কয়েক মাস(মাস চারেক মত) চাষীর হাত থাকত প্রায় শূন্য; দিন কাটত অনাহারে-অর্ধাহারে। এই সময় বেঁচে থাকার জন্য চাষীকে নির্ভর করতে হত পাইকার-ব্যাপারী-ফড়েদের ওপর, যাদের অধিকাংশই আবার মহাজনী ব্যবসাও করত। ছোট ব্যবসায়ীরা অনেকেই চাষীর কাছ থেকে সরাসরি ধান কিনত। অর্থাৎ ধান-চালের ব্যবসার গোটা অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকত অনেকটাই চাষী-ব্যাপারী-পাইকারের ব্যক্তিগত সম্পর্কের ওপর। '৪২ সালে ডিনায়াল অপারেশনের জন্য যেসব এজেন্ট ও সাব-এজেন্টদের নিয়োগ করা হয়েছিল, তারা সকলেই বাইরের লোক,কেউই এই গোটা ব্যবস্থার মধ্যে কখনো ছিল না এবং এ ব্যাপারের বিন্দুবিসর্গও জানতো না। বহিরাগত আক্রমণকারীর মত তারা এই জটিল বাজার-ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে চাল বাজেয়াপ্ত করতে শুরু করল, অনেকক্ষেত্রেই গায়ের জোরে, কেননা সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী তারা প্রশাসনের কাছ থেকে এব্যাপারে সম্পূর্ণ মদত পেত। স্পেশ্যাল অফিসার পিনেল লিখেছেন-"যাঁরা বাংলার চাষীদের জানেন তাঁরাই বুঝতে পারবেন গোটা ব্যাপারটা ছিল কতখানি হৃদয়-বিদারক।" (8)

    রাইস ডিনায়াল নিয়ে খোলাখুলি জোচ্চুরি চলেছিল সেসময়। প্রায়শঃই সরকারী এজেন্টরা ডিনায়াল-এলাকার বাইরে অন্যান্য জায়গা থেকেও সরকারের নাম করে জবরদস্তি চাল বাজেয়াপ্ত করত। বাজেয়াপ্ত করা চালের খুব অল্প অংশই সরকারী গুদামে জমা পড়ত। যুদ্ধের সময় পরিবহন ব্যবস্থা অপ্রতুল-তার ওপর রাইস ডিনায়ালের পাশাপাশি 'বোট ডিনায়াল'ও চলছে জোরকদমে- ফলে বাজেয়াপ্ত চালের বেশ কিছু অংশ গ্রামেই পড়ে থেকে নষ্ট হত। অনেক সময় সরকারী অফিসারদের ঘুষ দিয়ে বড় চাল-ব্যবসায়ী ও ধান-কল মালিকরা স্পেশ্যাল পারমিট বের করে ডিনায়ালের চাল নিজেরা কিনে নিত ও সরিয়ে ফেলত।

    বোট ডিনায়াল-এর ধাক্কাও ছিল মারাত্মক।বাংলার কৃষি-অর্থনীতি আর পরিবহনে (বিশেষতঃ পূর্ববঙ্গে) নৌকার মাহাত্ম্য বাঙ্গালীকে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই। নোয়াখালির খালাসীরা নৌকায় করে বার্মা থেকে মেদিনীপুর চষে বেড়াত। খুলনা-বাখরগঞ্জের চাষীরা নৌকা করে নদীর চরে যেত চাষ-আবাদ করতে। চাঁটগাঁয়ের কুমোরদের মাটি আসত নৌকায়।নৌকাই ছিল জেলেদের একমাত্র ভরসা। পাট বলো পাট, ধান বলো ধান- ফসলমাত্রেই মাঠ থেকে বাজারে গিয়ে পৌঁছত নৌকায়। পোড়ামাটি নীতির নাম করে এই দেশী নৌকাগুলিকে ধ্বংস করা হল। উপকূলবর্তী জেলায় যে সমস্ত নৌকা ১০ জন বা তার বেশী মানুষ পরিবহন করতে পারে, তাদের রেজিস্ট্রি তৈরী হল। কমবেশী ৬৬০০০ এই জাতীয় নৌকার মধ্যে প্রায় ৪৬০০০ নৌকা বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে বা জলে ডুবিয়ে নষ্ট করে দেওয়া হল। নৌকার মালিকদের খেসারত দেওয়া হল, কিন্তু যেসব জেলে-কুমোর-খালাসী-চাষী এইসব নৌকা ইজারা নিয়ে জীবিকানির্বাহ করত তারা পেল লবডঙ্কা। অনেক প্রতিবাদের পরে ঠিক হয় তাদের তিন মাসের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। তিন মাসের ক্ষতিপূরণে তাদের আর কী হয়-দুয়েক প্রজন্মের উপার্জনের উপায় যেখানে এক নিমেষে কেড়ে নেওয়া হল। বিশেষ করে ঐ ভয়ংকর সময়ে, যখন এক মাসের রোজগারেই এক হপ্তাও চলে কিনা সন্দেহ। জনম মুখার্জী লিখেছেন-"অনেকের মনে হল, জাপানীরা নয়, ব্রিটিশরাই যেন বাংলার গ্রামগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করেছে" (9)। 'হরিজন' পত্রিকায় গান্ধী লিখলেন -'পূর্ববঙ্গের মানুষের কাছ থেকে নৌকা ছিনিয়ে নেওয়া তাদের দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়ার সামিল।'

    ডিনায়াল অবশ্য জোরকদমে চলল। শুধু নৌকাই নয়, স্টীমার, বাইসাইকেল, গোরুর গাড়ি, প্রাইভেট কার-যাবতীয় বেসামরিক যানবাহন বাজেয়াপ্ত করে নষ্ট করা হতে থাকল। শুধু মেদিনীপুর জেলা থেকেই ১০০০০ বাইসাইকেল বাজেয়াপ্ত হল।(১০)

    এতেই শেষ নয়। এরোড্রোম, সেনা ছাউনি, সাপ্লাই অফিস বসাবার জন্য কলকাতার দক্ষিণে ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে জমিজায়গা দখল করা শুরু হল। গভর্ণর বানিজ্যমন্ত্রককে নির্দেশ দিলেন ২৪ ঘন্টার মধ্যে এরকম ৪৭টি এলাকা দখল করতে হবে(১১) ডায়মণ্ড হারবারে কমপক্ষে ৩৬০০০ মানুষকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা হল; নোয়াখালিতে ৭০০০০। ফ্যামিন এনকোয়ারি কমিশন পরে স্বয়ং স্বীকার করবেন-"Compensation was of course paid, but there is little doubt that the members of many of these families became famine victims in 1943." (12)

    Notes
    1.Madhushree Mukherjee, p.56
    2.Ibid, p.55 (Ghosh, Kalicharan, Famines in Bengal, p.31)
    3.Janam Mukherjee, p.55
    4.Lizzie Collingham, The Taste of War, World War 2 and the Battle for Food, Penguin Books
    5.Janam Mukherjee, p. 57
    6.Madhushree Mukherjee, p.68 (অশোক মিত্র, তিন কুড়ি দশ, পৃ ১৪০-৪১; সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত, বঙ্গসংহার এবং, পৃ ৩৫)
    7.Janam Mukherjee, p. 59 ( Nanavati papers, p.743).
    8.Ibid, p.62 (Nanavati Papers, Testimony of L.G. Pinell, p.545).
    9.Ibid, p.65.
    10. Madhushree Mukherjee, p.67 (Nanavati papers, Vol II, p.544,547)
    11.Janam Mukherjee, p.66 (Nanavati Papers, p.868)
    12.Ibid, (Famine Enquiry Commission, Report on Bengal, p.27)
    প্রথম পর্বের লিংক-
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৪ নভেম্বর ২০১৮ | ১০০৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Amit | 9003412.218.0145.48 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩০63110
  • অসাধারণ হচ্ছে এই লেখাটা
  • Amit | 9003412.218.0145.48 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩১63111
  • কিন্তু অন্য লেখাটাও প্লিজ ছেড়ে দেবেন না । ওটাও দুর্দান্ত হচ্ছে ।
  • I | 785612.40.2389.80 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:২২63112
  • এটা আসলে অন্যটারই অংশ ও ধারাবাহিকতা।
  • dd | 90045.207.8945.154 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৩63113
  • চলুক চলুক
  • pi | 2345.110.784512.213 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:৫২63114
  • একই ব্লগে পরপর রাখবে? যদি না অসুবিধে হয়।
  • I | 785612.40.2389.32 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:২৮63115
  • কিন্তু তাহলে নতুন পর্ব বেরোলে লোকে বুঝবে কী করে?
  • pi | 785612.40.12900.148 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৮:৩৫63116
  • নতুন পর্ব আপেন্ড করলেই টইতে নোটি চলে আসে।
  • pi | 785612.40.12900.148 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ১১:০৮63117
  • আর আলাদা করেই লিখলে লেখার উপরে বা নিচে আগের পর্বের লিন্কটা একটু দিয়ে দিও।
  • I | 785612.40.891212.64 (*) | ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ১২:০৮63118
  • এই যে। দিয়ে দিলাম।
  • Nahar Trina | 89900.227.90012.5 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৪:৩১63119
  • অনেক তথ্য জানা হচ্ছে সিরিজটার কল্যাণে। শ্রমসাধ্য এই লেখার জন্যে ইদ্রনীলদাকে আন্তরিক ধন্যবাদ। পরের পর্ব আসুক জলদি।
  • কুশান | 342323.176.2389.102 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:১৬63122
  • অপূর্ব লেখা। রুদ্ধশ্বাস। বর্ণনাভঙ্গি অনন্য।

    শেষ পর্বে যে এরোড্রোম বসানোর জন্য মানুষ উচ্ছেদ এটা একটু বিস্তারে বলবেন? ৭০০০০.লোক মানে তো প্রায় ১০০ গ্রাম।
    কলাইকুনডা( খড়্গপুরের অদূরে) কি এভাবেই গ্রাম উচ্ছেদ করে তৈরি হয়েছিল?

    আমি আগের পর্ব পড়িনি। অবিলম্বে পড়ব।
  • কুশান | 342323.176.2389.102 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ০৭:১৬63121
  • অপূর্ব লেখা। রুদ্ধশ্বাস। বর্ণনাভঙ্গি অনন্য।

    শেষ পর্বে যে এরোড্রোম বসানোর জন্য মানুষ উচ্ছেদ এটা একটু বিস্তারে বলবেন? ৭০০০০.লোক মানে তো প্রায় ১০০ গ্রাম।
    কলাইকুনডা( খড়্গপুরের অদূরে) কি এভাবেই গ্রাম উচ্ছেদ করে তৈরি হয়েছিল?

    আমি আগের পর্ব পড়িনি। অবিলম্বে পড়ব।
  • শঙ্খ | 7845.11.896712.197 (*) | ২৮ নভেম্বর ২০১৮ ১০:০২63120
  • অবিশ্বাস্য এক ঘটনাপ্রবাহের এক অবিশ্বাস্য দলিল। পড়তে পড়তে দমবন্ধ হয়ে আসে।
  • রুখসানা কাজল | 7823.147.787812.124 (*) | ৩০ নভেম্বর ২০১৮ ১০:৫৬63123
  • ভাল হচ্চছে-- প্রাচীনদের কাছে শোনা কিছু শব্দের অর্থ বুঝতে পারছি। পোড়ামাটি নীতি -- রাইস ডিনায়াল ----
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন