এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দেবোত্তম চক্রবর্তী | 11.39.38.182 | ১৯ নভেম্বর ২০১৬ ০৯:৩২723727
  • বাবার চাকরির দৌলতে আসামের নানা চা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে ক্রমশ বড় হচ্ছেন সলিল, সলিল চৌধুরী, পাশাপাশি কানে গেঁথে নিচ্ছেন সেখানকার ঐশ্বর্যশালী লোকসংগীত । তাঁর বাবা পেশায় ডাক্তার, নেশা পাশ্চাত্য সংগীত । সেই সূত্রে অল্প বয়সেই সলিলের হাতেখড়ি হচ্ছে ধ্রুপদী পাশ্চাত্য সংগীতের পুরোধা বাখ, বিটোভেন, চাইকোভস্কি, শপ্যাঁ এবং অতি অবশ্যই মোৎজার্টের কাছে । ভবিষ্যতে সলিলের সুরে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সংগীতের যে মেলবন্ধন দেখে অভ্যস্ত হব আমরা তার শুরুটা হচ্ছে এখান থেকেই ।

    আসামের আদিগন্ত সবুজ ছেড়ে ইট-কাঠের জঙ্গলে ঠাসা কলকাতায় এসে পৌঁছচ্ছেন সলিল, ভর্তি হচ্ছেন বঙ্গবাসী কলেজে এবং আগ্রহী হয়ে উঠছেন কমিউনিস্ট মতাদর্শে । কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বিচ্ছুরণ ঘটছে তাঁর সৃজন প্রতিভার । গান লিখছেন, সাথে কবিতা - গল্প - নাটক আর তারই সাথে চলছে গানে সুর দেওয়ার কাজ । ১৯৪৩-এর ভয়ংকর মন্বন্তর সলিলকে এক বাঁকের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, তিনি যোগ দিচ্ছেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘে । ওই সংগঠনে একে একে জড়ো হচ্ছেন বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের তাবৎ দিকপাল — নাটকে বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক আর গানে সুচিত্রা - দেবব্রত - সলিল - হেমাঙ্গ বিশ্বাস । বাংলার গ্রাম-গ্রামান্তরে অভিনীত হচ্ছে ‘নবান্ন’ আর এই পর্যায়ে সলিলের কাছ থেকে আমরা পাচ্ছি ‘হেই সামালো ধান হো, কাস্তেটা দাও শান হো’, ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে’, ‘মানব না এ বন্ধনে, মানব না এ শৃঙ্খলে’ কিংবা ‘ও আলোর পথযাত্রী’-র মতো অসংখ্য অবিস্মরণীয় গান । সম্পূর্ণ নতুন কথা, সম্পূর্ণ নতুন সুর আর সম্পূর্ণ নতুন অর্কেস্ট্রেশনের ত্রিবেণীসঙ্গমে এক ঝটকায় সাবালক হয়ে উঠছে বাংলা গান ।

    আবারও পালাবদল । পূরণ চাঁদ যোশীর বদলে পার্টির সর্বময় কর্তা হচ্ছেন কট্টরপন্থী বি টি রণদিভে । পার্টির অনুমোদন ছাড়া প্রকাশ্যে সলিলের গান গাওয়া নিষিদ্ধ হচ্ছে । এহেন ফতোয়ায় অপমানিত এবং ক্ষুব্ধ সলিল, পার্টিরই জন্য জীবনের চার-চারটে অমূল্য বছর আন্ডারগ্রাউন্ডে কাটানো সলিল তীব্র ঘৃণায় IPTA ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন । আর তারপর কলকাতার পিছুটান ঝেড়ে ফেলে বিমল রায়ের আহ্বানে ‘দো বিঘা জমিন’-এর সুর করার দায়িত্ব নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন বোম্বে । পিছনে, অনেক পিছনে পড়ে থাকছেন তাঁর তিন সহযোদ্ধা দেবব্রত - হেমাঙ্গ - ঋত্বিক যাঁরা মনেপ্রাণে চাইছেন নতুন জগতে সলিলের সাফল্য ।
    *****************************
    সলিল সুরের সরল সাংগীতিক কাঠামোয় বিশ্বাসী ছিলেন না । তাঁর গানে নানা নতুন এক্সপেরিমেন্ট ছিল, সুর নিয়ে নানা নতুন ভাবনা চিন্তা ছিল । সেই গান গাইতে গেলে যে পরিশীলিত কণ্ঠসম্পদের দরকার সেটাও উপলব্ধি করেছিলেন তিনি । বাংলা বেসিক গানের ক্ষেত্রে তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে, বলেছিলেন ‘ঈশ্বরের গান গাইতে ইচ্ছে হলে তিনি হেমন্তর গলায় গান করেন’। ১৯৪৯-এ হেমন্ত এই প্রথম সলিলের কথায় ও সুরে গাইলেন ‘গাঁয়ের বধূ’ । চারিদিকের হইহই রইরই মেলাতে না মেলাতেই ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ল ‘রানার’,‘অবাক পৃথিবী’,‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ বা ‘পথে এবার নামো সাথী’ । ততদিনে হেমন্ত - সলিল বাংলা গানের জগতে অনন্যসাধারণ জুটিতে পরিণত । মধ্যিখানে দু’জনের সাময়িক ভুল বোঝাবুঝির পর আবারও আমরা শুনতে পেলাম ‘পথ হারাব বলেই এবার’,‘আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম আমার ঠিকানা’,‘আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা’ কিংবা হেমন্তর জীবনের সবচেয়ে স্টাইলিশ ‘শোনো কোনও একদিন’ ।

    সতীনাথ বাংলা গানে লতা মঙ্গেশকরকে প্রথম নিয়ে এসেছিলেন ঠিকই কিন্তু লতা বাংলা গানে পরিচিতি পেয়েছিলেন সলিলের হাত ধরেই । আর সেসব একেকটা হীরকখণ্ড যেন — ‘না মন লাগে না’,‘পা মা গা রে সা’, ‘কিছু তো চাহিনি আমি’,‘ও মোর ময়না গো’,‘এ দিন তো যাবে না’,‘আজ নয় গুনগুন গুঞ্জন প্রেমের’ অথবা ‘কেন যে কাঁদাও বারে বারে’ । আরেক কিন্নরকণ্ঠী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন ‘যারে যা, যা ফিরে যা’,‘গুনগুন মন ভ্রমরা’,‘সজনী গো কথা শোনো’ বা ‘যদি নাম ধরে তারে ডাকি’-র মতো দুর্দান্ত সব কম্পোজিশন । আফশোস সলিল কেন তাঁকে দিয়ে আরও অজস্র গান গাওয়ালেন না, কেনই বা আশা ভোঁসলের সৌভাগ্য হল না সলিলের সুরে বাংলা গান গাওয়ার ।
    *****************************
    শুধু বেসিক গানে নয়, সলিলের প্রতিভার স্বাক্ষর ছড়িয়ে রয়েছে সিনেমার গানেও — তা সে বাংলা বা হিন্দি যাই হোক না কেন । মর্জিনা আবদাল্লা-য় মান্না দে একাধারে গাইছেন ‘ও ভাই রে ভাই’ আর ‘বাজে গো বীণা’-র মতো একদম বিপরীতধর্মী গান; লাল পাথর-এ শ্যামল ফাটিয়ে দিচ্ছেন ‘ডেকোনা মোরে ডেকোনা’ গেয়ে; ওদিকে কিশোরকে অন্তর্ঘাত-এ দেখছি ‘ও আমার সজনী গো’ গাইতে; লতা একদিন রাত্রে-তে এই গাইছেন ‘জাগো মোহন প্রীতম’ তো মর্জিনা আবদাল্লা-য় ‘হায় হায় প্রাণ যায়’ কিংবা যেশুদাস-সবিতা চৌধুরী ‘নাম শকুন্তলা তার’ গেয়ে মুগ্ধ করে দিচ্ছেন আমাদের ।

    হিন্দিতে সলিলের প্রথম পছন্দ মুকেশ, তারপর কিশোর আর লতা । মধুমতী থেকে সলিল - মুকেশ জুটির ‘সুহানা সফর’ শুরু যা আনাড়ি -‘কিসিকি মুসকুরাহাটো কি’, আনন্দ -‘ম্যায়নে তেরে লিয়ে’, রজনীগন্ধা -‘কই বার ইঁউ ভি দেখা’ হয়ে ছোটি সি বাত-এর ‘ইয়ে দিন কেয়া আয়ে’-তে এসে পূর্ণতা পাচ্ছে । কিশোর মেরে আপনে-তে গাইছেন ‘কোই হোতা যিসকো আপনা’, অন্নদাতা-য় ‘গুজর যায়ে দিন’ (এই গানটি আমি প্রথম শুনি কিশোর যেদিন মারা যান তার পরের দিন দূরদর্শন চিত্রহারে এবং হিন্দি গানে সলিলের দিওয়ানা হই, বাংলা গানে তারও আগে থেকে) কিংবা জীবন জ্যোতি-তে ‘মওজো কি ডোলি চলি রে’ । লতার বেশি না দুটো গান থাক ‘রজনীগন্ধা পেয়ার তুমহারা’ আর ‘না জানে কিঁউ’ ।
    *****************************
    একদিন শচীনকর্তা আর সলিল মুখোমুখি । কত্তা সলিলকে অনুযোগ করছেন “পঞ্চম ওয়েস্টার্ন মিউজিকের অন্ধ ভক্ত । আমি অর বাবা । কিন্তু ও আমারে না, তোমারে গুরু মানে । অরে বুঝাও” । সলিল মৃদু হাসছেন, সে হাসিতে প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় । তিনি বেশ বুঝতে পারছেন তাঁর হাত থেকে ব্যাটন নিয়ে দৌড়ানোর লোক এসে গেছে, পরম প্রত্যাশায় তিনি পঞ্চমের হাতে তুলে দিচ্ছেন তাঁর ব্যাটন । সলিলের দীর্ঘ তিরিশ বছরের দৌড় শেষ হচ্ছে, নতুন উদ্যমে দৌড় শুরু করছেন পঞ্চম । আসলে যদিও তা নিছক দৌড় না হয়ে পর্যবসিত হবে স্বপ্নের উড়ানে ।

    আজ সলিল ৯৪-এ পা দিলেন ।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন