এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • নবজাতক ও কিছু কিছু

    Binary লেখকের গ্রাহক হোন
    অন্যান্য | ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ | ১৭৬৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Binary | ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ ২২:১০691961
  • আগের টই-টা ডুবে গ্যাছে , তাই একটা নতুন খুললাম ..

    নবজাতক

    জন্মদাত্রী মা আর জন্মদাতা বাবা তো ছিলই সীতারামের। আর পাঁচটা মানুষ মানুষীর মত কোনো এক শীতের ভোরবেলা পৃথিবীতে এসেছিল সীতারাম। তবে সময়টা শীতকাল ছিল এইটুকুই যা মনে আছে সীতারামের নিরক্ষর মায়ের , দিন মাস বছরের হিসেব আর জানা নেই। আর উল্টোডাঙা স্টেশনের দরমার বেড়া দেওয়া বস্তির ঘরে দাই-এর কাছে সীতারাম যখন জন্মাচ্ছিল , তখন ওর বাবা শিয়ালদা স্টেশনের ইয়ার্ডে ব্রেক্ভ্যান থেকে কাঁধে করে মাল খালাস করতে ব্যস্ত ছিল। তো , এরকম জন্মের কোনো বার্থসার্টিফিকেট হয় না। আঙ্গুঠা ছাপ বাপ-মা , অক্ষরিক অর্থে বার্থসার্টিফিকেট , মানে কি তাই হয়ত জানে না।

    তো, সীতারামের কোনো জন্মদিন নেই। নেই তো নেই। দরকার-ও নেই। ফুটপাথে ডিগবাজি খাওয়াটা যার বা যাদের শৈশব-এর আনন্দ তাদের আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা-ই বা কি ? রিক্সাটানা ব্যবসা বা মুটেগিরি চাকরিতে কোনদিন বার্থসার্টিফিকেট , লাগে বলেও শোনা যায় না। মাস্তান বা ওয়াগান ব্রেকার হলে তো কথাই নেই।

    সে যাইহোক , ভাববেননা যেন আমি আবার কোনো সাবঅল্টার্ন প্রভিলেজড সমাজ চেতনার গল্প খাড়া করতে চলেছি। আর এমনিতেই ওপরের যা কিছু বললাম , শহুরে মধ্যবিত্ত আতুপুতু ছেলেবেলা কাটানো আমার পক্ষে, খালি দেখে লেখা সম্ভব নয় , অনুভব তো নয়-ই। আমাদের একটা স্ট্রাকচার্ড ছেলেবেলা আছে। পরিকল্পনা মাফিক শিক্ষা , পরিকল্পনা মাফিক জীবন। তাতে ঘুরে ঘুরে খুশির দিন আসে। জন্মদিন আসে বছর বছর , বিবাহবার্ষিকী আসে দাম্পত্য জীবন সুরু করার পর , সেই বছর বছর। বিশেষ দিন গুলো ফিরে ফিরে আসে আর আর পুলকিত আমরা বন্ধু-বান্ধব-পরিচিতবৃত্তের শুভেচ্ছায় ভেসে থাকি।

    কথাটা ঠিক সেটা নয়। আমাদের এই সীতারাম-এর গল্পটা স্টিরিওটাইপ মুটেগিরি করা ভবিষ্যতের একটু বাইরে। সীতারাম-দের বস্তিটা এক সময় কোনো সমাজসেবী এনজিওদের নজরে আসে। বিশেষত বস্তিবাসী পরিবার আর তাদের ধুলোমাখা, ইজের পরা বাচ্চাদের দেওয়ালে লেখা ভবিতব্য কিছুটা পাল্টানোর তাগিদে। তাদের চেষ্টায় , সেচ্ছাসেবী সরকারী আর বেসরকারী অনুদানে চলা ইস্কুলে পড়তে পায় সীতারাম আরো সংঙ্গী কিছু ন্যাংটো রাস্তার বাচ্ছা-র সাথে। আজকাল উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা-র খরচ সীমিত। যদি না , কারিগরী-মেডিকাল-এর উচ্চশিক্ষার খুড়োর কল সামনে না থাকে। তো , সীতারামদের উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়ার যাকিছু খরচ যুগিয়েছিল সেই এনজিও। এমনকি পার্শ্বশিক্ষকের দ্বায়িত্ব-ও পালন করেছিল তারা। উচ্চমাধ্যমিক-র পর-ও বঙ্গবাসী কলেজ থেকে পাসকোর্সে বি.এ পাশ করে যায় সীতারাম। ওই দরমার ঘরে থেকে থেকেই। মোটামুটি ভালো ধীশক্তি-র জোরে একটু দুরের শহরতলিতে বিমা কোম্পানিতে কেরানির একটা চাকরি-ও ওর জুটে যায় । আরো দুটো ভাই যদিও ফুটপাতেই বড় হয় , আর বাপটা মুটেগিরি আর মা বাসনমাজার কাজ চালিয়ে যায় তখন-ও। এই পর্যন্ত সীতারামের গল্পটা হয়ত একটু কম সাদামাটা। ফুটপাথ থেকে বিমা কোম্পানির আপিস , এই সফর-টা কিছু হয়ত চমকপ্রদ। কিন্ত আমার লেখার অধিশ্রয় সেখানে নয় , অন্যখানে।

    বিমা কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার পর , ওই শহরতলি তে , একটা এক কামরার পাকাঘর ভাড়া নেয় সীতারাম। একচিলতে বাথরুম , সিঙ্গিলখাট আর লেখাপড়ার টেবিল। তো , অবৈতনিক ইস্কুল থেকে কলেজ পর্যন্ত রেজিস্টারে নাম , বাবার নামের সাথে জন্মদিন-ও লিখতে হয়েছিল প্রয়োজন হিসাবে। সেসব করে দিয়েছিল এনজিও-র লোকেরাই। কাল্পনিক কোনো একটা দিন , কোনো একটা মাস , কোনো একটা বছর। চাকরির দরখাস্ত করার সময়-ও ওই জন্মদিন লিখেছিল 'ডেট অফ বার্থ' এর পাসে। মুখস্ত করে রেখেছিল তাই। কোনদিন মনেও হয় নি যে ওই মাস দিন তারিখের কোনো আলাদা দ্যোতনা আছে। জীবনটা তো মধ্যবিত্ত নয়, যে জন্মদিনের স্বতন্ত্র মানে থাকবে।

    বিমাকোম্পানি-তে পরমা ছিল ওর সহকর্মী। প্রেমে পরে সীতারাম। একসঙ্গে কাজ করতে করতে , আপিসের নিচের চা দোকানে পাউরুটি -ঘুগনি খেতে খতে , সাইকেল-এ একসাথে আপিস যেতে যেতে। সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়। আর পাঁচটা প্রেমের মত। চিঠি লেখালেখি হয় আর পাঁচটা প্রেমের মত। হাত ধরাধরি হয় পাঁচটা প্রেমের মত। পরস্পর কে পরস্পরের কথা উজার করে বলা হয় , আর পাঁচটা প্রেমের মত। শুধু যখন পরমা ওর জন্মদিন জানতে চায় , সীতারাম বলে ২০ জানুয়ারী , কিছুটা যান্ত্রিকভাবে, তারপর ভুলেও যায়।

    *****
    এরপর ২০ জানুয়ারী-র , শনিবারের দুপুরে , সীতারাম যখন ঘুমোচ্ছিল ওর ভাড়া ঘরে , সিঙ্গিল খাটে , এটা যে ওর বানিয়ে নেওয়া জন্মদিন , সেটা যখন ওর আদৌ খেয়াল নেই , তখন দরজায় আলতো টোকা মেরে ঘরে আসে পরমা। হাতে একটা সস্তা চকলেট-এর বাক্স। কিছু বুঝে ওঠার আগেই , আধা ঘুমন্ত সীতারাম-কে জড়িয়ে ধরে প্রবল আশ্লেষে।

    তারপর অপাঙ্গে আলিঙ্গন আর গভীর উত্তেজনার মুহুর্তে , যখন অনুভূতিগুলো আর নিজের বশে থাকে না , যখন ঠিক মরে যাওয়াকেও অবাস্তব মনে হয় , সেই সময় কানের কাছে ভালবাসায় ফিসফিস করে পরমা বলে "শুভ জন্মদিন" .....

    তোমার চাঁদের আলোয় , মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান॥

    -----------
    ডাক দিল অচিনপুর

    রবি ঠাকুরের সব সৃষ্টি , আমার কেমন যেন , সেতারের বাজতারার মিঠে ধ্বনি -র মত রোমান্টিকতায় মাখানো মনে হয়। বাস্তবের অনেকটাই বাইরে। গল্প-উপন্যাসের হাসি কান্না ঝগড়া অভিমান , সবেতেই একটা মিউজিকল মুর্চ্ছনা। কোথায় যেন একটা এলিটিস্ট প্রলেপ। খুব সাধারণ দারোয়ান , কেরানি , দাসী , মাস্টারমশাই সব চরিত্র গুলো , প্রত্যেকেই এক এক জন কবি। তাদের প্রতিটা সংলাপে অসাধারণ জীবন দর্শন। যেমন ডাকঘরের দইওয়ালা। রোগা ভোগা অমলের কাছে স্বপ্ন ফেরি করে , বাড়ি তার অচিনপুর , সাতসমুদ্র তের নদীর দূরদর্শন দেখায় সে। ফেরিওয়ালা চরিত্রটা তার গৌন , রোমান্টিসিসম-টাই মুখ্য।

    ফেরিওয়ালা ব্যপারটা কিন্তু অনেক বস্তুনিষ্ঠ অনুসঙ্গ। ফেরিওয়ালা-রা একসাথে কাঁচা বাজার , ফাস্টফুড , সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি। হাপপ্যান্ট পরে তিড়িং বিড়িং বয়েসে শীতের দুপুরের স্মৃতিতে , আমাদের পঞ্চানন তলার বাড়িতে একটা রোদ বারান্দা ছিল। দুপুর বেলা সেখানে বসে , আমার সাদা ধপধপে থান কাপড় পরা , কাঁচা পাকা এলো চুলের ছোটখাটো মিষ্টি মত ঠাকুমা , সমবয়সী আর এক বিধবা ঘোমটাদেওয়া মহিলা-র কাছ থেকে চাল কিনতেন। ফি হপ্তায় সেই চালওয়ালী আসতো দুপুরে। অদ্ভুত সুরেলা ছিল তার , হাঁক পেড়ে পেড়ে যাওয়া। চালের নাম যে চাউনমনি , সেই খুদে বয়সে 'কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশিল রে' ছিল আমার। সেই চালের ফেরিওয়ালির নাম ছিল 'চালের মাসি'।

    শীতের আগে আগে বেলা দশটার দিকে লুঙ্গিপরা ছুচলো দাড়ির এক ধুনকর আসত পাড়ায় , সঙ্গে এক স্যান্ডোগেঞ্জিপরা সাগরেদ , তাদের কাঁধে বিশাল ধুনাকরী ধনুক। তাদের ধুনসটঙ্কারে পাড়া কাঁপত ধাই ধাই ধপ ধপ ধপ ধাই ধাই। পুরনো বালিশ লেপ তোষকে , নতুন তুলোর ওম ভরে দিত তারা। আর দুপুরে দেহাতি কাপড় আর ইয়াব্বড়ো লালটিপ পরা বাসনওয়ালী আসতো তার বারো বছরের ছেলে কে সঙ্গে নিয়ে। মাথায় পাহাড় প্রমান স্টিল/এলুমিনিয়ায়াম বাসনের ঝুড়ি। তার আবার ব্যবসা ছিল বিনিময় প্রথায় , পুরনো কাপড়ের এত্তয়াজ-এ। বাবার আধা নতুন পাজামা, শার্ট একদুবার চলে গ্যাছে , বাসনয়ালি-র ঝুলিতে , মা-এর স্টিলের গামলা কেনার নেশায়।

    *****
    বছর তিন/চার আগে , ডিসেম্বরে কলকাতা গিয়েছিলাম সপরিবারে। তো, এক সকালে রাস্তারপাশের জানালাওয়ালা বসার ঘরে চা খাচ্ছিলাম , সঙ্গে সদ্য কিশোরী কন্যা। ওর পশ্চিমী বেড়ে ওঠা জগতে ফেরিওয়ালা কনসেপ্ট-টাই বেমক্কা নতুন। সকালবেলা ঝারুওয়ালা , সব্জীয়য়ালা , মুড়িওয়ালা তাদের কিম্ভূত বিচিত্র হেঁড়ে মিঠে সরু গলায় হেঁকে হেঁকে যাচ্ছিল , আর মেয়ে প্রতিবার চমকে চমকে উঠে আমায় খোচাচ্ছিলো 'হোয়াট দে আর সেলিং ?' বলে বলে। আমার মনে হলো ওর জিজ্ঞাসা ঠিক এই নয় যে 'হোয়াট দে আর সেলিং ?' , জিজ্ঞাসা-টা অনেকটা ওই পিলে চমকানো ডাক থেকে আমরা কি করে বুঝি , কোন ফেরিওয়ালার পসরা কি ?

    তো যে কথাটা বলছিলাম। এরা রাবীন্দ্রিক রোমান্টিসিসম থেকে অনেক দুরে। এদের উপস্থিতি পুরোটাই বস্তুনিষ্ঠ। এরা মুড়িওয়ালা, চালের মাসি , দোসা (মানে দোসা বিক্রি করে) , তিরিশটাকা (এর ভ্যান গাড়িতে রান্না ঘরের ছাকনি থেকে জুতোর পালিশ পাওয়া যায় তিরিশটাকায়)। এদের সবার বেনামী আইডেন্টটিটি।

    ঠাকুমা বিগত হয়েছিলেন অনেক পরিপক্ক বয়সে , নব্বই-এর কোঠায়। তো ঠাকুমার পরলৌকিক ক্রিয়া কর্ম হয়েছিল আমাদের বাড়িতে , আর বাবা , কাকু , জেঠুদের সাতভাই-এর সপ্তর্ষি মন্ডল একযোগে মাথা মুণ্ডন করেছিলেন আমাদের বাড়ির উঠোনে। তো, সেই সময় পাড়ায় আসত শম্ভু পরামাণিক , চলমান ইতালিয়ান সেলুন। ওই যেমন বললাম , ফেরিওয়ালা সার্ভিস ইন্ডাস্ত্রী। আসলে , ওর নাম যে শম্ভু , সেটা বিশেষ কেউ জানত বলে মনে হয় না। ওর আইডেনটিটি ছিল , 'চুলকাটা দাড়িকাটা'। ময়লা ফতুয়া আর খেটো ধুতি পরা হার জিরজিরে বুড়োটে একটা লোক। সঙ্গে কাঠের বাক্সে ক্ষৌরো কর্মের সরঞ্জাম। তো, ওই শম্ভু , বাবা-দের ক্ষৌরো কর্ম করেছিল ঠাকুমা বিগত হওয়ার পরে। আর , দক্ষিনা ছাড়াও , কোরা ধুতি পাঞ্জাবি , চাদর বখশিস পেয়েছিল শম্ভু। পরলৌকিক কাজ কর্ম মিটে যাওয়ার পরে, আত্মীয়-পরিচিতদের শ্রাদ্ধ বাসরে শম্ভু-ও , এসেছিল নতুন ধুতি চাদর পরে। কিকরে যেন , সেই কাঠের হাতবাক্স ছাড়া, নতুন পাঞ্জাবীপরা হাসিমুখ শম্ভু-র চেহারাটা আমার পষ্ট মনে আছে এতদিন পরেও।

    এবার কলকাতা যাওয়ার সময় , এয়ারলাইন্সের বদান্যতায় , আমার একটা ক্যানভাসের সুটকেস ছিড়ে গিয়েছিল ধারের সেলাই বরাবর। তো একদিন এক চর্মকার কে ডেকে নিয়ে এলাম বাড়িতে , মেরামত করা জন্য। তো , ওই চর্মকার-ও ফেরিওয়ালা সার্ভিস ইন্ডাস্ত্রী। নাম টাম জানিনে। বাড়ির রাস্তায় হেঁকে হেঁকে যায় 'জুতো সেলাই' বলে বলে। তো , নিজের কাজের কাস্টমার রেফারেন্স দিতে গিয়ে একগাল হেসে বলল। 'আপনাদের বাড়ি আমি আগে কাজ করিছি তো , বড় বাবু (আমার পরলোক গত জ্যাঠামশাই) আমায় দিয়ে পামশু-র সোল্ মেরামত করেছেন কত্তবার , বলতেন "তোর্ ইস্কিল (স্কিল) আছে রে নির্মল" '। শুনে , আমি ঠিক দুটো ব্যাপারে একটু নাড়া খেলাম। এক ওর নাম নির্মল , আর দুই জ্যাঠামশাই -এর ওপর ওর ভালবাসাটা , ঠিক কাজের জন্য নয় , ওই 'নির্মল' বলে ডাকার জন্য।

    ***
    লেখাটা ঐখানেই শেষ হতে পারত। কিন্তু জীবন দর্শনে ফিরে যেতে চাওয়া পিছু ছাড়ে না যে। হঠাত মনে হলো , দাম্পত্য আর প্রেমের সম্পর্ক গুলো আজকাল ফূরিয়ে যায় তাড়াতাড়ি। সম্পর্ক গুলো শিমুল তুলোর লেপে-র মত। সুরুতে খুব তার ওম , জড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। তারপর সময়ের সাথে সাথে একঘেয়ে হয়ে আসে।

    এপাড়ায় ফেরিওয়ালা ধুনকর নেই যে , নরম নরম নতুন তুলো ভরে দেবে পুরনো লেপ-এ .....
  • dd | 116.51.31.148 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ ২২:৪০691962
  • বাঃ। বাঃ।
  • Du | 81.170.213.17 | ২৯ জানুয়ারি ২০১৬ ২৩:২৮691963
  • অনেকদিন পর। খুব ভালো লাগলো লেখা পড়ে।
  • rabaahuta | 215.174.22.20 | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০২:৩১691964
  • খুব ভালো লাগলো।
  • | ৩০ জানুয়ারি ২০১৬ ০৯:৫৭691965
  • একদম চেনা বাইনারি।

    তোমার ঐ রিক্শায় চড়া আর রিক্শাওয়ালার ছেলের গল্পটাও দিও এখানে।
  • Binary | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৩:৪৯691966
  • স্থূলাগ্র
    -------

    সল্টলেকের বাড়ির সামনে যে আবাসিক রাস্তা , তার মোড়ে , যেখানে বড় রাস্তায় মিশেছে , সেখানে একদিকে ভেলপুরির ঠ্যালা গাড়ি আর ফুচকার ঝুড়ি আর অন্যদিকে ইস্তিরিয়ালার কাঠের ঘুমটি আর কোনাচে করে রিক্সাস্ট্যান্ড। গত তিরিশ-বত্রিশ বছরে সল্টলেক আমূল পরিবর্তন হয়ে গেলেও, এই রিক্সাস্ট্যান্ডটা ঠিক এক জায়গায়তেই আছে। রিক্সাগুলো বাহারে আর গতরে পরিবর্তন হয়েছে অবশ্য, আগে ছিল কাঠের ওপরে টিনের পাত বসানো , আর এখন এলুমিনিয়াম বা হালকা স্টিলের। রিক্সাচালকের পরিবর্তন হয়েছে নিশ্চই , তিরিশ বছর আগের বুড়ো রিক্সাওয়ালার নাতি এখন চালায় হয়ত। কিন্তু স্ট্যান্ডটা ঠিক এক জায়গাতেই আছে। একবার শীতের মাঝামাঝি দেশে ছুটি কাটাতে এসে , ওই স্ট্যান্ড থেকে রিক্সায় উঠলাম। এরকম রিক্সায় তো রোজ-ই উঠি। কোনদিন রিক্সা কে চালাচ্ছে তার মুখ পর্যন্ত ভালো করে দেখি না। কোথায় যাব বলি আর ভাড়া কত জিগ্যেস করি, খালি এইটুকু-ই শব্দ নির্বন্ধ ব্যয় করি। রিক্সা যে চালাচ্ছে , সে কালো না ফর্সা , রোগা না মোটা , স্যান্ডোগেঞ্জি পরে ছিল না জামা, রিক্সা থেকে নেমে তিন পা হাঁটলেই আর মনে থাকে না। সুধু ক্যচর-কচোর করে যেটুকু পথ ওর রিক্সায় বসলাম , সেটুকু-ই যা সান্নিধ্য। সে যাই হোক , যে কোনো পাবলিক ইন্টারঅ্যাকশন -এ এটাই দস্তুর। একজন বাস কন্ডাক্টর-ই বা কতজন যাত্রী কে মনে রাখে ? হাতিবাগানের সিনেমা হলের সামনের চানাচুরওয়ালা-ই বা কতজন খরিদ্দার কে মনে রাখে ?

    কিন্তু সেইদিন , রিক্সায় উঠে খেয়াল করলাম, যে রিক্সাটা একটু অন্য রকম। মানে বসার জায়গা, মাথার ওপর ভাঁজ করা ছাতা এসব ঠিকঠাক-ই আছে , কেবল রিক্সার সামনে-র লোহার রড-এ একটা পুঁচকে ক্যারিয়ার সিট্ লাগানো। কিন্ডারগার্ডেন-এর বা ওই রকম ছোটবাচ্চারা ঐরকম সিট্-এ বসে বাবার সাইকেল-এ ইস্কুল যায়। রিক্সাওয়ালাটা অল্পবয়সী , বয়স হয়ত তিরিশ হবে বা কম । কালো , লম্বাটে , পাতলা মুখ , বাদামী ময়লা গেঞ্জি পরা, অপুষ্টিজনিত পেশী। আমায় 'দাদা বসুন' বলে , ভেলপুরিওয়ালার পাশে একটা কাঠের টুলে বসে প্রায় ঘুমিয়ে পরা একটা আড়াই-তিন বছরের বাচ্চাকে কোলেকরে নিয়ে এসে ওই ক্যারিয়ার সিট্-এ বসালো। বাচ্চাটা কালোকুলো , পুরনো হলদেটে সোয়েটার পরা , একটু মোটাসোটা। রিক্সাওয়ালা লোকটাকে , 'তোমার ছেলে ?' জিগ্গেস করাতে , একটু লাজুক মুখে বলল 'আগ্গে হ্যা'। তারপর সারা পথটুকু , বাচ্চাটার "বাবা কোথায় যাচ্ছিস ?" , "কাল বেলুন কিনে দিবি , বাবা ?" ইত্যাদি অধো আধো কথার উত্তরে নানা রকম আগডুম বাগডুম বলে গ্যালো , ঠিক আমি যেমন আমার মেয়ে-কে বলতাম ওই বয়সে। রিক্সাথেকে নেমে ভাড়া দেওয়ার সময় , মনে হয় এই প্রথম কোনো রিক্সাওয়ালার মুখের দিকে খেয়াল করলাম, অল্পবয়সী মুখে অপরিসীম বাত্সল্য আবেগ মাখানো , ঠিক আমার যেমন হত মেয়েকে কোলে নিলে।

    গল্পটা এখানেই শেষ হত হয়ত। কিন্তু আরো একটুখানি বাকি আছে। আরো চার-পাঁচ বছর পরে , সেই রকম এক ডিসেম্বরে-র সকালে , আমি আবার শীতে-র ছুটি কাটাতে কলকাতায় , বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরের বাজারে গেছি , অনেকদিন স্বাদ না পাওয়া জিলিপি-সিঙ্গারা কিনতে। তো , ফেরার পথে বাজারের সামনের রেলিঙ্গের গায়ের পত্রিকা স্টান্ডে সকালের আনন্দবাজার (আমার বাবা আবার আনন্দবাজার পত্রিকার ঘোরতর বিরোধী তাই বাড়িতে আসে না) আর একটা 'ইন্ডিয়া টুডে' নেড়েচেরে দেখছি , তো দেখি পাশের স্ট্যান্ড থেকে একজন রিক্সাওয়ালা , দাম দিয়ে দু-তিনটে হাঁদাভোদা আর নন্টেফন্টে কমিক্স কিনলো। আমার যেমন স্বভাব , সাদামাটা সব কিছুই , মাথার পেছন দিক দিয়ে চিন্তা করা তাতে, দেখে একটু অবাক-ই হলাম। তারপর , দেখি , রিক্সাস্টান্ডের সিমেন্ট বাধানো বটগাছে-র বেদিতে পা ছড়িয়ে বসে মুড়ি খাচ্ছে একটা সাত-আট বছরের ছেলে , তাকে সদ্য কেনা হাঁদাভোদা আর নন্টেফন্টে বই দুটো দিয়ে "তুই এখান বসে পড় , ইদিক উদিক কথাও যাবি নাই যেন , আমি একটা টিরিপ মেরে আসি ...' বলে আমায় 'আসুন দাদা ..' বলে ডাক দিল লোকটা। রিক্সায় উঠে ফেরার পথে জিগ্গেস করলাম , 'তোমার ছেলে ইস্কুলে যায় ?' , তাতে বলল 'যায় তো , এখন তো শীতের ছুটি' । সেই আড়াই-তিন বছরের বাচ্চা-টা এখন আটবছুরে , ইস্কুলে গিয়ে পড়তে শিখে গ্যাছে , হয়ত নিরক্ষর , কিন্তু একবুক মায়াভরা রিক্সাওয়ালা বাবা , কিনে দিচ্ছে গল্পের বই।

    ***
    দমদম বিটি রোডের , পাকপাড়া ক্রসিং-এর পরে 'সি আই টি' বলে একটা বাসস্ট্যান্ড আছে। প্রাইভেট বাসের হেলপার গুলো এখানে বাস দাঁড়া করিয়ে , 'ডানলপ ডানলপ' বলে চিলচিত্কার করে। তো এই রকম একটা বেবাক ধুলি ধুসরিত উত্তর কলিকাতার বাসস্টান্ডে , আমি একসময় বেশ কিছুদিন বাস থেকে নেমেছি। বাস স্টান্ডের গায়ে লাগানো একটা টালির ছাউনি দেওয়া পান-বিড়ি-সিগারেট-খৈনী-লজেন্সের দোকান থেকে গোল্ডফ্লেক কিনে দোকানে পাসের দড়িতে ঝোলানো আগুন দিয়ে সিগারেট ধরিয়েছি প্রায় রোজদিন-ই। বিকেলের দিকে দোকানে প্রচুর ভিড় থাকত , উল্টোদিকের রবীন্দ্র ভারতী ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের। দোকানি একটা কাঁচা পাকা দাড়ির বুড়োটে লোক , হেঁকে হেঁকে কথা বলত খরিদ্দার দের সাথে। কথায় পঞ্চাশ ভাগ হিন্দি আর পঞ্চাশ ভাগ বাংলা। পরিস্কার অবাঙালি , ব্যবসার খাতিরে ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলে। একটা কন্ঠি পরা রোগা মত , কোকড়া চুলের ছেলে-ও দোকানে থাকে , ওই বুড়োর ছেলেই হবে হয়ত। ছেলেটা অবশ্য বাংলা বলে পরিস্কার।

    একদিন দুপুরের দিকে সিগারেট কিনতে গেছি , দেখি দোকানে ছেলেটা একাই। দোকানের ভেতরে একটা চৌকিতে বসে কিএকটা বই-এ মুখ গুজে আছে। আমায় সিগারেট দিয়ে আবার তারাতারি গিয়ে বই নিয়ে বসলো। দড়িতে সিগারেট ধরানোর সময় খেয়াল করলাম , বইটা। প্রথমে বিশ্বাস-ই হচ্ছিল না। আবার ভালো করে কাছে গিয়ে দেখলাম , লেখকের নাম 'নীরোদ সি চৌধুরী' , বইয়ের নাম 'আত্মঘাতী বাঙালি' । ....

    ***
    ওপরের দুটো পর্যায়ক্রম আপাত ভাবে সঙ্গতিহীন। কোনো সুত্রে-ই যোগ করা যায় না। কিন্তু যেটা বলার , দুটোই আমাদের ছকে বাঁধা চিন্তাবৃত্তের বাইরের গল্প। আমাদের খোলস পরা সাধারন মূল্যায়নকে হারিয়ে দেওয়ার গল্প।

    অবাঙালি অল্পশিক্ষিত পানদোকানির ছেলের হাতে 'আত্মঘাতী বাঙালি' ..... ......
  • rabaahuta | 108.192.41.166 | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৫:৫৩691967
  • খুব ভালো লাগছে - পুরনো লেখাও খুঁজে বের করে পড়ছি আবার। এই শেষের লেখাটা দেওয়ার কথা বলার জন্যে দমদিকে থ্যাঙ্কিউ।
  • Tim | 108.228.61.183 | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৬:২৪691968
  • দ্বিতীয় গল্পটা আগে পড়েছি কিনা মনে করতে পারলাম না। বাইনারিদার লেখা নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। ভালো লাগলো খুব।
  • Tim | 108.228.61.183 | ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০৬:২৭691969
  • গল্প বলে ফেললাম, তারপর ভাবতে গিয়ে বুঝলাম রূপকথার মত সত্যিদুটো, তাই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন