এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • মিশনের ধুপছায়া দিনগুলি

    ranjan roy
    অন্যান্য | ২৪ মে ২০১২ | ৪০৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • manish | 127.200.83.149 | ২৯ মে ২০১২ ১০:২৮552380
  • বসে আছি পথ চেয়ে
  • ranjan roy | 24.96.83.227 | ২৯ মে ২০১২ ১৬:৪৪552381
  • কিন্তু ঘুম আসে। আসে ক্লাসরুমে, রোববারের সন্ধ্যেয় আশ্রমের আঙ্গিনায় ১৬ মিমি প্রোজেক্টরে ফিল্ম ডিভিশনের ডকুমেন্টারি দেখতে দেখতে।
    ভোর সাড়ে চারটেয় উঠে লাইন দিয়ে বাথরুম ইত্যাদি সেরে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মত প্রার্থনার পরে সোজা মাঠে গিয়ে পিটি এবং ড্রিল। করাতেন অমলদা। যতদূর জানতাম পিতৃমাতৃহীন বালক হিসেবে আশ্রমে ঠাঁই পেয়েছিলেন। তারপর ম্যাট্রিকুলেট্ট হয়ে মিশনের স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে টিচার, আর সকালে ড্রিল করানো এবং বিকেলে বিভিন্ন অকেশনে ভলিবল বা ফুটবল খেলার সময় রেফারি-- এই ছিল ওনার মিশন নির্দিষ্ট ভূমিকা আর সেটা তিনি যথেষ্ট যত্নের সঙ্গেই পালন করতেন। তখনো হিন্দিতে কম্যান্ড ( আগে চলে আপ-পিছে মুড়, বা বাঁয়ে চলে আপ ডাইনে মুড়) শুরু হয় নি। আজও কানে ভাসে ওনার গলায়--- মার্ক টাইম, লেফট-রাইট-লেফ্ট। কেউ ড্রিলের সময় হালকা মুডে থাকলে বেদম চটে যেতেন। ক্লাস টেনের শান্তশিষ্ট গোবেচারা স্বভাবের একটু " লুকিং লন্ডন, টকিং টোকিও" টাইপের দেবেশদাকে অন্যমনস্ক দেখে উনি গর্জে উঠলেন--য়ু প্রফেসর! অ্যাম টকিং টু ইয়ু!
    ব্যস্‌, দেবেশদার আশ্রম ছাড়া অব্দি "প্রফেসর" নাম আর ঘুচল না। আমরা কজন দেবুদাকে পছ্নদ করতাম ওনার পাতলা আওয়াজে তালাত মামুদের বাংলা গান শোনানোর জন্যে; --' এল কি নতুন কোনো গোধূলি বেলা,' বা ' হয়তো হাত লেগে পড়েছে খোঁপা থেকে ফুল ঝরে', অথবা সুপারহিট
    " যেথা রামধনু ওঠে হেসে, আজো ফুল ফোটে ভালোবেসে,
    বল তুমি যাবে কি গো সাথে, এই পথ গেছে সেই দেশে।' আর হিন্দিতে " জায়ে তো জায়ে কহাঁ"।
    সে যাই হোক, এর পরে টিফিন খেয়ে পড়া করে সাততাড়াতাড়ি চান সেরে ডাল-ভাত-কুমড়োর তরকারি নাকেমুখে গুঁজে ক্লাসে যাওয়ার পর অবধারিত ভাবে চোখে নামে ভাতঘুম।
    ফার্স্ট এবং ফিফ্থ পিরিয়ড হয়তো ভগবান ঘুমোনোর জন্যেই সৃষ্টি করেছিলেন। সে পিরিয়ড যদি বাংলা বা ইতিহাস হয়, ঘুম অবধারিত। ইংরেজি, অংক বা সংস্কৃত হলে ঘুমোনোর ফ্রিকোয়েন্সি একটু কম।
    ধরুন, ক্লাস নাইনের ফার্স্ট পিরিয়ড,-- বাংলা।
    পড়াচ্ছেন আর বি, অর্থাৎ রণেন্দ্র ভট্টাচার্য্য।আশ্রমের ছেলেরা অবধারিত ভাবে ব্যাকবেঞ্চার। খানিকক্ষণ ওনার লেকচার শোনার পর তুমি কনুই দুটো মুড়ে বেঞ্চের ওপর রাখলে। তারপর ঠান্ডা ডেস্কের ওপর গাল পেতে দিয়ে পেলে শীতলপাটির ছোঁয়া। আস্তে আস্তে ওনার কথাগুলো একঘেয়ে হয়ে অস্পষ্ট হতে হতে মৌমাছির গুনগুন হয়ে গেল, আরামে জুড়ে গেল তোমার চোখ এবং তখন তুমি অন্য জগতে চলে গেলে।
    হটাৎ পাঁজরে আঙুলের খোঁচা, সঙ্গে ফিসফিসানি-- ওঠ, ওঠ, স্যার দেখছেন। তুমি লাল চোখ নিয়ে ধড়মড়িয়ে উঠলে, বোকা বোকামুখ, মুখে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর টেবিলের ওপর মুখ থেকে গড়ানো নাল। একেবারে "বালিকা বধূ" সিনেমায় ক্লাস রুমে ঘুমন্ত বঙ্কিম ঘোষ!
    স্যার এগিয়ে এসেছেন। গোটা ক্লাস হাসছে। সামনের সারির ডে-স্কলার ছেলেগুলো সাগ্রহে তাকিয়ে -- আজ হোস্টেলের একটা ছেলে ঠ্যাঙানি খাবে।
    ( জনান্তিকে বলে রাখি, ফাইভ থেকে ইলেভেন অব্দি প্রত্যেক ক্লাসে মেরিট লিস্টের প্রথম পাঁচজনের মধ্যে অন্ততঃ দুই থেকে তিনজন হোস্টেলের। এটা কেন যেন কিছু ছেলের এবং টিচারের গাত্রদাহের কারণ ছিল।)
    ---- এতক্ষণ কী পড়ানো হচ্ছিল?
    বিমুঢ় তুমি এদিক ওদিক তাকাচ্ছ। ঘুমের ঘোর কাটেনি। মাথার মধ্যে মেঘ ও কুয়াশা। মাগো, কেন যে এইসব বোকাবোকা প্রশ্ন!
    --- কী পড়ানো হচ্ছিল? মানে আপনি যা পড়াচ্ছিলেন।
    স্যার আরও দু'পা এগিয়ে এলেন।
    --- আমি কী পড়াচ্ছিলাম?
    পেছন থেকে ফিসফিস-- শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রা!
    --- বেশ, তা শকুন্তলা পতিগৃহে পৌঁছেচেন, না কি মাঝরাস্তায় বঙ্কিমচন্দ্রের "ইন্দিরা"র মত ডাকাতের খপ্পরে পড়েছেন?
    এবার ওনার হাতের ডাস্টার উদ্যত, তুমি ভাবছ হাউ-টু-ফেন্ড? কারণ, ওনার হাতে ডাস্টার কথা বলে।
    কিন্তু তোমার পাশ ও পেছন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে অন্ততঃ জনা পাঁচেক আশ্রমিক ছেলে। প্রথম আঘাতের আগেই তাদের কোরাস শুরু হয়ে যায়-- " স্যার, স্যার! প্লীজ ওকে মারবেন না। ওর কাল রাত থেকে গায়ে ব্যথা, জ্বর, বমি। আজকে ডাক্তার ওকে আসতে বারণ করেছিলেন। শুধু আপনার ক্লাস বলেই এসেছে। আপনি যদি চান তো টিফিনের পরে ডাক্তারবাবুর থেকে লিখিয়ে আনতে পারি।"
    আরবি স্যার হকচকিয়ে যান। -ঠিক বলছিস? ডাক্তারের থেকে লিখিয়ে এনে দেখাতে পারবি?
    -- হ্যাঁ স্যার।
    ছেলেগুলো জানে আশ্রম প্রাঙ্গণের হোমিও দাতব্য চিকিৎসালয়ের গোবেচারা ডাক্তারবাবুর , নিক নেম মার্ক সল-থার্টি( উনি নাকি অধিকাংশ রোগীদের -- তোর কি হয়েছে রে! জিগ্যেস করেই একটুকরো কাগজে মার্ক সল-৩০ লিখে দিতেন আর ওনার কম্পাউন্ডার ব্রহ্মচারী শিশির কাগজের পুরিয়ায় কিছু সাবুদানার মত ভরে দিতেন) থেকে সার্টিফিকেট আনা দুনিয়ার সহজ কাজগুলোর মধ্যে একটি।
    কনফিউজড আরবি তোমাকে-- যা , বাইরে যা! হাত-মুখ ধুয়ে জল খেয়ে পরের পিরিয়ড থেকে ক্লাস করবি বলে ছেড়ে দিলেন।
    এখন বুঝতে পারি কোন পলিটিক্যাল পার্টির লোককে পুলিশ অ্যারেস্ট করলে " জনগণ" কেন এবং কিভাবে অপরাধীকে ছাড়িয়ে নেয়।
    ফিফথ্‌ পিরিয়ডের স্যারেরা ঘুমোনোর অপরাধে ঠ্যাঙাতেন না। মুখে চুকচুক করে বলতেন-- তোমাদের হস্টেলের ভাতে কিছু মেশানো থাকে নাকি? ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন, সর্বত্র এক ছবি! লাস্ট বেঞ্চে হস্টেলের কিছু ছেলে ঘুমোচ্ছে। ছ্যা- ছ্যা!
  • maxmin | 69.93.210.120 | ২৯ মে ২০১২ ১৬:৫১552382
  • ইয়ে রঞ্জন আমার একখান প্রশ্চেন ছিল। খন্ডন ভব বন্ধন ইমন কল্যান, এটা কি মিশনের ছাপা কোনও বইতে লেখা আছে? নাকি রাগনির্ণয় লেখকের নিজের?
  • ranjan roy | 24.96.83.227 | ২৯ মে ২০১২ ১৭:৩৩552383
  • ম্যাক্সিমিন,
    বরানগর মিশনের গানে যে বইটি, সংকলন- স্বামী শান্তিনাথানন্দ, তাতে আরাত্রিকের (খন্ডন-ভব-বন্ধন) ওপর লেখা আছে রাগ-ইমনকল্যাণ, তাল-চৌতাল। আবার শেষের চারলাইনে " নমো নম প্রভু, বাক্যগুণাতীত" -- লেখা আছে ত্রিতাল, আর অন্তিম দু-লাইন " ধে-ধে-ধে লঙ্গ-রঙ্গ-ভঙ্গ, বাজে অঙ্গ-সঙ্গ-মৃদঙ্গ"- একতাল।
  • maximin | 69.93.210.120 | ২৯ মে ২০১২ ১৭:৩৭552384
  • তাল তো চৌতাল বটেই। সে যাই হোক, উত্তর দেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ রঞ্জন। লেখাটা ভালো লাগছে। জলপাইগুড়িতে আমাদের বাড়ি ছিল আশ্রমপাড়ায়। হোমিওপ্যাথিক দাতব্য চিকিতসালয় ইত্যাদি খুব নস্টালজিক করে দিচ্ছে।
  • ranjan roy | 24.96.20.94 | ৩০ মে ২০১২ ১৮:২৮552385
  • ঘুম আসার আরেকটি নির্ধারিত লগ্ন হল রোববারের সন্ধ্যেয় হস্টেলের প্রাঙ্গণে ১৬ মিলিমিটারের প্রোজেক্টরে ডকুমেন্টারি সিনেমা দেখার সময়।
    সারা সপ্তাহ ধরে রুটিন মেনে চলার দিনগুলোয় অবচেতনে বাজে দাড়িদাদুর বাচ্চাটির মায়ের কাছে আকুতিঃ
    রবিবার সে কেন যে মা এত দেরি করে?
    ধীরে ধীরে পৌঁছয় সে সকল বারের পরে!
    শনিবার স্কুলের হাফ ডে; তখন থেকেই মন যে খুশি-খুশি-আজ। ফুটবল বা ক্রিকেট খেলার মাঠে চলে যাওয়া যায় অনেক আগে থেকেই। সন্ধ্যের কোচিং এর পর , রাত্তিরের খাওয়ার আগে এবং পরে , আড্ডা ও পরের দিনের জন্যে নানারকম প্ল্যান চলতেই থাকে।
    সকালে ড্রিল হয় একটু বেশি সময় ধরে। জলখাবারে একটু মুখ বদলানোর প্রত্যাশা-- মানে বোঁদে-মুড়ি, পাঁপড়ভাজা-মুড়ি, ঘিঁচকে-মুড়ি( ঘি-চিনি-মুড়ি), এসবের বদলে পাঁপড়্বের ঝোল-মুড়ি অথবা দুধ-চিঁড়ে( দুধে-জল নয়, জলে-দুধ) না দিয়ে চারটে স্লাইস-ব্রেড - চিনি ও একটি চাঁপা কলা।
    দুপুরে কারি-পাউডারের ঝোল ও অসিদ্ধ কাঁটা না দেয়া ডালের সাথে অন্ততঃ মাসে একদিন মাংসের ঝোল( একটু আধটু পোড়া হলেও কি আসে যায়!) আর রাত্তিরে মাসে একদিন পায়েস( পাউডার মিল্ক গুলে পঞ্চা রেঁধেছে তো একটু আধটু তলানিতে লেগে যাওয়ার পোড়া গন্ধ থাকতেই পারে)।
    আর পড়াশুনোর বদলে অনিলদার ধর্মক্লাস। উনি ভালো প্রচারক ন'ন; শিক্ষকও নয়। কিন্তু গাঁ থেকে আসা এই সন্ন্যাসীর মধ্যে নিজের আদর্শের প্রতি গভীর বিশ্বাস ও একধরণের সারল্য ছিল।
    ওনার উৎসাহ ছিল সব ব্যাপারে, গান-কোচিং- ক্রিকেট- নাটক কি নয়? কিন্তু কোনটাতেই গভীরতা ছিল না। মিশনের সন্ন্যাসীদের প্রোবেশন পিরিয়ড ( ব্রহ্মচারী অবস্থায়) গান শেখা কম্পালসারি। ফলে ভয়ানক বেসুরো অনিলদা( স্বামী আপ্তানন্দ) হারমনিয়ামের রীড টিপে কুল্যে তিনটে গান গাইতে পারতেন। উনি নিজেও বোধহয় ব্যাপারটা জানতেন। তাই কদাচিৎ প্রেয়ার হলে হার্মনিয়ামে বসতেন। কিন্তু যেদিন বসতেন সেদিন আমাদের মনে হত-- না ভীষ্মলোচন নয়, অ্যাস্টেরিক্স নামের কমিক স্ট্রিপ থেকে ক্যাকোফোনিক্স এয়েছেন, সবাই মনে মনে কানে আঙুল দিত।
    বছরে একবার নাটক হয়, কখনো কর্ণার্জুন, কখনো কেদার রায় । সেবার গরমের ছুটির আগে নাটক হবে চন্দ্রগুপ্ত। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পরে অনিলদার ঘরে প্রাথমিক রিহার্সাল চলছে। একটি দৃশ্যে
    বিজয়ী গ্রীকসৈনিকের দল যুদ্ধ জিতে রাত্তিরে নদীর তীরে আগুন জ্বালিয়ে আনন্দউল্লাস করছে, নাচ-গান চলছে ( কেকেআর উৎসবের কথা ভাবুন!)।
    স্ক্রিপ্টে একটি গানের লিরিক দেয়া আছে। কিন্তু অনিলদা বল্লেন-- ওসব ছাড়; বিজয়ী গ্রীক সৈনিকের দল গাইবে-- জয় রামকৃষ্ণ, রামকৃষ্ণ বলরে আমার মন!
    ওনাকে বোঝানো মুশকিল যে ওদের সঙ্গে ঠাকুরের প্রায় দুহাজার বছরের বেশি ব্যবধান। ওনার দৃঢ় বিশ্বাস যে গ্রীসেও মিশনের শাখা আছে।
    একবার রাত্তিরে চোর এসে অনেক বাসনপত্তর চুরি করে নিয়ে গেল। সকালে দেখা গেল স্কুলের পেছনের গলিতে চোরটি পূজার বাসনের একটি বস্তা ফেলে দিয়ে গেছে।
    অনিলদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বল্লেন-- চোরের মনটা ভাল, শ্রদ্ধা আছে, তাই পূজোর বাসনগুলো ছেড়েদিয়ে গেল। কিন্তু ও বুঝলনা যে আশ্রমের সব বাসনই পূজোর বাসন!
    ধর্মক্লাসে উনি বেদের হোমাপাখির গল্প শোনাচ্ছেন ----যে পাখির ডিম আকাশ থেকে মাটিতে পড়ার আগেই ডিম ফেটে ছানা বেরিয়ে পাখা গজিয়ে আবার আকাশে উড়ে যায়। কিন্তু গল্পের মেটাফর ভেঙে আধ্যাত্মিক ভূমিতে আসতে অনিলদা অপারগ, ফলে ছেলেগুলো বোর হয়। আবার ক্রিকেট ম্যাচ আছে। খেলার জন্যে টিম তৈরি হয়ে গেছে। পেছনের সারি থেকে ফিসফিসানি বাড়তে থাকে। রঞ্জন বার খেয়ে শহীদ হওয়ার জন্যে তৈরি হয়।
    অনিলদা প্রশ্ন করেন-- মানুষ কখন দুপেয়ে থেকে চারপেয়ে হয়? পারলে না তো? যখন বিয়ে করে সংসারী হয়, বৌয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে নেয়।
    ---- মহারাজ, বিয়ের পর বাচ্চা হয়ে গেলে কি ছ'পেয়ে হবে?
    সবাই হেসে ওঠে, ধর্ম ক্লাসের ওখানেই ইতি। কিন্তু ক্রুদ্ধ আত্মানন্দের সর্ষের তেল মালিশ করে ব্যায়াম করা হাতে ছেলেটা রামক্যালানি খায়।

    রোববার স্নানের আগে সারা সপ্তাহের বাসি জামাকাপড় কাচা -- বিছানার চাদর কাচা, নোখ কাটা কম্পালসারি। তারপর দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে যেকোন সময়ে অনিলদা এসে রুম ইনস্পেক্শন করবেন। সবার বিছানার চাদর, ঘরের কোণা , জানলার কাঁচ সব খুঁটিয়ে দেখবেন।
    নী্ধের তলার ঘর থেকে খবর এসে যায় -- ইন্স্পেকশন শুরু হয়েছে। দ্রুত হাতপা চালায় ছেলেরা। না- ধোয়া কাপড় বা ঝাঁট দিতে গিয়ে চোখ এড়িয়ে যাওয়া নোংরা কি করে লুকনো যায় তার ফন্দিফিকির চলে। আন্দাজ লাগানো হয় আর কতক্ষণ পরে উনি আমাদের ঘরে এসে পড়বেন। কিন্তু অনিলদার রাবার সোলের চটিতে শব্দ হয় না। দ্রুত তাঁর চলাফেরা। তাই ওনার নিকনেম "প্রাইভেট বাস"।কখন পৌঁছে গিয়ে উনি তীক্ষ্ণ নজরে সব দেখে নিচ্ছেন,-- তোষকের নীচে গুঁজে রাখা নোংরা জাঙ্গিয়ার নীচে একটি সিগারেটের প্যাকেট?
  • ranjan roy | 24.96.20.94 | ৩০ মে ২০১২ ১৮:৪৪552386
  • বছরে একবার করে হত কালচারাল ফাংশান, প্রায় সাতদিন ধরে। তাতে সাধুসেবা, ফিলিম শো, পূর্ণদাস বাউল এবং রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের গান, ধ্রুপদ-খেয়াল-ভজন সবই হত। কিন্তু অলিখিত নিয়মে গায়িকারা অপাংক্তেয়। রাধারাণী-ছবি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কীর্তনের কথা ভাবাই যায় না।
    স্থানীয় যাত্রাপালার দল এসে অভিনয় করে যেত-- কংসবধ, যবন হরিদাস ইত্যাদি। কিন্তু তাতে মহিলা চরিত্রের অভিনয় পুরুষ অভিনেতাকেই করতে হবে।
    যবন হরিদাস পালায় হরিদাসের জপে বিঘ্ন ঘটাতে একজন নগরবধূকে পাঠাবে কাজির দল। স্টেজে সেই নারীভূমিকার দেঁতো হাসির ছলাকলায় সেভেন থেকে ইলেভেনের ছেলের দল মুগ্ধ, হটাৎ কেউ দেখালে অনিলমহারাজ চেয়ারে বসে অভিনয় দেখার সময় যতবার নারীচরিত্রটি স্টেজে উঠছে ততবার চোখে হাতচাপা দিচ্ছেন। পেছন থেকে কোন বখা ছোঁড়া চেঁচিয়ে উঠল-- ওরে, মহারাজ আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখছে রে!
    হাসির হর্‌রার মাঝে অনিলদা উঠে বেরিয়ে গেলেন।
    পরবর্তী জীবনে যখনি কোন তৃণমূল স্তরের নিষ্ঠাবান সিপিএম ক্যাডারের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যাঁরা যে কোন সমস্যার নিদান দিতে পার্টি পত্রিকার বুকনিগুলো হুবহু কোট করে নিশ্চিন্ত থাকতেন , তখনি আমার মনে হয়েছে অনিলদার কথা।
  • maximin | 69.93.201.57 | ৩০ মে ২০১২ ২২:৪০552387
  • ভালো লাগছে।
  • Abhyu | 138.192.7.51 | ৩০ মে ২০১২ ২২:৫৮552388
  • "চোরের মনটা ভাল, শ্রদ্ধা আছে, তাই পূজোর বাসনগুলো ছেড়েদিয়ে গেল।"
  • অপু | 24.99.254.72 | ৩০ মে ২০১২ ২৩:০৪552390
  • মিনি দিঃ 'প্রার্থনা সঙ্গীত' এ পাবে।
  • maximin | 69.93.160.48 | ৩১ মে ২০১২ ১৪:২০552391
  • না অপু, গানটা তো জানি। ইমন কল্যাণের অনেকরকম রূপ হয়। এটাও একটা এক্সপেরিমেন্ট।
  • kc | 204.126.37.78 | ৩১ মে ২০১২ ১৫:০৩552392
  • ওটা কল্যাণ।
  • maximin | 69.93.160.48 | ৩১ মে ২০১২ ১৬:১০552393
  • মানে ইমন?
  • maximin | 69.93.160.48 | ৩১ মে ২০১২ ১৬:১৮552394
  • সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি কল্যাণ নামে কোনও আলাদা রাগের অস্তিত্ব স্বীকার করে না।

    Rajan Parrikar বলছেন উই শ্যাল ইউজ দি নেইম ইন্টারচেইঞ্জেবলি উইথ য়মন।
  • maximin | 69.93.160.48 | ৩১ মে ২০১২ ১৮:৩৭552395
  • রঞ্জন, তারপর?
  • aranya | 154.160.226.53 | ৩১ মে ২০১২ ২২:৪৯552396
  • রঞ্জন-দা, বরাবরের মতই, জমিয়ে দিয়েছেন।
  • ranjan roy | 24.96.103.181 | ০২ জুন ২০১২ ০১:৪৩552397
  • ৪) সিনেমা, খাওয়াদাওয়া ও ঘুমের স্বর্গরাজ্য
    ---------------------------------------------------
    রোববারের সন্ধ্যে। আগে থেকে জানার চেষ্টা করি আজ কি সিনেমা দেখানো হবে অথবা আদৌ কোন সিনেমা দেখানো হবে কি না।
    সাধারণতঃ ফিল্ম ডিভিশনের সরকারি প্রচারমূলক তথ্যচিত্র ও বৃটিশ দূতাবাস ও কাউন্সিলের তথ্যচিত্র দেখানো হত। ফলে আমরা রানী এলিজাবেথ , রাষ্ট্রপতি জন কেনেডির ভারত ভ্রমণ,। স্কট্ল্যান্ডের ঘোড়ার ফার্মের বা ডেয়ারি-পোলট্রির সঙ্গে কখনো কখনো গোরাচামড়ার ছেলেমেয়েদের স্কাউটিং বা ট্রেকিং, নদীতে নৌকোচালানো বা ট্রাউট মাছ ধরা এইসব দেখতে পেতাম।
    হিন্দি প্রচারমূলক ছবিতে দেখানো হত নেহেরু সরকার দেশের জন্যে কত কারখানা , বাঁধ, জলবিদ্যুত কেন্দ্র এই সব বানাচ্ছে।
    একটি টাকমাথা টুপি পরা চরিত্র দেখানো হত চন্দু নামে। সে বিশ্বনিন্দুক। বাসে যেতে যেতে, চায়ের দোকানে খবরের কাগজ টেনে নিয়ে লোকের গায়ে পড়ে বোঝাতে থাকতো-- সরকার খালি মুখে বলে এটা করব, সেটা করব, কিন্তু করে কচু! শেষে সে অফিসে গিয়েও কাজ না করে সহকর্মীদের টেবিলে বসে মাইল্কের নিন্দে করতে থাকে। মালিক বুড়ো-হাব্ড়া, অকর্মণ্য এইসব বলতে থাকে। ইতিমধ্যে মালিক এসে এককোণে দাঁড়িয়ে সব শোনে আর তক্ষুণি চন্দুকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। তথ্যচিত্রটির শেষে দেখানো হয়। চন্দু একদম পাল্টে গেছে। সরকারের তৈরি সিন্ধ্রি সারের কারখানা থেকে ডিলারশিপ নিয়ে দোকান খুলে চাষীদের মধ্যে কেমিক্যাল সারের গুণের প্রচার করছে।
    যতদূর জানি সিন্ধ্রি সার কারখানা বহুদিন বন্ধ হয়ে গেছে।
    আজ ভাবি, চমস্কি কথিত কনসেপ্ট-ম্যানুফাকচারিং বোধহয় সবদেশে সরকারের ধর্ম।
    এ'ছাড়া কখনো কখনো অ্যানিমেশন ফিল্ম দেখানো হত। আর বছরে কয়েকবার দেখানো হত কাহিনীচিত্র, প্রত্যাশিত ভাবেই ধার্মিক ফিল্ম। যেমন শ্রীরামকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য, কংসবধ ইত্যাদি।
    রামকৃষ্ণের ভূমিকায় কানু বন্দোপাধ্যায়ের অভিনয় ভোলার নয়, বিবেকানন্দের চরিত্রে আশীষকুমারকে ভালো লাগেনি। আর চৈতন্যের ভূমিকায় বসন্ত চৌধুরি ও বিষ্ণুপ্রিয়ার ভূমিকায় সুচিত্রা সেন। কিন্তু নিত্যানন্দের ভূমিকায় পাহাড়ী সান্যাল সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিলেন।
    তবে অন্যরকম ফিচারফিল্ম দু'একটা মাঝে মাঝে দেখানো হত, সে নেহাৎই ব্যতিক্রম। তার মধ্যে অজয় কর পরিচালিত মনোজ বসুর গল্প নিয়ে তৈরি স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমিকায় "ভুলি নাই", শম্ভুমিত্র-তৃপ্তিমিত্র-অমর গাঙ্গুলী অভিনীত অলিভার টুইস্টের বঙ্গীকরণ "মানিক" আমাদের কিশোর মনকে ছুঁয়ে গেছল।
    খালিসময় হস্টেলে ছেলেরা সিনেমায় দেখা সিকোয়েন্সের নকল করে আনন্দ পেত।
    তাতে রামকৃষ্ণ, তাঁর ভাগ্নে হৃদয়, তোতাপুরি এবং ভৈরবী(?), শম্ভুমিত্রের ফকিরচাঁদ, তৃপ্তিমিত্রের লিলি-- কাউকেই রেহাই দেয়া হত না। সেসব গল্প যথাস্থানে হবে। খালি একটা কথা বলে রাখি। শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য দেখে রাত্তিরে হলে খেতে যাচ্ছি, এমন সময় এলেন আমাদের হেডমাস্টার ষোড়শীমোহন ভট্টাচার্য্যের( ছেলেরা বলত সাঁড়াশীমোহন) বড়ছেলে কৃপাসিন্ধু। আমরা তটস্থ। উনি স্মিত হেসে বল্লেন-- সিনেমা দেখলে? সুচিত্রা সেনের ওই ডায়লাগ ডেলিভারিটা খেয়াল করলে?
    আমতা আমতা করি-- কোনটা স্যার?
    --ওই যে, যখন নিমাই সংসারত্যাগ করছেন বৃহত্তর সংকল্প নিয়ে তখন বিষ্ণুপ্রিয়া ওনাকে বিদায়ের সময় বলছেন --- আমার কি হবে?নিমাই তো এড়িয়ে যাওয়া জবাব দিলেন, মায়ের দেখাশোনা করবে।
    অনুচ্চারিত প্রশ্নটি হল--তাহলে বিয়ে করেছিলে কেন?
    তোমরা এখন ছোট। বিষ্ণুপ্রিয়ার ট্র্যাজেডি বুঝতে চেষ্টা কর। শুধু নিমাইকে পূজো করে মহাপ্রভু বানালে হবে না।
    আমরা হতভম্ব।
    -- স্যারটা খ্যাপা না কি রে? কিসব আলবাল বকে গেল? তুই কিছু বুঝলি?
    রঞ্জন চুপ। ও হটাৎ সেই মূহুর্তে বড় হয়ে গেছে।

    প্রথম দুয়েক বছর বিবেকানন্দ হলের নীচের তলায় ডাইনিং হলে সিনেমা দেখানো হত। হলটা ছিল হতচ্ছাড়া। মেজেয় খাবলা খাবলা সিমেন্ট উঠে গেছে। কাঠের পিঁড়িগুলোতে ময়লা এঁটে বসেছে। মাসে-ছমাসে মিদনাপুরি পাচক পঞ্চা আর তার সাঙ্গোপাঙ্গ সেগুলো পরিষ্কার করত। তখন দেখলে মনে হত পিঁড়িগুলো যেন সেলুন থেকে চুল কেটে ধোপদুরস্ত হয়ে এসেছে।
    তারপর আরো গ্রান্ট এল। একজন কেন্দ্রীয় রাজ্যমন্ত্রী খান্নাসাহেব এসেছিলেন তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে, সরকারি টাকায় নতুন ছাত্রাবাস ও ডাইনিং হল পরিদর্শনে। তখনো হলের মেজে দুরমুশ হচ্ছে। তার মধ্যেই টেবিল, সুন্দর টেবিলক্লথ আর ফুলদানি দিয়ে ওনাদের সম্বর্ধনা দেয়া হল। হস্টেলের গানের ছোট্ট দলটি গাইল-" সুন্দর লালা, নন্দদুলালা, নাচত শ্রীবৃন্দাবন মেঁ।"
    মন্ত্রী দম্পতি খুশী হয়ে সামনে বসা একটি ক্লাস নাইনের ছেলেকে বলিলেন-- কি বর চাই?
    ছেলেটি ঘাবড়াইল, তোতলাইল, কিন্রু সাথীদের প্রম্পটিং শুনিয়া বলিল-- দেব! যদি একটি সম্পূর্ণ ক্রিকেট-সেট পাওয়া যায়?
    দেবতা বলিলেন-- তথাস্তু!
    তৎক্ষণাৎ মলয় পবন বহিতে লাগিল। মহারাজদের মুখ হাসি-হাসি হইল। আমরা কিষ্কিন্ধ্যাবাসী বানরের দল উদ্বাহু হইয়া নৃত্য করিতে লাগিলাম।
    দেবতা কথা রেখেছিলেন। এসে গেল দুজোড়া ব্যাটিং প্যাড ও গ্লাভস্‌, উইকেট কীপিং এর আলাদা গ্লাভস ও প্যাড, পার্চমেন্ট ব্যাট গোটা চারেক। ছ'টি লালরঙা ক্রিকেট বল ও নেট।
    টেনিস বলে খেলা ছোটদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রইল। বড়দের খেলা বা এক্স- স্টুডেন্ট দের সঙ্গে বর্তমান আশ্রমের টিমের ম্যাচ রেগুলার ক্লাব ক্রিকেটের স্টাইলে খেলা হতে লাগল।
    তখন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মাত্র ষোল বছর হয়েছে। ক্রিকেট তখনো আম জনতার খেলা হয়ে ওঠেনি। তখনো ফুটবল লীগ, আই এফ এ শীল্ড এর সঙ্গে রোভার্স এবং ডুরান্ড কাপ নিয়ে লোকে উত্তেজিত হত। বাইটন কাপ এবং কোলকাতা হকি লীগ দেখতে মাঠে ভীড় হত। লিয়েন্ডার পেজের বাবা ডঃ ভি পেজ, কাস্টমসের ক্লডিয়াস, মোহনবাগানের ইনামূল হক, ইক্রামূল হক এবং অল্প পরে ধ্যানচাঁদ-পুত্র অশোককুমার কোলকাতায় নক্ষত্রের মর্য্যাদা পেতেন। সেই সময় ক্রিকেট ছিল একটি এক্সক্লুসিভ্গ্রুপের খেলা, ক্রমশঃ জনপ্রিয় হতে চলেছে। কাজেই তখন ক্রিকেট সেট পেয়ে যা আনন্দ হয়েছিল তা আজ অনুভব করা মুশকিল।
    তারপর পেছনের খালি মাঠে ইউ শেপের ডিজাইনে নতুন ছাত্রাবাস হল। তাতে কোন হল নেই। প্রত্যেক ঘরে পাঁচটি জানালা আর পাঁচটি খাট। কয়েকটিতে কিচেন, স্টোর ও ওয়ার্ডেনের থাকার ব্যব্স্থা। আর মন্ত্রীজি দেখে যাবার অল্পদিনের মধ্যেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ডাইনিং হলে অন্ততঃ দুশো ছেলের একসঙ্গে বসে খাবার ব্যবস্থা হল। খাবার কোয়ালিটি আগের চেয়ে একটু ভাল হল, আমাদের খিদেও বেড়ে গেল।
    আর ওই ইউ-শেপের বিল্ডিং এর মাঝের খালি জায়গায় পর্দা টাঙিয়ে সিনেমা দেখানো হত। প্রোজেক্টর চালাতেন গৌরদা।ওনার একটি হাত কব্জি থেকে কাটা। কিন্তু ওই এক হাতে ভলি বলের মাঠে নেটের ওপর ভেল্কি দেখাতেন। আর কালীকীর্তনের দলেও ভাল গলা মেলাতেন।
    সাধারণতঃ তথ্যচিত্রগুলো বহুবার ব্যবহৃত হতে হতে শুয়োরের মাংস হয়ে যায়।আমরা আগে থেকেই বুঝতে পারতাম এরপর কি আসছে বা কখন রীলের ফিতে আটকে যাবে। তাই ঘুম পেত। শুধু এ ওর ঘাড়ে মাথা দিয়ে নয়, কেউ কেউ আসন-সতরঞ্চি-বালিষ নিয়ে আসতো ঘাসের ওপর পেতে ঘুমোবে বলে। এই ঘুমের সময় কারো নজরদারি থাকত না, কেউ নাম নোট করত না। তাই সিনেমা শুরু হলেই আয় ঘুম।
    ঘন্টা দুইয়ের এই ফিলিম-পর্ব শেষ হলে আলো জ্বললে এখানে ওখানে যুদ্ধক্ষেত্রে কাটা সৈনিকের মত পড়ে থাকা ছেলে গুলোকে ডেকে তুলে ঘরে পাঠানো হত। তারপর হয়ত আধঘন্টা পরে খাবার ঘন্টা বাজবে। কাঁচাঘুম থেকে ওঠা ছেলেগুলো নিজেদের ঘরে গিয়ে সোজা বিছানায় ডাইভ মারত।
    খাবার ঘন্টা বাজলে আবার একপ্রস্থ ডাকাডাকির পালা।
    এই নিয়ে একটা কান্ড ঘটে গেল।
    এমনি এক রাতে সিনেমা শেষ হয়েছে। ঘরে ঘরে ছেলেরা খাবার ঘন্টা বাজার ফাঁকে ঘুমিয়ে নিচ্ছে। আমরা তিন বন্ধু একটি খেলা শুরু করলাম। একেকটি রুমে যাই ঘুমন্ত একটি ছেলের খাটের দু'মুড়োয় দুজন দাঁড়াই। একজন লাইটের সুইচের কাছে। চাপাস্বরে ওয়ান-টু-থ্রি বলার সঙ্গে সঙ্গে একজন লাইট নিভিয়ে দেয়। অন্য দুজন ঘুমন্ত ছেলেটির খাট কাত করে দেয়। ছেলেটি হড়বড়িয়ে আঁতকে ওঠে এবং মাটিতে পড়ে যায়। হাসির হররা ওঠে। আমরা পরের ঘরটিতে যাই। অ্যাকশনগুলো ক্রমানুসারে রিপিট করি। মুগ্ধ দর্শকদের সংখ্যা বৃদ্ধি হতে থাকে। এইভাবে রুম নম্বর এক থেকে শুরু করে চলতে চলতে পৌঁছে যাই রুম নম্বর কুড়িতে।সেই রুমে দেখি মাত্র একজন সাদাচাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে। আমরা যে যার পজিশন নেই। অপারেশন শুরু। খেয়াল করিনা যে দর্শককুল উধাও। অন্ধকারে খাট কাত করতেই চাদরমোড়া ভারি শরীরটি খাট থেকে পড়ে যায়। আর দৌড়ে পালাতে পালাতে আমরা শুনতে পাই এক ক্রুদ্ধ চিৎকার--- অ্যাই কে রে? কার এত সাহস?
    আওয়াজ আমাদের পরিচিত। ঝোঁকের মাথায় ভুলে গেছলাম যে এই রুমটিতে একজনই থাকেন-- নীচের তলার ওয়ার্ডেন ব্রহ্মচারী সুশীলদা।
  • ranjan roy | 24.96.101.254 | ২৪ জুন ২০১৪ ০০:২৫552398
  • ৩) ফুটবল! ফুটবল!
    -------------------
    আগস্ট মাসে জলকাদায় ভরা মাঠ।তাতে কি! সকাল বেলা প্রেয়ারের পরে মাঠে ড্রিল করা ও বিকেলে কাদায় গড়াগড়ি দিয়ে স্লিপ কেটে ফুটবল খেলায় কোন কমতি নেই!
    ইন্টারক্লাস ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেছে।সবাই হাঁ করে দেখে নোটিস বোর্ডে ফিক্সচার। ওদের সিক্স-বি'র বিপক্ষে যে টিম তার ক্যাপ্টেন গৌতম সরকার বলে একটি বেঁটে মত স্থানীয় ছেলে।
    কিন্তু ওর কি খেলা! কী হার্ড ট্যাকল্‌ ! অনায়াসে বয়সে বড় ও লম্বা ফরওয়ার্ডের পা থেকে বল কেড়ে নেয়।
    হেরে যাওয়া টিমের ছেলেরা বলাবলি করে--কেমন গাঁট দেখেছিস? নিঘ্ঘাৎ বয়স বেশি হবে।
    কিন্তু ওর মুখের কাঁচা খিস্তি শুনে বাচ্চা ছেলেগুলো বেশ আমোদ পায়। ঝগড়া হয় না, গালাগাল গুলো শুধু নিজের দলের প্লেয়ারদের জন্যেই বরাদ্দ-- বিশেষ করে সিটার মিস করলে বা বল বাড়াতে ভুল করলে।

    না, না, পাকাচুল স্মিতহাসি যে গৌতম আজ টিভি চ্যানেলে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দলগুলোর খেলার স্টাইল নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় মেতেছেন তিনি নিশ্চয় অন্যগ্রহের কেউ।

    রোববারে আবার অন্য গল্প। তখন শুধু আশ্রমের আবাসিক ছেলেদের খেলা। এর মধ্যে আছেন অনন্তদা, অনন্তপ্রসাদ পাল। উনি নাকি একসময় এরিয়ান্স টিমে চান্স পেয়েছিলেন। এখন অফিসে দশটা-পাঁচটা চাকরি করেন। কিন্তু থাকেন আশ্রমে, পেটভাতায়। ওনার বড় ভাই অচ্যুতদা আশ্রমের ক্লার্ক। অবিবাহিত দু'ভাই। তবু কোন কোন দিন স্থানীয় দু একজন বয়স্ক প্লেয়ার আসেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখি অনন্তদার হটাৎ নেওয়া ব্যাকভলি!
    আমরা আগে থেকে টিম বানাই, বাড়িতে আবদার করে কালো ইল্যাস্টিক দেওয়া প্যান্ট ও অন্ততঃ এক পায়ের জন্যে একটা অ্যাংকলেট আদায় করি। আর আমাদের দেশি কোচ গোষ্ঠদার কাছে সময় বের করে পায়ের আউটস্টেপ ও ইনস্টেপ দিয়ে বল রিসিভ করার টেকনিক অভ্যাস করি।
    তারপর জলকাদায় আছাড় খেয়ে প্রাণপণে ফুটবল পেটাই, হেরে ও কাদা মেখে ভূত হই, ব্যর্থতায় নিজেদের মধ্যেই লাথালাথি ও দোষারোপ করি। তারপর যোগানন্দ ধামের সামনের এঁদো পুকুরে কাদা ধুয়ে শেষে কলতলায় গিয়ে জামাকাপড় কেচে স্নান করে প্রেয়ার হলে যাবার জন্যে তৈরি হই।
    আর রাত্তিরে খবরের কাগজ বা "খেলার মাঠ", "স্টেডিয়াম" গোছের ম্যাগাজিন থেকে প্লেয়ারদের ছবি কেটে আঠা দিয়ে স্ক্র্যাপবুকে লাগাই। ফুটবল তারকাদের নামে নিজেদের নামকরণ করি।
    তাই সুব্রত হয়ে যায় পুসকাস, চন্দন ডিডি, সলিল ভাভা। না কেউ গ্যারিঞ্চা বা পেলে হই না। সাহস হয় না। গ্যারিঞ্চার যে বাঁকা পায়ের ড্রিবল! আর পেলে! গোষ্ঠদা বলেন আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি-- রঘুডাকাতের গল্পের মত। র
    সেই যে পেলে হিল দিয়ে দুজন রাশিয়ান ডিফেন্ডারের মাথা টপকে বল গোলি আর ওদের মাঝখানে লব করে আবার বল মাটিতে পড়ার আগে দৌড়ে গিয়ে ভলিতে গোল করলেন! কল্পনায় ছবিটা ধরার চেষ্টা করি।
    এবার রহড়া মিশনের মাঠে আমাদের ম্যাচ, স্থানীয় নরেন্দ্রনাথ বিদ্যামন্দিরের সঙ্গে।
    দল বেঁধে সেক্রেটারি মহারাজের কছে যাই। আমাদের অন্ততঃ মিশনের ডজ ভ্যানে করে রহড়া নিয়ে যাওয়া হোক।একজন ওয়ার্ডেন সঙ্গে যাবেন। আমরা দলের জন্যে গলা ফাটাবো।
    আমরা নিশ্চিন্ত যে বিদ্যামন্দিরকে গুনে গুনে চার গোল দেব, প্রত্যেক হাফে দুটো করে।
    আমাদের স্কুলের সেন্টার ফরওয়ার্ড ঐত্রী বসু রায়, দুই ইনসাইড মাখন্দা, পান্নাদা আর লেফ্ট আউট সৌরেন--- আমাদের গর্ব।
    আর বিদ্যামন্দির তো ছোট স্কুল, আমাদের সঙ্গে তুলনা? হ্যাঃ!
    কিন্তু রহড়া মিশনের মাঠটা মনে হল অনেক বড়। আমাদের ছেলেরা যেন খেলাটা ধরতেই পারল না। তিন-এক গোলে হেরে আশ্রমে ফিরলাম। ফেরার সময় মুখে কথা নেই। কিন্তু রহড়া মিশনের বিল্ডিং আর মাঠ ! বড় হিংসে হল।
    কেমন মনে হল বরানগর মিশন বেশ গরীব, আর রহড়া নরেন্দ্রপুর বড়লোক।
    আর সেই সঙ্গে মনের কোণে জন্ম নিল বরানগরের জন্যে কিরকম এক কষ্ট মেশানো ভালবাসা।
  • Abhyu | 109.172.118.125 | ২৪ জুন ২০১৪ ০০:৫৩552399
  • ভালো লেখা, রঞ্জনদা।
  • ranjan roy | 24.99.18.7 | ০৭ মার্চ ২০১৫ ২১:৩৪552401
  • ৫)
    আশ্রমের আশ্রিতরা
    ===================
    কয়েকজন গুণীলোক নিরুপায় হয়ে আশ্রমে ঠাঁই নিয়েছিলেন।
    এদের মধ্যে দুটো গ্রেড ছিল। কয়েকজন ছিলেন বেতনভোগী কর্মচারী। আর বাকিরা হয় অন্য কোথাও সামান্য চাকরি করতেন বা নিজের মত করে থাকতেন।
    কিন্তু এদের মধ্যে কমন ফ্যাক্টর হল যে এরা সবাই মিশনের কোন না কোন কাজে অপরিহার্য ছিলেন। আর সবাই থাকতেন পেটভাতায় , তবে মিশন এদের মাথার উপরে ছাদের নিশ্চিতি দিয়েছিল। ষাটের দশকে সেই বা কম কী!
    আগে বলি রামকানাই মহারাজের গানের দলটির কথা। কালীকীর্তনের দল। সুন্দর ক্যালিওগ্রাফির স্টাইলে প্রায় তিন ইঞ্চি সাইজের অক্ষরে বড় বড় খেরো খাতায় তুলি দিয়ে গানগুলো , রাগ ও তালের সঙ্গে, লেখা থাকত। অন্ততঃ দুটো খাতা ছিল। ফলে গোটা গায়ক দল দূর থেকেই কথা গুলো পড়ে নিত। বেশ কয়েকটি ধ্রুপদাঙ্গের চৌতালে।
    যেমন " তুমি শ্যামা হর রমা সদা শিবের মনমোহিনী"--এটা দিয়েইশুরু হত। আর "নীলবরণী নবীনা রমণী, নাগিনী জড়িত জটা বিভুতিনী"। দুটোই চৌতালে, প্রথমটা জয়জয়ন্তী। আমার ফেভারিট ছিল " কেমন মেয়ে নগ্না হয়ে আসিল এ সমরে"। জয়জয়ন্তী, তেওড়া।
    আর "ওমা কালভয়বারিণী, কপালিনী; শম্ভুভামিনী নিশুম্ভঘাতিনী"।
    আর খেমটা তালে "সমরে নাচে রে কার এ রমণী, নাশিছে তিমিরে তিমিরবরণী"।
    এসব বোধহয় পুরনো যাত্রাদলের জুড়ির দলের গানের ট্র্যাডিশন থেকে এসেছে।

    অন্ধ বাদক নগেশদা অসাধারণ পাখোয়াজ বাজাতেন। প্রতিদিন প্রার্থনা হল ছাড়াও সমস্ত বিশেষ গানের অনুষ্ঠানে। থাকতেন পেটভাতায়। শীতের দিনে বছরের পর বছর একটি শস্তা কালো র‌্যাপার।

    প্রেমনাথ রায় বা প্রেমবাবু স্যার।
    একটি সাদা খদ্দরের লুঙ্গিমতন, ওপরে কখনো ফতুয়া কখনো অমনই একটি সাদা খদ্দরের চাদর। চমৎকার ভায়োলিন বাজাতেন, কালীকীর্তনে তো বটেই। বিলম্বিত ধ্রুপদাঙ্গের গানের সঙ্গেও। প্রথম জীবনে হয়ত প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন, তাই স্যার শব্দটা নামের সঙ্গে জুড়ে গেল। ডাইনিং হলের কোণে বসে চুপচাপ নিজের সামান্য খাওয়াটুকু খেয়ে উঠে যেতেন।
    প্রৌঢ় মানুষটির মুখে সব্সময় একটি প্রশান্তির ভাব লেগে থাকত। আমাদের মত সিক্স-সেভেনের বাচ্চাদের আবদারে চলার পথেই দাঁড়িয়ে পড়ে বেহালায় অন্ততঃ তিনটি রাগে ( মল্লার ও দেশ মনে আছে) বন্দেমাতরম বাজিয়ে শোনাতেন।
    সকালে দেখা যেত সদ্যস্নাতঃ প্রেমবাবুস্যার বুকের কাছে জোড়া হাত , "জয় গুরু, জয় গুরু, জয় গুরু, জয়", বলতে বলতে চলেছেন-- সমনে পড়ে গেলে সবাইকে প্রীতি সম্ভাষণ, সবার জন্যে শুভকামনা।
    কিন্তু কুঁচোকাচার দল বড্ড বাঁদর। ওনার নাম দিল ফটফটি বা মোটরসাইকেল। কারণ ওনার বায়ু দোষ। চললে পেছন থেকে মোটরসাইকেলের সাইলেন্সারের মত ফটফট আওয়াজ হত। উনি নির্বিকার।

    গোষ্ঠদা।
    কাশীপুর গানসেল ফ্যাক্টরির শ্রমিক। চোখে পাওয়ারফুল চশমা। টুইলের হাফ্শার্ট আর ধুতি, পায়ে কেডস্‌। ফুটবল ও ভলিবলের
    রেফারি এবং কোচ। অনেক যত্ন নিয়ে শেখাতেন-- ইনস্টেপ ও আউটস্টেপ দিয়ে বল রিসিভ করা ও পাস দেওয়া। ভলিবলের ফিংগারিং।
    কিন্তু ওনার আসল প্যাশন গানের আসরে খঞ্জনি বাজানো এবং নাটকের সময় ডিরেক্শন দেওয়া।
    কেদার রায় নাটকের সময় রঞ্জনের বড় শখ চাঁদ রায় করে। দুটো মাত্র সীন। তাতে বিধবা মেয়ে সোনার ঈশা খাঁর সঙ্গে পালিয়ে যাওয়া এবং তাকে উদ্ধার করতে আসা কাকার ফৌজের বিরুদ্ধে নিজের হাতে তলোয়ার ধরার খবর পেয়ে পতন, মূর্চ্ছা ও মৃত্যু। কী দারুণ ক্ল্যাপস!
    কিন্তু তখন চোদ্দবছর বয়স। গলা ভাঙছে। ফলে গোষ্ঠদার অনেক পরিশ্রম সত্ত্বেও সেই হাহাকার বেরোল ফাটা বাঁশের মত কোরাস গলায়। ট্র্যাজিক সীন কমিক হয়ে গেল।
  • ranjan roy | 24.96.90.22 | ০৮ মার্চ ২০১৫ ০০:২৬552402
  • অনন্তদা ও অচ্যুতদা।
    ছোটভাই অনন্ত প্রসাদ পাল সুন্দর পেটানো চেহারা। কোন একটি অফিসে কাজ করতেন ও আশ্রমে থাকতেন। সেসময় এরিয়ান্স ক্লাবে ফুটবল খেলতেন--সেটা নিয়ে ওর বড় ভাই ও আমাদের বেশ গর্ব ছিল। আশ্রমের হয়ে একটি ম্যাচে হাওয়ায় শরীর ছুঁড়ে ব্যাকভলি বেশ মনে আছে।
    ক্রিকেটের সময় মিশনের টিমে প্রীতি ম্যাচে মিডিয়াম পেস বোলিং ও টেইল এন্ডার হিসেবে সব বলেই সিক্স মারার চেষ্টা।
    কিন্তু রামকানাই মহারাজের কালীকীর্তনের টিমে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী ও কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা এই ইয়ংম্যানের সুরেলা কন্ঠস্বর আমাদের কোরাসে শক্তি যোগাত।
    আবার আমেরিকার CARE সংস্থার পাঠানো গুঁড়ো দুধ গুলে বিশাল লোহার তৈরি নৌকোর মত পাত্র থেকে স্থানীয় গরীবদের মধ্যে বিতরণের দায়িত্বও ওনার।
    কোন কোন ছুটির দিন দেখতাম পানা পুকুরে ওই লোহার গামলা চড়ে জলঝাঁঝি/পানা পরিষ্কার করছেন।
    আমার মনে পড়তঃ
    "তারা ছাঁকনি চড়ে সাগর পাড়ি দেবেই দেবে,
    নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল,
    পাপাঙ্গুল।"

    অচ্যুতদা মিশনের ক্লার্ক। পেটভাতায় ও সামান্য মাইনায় আছেন। নির্বিরোধী মানুষ। কিন্তু রুটি খেতে পারতেন না। ১৯৬৫তে ভারত-পাক যুদ্ধের সময় র‌্যাশনিং শুরু হল। চাল পাওয়া যায় না। সরকার একবেলা রুটি খেতে বলছেন। হোস্টেলে রাত্রে সবার জন্যে রুটি বরাদ্দ হল। উনি দু-একদিন নাড়াচাড়া করে উঠে গেলেন। তৃতীয়দিন কেঁদে ফেললেন। ওনার কান্নাকাটি দেখে রাত্তিরে দু-হাতা ভাত ওনার জন্যে বরাদ্দ হল।
    আজ দেখি গলিতে গলিতে মহিলারা/পুরুষরা রুটি বেলছেন, লোকে লাইন দিয়ে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। সত্যি, গত ৫০ বছরে বাঙালীর খাদ্যাভ্যাস পাল্টে গেছে।
  • ranjan roy | 24.96.90.22 | ০৮ মার্চ ২০১৫ ০১:০১552403
  • গৌর সাহা।
    একটি হাত নেই। কিন্তু একহাতেই কামাল। কালীকীর্তনে সুরে গাইছেন। ভলিবল মাঠে নেটের সামনে লাফিয়ে একহাতেই স্ম্যাশ করছেন বা প্লেস করছেন। স্বল্পবাক, স্মিতহাসি।মুখে একটা পান।
    আমাদের মধ্যে উনি জনপ্রিয় কারণ রোববারে সন্ধ্যের প্রার্থনার পরে প্রোজেক্টর চালিয়ে সিনেমা দেখানোর কাজটা উনিই করতেন। ইউসিস/ বৃটিশ হাই কমিশনের অফিস বা ফিল্ম্স ডিভিশনের থেকে সিনেমার ক্যান নিয়ে আসার দায়িত্বের সাথে প্রোজেক্টরে ফিতে ফেঁসে যাওয়া, গরম হয়ে থেমে গেলে রিপেয়র করা-সব ওঁর দায়িত্ব।

    ভূপতি সিংহ( বড়দা)
    ----------------------------------
    স্ত্রীবিয়োগের পর আমাদের সবার বড়দা দুইছেলেকে নিয়ে আশ্রমের আশ্রয়ে এলেন। উনি ছিলেন আমাদের সিক-রুম ইন্চার্জ। যোগানন্দ ধামের দোতলাটার ছোট-বড় দুটো ঘর ওনার থাকার জন্যে এবং সিক রুমে হিসেবে ব্যবহারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হল। কেউ অসুস্থ হলে তাকে সিকরুমে গিয়ে থাকতে হত। একজন এম বি ও একজন এল এম এফ ডাক্তার পালা করে আমাদের দেখতে আসতেন। তাঁদের ফি, প্রেসক্রাইব্ড ওষুধপত্তর আনানো, রোগীদের পথ্য--সব বড়দার দায়িত্ব। পেট খারাপ হলে যে পেঁপে সেদ্ধ দিয়ে ভাত দেওয়া হত ( বার্লি দেখলেই না না করে উঠতাম) তাতে ই খুশি হতাম। বাড়াবাড়ি অসুখ হলে বাড়িতে খবর দিয়ে নিয়ে যেতে বলা হত।
    ক্লাস টেনে পড়ার সময় সন্ধ্যের প্রেয়ারে না গিয়ে আলো নিভিয়ে ঘরে শুয়ে ছিলাম। কপাল মন্দ, পড়বি তো পড় কেশব মহারাজের পাল্লায়। ওনাকে বললাম-- আমিঅসুস্থ। সঙ্গে সঙ্গে উনি আমাকে সিক রুমে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আর বললেন সেখান থেকে নিজেদের বন্ধুবান্ধবের হোস্টেলে আসা চলবে না। পড়াশুনা সবই সিকরুমে। স্কুল যাওয়া বন্ধ। তিনদিন পর অসহ্য হয়ে ওঠায় মাপ চেয়ে হোস্টেলের ঘরে আসি।

    উনি নাকি পূর্বাশ্রমে পুলিশ অফিসার ছিলেন। তিক্ত সার্কাস্টিক বাক্যপ্রয়োগ, ঠ্যাঙানোর হাত ও চিবিয়ে চিবিয়ে ইংরেজ আমলের পুলিশের ধৌঁস দেওয়া --- আমাদের গেরুয়ার প্রতি মিনিমাম শ্রদ্ধাটুকু উপে গেল। সেবার কালীপূজোর রাত্তিরে একটা রকেট বোম ওনার দোতলায় ওনার ঘরের জানলায় ফাটলো।
    উনি সন্দেহ করলেন পরিতোষকে( নিখুঁত এক্সিকিউশনের জন্যে) আর আমাকে ( প্ল্যান জোগানোর জন্যে)।
    কিন্তু আজও বলছি--ওই প্ল্যান আমার ছিল না।
    তা উনি বন্ধ দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে পরিতোষকে লাগালেন এক ঘুঁষি। গোদা হাতুড়ির মত হাত। পরিতোষের দাঁত নড়ে গেল। পরের ঘুষিটা পরিব্যাটা আন্দাজ করে ঠিক সময় ডাক করলো।
    ঘুঁষি লাগলো দরজার লোহার কড়ায়। কড়া গেল বেঁকে। কিন্তু মহারাজের আঙুলের হাড় গেল নড়ে।
    আমরা সেদিনই জেনেছিলাম-- ভগবান আছেন আর তাঁর ন্যায়ের রাজ্যে "দের হ্যায়, পর অন্ধের নহীঁ।"
    বড়দার স্নেহ আমরা সবাই অনুভব করতে পারতাম।
    গোড়ার দিকে মজা পুকুরের পানাভরা দুর্গন্ধ জলে কাপড় ও বাসন ধুতে এবং চান করতে করতে আমাদের বিচ্ছিরি খোস-পাঁচড়া হয়েছিল। তখ পেনিসিলিন ইনজেক্শন ও সালফার মলমের ব্যব্স্থা করবে কে? বড়দা।
    কিন্তু একদিন উনি আমার সহপাঠী সুব্রত সাঁইয়ের কোন কথায় চটে গিয়ে দুই চাঁটি লাগিয়ে বললেন-- আমি তোর ইর্কির যোগ্য? ইর্কির যোগ্য? আইজুক্যাল তুই? আইজুক্যাল তুই?
    একটু পরে সুব্রত বুঝলো-- আইজুক্যাল তুই= আই ইজ ইক্যুয়ল তুই???
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে মতামত দিন