এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আমার বৈদেশ গল্পগাছা

    Kulada Roy
    অন্যান্য | ০৬ এপ্রিল ২০১২ | ১১১৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kulada Roy | 67.243.132.73 | ০৬ এপ্রিল ২০১২ ১৯:০৩537273
  • পার্কের ভিতরে ছায়া : ফ্লাই উইদাউট উইংস
    কুলদা রায়

    পাতা বলল, এদিকে আয়। পাতা বলল বলেই এদিকে আসতে হল। রোদ একটু খাড়া হয়েছে। ছায়া ছোট হয়ে এসেছে।

    পরী বলল, এলি কেন?
    –পাতা বলল যে।
    –পাতা বললেই আসবি?
    –এলে কি হয়?
    –কষ্ট হয়।
    –কষ্ট কী রে?
    –জানি না।
    -তাইলে কি জানিস?
    –কিছুই জানি না। ছায়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল—কষ্ট নেবে গো কষ্ট।
    –কে লিখেছে?
    –হেলাল হাফিজ। কবি। বাড়ি নেত্রকোণা। বাংলাদেশ। থার্ডওয়ার্ল্ড। লাল কষ্ট। নীল কষ্ট। সাদা কষ্ট। হরেক রকম কষ্ট আছে।

    পরী বলল, ও কিছুই জানে না।
    –তাহলে কে জানে।
    –কেউ না।

    পরীর মুখ ভার হয়ে গেছে। একহাতে ম্যাপল পাতার মুকুট। আরেক হাতে পাখির লম্বা পালক। টান টান দাঁড়িয়ে যেতে গিয়ে পিঠটা সামান্য বেঁকে গেছে।

    এখন সকাল। গোল পার্কটির চারিদিকে স্ট্রিট আর এভিনিউ। সাই সাই করে গাড়ি চলে যায়। বড় বড় গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে গোল চক্কর। চারিদিকে হাতলওয়ালা কাঠের বেঞ্চি। ঠিক মাঝখানে একটি উঁচু বেদীতে ডানা মেলে পরী দাড়িয়ে আছে। কয়েকটি কবুতর ডাল থেকে উড়ে এসেছে। গোল চক্করে খুটে খুটে দানা খাচ্ছে।

    একটি লোক চুপ করে বসে আছে পশ্চিমের বেঞ্চিতে। বেঞ্চির হাতলে মাথাটা সামান্য হেলানো। তার কোনো ছায়া নেই। মুখ ভর্তি দাড়ি। সাদা। চশমা ছিল কিনা বোঝা মুশকিল।

    ল্যাংলি বহুক্ষণ ধরে কু কু করছিল। কয়েকটা কুকি চিবিয়েছে। খেয়েছে পানি। গভীর আগ্রহে জেনিফারের পা চেটেছে। জেনিফারের বাম হাটুর নিচে একটা কাটা দাগ। কৈশোরে পড়ে গিয়েছিল।অসে এক মজার কাহিনী। ল্যাংলি এটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চেটেছে। শিরশির করে ওঠে জেনিফারের। জেনিফার আহ্লাদে বলে, নো ল্যাংলি। নো মোর ডার্লিং। ইউ নটি বয়। হুউম। চুক চুক।

    ল্যাংলি থাবার মধ্যে মুখ রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। দেখে জেনিফার মাথা নাড়ল। হালকা করে হেসেও উঠল। ল্যাংলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, দুষ্টু বালক। কাটা দাগটি ছাড়া সাধ মেটে না।

    কাটা দাগটির উপরে একটি বড়োসড়ো লাল জড়ুল আছে। ওটা হট পয়েন্ট। মাঝে মাঝে টের পায় জড়ুল বলছে—আর না। আর না। দুটি মাত্র শব্দ। শুনে সামর্থ্য ঠোঁট দুটি বলছে—উহু। উহু। চুপ চুপ চুপ। আশ্লেষে জড়ুলটি কোনো এক চাঁদের আলোতে পুড়ে গেছে। সে এক গভীর আগ্রাসী চাঁদ। চাঁদের আহ্লাদে তাকে একবার পড়ে যেতে হয়েছিল। হাঁটুর উপরে সে চিহ্ন আছে। চিহ্‌ণ কিছু থেকে যায়। মোছে না। ল্যাংলি তুই কি এসব জানিস? জানিস ল্যাংলি?

    এ সময় জেনিফার দেখতে পেল, ওপাশে বুড়োটা এক দৃষ্টিতে জড়ুলটাকে জুল জুল করে দেখছে। আর হালকা হাওয়ায় তিরতির করে নড়ছে তার ফিনফিনে গোফটি। ফ্যাল ফ্যাল চোখ। জেনিফার বাম হাতটি দিয়ে উরুদেশের জড়ুলটি ঢেকে ফেলল। বুড়োটি তখনো একইভাবে চেয়ে আছে। জেনিফার হাঁটুর উপরে হাঁটু রাখল। বুড়োটি তবু একইভাবে চেয়েই আছে। নড়ন চড়ন নট। বিড়বিড় করে গালি দিল জেনিফার, স্টুপিড বুড়ো।

    পরী বলল, দেখেছিস?
    ছায়া একটু আনমনা হয়ে পড়েছিল। থমথম খেয়ে বলল, কী?
    –জেনিফার আধবুড়িটাকে।
    -হাঁটু মুড়ে বসে আছে। রাগে গজগজ করছে।
    –উহুরে গাধা। মোটেই রাগ নয়। মজাও পাচ্ছে। বুড়োটা ওর জড়ুলটাকে দেখছে। তবুও কেউ দেখছে। কে আর দেখে এই বুড়িকে!

    এ সময় একজোড়া ছেলেমেয়ে ঢুকল পার্কের ভিতরে। কাঁধে ব্যাগ। পরী বলল, চিনতে পারিস?

    –স্কুলের ছেলে মেয়ে।
    –স্কুলের পথে একটু লাভ করছে।
    –তাইলে তো মুশকিল। লেটমার্ক পাবে স্কুলে।
    –হু কেয়ারস। পাক না।

    গাছের পাতা সড় সড় করে। ফিসফিস করে বলে, আয় না। আয় না।

    একটা বেঞ্চিতে ছেলেটা ধপ করে বসেছে। আর মেয়েটা এদিক ওদিক তাকিয়ে ছেলেটার গলা ধরে ঝুলে পড়ল। ছেলেটা দুহাত দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। দুজনেই টগবগ করে ফুটছে। এভাবে কিছুক্ষণ কেটে গেলে ছেলেটা দেখতে পেল খুব বুড়ো একজন লোক ওদের তাকিয়ে দেখছে। ফ্যাল ফ্যাল চোখের দৃষ্টি। পুরু ভ্রু। সাদা। ছেলেটা মেয়েটাকে এক ঝাটকায় সরিয়ে দিল। মেয়েটা তখনো ঝুলে আছে। বেনী দুলিয়ে ছটফটিয়ে উঠছে—না। না। না। ছেলেটা ফিসফিস করে বলল, বুড়ো শয়তানটা লক্ষ করছে। পুলিশ কল করতে পারে। চল, পালাই।

    দুজনে যেভাবে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসেছিল, সেভাবে ছুটে পালাল পার্ক থেকে—স্কুলের দিকে। মেয়েটা একবার পিছন ফিরে তাকাল। ভেংচি কেটে বলল, ও বুড়ো–তুমি গুড়ো গুড়ো। ভ্যা।

    বুড়োটা তখনো চোখ মেলে তাকিয়ে রয়েছে একইভাবে। ছেলেমেয়ে দুটোর পিঠে স্কুল ব্যাগ– ঝকর ঝকর করে দুলছে।

    এ সময় লোপেজের মনে পড়ে ডিজাইনটায় যে ব্যালকনির কথা ভেবেছে সেখানে কী লতা দেবে—এই লতাটির নাম স্মরণে আসে নি কাল সারাদিন। ব্যালকনির গায়ে নানা কায়দায় ফুটিয়ে তুলতে চাইছে পাতার আকার আর একে বেঁকে যাওয়া লতাটির দেহ। কখনো হলুদ রঙের ফোটা দিচ্ছে। কখনো গাঢ় সবুজের উপরে হালকা কমলা দিতে দিতে সখ করছে দুটো বাজপাখির মূর্তি খেড়ে দিতে। বাজপাখির রঙ কী হবে? সাদা? –না, ধুসর? ধূসর—না, সাদা? খসখস করে পাতার উপরে, লতার উপরে ব্যালকনির উপরে সাদা অথবা ধুসর রঙ চাপাতে চাপাতে মাথা এদিক ওদিক নাড়ছে। আর বিড় বিড় করে বলছে—সাদা—না, ধুসর? ধুসর-না, সাদা? বলতে বলতে আড় চোখে দেখে নিচ্ছে বুড়োটা নির্বিকার চোখে তার রঙের আচড়টির দিকে চোখ পেতে রেখেছে। নড়ন চড়ন নট। বুড়োটাকে দেখতে দেখে আরও জোরে খসখস করে রঙ চাপায়। আর তাড়াতাড়ি বলে, সাদা—না, ধুসর। ধুসর—না, সাদা? বুড়োটার চোখের সামনে লোপেজের কপাল বেয়ে ঘাম বেরিয়ে এসেছে। আর মিডিয়াম স্ট্রলারে তার কয়েকটি সোয়েটার, জুসের ক্যান এবং পুরনো একটি রেডিও ঝুলছে। রেডিওর ভলিউম বাড়ানো। কদিন ধরে ভলিউমটি বাড়ানৈ আছে। বন্ধ করতে মনে নেই। শুধু মনের মধ্যে থাকে, সাদা—না, ধুসর? ধুসর—না, সাদা?

    পরী লোপেজকে পছন্দ করে। লোপেজের ঘনঘন মাথা নাড়া দেখে মনে হল—একটুকু আড়মোড়া ভাঙা যেতে পারে। একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখুক না অঙ্গ মহিমা। আঁকুক না তার তণুরেখাটি। বলুক না, কেউ এসে—ওহে পরী, তুমি সুন্দর।

    ছায়া বলে, ও পরী, তুমি কী করো?

    –কাঁদছি।
    –কাঁদছ কেন?
    –লোকটি ছবি আঁকছে—কিন্তু পেন্সিলে শিস নাই। রঙ নাই।
    –তাহলে কাগজে কী করছে?

    খস খস করে দাগ কাটছে। দাগ পড়ছে না। ভান করছে রঙ দেওয়ার। রঙ পড়ছে না। কোনো এক লতার জন্য প্রাণ উজাড় করে দিচ্ছে। কিন্তু লতাটিকে মনেই আনতে পারছে না। ওটা কী নলিমণি লতা, না, ব্লিডিং হার্ট?

    বলতে বলতে পরীটি হু হু করে কাঁদছে। কিন্তু জল পড়ছে না চোখ থেকে। মাথার উপরে পাতা সড় সড় করছে, আর না। আর না। ছায়া বলছে, কাঁদে না সোনা। কাঁদে না সোনা।

    পরীটির ডানার পিছনদিকটিতে গীটার বাজিয়ে জোসেফ ততক্ষণে গান ধরেছে

    ও আমার হাওয়া
    তোমার তরে এই কী আমার যাওয়া
    তবুও তুমি বলছো নাতো—পাওয়া

    সন্ধ্যে হলে আঁধার আসবে ঘিরে
    তখন তুমি দেখবে কী আর ফিরে
    তোমার তরে শেষ করেছি নাওয়া
    ও আমার হাওয়া

    পরের বেঞ্চিতে জারমিনা দুবার হাই তুলছে। হাতে আধখানা সিগারেট ধরা আছে। খেতে পারলে ভাল হত। কিন্তু লাইটার নেই। হারিয়ে ফেলেছে। হাই তুলতে তুলতে জারমিনা দেখতে পেল দূরে বুড়োটার পকেটে একটা লাইটার উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু বুড়োটার কোনো সিগারেট নেই। কী এক বিস্ময়ে তাই ওর ডান হাতের সিগারেটটি বুড়ো তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। জারমিনার চাপা কলির মত আঙুল। সিগারেটের তাপে দুআঙুলে সামান্য পোড়া দাগ পড়েছে।অএখন সিগারেটটির জন্য দাগটিতে চুরবুর করছে। লাইটারটি পেলে বেশ হত। বুড়োর পকেটের লাইটারটির দিকে গভীর আগ্রহ নিয়ে জারমিনা দুএকবার চোখ রেখে দেখতে দেখতে হাই তুলল। মনে মনে বলল, ও বুড়ো তোমার তোমার লাইটারটা দাওতো দেখি। কষে সুখ টান দেই। তুমিও না হয় দিবা দুয়েকটা টান।

    বুড়ো ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। আর জারমিনার সিগারেটটি অপলক দেখছে।

    বুড়োর তাকানো দেখে জারমিনা হেসে ফেলল। খিলখিল করে হাসল। আবার বুড়োকে অপাঙ্গে দেখে শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসল। দাঁড়িয়ে দুপাক ঘুরে নানা কায়দায় সর্বাঙ্গের দোলা লাগা দেখাল। এই দুলতে দুলতে আর হাসতে হাসতে তার দুআঙুলে ফাঁক থেকে আধপোড়া সিগারেটটি পড়ে গেল ঘাসের ভিতরে। নিচু হয়ে চাপা কলির মত আঙুল দিয়ে ঘাসের ভিতর সিগারেটটি খুঁজতে থাকে। দেখে বুড়োটা তখনো তাকিয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বুঝতে পারছে জারমিনার দুআঙুলের ফাঁকে সিগারটেটি নেই। ঘাসের মধ্যে পড়ে গেছে। হারিয়ে গেছে। খুঁজে পাচ্ছে না। তবু চেয়ে আছে। জারমিনার মুখ থমথমে হয়ে গেছে। ঘাসের মধ্যে আঙূল ডুবিয়ে সিগারেটটি খুঁজতে খুঁজতে জারমিনার মনে হল—বুড়ো লোকটি তার আঙুলের পোড়া দাগটিও দেখতে পাচ্ছে। জারমিনার নরম স্তন হাওয়ায় হালকা দুলছে। রাগে গজ গজ করতে করতে বলছে, হতচ্ছাড়া বুড়ো। তুই মর। তুই মরগে যা। এত দেখার কী আছে রে?

    জারমিনার পিছনটার মিনি স্কাটটা একটু সরে গেছে।

    শেষ পর্ব :

    ঠিক তখনি জোসেফকে আরেকটু চড়া গলায় সুর ধরতে হল। আঙুলের ডগা দিয়ে টিং টিং গীটারের তারে আঘাত করলেও শব্দ হচ্ছে না। তাই আরও জোরে গাইতে হচ্ছে। গাইতে গিয়ে তার মনে হল—বাম মাড়ির উপরে দাঁতটিতে ব্যাথা আবার ফিরে আসছে। ব্যাথাটি বাড়ছে। এই ব্যাথার কারণে তার মুখের ভিতরটি নড়ছে না। সুললিত সুরের বদলে গড় গড় শব্দ বেরুচ্ছে। ডেনটিস্টের কাছে যাওয়া দরকার। কিন্তু হেলথ ইনস্যুরেন্সটা আপডেট করা হয় নাই। ডেনটিস্টের কাছে যাওয়ার কথা ভাবতে গেলে তার মুখের ভিতরে পেশীগুলো একেবারে নড়ন চড়ন নট হয়ে যাচ্ছে। গড় গড় শব্দও নয়—ফ্যাস ফ্যাস করে কিছু হাওয়া বের হচ্ছে। এই হাওয়া দেখে জুবুথুবু বুড়োটি তাকিয়ে রয়েছে। মুখপানে চেয়ে আছে। ল্যাংলি ঘুমের মধ্যে বারকয়েক খ্যাক খ্যাক করে ওঠে। জেনিফার মাথায় আলতো করে হাত রাখে। টের পায় উরুর উপর লাল জরুলটা তখনো বুড়ো চোখের নজরে আছে। একটু ঘুরে আসতে গিয়ে সোজা হয়ে বসে। বিড়বিড় করে বলে, বলতো ল্যাংলি, কী বিপদ। বুড়ো মানুষের ভীমরতি ঠেকাই কী করে।

    শুনে ল্যাংলি ঘুমের মধ্যে খ্যাক খ্যাক করে ওঠে। একবার মাথা তুলে লাল জড়ুলটা চেটে দিয়ে আবার গভীর ঘুমের মধ্যে তলিয়ে গেল।

    এ সময় আকাশের সূর্যটা আরেকটু পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। ছেলেটি এবং মেয়েটি আবার ফিরে এসেছে। দৌঁড়ে দৌঁড়ে এসে মেয়েটি ধপ করে একটি বেঞ্চিতে বসে পড়েছে। আর ছেলেটির তর সইছে না। ঝাঁপিয়ে পড়ে মেয়েটির গলা ধরে ঝুলে পড়ল। মেয়েটি পড়তে পড়তে সামনে নিল এবং কী দেখে সুড় সুড় করে উঠে পড়ল। ছেলেটি বলে, উহু, উহু। মেয়েটি ছেলেটির হাত ধরে গোল পার্ক থেকে সোজা বাইরে চলে গেল। এভিনিউতে। হুস হুস করে সেখানে গাড়ি চলে। ছেলেটি বলল, কেনো, কেনো?

    –ঐ দ্যাখ।
    –কী?
    –পুলিশ। বুড়োটা ফোন করে দিয়েছে মনে হয়। পালা। পার্কের মধ্যে ততক্ষণে একটি সাদা গাড়ি ঢুকেছে। গায়ে নীল রং দিয়ে লেখা –পুলিশ। রাস্তা থেকে সরু নাতিদীর্ঘ পথ দিয়ে ধীরে ধীরে গাড়িটি ঢুকছে। নি:শব্দে। গোল চত্বরে আসার একটু আগেই থমকে গেল। নো নড়ন চড়ন। গাড়িটার উপর কয়েকটা ম্যাপল পাতা ঝরে পড়ছে। আর শব্দ হচ্ছে—টুপ টাপ। টুপ টাপ।

    পরীটা বলল, দেখেছিস?
    –কি গো?
    –গাড়িটার চাকা নেই।
    –হু, এভাবে এলো কিভাবে?
    –ওরা আসে। পুলিশের গাড়ি চাকা ছাড়াই চলতে পারে।

    লোপেজ কাগজের উপরে আরেকটু ঝুঁকে পড়ে এবার কমলা রংয়ের একটি পাতা আঁকার চেষ্টা করছে। রেডিওটার ভলিউম আরেকটু বাড়িয়ে দিয়েছে। কী একটা সুর মনে করে তালে তালে পাতাটিকে আঁকতে আঁকতে বলছে—ও লতা, তুই সাদা—না, ধুসর? ধুসর—না, সাদা?

    জারমিনা ঘাসের মধ্যে আধ খাওয়া সিগারেটটি তখনো খুঁজে পায় নি। একদম উবু হয়ে পার্কের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে শিরশিরে ঘাসের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে সিগারেটটি খুঁজে চলেছে। হাঁটুতে ঘাসের সবুজ মাখামাখি। পা থেকে খুলে গেছে কেডস। স্ক্যার্টটা ঢলঢলো করছে। দু স্তনের মধ্যে গলা থেকে ঝুলছে ক্রুশবিদ্ধ যীশু। আর গুণ গুণ করছে, সিগারেটটা পেতে হবে। পেতে হবে বুড়ো লাইটার।

    পরীটা কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। ভয়ে ভয়ে ফিসফিস করে, এইবার গাড়িটার দরোজাটা খুলে যাচ্ছে। সত্যি সত্যি দরোজাটা শব্দহীনভাবে খুলে গেল। এইবার ভিতর থেকে পুলিশ নামবে। সত্যি সত্যি গাড়ির ভিতর থেকে কয়েকজন পুলিশ নেমে পড়েছে। এইবার পুলিশগুলো পজিশন নেবে। পুলিশগুলো গোল পার্কের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পজিশন নিয়ছে। পুরো যুদ্ধদৃশ্য। অপর পক্ষ নেই। শুধু পুলিশপক্ষ। পুরো গোলপার্ক যথাপূর্বং। নো চেঞ্জ। সুতরাং সবাই ঘুরে ঘুরে দেখছে সবকিছু। খুব খেয়াল করে। চোখে সার্চ লাইট বসানো। মাথার উপরে গাছের ডালে কয়েকটা কবুতর ঘুমরু ঘুমরু করছিল। সেদিকে দুএকটি পুলিশ গম্ভীরভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখল। আর রেডিওতে বিড়বিড় করে কয়েকটি মেসেজ পাঠাল।

    জোসেফ কোলের উপরে গীটারটা রেখে তারস্বরে তার মত করে গান গাইছে—

    ও আমার হাওয়া
    তোমার তরে এই কী আমার যাওয়া

    গলার শিরা ফুলে উঠেছে। কিন্তু ফিসফিসানিও নাই। গীটারের ছেঁড়া তার পতপত করে দুলছে। কানা পুলিশটি জোসেফের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে ভাল করে দেখল। তদগত জোসেফের সেদিকে ফিরে তাকানোর সময় নাই। পুলিশটি জোসেফের চোখের সামনে কয়েকবার হাত নাড়ল। গলায় ঝোলানো কার্ডটি দেখল ঝুঁকে পড়ে। রেডিওতে বলে গেল—আলবার্ট জোসেফ, বয়স ৩৭। পেশা—গায়ক। এস এস ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ।

    জেনিফার একহাতে লাল জড়ুলটি ঢেকে রেখেছে। আরেক হাত ল্যাংলির মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে। বলছে, ল্যাংলি, ডার্লিং, ওকে বল না, এভাবে মেয়েদের দিকে চোখ রাখতে নেই। ল্যাংলি দুথাবার মধ্যে নাক ডাকছে—ঘড় ঘড়। কানা পুলিশটি জেনিফারের চারিদিকে ঘুরে ফিরে বার কয়েক এক্সকিউজ মি এক্সকিউজ বলল। তারপর গলায় ঝোলানো কার্ড পড়ে বলল, লিনডা জেনিফার। বয়স ৫৫। পেশা—এয়াক্ট্রেস। এসএস—ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ।

    ল্যাংলির গলায় কার্ড থেকে বলল, ল্যাংলি জেনিফার। বয়স ৪.৫। পেশা–সঙ্গ প্রদান। এসএস—ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ।

    লোপেজের কিছুটা জল পিপাসা পেয়েছে। ঠোঁট শুকিয়ে এসেছে। স্ট্রলারে কয়েকটি বোতল আছে। কোনটিতে আপেল জল। দুই এক বছর আগেকার একটি ক্রান্সবেরী জুসের অর্ধেকটা এখনো রয়ে গেছে। গ্রেপ জুসের বোতলটা এখনো খোলাই হয় নি। পাইনাপেল জুসের ক্যানে সামান্য তলানি আছে। আর আছে খানিকটা ইন্ডিয়ান গ্রোসারী থেকে আনা ম্যাঙ্গো পান্স। স্প্রিং ওয়াটারের বোতলটি এর মধ্যে কোথাও হয়তো আছে। হয়তো উইন্টার জ্যাকেটের পকেটে থাকতে পারে। লোপেজের মাথায় পাতার আকারটা আসছে না। কিন্তু শিরাগুলি নানা ভঙ্গিতে আসছে। পানি তেষ্টা পেয়েছে বলে গলাটা ঘ্যাসঘ্যাসে হয়ে রয়েছে। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলছে—পানি—না, সাদা। সাদা—না, পানি। খসখস করে কাগজের উপর পাতার শিরাগুলি আঁকছে। আর বিড়বিড় করে বলছে—ধুসর—না, পানি। পানি—না, ধুসর। ধেড়ে পুলিশটার ইঙ্গিতে নীল পুলিশটা লোপেজের আইডি কায়দা করে দেখে নিল। বলল, লোপেজ ব্রাউন। বয়স ৫৪। পেশা বাস্তুবিদ। এসএস ডট ডট ডট।

    জারমিনার মনে পড়ে আজ তার মেডিকেইড অফিসে যাওয়ার কথা ছিল। কেসওয়ার্কার মিস বেনসন মেজাজী মহিলা। বারবার বলেছে, ডোন্ট বি ক্রেজী। টাইমলি চলে এসো। নাহলে তোমার ফুড স্টাম্প বাতিল। বোঝৈ তো ফিনানসিয়াল কন্ডিশান খুবই খারাপ। কোন ত্রুটি পেলেই তোমার ফুড স্টাম্প, ফ্রি শেল্টার,ফ্রি ট্রিটমেন্ট, ফ্রি ট্রান্সপোর্ট বাতিল হবে। মেডিকেইড বাতিল হলে রিনিউ করা কঠিন। জারমিনা বলেছিল, বাতিল হলে খাব কি?

    –চাকরী করবে।
    –চাকরী কোথায়?
    –গড নোজ।
    –গড কোথায়?
    –নোবডি নোজ। এই সময় জারমিনার গা-টা থরথর করে কেপে ওঠে। পায়ের শক্তি কমে আসে। আর বুকের মধ্যে ধুকপুক করে। কেস ওয়ার্কারের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বলে, নোবডি নোজ কি একটা সিগারেট দেবে?

    –নোবডি অলসো নোজ। বলে কেস ওয়ার্কার জারমিনার দিকে তাকায়। জারমিনার দুআঙুলের পোড়া দাগ চোখে পড়ে। কানদুটো কাঁপতে দেখা যাচ্ছে। বেনসন ব্যাগ থেকে আধপোড়া একটি সিগারেট ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ওকে ডার্লিং। অবশ্যই তুমি আগামীকালের মর্নিং এপয়েন্টেমেন্ট মিস করবা না। বাই।

    জারমিনা বাই বলতে গিয়ে আধপোড়া সিগারেটিট খুঁজে পাওয়ার আশা করছে। ঘাসের মধ্যে পা টেনে টেনে হাঁটুতে ভর দিয়ে এগিয়ে চলছে। পিঁপড়ের মত খোঁজে সিগারেটটি। গলা থেকে আইডিটা বাতাসে ঝুলছে। খাটো পুলিশটি বলে উঠল, জারমিনা জনসন।অবয়স ৩৩।. পেশা ফার্মাসিস্ট।. এসএস ড্যাশ ড্যাশ ড্যাশ।

    বুড়োটার সামনে এসে ঝামেলা হয়ে গেল। বুড়োর মাথায় বাদামী হ্যাট। সামনের দিকে একটি ছোট্ট লাল গোলাপ। উলুক ঝুলুক ভুরু। লম্বা জ্যাকেটের পকেটের ভিতর থেকে উঁকি দিচ্ছে একটি মাত্র ম্যাচ লাইটার। পায়ে মিলিটারি বুট। নীল পুলিশটি সামনে পিছনে চারিদিকে ঘুর ফিরে দেখে শুনে কোনো আইডি দেখতে পেল না। ধেড়ে পুলিশটি গাম চিবুতে চিবুতে বলল, কী রে নীল। বল—

    নীল পুলিশ আইডিটা আবার খুঁজতে লেগেছে। কখনো দূর থেকে। কখনো একটু কাছে এসে। ধেড়ে পুলিশটি বলল, কীরে হারামজাদা, বলছিস না কেন? –গুরু, পাচ্ছি না তো।

    –ভাল করে খুঁজে দ্যাখ। আইডি ছাড়া মানুষ। হাওয়া ছাড়া ফানুষ। ইমপসিবল।
    –থাকলে তো দেখব। নীল পুলিশ বুড়োটার সামনে এসে ঝুঁকে দাড়াল। খুব মোলায়েমভাবে প্রশ্ন করল, এক্সকিউজ মি স্যার।

    ধেড়ে পুলিশটি তারিফ করে, পারফেক্ট প্রফেশনাল ম্যানার। নীল পুলিশটি একটু হেসে বুড়োটার দিতে তাকায়। একটু জোরে গলা খাকড়ি দিয়ে বলে, এক্সকিউজ মি স্যার। হ্যাল্লো স্যার।

    ধেড়ে পুলিশ জিজ্ঞেস করে, কিছু বলছে?
    –না গুরু।
    –হুউম। আবার জিগা।

    নীল পুলিশ আরেকটু জোরে বলে উঠল, এক্সকিউজ মি স্যার। তারপর ধেড়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কিছুতো বলে না গুরু। ঘটনা কি? মইরা গেছে নাকি? –বাঁইচা আছে—না, মইরা গেছে—অইটা আমগো বিষয় না। মেডিকেলের বিষয়। আমগো দরকার আইডি। হেইডা দ্যাখ।
    –নাই। পকেট হাতড়ে দেখব?
    –নো। নেভার। ইটস সিম্পলি প্রফেসনালি ইমপারফেক্ট প্রসেস। গাঁধা। মরতে চাও। পারমিশন ছাড়া বিরক্ত করা যাবে না। কেস করে দিতে পারে। স্ক্যান কর।

    স্ক্যানারটা সেট করা হল। বুড়োটার চারিদিকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে স্ক্যান করা হচ্ছে। মনিটর দেখে নীল পুলিশটি বলল, গুরু। নেই।

    –কিছু নাই? কোনো ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্ট. ড্রাইভিং লাইসেন্স, ওয়ার্ক পারমিট, ইন্সুরেন্স? কোনো লাইলেন্স?
    –না। বুক পকেটে দেখা যাচ্ছে একটা কাগজ। -
    -গুড। জুম কর।

    জুম করে দেখা গেল কাগজটি সাদা। তবে বহু পুরনো বলে বাদামী বর্ণ ধারণ করেছে। আরও জুম করে কয়েকটি অক্ষর পাওয়া গেল। আঁকা বাঁকা লেখা। –কি লেখা কাগজে?

    –ফ্লাই উইদাউট উইংস। শালা কবি না দার্শনিক। কোনো নাম? এড্রেস? ফোন নম্বর?
    –না গুরু। কাগজে লেখা –ফ্লাই উইদাউট উইংস। হুউম। ডেন্টি ওরি। ওটা অন্য কেস। সাইকিক।

    ধেড়ে পুলিশ ল্যাপটপ খুলে বসেছে। ব্রাউজ করল—ফ্লাই উইদাউট ফ্লাইং। পাওয়া গেল আরও কয়েকটি লাইন—ওয়াক উইদাউট ফিট। থিংক উইদাউট মাইন্ড। লিভ উইদাউট বডি। নিচে লেখা ভগবান রজনীশ। ফার্স্ট নেম ভগবান। লাস্ট নেম রজনীশ। কাম ফ্রম ইন্ডিয়া। মিরাকল।

    –চেহারা তো ইন্ডিয়ান মনে হয় না।

    –হুউম। তাইলে কী মনে হয়? আফগান?

    –কালো– আবার কালো না। ধলো– আবার ধলো না।

    জোসেফ আরও জোরে গান ধরেছে- সন্ধ্যে হলে আঁধার আসবে ঘিরে তখন তুমি দেখবে কী আর ফিরে তোমার তরে শেষ করেছি নাওয়া ও আমার হাওয়া

    গীটারটি বাজছে না। কিন্তু আঙুল বেয়ে রক্ত ঝরছে। সেদিকে তাকিয়ে ধেড়ে পুলিশটা কিছুটা ভুরু কোঁচকালো। কিছু বলার পারমিশান নাই। বলল, বুড়োটার নিম্নাঙ্গে কিছু আছে?

    –নিম্নাঙ্গে একজোড়া অতি পুরনো জুতা। থার্মাল—তার উপর দাগওঠা জিন্স।
    –তারপর?
    –প্রাইভেট পার্টস।
    –ওখানে কী আছে?
    –ওটা দেখা কী ঠিক হবে গুরু? বুড়ো মানুষ। তারপর প্রাইভেট পার্টস। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লংঘন হতে পারে।
    –হু কেয়ারস।
    –ওকে গুরু। আপনের দায়। আমার কী।

    দেখা গেল বুড়ো মানুষটির নিম্নাঙ্গ কয়েকটি ম্যাপল পাতা দিয়ে শক্ত করে বাঁধা।
    –অঙ্গ নাই?
    –নো গুরু। অঙ্গ নাই। শুধু ম্যাপল পাতা।
    –তাইলে?
    –মে বি বেশি ত্যাগে নয়– ভোগে কম্ম শ্যাষ। ভোগের শ্যাষ দেখিয়া ছাড়। তখন ভোগ তোমাকে ছাড়িয়া যাইবে। ত্যাগ আসিয়া পড়িবে। অঙ্গহীন ভালবাসা। ফাক উইদাউট পিনেস। ওসো রজনীশ। যুগ যুগ জিও। মার্কিন দ্যাশে আসিও।

    হা হা হা হাসে নীল পুলিশ। খুব মজা পেয়েছে। ধেড়ে পুলিশটার ফোনটা বেজে ওঠে। লরেনার কল। লরেনা কইছি। ডার্লিং, আইজ তুমি আইস না। সিক ফিল করতাছি।

    ধেড়ে পুলিশের মেজাজটা ডকে উঠে গেল। বলল, সে কি লরেনা মেরেজান। এইরহম তো কথা আছিল না। তুমি সিক হৈলে যামু কই।

    –সেইটা আমি কী জানি। তুই কই যাইবা হেইটা তুমি ঠিক করো। আমি আইজ নাই। বাই।
    –তাইলে তুমি কী অই অসুরটার লগে যাইতাছ?
    –এটা তোমার বিষয় না পরভু। পারসোনাল বিষয়ে নাক গলাবা না। আমি আইজ তোমার লগে কমফোর্ট ফিল করতাছি না। কথা শ্যাষ। বাই।

    ধেড়ে পুলিশটার মাথা গরম হয়ে গেল।অফোনটার দিকে তাকিয়ে বলল, ফাকিং বিচ।
    নীল পুলিশটা বলল, এখন কী হবে?
    –বাল হবে।
    –গুরু। তুমি কিন্তু আমারে এবাউজ করতাছ।

    ধেড়ে পুরিশ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, সরি সরি। খুব সরি নীল। মাইন্ড খাইও না। মেজাজ খারাপ। সিক সিক লাগতেছে। আমি মাল কিনে বসে আছি—আর লরেনা চলেছে—আরেক ব্যাডার লগে। মাথা ঠিক থাকে?

    নীল বিষয়টা বোঝে। মাথা নাড়ে। তার ক্ষেত্রেও মাঝে মাঝে একই রকম ঘটনা ঘটে। জীবন শ্যাষ। বলল, গুরু, আইডিটা তো পাইলাম না। এখন কী হবে? কেসটা মনে হয় কেঁচে গেল।

    –হতে পারে। আবার নাও হতে পারে। বিজ্ঞের মত করে জবাব দিল ধেড়ে। ল্যাপটপের দিকে তাকাল। খটখট করে লিখল—১৭৫ স্ট্রিট। হিলসাইড এভিনিউ।অকুইনস। জিপকোড ১১৪৩২। মনিটরে পরী পার্কটি ফুটে উঠল। উঁচু বেদীর উপর পরীটি দুহাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। বামহাতে ম্যাপল পাতার মুকুট। ডানহাতে পাখির পালক। ডানা খাড়া। পরণে গাউন। উড়ে যাবে। পুড়ে যাওয়া বর্ণ পরীটির।

    পরীটিকে ঘিরে গোলাকার পাকা চত্বর। বারোটি কাঠের বেঞ্চ। কাঠের পিঠ ঠেকনা। ল্যাংলি থাবার উপরে ঘুমিয়ে আছে। তার মাথার উপরে ঝুঁকে আছে জেনিফার। জোসেফ গীটার বাজিয়ে গান গাইছে। লোপেজ কাগজের উপর খসখস করে একটা পাতার ডিজাইন আঁকছে। জারমিন—ঘাসের ভিতর হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে। আর একজন বুড়ো লোক বেঞ্চির পিঠ ঠেকনায় মাথা হেলিয়ে বসে আছে।

    ৪১টি গাছ। ১৯৪৭ সালে রোপিত। পাতা এখন বহবর্ণিল। বাতাসে সড় সড় করে পাতা কাঁপে। কিছু হাওয়ায় ঝরে পড়ে। পার্কে ৬৫টি কবুতর আছে। কিছু ডাল বসে আছে। আট দশটি পরীর মাথায়, কাঁধে এবং উন্নত স্তনে পা রেখে দুটি কবুতর হা করে চেয়ে আছে ঠোঁটের দিকে। আর একঝাঁক গোল চত্তরে হেঁটে হেঁটে দানা খাচ্ছে। মনিটরে এসব তথ্য ভেসে আসছে। পার্কের চারিদিক দিয়ে রাস্তা আর এভিনিউ দিয়ে হুস হুস করে গাড়ি চলে যায়। আকাশে মাঝে মাঝে দেখা যায় প্লেন। নি:শব্দে চলে। পুলিশের তিনটে গাড়ি থমকে আছে। চারিদিকে চক্রাকারে পজিশন নিয়ছেঁ পুলিশ। নীল পুলিশটি গাম চিবুচ্ছে। আর ধেড়ে পুলিশটি ভার্চুয়াল আর্কাইভে ঢোকে। দেখা যায়—পার্কটিতে গতকালও এ ছবিটি আছে। পাল্টে নাই। মাসখানেক আগেও তাই। বছর খানেক আগেও নো চেঞ্জ। একটু অবাক হয়ে ধেড়ে পুলিশটি বলে ওঠে, ঘটনা কী?
    –কি গুরু?
    –ছবিগুলো একই রকম। সেই পার্কে একই লোকগুলো একই কায়দায় বসে আছে। কোনো আপডেট নাই।
    –ভাল করে দেখেন। আপডেট তো থাকার কথা।
    –হুম। আপডেট আছে। প্রতিটি ছবির নিচে তারিখ বসানো আছে। লোকগুলো একই—কোনো পাল্টপাল্টি নাই। তবে দৃশ্যের মধ্যে কখনো তুষার পড়ছে। বৃষ্টি পড়ছে। অথবা নতুন পাতা গজাচ্ছে।

    –তাইলে?

    –গ্যাড়াকল।
    –মহাগ্যাড়াকল। হেডকোয়ার্টারে মেসেজ দ্যান।
    –খাড়া। আরেকটা ব্যাকআপ আছে। হেইডা দেখি।

    পাসওয়ার্ড দিয়ে ব্যাকগুলো খুলে দেখা গেল—পার্কটি আছে। ঠিক একই রকম। ধেড়ে পুলিশটি পরীটিকে জুম করে নিয়ে এল। পরীটি বেদীর উপরে দাঁড়িয়ে আছে। ১৮৬১-১৮৬৫।. সে সময়ে বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ টেগোর নামে এক সন্ত কবি জন্মাচ্ছে। মায়ের পেট থেকে বেরিয়ে সুর করে গান করছে—আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণ তলে। পরীর পায়ে তামাটে গাউন বাঁক খেয়ে লটপট করছে। শূন্যে দুহাত তোলা। হাতে ম্যাপল পাতার মালা। উন্নত স্তন। নাভিচিহ্‌ণ স্পষ্ট। হাঁটুর নিচে গাউনটি ঢেউ খেলেছে। ও ঢেউ খেলো না। আঁখি দুটি ম্যালো না। আঁখি দুটি তুললে যদি– হৃদভাব গেল না।অ।

    ব্যাকআপ ফাইলের আরও পিছনে যেতে যেতে দেখা গেল—পরীটার ডানা নেই। তারপর আরও পিছনে গেল পরীটিও নেই। শুধু একটি বেদী নির্মিত হয়ে আছে। পিছিয়ে যেতে যেতে দেখা যায়—একটি মেয়ে স্ট্রিটে এবং এভিনিউতে ঘুরছে। এলোমেলো ছুটছে। চেঁচিয়ে বলছে—মিস্টার ফ্রাই। মিস্টার ফ্রাই। ঘামে জবজব মেয়েটি। হাতে ম্যাপল পাতার মুকুট।

    তারও আগে দেখা যায়—জাহাজ থেকে নামছে একপি তরুণী। আলু থালু চুল। দুজন লালমুখো দুটো ডানা ধরে আছে। বলছে, চল। নকশা করিস না। দেখা যায় দূর কোনো ঘাট থেকে জাহাজ ছাড়ছে। আর এখানে ওখানে হাহাকার করছে কিছু মানুষ। ওদের চামড়া ছুলে গেছে। তাদের ঘিরে আছে তীক্‌ষ্‌ঞধার সঙ্গীন। সামনে পিছনে আরও কয়েকটি জাহাজে ভো ভো শব্দে ছুটে চলেছে। মাস্তুলের কাছে একজন দীর্ঘকায় যুবক চেঁচিয়ে উঠছে, পরী। আমার পরী। সমুদ্রে ঢেউ ওঠে ফুলে ফুলে। জলে ফেনা জেগে ওঠে। ঠা ঠা করে শব্দ বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ছে। যুবকটি বলে,ও পরী। ও পরী।অতুমি কোথায়?

    –আমি নাই।
    –তাহলে কী হবে?
    –ছায়া পাবে। ছায়া নিয়ে থাকো।

    নীল বলে, পাওয়া গেল কিছু? ধেড়ে পুলিশটি নির্ণিমেষে মনিটরের দিকে চেয়ে আছে। কিছু বলে না। এ সময় ঘণ্টি বাজিয়ে এম্বুলেন্স এলো। স্ট্রেচার হাতে ছুটে দুজন ভ্রাম্যমান মেডিকেল পুলিশ—ছুটে গেল গেল বুড়োটার কাছে। চারিদিকে চারজন মেডিকেল পুলিশ দাঁড়িয়ে বুড়োটাকে নজর করে দেখে। বুড়ো দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে যায়। মুখের দিকে তাকিয়ে সহসা কেঁপে ওঠে। পিছু হটে আসে। বলে, দাড়ি।

    –কী?
    –বুড়ো মুখে লং বেয়ার্ড। লম্বা দাড়ি।
    –তাতে কী?
    –উহু। কী নয় কাকু! টেররিস্ট। সন্দেহজনক। আত্মঘাতি বোমাবাজ।

    চারিদিকে এলার্ম বাজতে থাকে। পথে পথে স্পেশাল ব্রাঞ্চের গাড়ি। আকাশে হেলিকপ্টারের শব্দ। সার্চ লাইট ফেলছে। জেনিফার, ল্যাংলি, লোপেজ, জোসেফ, জারমিনা এসব কিছুঅই জানে না। বুড়োটি পিঠ ঠেকনায় মাথা হেলিয়ে সেই একইভাবে বসে আছে। হালকা হাওয়ায় তার লম্বা দাঁড়ি ওড়ে। নাকে মুখে কানে লাগে। টুপির উপরে গোলাপটি। ছুটে আসে দুটো মাছি—নাকের ডগায় বসে। ঠোঁটের উপরে বসে। তাইরে নাইরে করে ঠোঁটের ভিতর সুড়ুক করে ঢুকে যায়। আর একঝাঁক কবুতর পরীর কাঁধ থেকে উড়ে আসে। বুড়ো লোকটির মাথায়, কাঁধে, হাঁটুর উপর বসে। বক বকুম বক বকুম করে ডাকে। সন্ধ্যা নেমে আসে। পরীটার ভয় করে। ছায়াটি হারিয়ে যায়। ভয়ংকর একা লাগে। পরীটা ফোঁপাতে থাকে।

    বেদীর উপরে পরীটি নড়ে চড়ে ওঠে। থরথর করে কাঁপছে। ডানায় পতপত শব্দ হয়। ডানাদুটি শব্দ করে গলে ঝরেপড়ে। ডানাহীন পরী দুইহাত উপরে বাড়িয়ে দেয়। বেদীর একটু উপরে উঠে আসে পাদুটি। আর ঢেউতোলা গাউনটি ঝুলে পড়ে। বেদী ছেড়ে চলে যায় যায় পরীটি দূরে। আকাশে। পাতা বলে, ও পরী, কই যাও?

    –জানি না।

    –কে জানে?

    –জানি না।

    পাতা ঝরে পড়ে। ধেড়ে পুলিশটির ফোন বাজে। ধেড়ে খুব বিজি মনিটরে। অনেকক্ষণ পরে কে এক ফিওনা মেসেজ রাখে, ডার্লিং। মধ্যরাতে আসতে পার। তার আগে নয়। বাই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন