এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Monorama Biswas | 71.167.46.249 | ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ ০৮:১১511095
  • আমার কথা। আমার কথা মুক্তিযুদ্ধ থেকেই শুরু করি। আমি তখন খুব ছোট। কত ছোট তা আমার মনে নেই বা বলতে পারব না। এইটুকু বলতে পারি, আমার মধ্যে তখন সুখ-দু:খের অনুভূতি জন্ম নেয়নি। একটা ঘটনা থেকে সেটা বুঝতে পারি। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরকে ভিটা ছাড়া করা হয়। আমরাও ভারতে আশ্রয় নিই। এখন বুঝি ঐ সময় সাজানো সংসার, ঘর-বাড়ি ছেড়ে আমার বাপ-ঠাকুরদার যে কত কষ্ট হয়েছিল। মহিলা আর শিশুরা না জানি কী নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছে। সে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কতজন যে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে!

    আমাদের পাশের গ্রামে যখন মিলিটারি আসে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তখন আমার কাকা আমাদের সবাইকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে আমরা গড়াই নদীর ও-পাড়ে রাখসাকান্দি নামক গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। বাবা আর দাদা হাটে গিয়েছিল। সেদিন কী বার, কোন মাস কিছুই জানি না, তবে দিনটা ছিল হাটবার। আমরা সেদিন গড়াই নদীতে স্নান করতে যাই। আমি বাচ্চাদের সঙ্গে স্নান করতে ব্যস্ত নদীতে। হঠাৎ দেখি নদীর পাড়েই একটু উপরে আমার মা আর দিদি কান্নাকাটি করছে। আমার বাবা আর ঠাকুরদা তখনও এসে পৌঁছায়নি। আমাদের পাশের গ্রামের শৈলেন ডাক্তারকে রাজাকারেরা গলা কেটে মেরে ফেলেছে। মুণ্ডুটা কেটে তার বউয়ের কোলে দিয়েছে। সে মহিলা আমার মায়ের তরফ থেকে আত্মীয়। আমার মায়েরও একই রকম আতঙ্ক শুরু হয়েছে। রাজাকারেরা আমার বাবাকেও হয়তো সেভাবে মেরে ফেলতে পারে। মায়ের কান্নাকাটি দেখে আমার বড়বোনও কাঁদছে। আমি ভিজা কাপড় পরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কান্না আসছে না, কারণ আমার মধ্যে তখনও এই কষ্টের অনুভূতি জন্ম নেয়নি। আমার খুব অল্প মনে আছে এই স্মৃতিটা। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক বছর ধরে শৈলেন ডাক্তারকে কীভাবে মারল সে গল্প শুনতাম। সেই থেকেই এইটুকু লিখতে পারছি।

    শরণার্থী হয়ে ইন্ডিয়া যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটা ঘটনা এখনও মনকে নাড়া দেয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটা উল্লেখ করছি, আমাদের গ্রামবাসীরা একটা দলে চলছিল। এভাবে বেশ কয়েকটা দল পরস্পর খবর আদান-প্রদানের মাধ্যমে চলছিল। রাত হলে অনেকগুলো দল একসঙ্গে খোলা আকাশের নীচে ঘুমাত। কখনো-কখনো কোনো স্কুল ঘরেও ঘুমাত। কখনো-কখনো এসব দল দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হত। রাতের অন্ধকারে এদের কাছ থেকে শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিত। এমনই এক আক্রমণে এক কিশোর ছেলে মারা যায়। মৃত ছেলেটির মামা-বাড়ি ছিল আমাদের গ্রামে। ওদের গ্রামটা আমদের গ্রাম থেকে বেশি দূরে নয়। গ্রামের নাম ক। ওদের দল রাতে একটা স্কুলে আশ্রয় নেয়। কিছু দুর্বৃত্ত দ্বারা ওরা আক্রান্ত হয়। সে ছেলেটি ঘরের বাইরে ছিল। দৌঁড়ে সে যখন ঘরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই সময় ভেতর থেকে অনেক লোক দরজা চেপে ধরে। ছেলেটির একটা হাত তখনও বাইরে, হাতটা ভেতরে ঢোকাতে পারল না, প্রচণ্ড চাপে হাতটা কেটে পড়ে যায়। ছেলেটি অনেক চিৎকার করেছিল, কার কথা কে শোনে। এদিকে গোলাগুলি চলছে, একটা গুলি ছেলেটির নাকের নীচে এবং উপরের ঠোঁটের উপর দিয়ে চলে যায়। গুলিতে সে মারা যায়নি, মারা যায় প্রচুর রক্তক্ষরণে। আমি ছেলেটির মৃতদেহ দেখেছি। তার মা আমাদের গ্রামের মুরsব্বিদের জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। এখনও সে কান্না আমার কানে ভাসে। ছেলেটির নাম ছিল বিবেক।

    বাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে আমরা যশোর হয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছি। একদিন পথের পাশে একটা সদ্যোজাত শিশু পড়ে থাকতে দেখি। আমরা ছোটরা ঐ বাচ্চার দিকে এগিয়ে যাই, বড়রা ধমক দিয়ে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যায়। এক মহিলা ঐ বাচ্চা কোলে তুলে নেয়। কিছুদুর যাওয়ার পর একদিন বা দু’দিন পর ঐ বাচ্চাটি মারা যায়। ঐ মহিলা মৃত বাচ্চা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। না পারছিল তাকে ফেলে যেতে, না পারছিল নিয়ে যেতে। মৃত বাচ্চা কোলে নিয়ে এক মা দাঁড়িয়ে আছে। তার শেষকৃত্য করারও সুযোগ নেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেউ দাঁড়াতে পারছে না। প্রাণ বাঁচাতে সবাই চলে যাচ্ছে। এক সময় তাকে পথে ফেলে রেখে কাঁদতে-কাঁদতে সেই মাকেও এগিয়ে যেতে হল। তা দেখে আমার মা বলেছিল, ‘কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে মারা গেছে, তা নিয়ে আদিখ্যেতা দেখো।’ তখন সারা দেশে মানুষের হত্যাকাণ্ড দেখতে-দেখতে এই মৃত্যুটাও গায়ে সয়ে গিয়েছিল। তার জন্য কান্নাকাটি করাটাও আদিখ্যেতা মনে হয়েছিল। আরও দু’টি ঘটনা আমার আবছা মনে আছে। দশ-এগারো বছরের মেয়ে, হাঁটুতে গুলি লেগেছে। মেয়েটাকে একটা ঝুড়িতে বসিয়ে বাবা আর কাকা কাঁধে করে বয়ে চলেছে, মেয়েটা অঝোরে কাঁদছে, হাঁটু থেকে রক্ত ঝরছে, সেই রক্ত ঝুড়ি বেয়ে টপ-টপ করে পড়ছে, কাদার উপর রক্ত, পথের উপর রক্ত। মেয়েটার মা, আলু-থালু বেশে ঝুড়ির পেছন-পেছন দৌঁড়াচ্ছে। তখন ঐ মহিলাকে পাগল মনে হচ্ছিল। পরে দিদি আমাকে বলেছিল, মেয়েটা নাকি মারা গিয়েছিল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। নদী পার হয়ে ও-পাড়ে অর্থাৎ ভারতে গেলাম। জল-কাদা পেরিয়ে ও-পাড়ে গিয়ে আমরা সবাই ছিলাম ক্ষুধার্ত । বাবা কোথা থেকে যেন কিছু চিড়া আর গুড় নিয়ে এল, পরে জেনেছি ক্যাম্প থেকে। নদীর ধারে, একটা গাছের নীচে বসে সেই চিড়া আর গুড় যেই খেতে যাব, হঠাৎ অদূরে নদীর ধারে দেখি একটা কিশোর ছেলে শোয়ানো। মনে হচ্ছিল ছেলেটা ঘুমাচ্ছে, আসলে ছেলেটা ছিল মৃত। আত্মীয়রা তাকে সেভাবেই রেখে চলে গেছে। আমাদের আর সেখানে বসে খাওয়া হল না। পাক-হানাদারের হাত থেকে বাঁচলেও রোগ-শোকের হাত থেকে কিন্তু রেহাই পায়নি। অনেক লোক কলেরায় মারা যায়। আমাদের গ্রামের লোকও মারা যায়।

    আমরা ইন্ডিয়া গিয়ে রানাঘাট নামক এক ক্যাম্পে ছিলাম। এখানে এসে সবার চোখ ওঠা রোগ হয়, এই রোগের নাম ছিল জয়-বাংলা রোগ। এর পর হয় খোঁস-প্যাচড়া অর্থাৎ skindisease. একই কলের জলে নারী-পুরুষ স্নান করত। ক্যাম্পের পরিবেশ ছিল খুবই নোংরা। ক্যাম্পের জীবন নি:সন্দেহে মানবেতর ছিল, কিন্তু আমি কিছু বুঝতাম না। রেশনে পাওয়া আলু আর বড়-বড় পিঁয়াজ দিয়ে মালাই বরফ কিনতাম, সেটা বেশ মনে আছে। কতদিন ঐ ক্যাম্পে ছিলাম, তা মনে নেই। দেশ স্বাধীন হল, ট্রেনে করে দেশে ফিরে এসেছিলাম। ট্রেনে ভীষণ ভিড় ছিল। পাংশা রেল স্টেশনে আমরা নেমেছিলাম। স্টেশনের পাশেই আমার মা আর কাকি ভাত রান্না করে। আমরা খেতে বসলে প্রচুর বুভুক্ষু লোক সেই ভাতের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিল। একটা হাড়ঝিরঝিরে লোক তার কিশোর ছেলেটার জন্য কয়টা ভাত চাইছিল। আমার ঠাকুরদা নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে প্লেটটা সেই ছেলের দিকে এগিয়ে দেয়। এই ঘটনাও আমি ভুলতে পারিনি। প্রতি বছর বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস এলেই দেখি এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত নাটক হয় টেলিভিশনে। কিন্তু এই যে বিশাল জনগোষ্ঠী দেশ ছেড়ে মানবেতর জীবন-যাপন করল, কত জীবন কলেরায় অকালে ঝরে গেল, সে-সব নিয়ে কিন্তু কোনো নাটক বা সিনেমা আমি দেখিনি। কেন যে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে উপেক্ষিত হল, জানি না। হিন্দুদেরও দেখছি, এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের পরবর্তী প্রজন্ম যে হিন্দুদের এই আত্মত্যাগের কথা মনে রাখবে না, সে বিষয়টা এরা চিন্তা করে না বা করছে না। বাংলাদেশের জন্য হিন্দুরাই বেশি প্রাণবিসর্জন দিয়েছে। সেই বাংলাদেশে এখন হিন্দুরা উপেক্ষিত।

    স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমার যখন স্কুলে যাওয়ার সময়, সেই সময় আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাবা স্কুলের টিচার, গ্রামেই স্কুল, তার পরও কেন আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি, তা আমি আজও বুঝতে পারি না। হয়তো দারিদ্‌র্‌য এর অন্যতম কারণ ছিল। স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাক বা বই কেনার সামর্থ্য আমার বাবার মনে হয় তখন ছিল না। সে যে কী রকম দারিদ্‌র্‌য তা আমার ছেলেরা বা আমার ছোটো ভাই-বোন উপলব্ধিই করতে পারবে না। জমিতে ঠিকমতো ফসল হয় না, কৃষিকাজ ছিল নিতান্তই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি হলে খেতে ধান বোনা হত, ঠিকমতো সার বা সেচের ব্যবস্থা ছিল না। অনেকটা দৈবের উপর নির্ভরশীল। নতুন ধান উঠলে আমাদের সে কী আনন্দ হত! নতুন ধানের ভাত, অন্য রকম স্বাদ। সংসারে প্রচুর লোক, বাবা ও কাকার একান্নবর্তী পরিবার। ঠাকুরদা, বড় পিসি সবাই একসঙ্গে। আমার এই পিসি বোবা, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই এই পিসিকে দেখছি আমাদের পরিবারে। অত্যন্ত সংবেদনশীল এই মহিলা আমাদের খুব ভালোবাসতেন, এখনও বাসেন। কারণ তিনি এখনও জীবিত। এক-একবার আমাদের চার সের চালের ভাত রান্না করতে হত। এত চালের জোগান কোত্থেকে আসে? বাবার যা বেতন তা দিয়ে সংসার চলত না। তাই আমরা এক বেলা রুটি খেতাম। তখন গমের দাম খুব কম ছিল। আমরা গমের ভাতও খেতাম। গম ছিল তখন গরিবের খাবার। হয়তো সেই কারণে আমি এখনও রুটির উপর বিরূপ। মনে হয় এটা গরিবের খাবার। এখন আমি সব চেয়ে দামি চালের ভাত খাই।

    আমার বাবা সর্বগুণে গুণী একজন মানুষ। আমার মতে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। এমন কোনো বিষয় নেই যা বাবা জানে না। সংসারে এমন কোনো কাজ নেই যা বাবা জানে না। বাবা ভালো মাছ ধরতে পারত, মাছ ধরার যন্ত্রপাতি বাবা নিজে তৈরি করত। আমাদের বাড়িতে বাঁশ-বেতের ঝাড় ছিল। বাঁশ-বেত দিয়ে যা-যা বানানো যায়, বাবা সবই বানাত। বড়-বড় ধামা, কুলা, খালই, ঝুড়ি সব বাবাই বানাত। ঘর বা উঠান ঝাঁট দেওয়ার ঝাঁটাও। গরু বাঁধার দড়ি পাট দিয়ে তৈরি এখনও বাবাই করে। ঘরের চাল, ঘরের বেড়া এসব কাজ বাবাই করত। বাবা ভালো রান্নাও করতে পারে। মা মামাবাড়ি গেলে বাবাই আমাদের রান্না করে খাওয়াত। আমরা তখন বেশ বড় হয়ে গেছি, দিদি কলেজে পড়ত। তবু বাবা আমাদের দিয়ে রান্না করাত না। এ ছাড়াও বাবা আরেকটা কাজ করত, সেটা হল প্রচুর বই পড়ত বাবা, এখনও পড়ে। কাজের চাপে পাড়ার সময় পেত না। স্কুলে যাওয়ার আগে বাবা মাঠে খেতের কাজ করত, মাঠ থেকে ফিরে স্নান করে যখন খেতে বসত তখন বাবার বাঁ হাতে বই থাকত। আমাদের তো ডাইনিং টেবিল ছিল না, এখনও গ্রামের বাড়িতে পিঁড়িতে বসেই ভাত খায়। সেই অবস্থায় বাবা পড়ত। আমি আর দিদি সব সময় বাবার সাথে-সাথে থাকতাম। বাবার এসব কাজের সময়ই আমরা দু’বোন বাবাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম, বাবার অসম্ভব ধৈর্য, কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি বাবাকে। আমাদের কখনো মারধর করেনি। প্রতিরাতে বাবাকে গল্প বলার জন্য বিরক্ত করতাম। কত যে গল্প শুনেছি বাবার কাছ থেকে! ‘বাঙালির হাসির গল্প’ কতবার যে আমাদের পড়ে শুনিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। শুধু আমরা নই, গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে চলে আসত, তারাও শুনত।

    যুদ্ধের পর গ্রামের লোকজনের মধ্যে কত মিল ছিল। সন্ধ্যার পর এক জায়গায় বসে হুঁকা খেত। এখন কিন্তু গ্রামের মানুষের মধ্যে সেই মিল মহব্বত নেই। নেই সেই সৌহার্দ্য। গ্রামের যে-সব মানুষকে এত আপন মনে হত তারা একে-একে গ্রাম ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেল, খুব খারাপ লাগত। এখন গ্রামে খুবই কম হিন্দু আছে। এখনও সেইসব দিনের কথা মনে হলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বাবা কখনো দেশত্যাগের পক্ষপাতী নয়। বড় হওয়ার পর বাবাকে বলতে শুনেছি—‘দরকার হলে আমেরিকা ইউরোপ যাও, ইন্ডিয়া নয়।’ মূলত তখন থেকেই আমার মধ্যে আমেরিকা আসার একটা স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। আমি একা-একা বিভোর হয়ে কত যে কল্পনা করতাম সেই ছোট বয়স থেকেই। অনেক উদার একটা পরিবেশে বড় হয়েছি। ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতাম। দাঁড়িয়া বাঁধা আমার একটা প্রিয় খেলা ছিল। গ্রামের সব ছেলে-মেয়ে মিলে এই খেলা খেলতাম। আর খেলতাম মার্বেল। আমার সঙ্গে খুব কম ছেলে-মেয়েই পারত। এদিকে আমি বেশ বড় হয়ে গেছি। কিন্তু নিজে পড়তে পারি না। বাবাকে বললাম আমি স্কুলে যেতে চাই। বাবা বলল ঠিক আছে। একদিন একটা কাগজে বাবা আমাকে লিখে দিল ক, কা, কু, কূ, কি, কী আর বলল এগুলো পারলেই অন্য সব অক্ষরও পারবি। ২-৯ ঘরের নামতা লিখে দিল। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই পড়তে পারলাম। বাবা আমাকে একবারে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিল। ঐ ক্লাস থেকেই আমি ‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর ‘বাঙালির হাসির গল্প’ বই দুটো শেষ করি। ছ’মাস পর আমি চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে যাই। এই ক্লাসে ছয় মাস পড়ার পর পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে যাই এবং ভালো রেজাল্ট করেই। এর পর আর আমাকে পায় কে? প্রত্যেক ক্লাস থেকে প্রথম স্থান অধিকার করি, পঞ্চম শ্রেণীতে স্কলারশিপ, অষ্টম শ্রেণীতে স্কলারশিপ এবং এস.এস.সি.-তে স্কলারশিপ পেয়ে কলেজে ভর্তি হই।
    আমার কথা। আমার কথা মুক্তিযুদ্ধ থেকেই শুরু করি। আমি তখন খুব ছোট। কত ছোট তা আমার মনে নেই বা বলতে পারব না। এইটুকু বলতে পারি, আমার মধ্যে তখন সুখ-দু:খের অনুভূতি জন্ম নেয়নি। একটা ঘটনা থেকে সেটা বুঝতে পারি। যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের হিন্দুদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, তাদেরকে ভিটা ছাড়া করা হয়। আমরাও ভারতে আশ্রয় নিই। এখন বুঝি ঐ সময় সাজানো সংসার, ঘর-বাড়ি ছেড়ে আমার বাপ-ঠাকুরদার যে কত কষ্ট হয়েছিল। মহিলা আর শিশুরা না জানি কী নিদারুণ কষ্ট ভোগ করেছে। সে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কতজন যে ভবলীলা সাঙ্গ করেছে!

    আমাদের পাশের গ্রামে যখন মিলিটারি আসে, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তখন আমার কাকা আমাদের সবাইকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে আমরা গড়াই নদীর ও-পাড়ে রাখসাকান্দি নামক গ্রামের এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। বাবা আর দাদা হাটে গিয়েছিল। সেদিন কী বার, কোন মাস কিছুই জানি না, তবে দিনটা ছিল হাটবার। আমরা সেদিন গড়াই নদীতে স্নান করতে যাই। আমি বাচ্চাদের সঙ্গে স্নান করতে ব্যস্ত নদীতে। হঠাৎ দেখি নদীর পাড়েই একটু উপরে আমার মা আর দিদি কান্নাকাটি করছে। আমার বাবা আর ঠাকুরদা তখনও এসে পৌঁছায়নি। আমাদের পাশের গ্রামের শৈলেন ডাক্তারকে রাজাকারেরা গলা কেটে মেরে ফেলেছে। মুণ্ডুটা কেটে তার বউয়ের কোলে দিয়েছে। সে মহিলা আমার মায়ের তরফ থেকে আত্মীয়। আমার মায়েরও একই রকম আতঙ্ক শুরু হয়েছে। রাজাকারেরা আমার বাবাকেও হয়তো সেভাবে মেরে ফেলতে পারে। মায়ের কান্নাকাটি দেখে আমার বড়বোনও কাঁদছে। আমি ভিজা কাপড় পরে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি। কান্না আসছে না, কারণ আমার মধ্যে তখনও এই কষ্টের অনুভূতি জন্ম নেয়নি। আমার খুব অল্প মনে আছে এই স্মৃতিটা। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক বছর ধরে শৈলেন ডাক্তারকে কীভাবে মারল সে গল্প শুনতাম। সেই থেকেই এইটুকু লিখতে পারছি।

    শরণার্থী হয়ে ইন্ডিয়া যাওয়ার পথে বেশ কয়েকটা ঘটনা এখনও মনকে নাড়া দেয়, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটা উল্লেখ করছি, আমাদের গ্রামবাসীরা একটা দলে চলছিল। এভাবে বেশ কয়েকটা দল পরস্পর খবর আদান-প্রদানের মাধ্যমে চলছিল। রাত হলে অনেকগুলো দল একসঙ্গে খোলা আকাশের নীচে ঘুমাত। কখনো-কখনো কোনো স্কুল ঘরেও ঘুমাত। কখনো-কখনো এসব দল দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত হত। রাতের অন্ধকারে এদের কাছ থেকে শেষ সম্বলটুকু কেড়ে নিত। এমনই এক আক্রমণে এক কিশোর ছেলে মারা যায়। মৃত ছেলেটির মামা-বাড়ি ছিল আমাদের গ্রামে। ওদের গ্রামটা আমদের গ্রাম থেকে বেশি দূরে নয়। গ্রামের নাম ক। ওদের দল রাতে একটা স্কুলে আশ্রয় নেয়। কিছু দুর্বৃত্ত দ্বারা ওরা আক্রান্ত হয়। সে ছেলেটি ঘরের বাইরে ছিল। দৌঁড়ে সে যখন ঘরে ঢুকতে যাবে ঠিক সেই সময় ভেতর থেকে অনেক লোক দরজা চেপে ধরে। ছেলেটির একটা হাত তখনও বাইরে, হাতটা ভেতরে ঢোকাতে পারল না, প্রচণ্ড চাপে হাতটা কেটে পড়ে যায়। ছেলেটি অনেক চিৎকার করেছিল, কার কথা কে শোনে। এদিকে গোলাগুলি চলছে, একটা গুলি ছেলেটির নাকের নীচে এবং উপরের ঠোঁটের উপর দিয়ে চলে যায়। গুলিতে সে মারা যায়নি, মারা যায় প্রচুর রক্তক্ষরণে। আমি ছেলেটির মৃতদেহ দেখেছি। তার মা আমাদের গ্রামের মুরsব্বিদের জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছিল। এখনও সে কান্না আমার কানে ভাসে। ছেলেটির নাম ছিল বিবেক।

    বাড়ি ছেড়ে পায়ে হেঁটে আমরা যশোর হয়ে ইন্ডিয়া গিয়েছি। একদিন পথের পাশে একটা সদ্যোজাত শিশু পড়ে থাকতে দেখি। আমরা ছোটরা ঐ বাচ্চার দিকে এগিয়ে যাই, বড়রা ধমক দিয়ে আমাদের সরিয়ে নিয়ে যায়। এক মহিলা ঐ বাচ্চা কোলে তুলে নেয়। কিছুদুর যাওয়ার পর একদিন বা দু’দিন পর ঐ বাচ্চাটি মারা যায়। ঐ মহিলা মৃত বাচ্চা নিয়ে কী করবে বুঝতে পারছিল না। না পারছিল তাকে ফেলে যেতে, না পারছিল নিয়ে যেতে। মৃত বাচ্চা কোলে নিয়ে এক মা দাঁড়িয়ে আছে। তার শেষকৃত্য করারও সুযোগ নেই। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কেউ দাঁড়াতে পারছে না। প্রাণ বাঁচাতে সবাই চলে যাচ্ছে। এক সময় তাকে পথে ফেলে রেখে কাঁদতে-কাঁদতে সেই মাকেও এগিয়ে যেতে হল। তা দেখে আমার মা বলেছিল, ‘কুড়িয়ে পাওয়া মেয়ে মারা গেছে, তা নিয়ে আদিখ্যেতা দেখো।’ তখন সারা দেশে মানুষের হত্যাকাণ্ড দেখতে-দেখতে এই মৃত্যুটাও গায়ে সয়ে গিয়েছিল। তার জন্য কান্নাকাটি করাটাও আদিখ্যেতা মনে হয়েছিল। আরও দু’টি ঘটনা আমার আবছা মনে আছে। দশ-এগারো বছরের মেয়ে, হাঁটুতে গুলি লেগেছে। মেয়েটাকে একটা ঝুড়িতে বসিয়ে বাবা আর কাকা কাঁধে করে বয়ে চলেছে, মেয়েটা অঝোরে কাঁদছে, হাঁটু থেকে রক্ত ঝরছে, সেই রক্ত ঝুড়ি বেয়ে টপ-টপ করে পড়ছে, কাদার উপর রক্ত, পথের উপর রক্ত। মেয়েটার মা, আলু-থালু বেশে ঝুড়ির পেছন-পেছন দৌঁড়াচ্ছে। তখন ঐ মহিলাকে পাগল মনে হচ্ছিল। পরে দিদি আমাকে বলেছিল, মেয়েটা নাকি মারা গিয়েছিল অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে। নদী পার হয়ে ও-পাড়ে অর্থাৎ ভারতে গেলাম। জল-কাদা পেরিয়ে ও-পাড়ে গিয়ে আমরা সবাই ছিলাম ক্ষুধার্ত । বাবা কোথা থেকে যেন কিছু চিড়া আর গুড় নিয়ে এল, পরে জেনেছি ক্যাম্প থেকে। নদীর ধারে, একটা গাছের নীচে বসে সেই চিড়া আর গুড় যেই খেতে যাব, হঠাৎ অদূরে নদীর ধারে দেখি একটা কিশোর ছেলে শোয়ানো। মনে হচ্ছিল ছেলেটা ঘুমাচ্ছে, আসলে ছেলেটা ছিল মৃত। আত্মীয়রা তাকে সেভাবেই রেখে চলে গেছে। আমাদের আর সেখানে বসে খাওয়া হল না। পাক-হানাদারের হাত থেকে বাঁচলেও রোগ-শোকের হাত থেকে কিন্তু রেহাই পায়নি। অনেক লোক কলেরায় মারা যায়। আমাদের গ্রামের লোকও মারা যায়।

    আমরা ইন্ডিয়া গিয়ে রানাঘাট নামক এক ক্যাম্পে ছিলাম। এখানে এসে সবার চোখ ওঠা রোগ হয়, এই রোগের নাম ছিল জয়-বাংলা রোগ। এর পর হয় খোঁস-প্যাচড়া অর্থাৎ skindisease. একই কলের জলে নারী-পুরুষ স্নান করত। ক্যাম্পের পরিবেশ ছিল খুবই নোংরা। ক্যাম্পের জীবন নি:সন্দেহে মানবেতর ছিল, কিন্তু আমি কিছু বুঝতাম না। রেশনে পাওয়া আলু আর বড়-বড় পিঁয়াজ দিয়ে মালাই বরফ কিনতাম, সেটা বেশ মনে আছে। কতদিন ঐ ক্যাম্পে ছিলাম, তা মনে নেই। দেশ স্বাধীন হল, ট্রেনে করে দেশে ফিরে এসেছিলাম। ট্রেনে ভীষণ ভিড় ছিল। পাংশা রেল স্টেশনে আমরা নেমেছিলাম। স্টেশনের পাশেই আমার মা আর কাকি ভাত রান্না করে। আমরা খেতে বসলে প্রচুর বুভুক্ষু লোক সেই ভাতের দিকে লোলুপ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছিল। একটা হাড়ঝিরঝিরে লোক তার কিশোর ছেলেটার জন্য কয়টা ভাত চাইছিল। আমার ঠাকুরদা নিজে খাওয়া বাদ দিয়ে প্লেটটা সেই ছেলের দিকে এগিয়ে দেয়। এই ঘটনাও আমি ভুলতে পারিনি। প্রতি বছর বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস এলেই দেখি এই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কত নাটক হয় টেলিভিশনে। কিন্তু এই যে বিশাল জনগোষ্ঠী দেশ ছেড়ে মানবেতর জীবন-যাপন করল, কত জীবন কলেরায় অকালে ঝরে গেল, সে-সব নিয়ে কিন্তু কোনো নাটক বা সিনেমা আমি দেখিনি। কেন যে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর আত্মত্যাগ জাতির ইতিহাসে উপেক্ষিত হল, জানি না। হিন্দুদেরও দেখছি, এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এদের পরবর্তী প্রজন্ম যে হিন্দুদের এই আত্মত্যাগের কথা মনে রাখবে না, সে বিষয়টা এরা চিন্তা করে না বা করছে না। বাংলাদেশের জন্য হিন্দুরাই বেশি প্রাণবিসর্জন দিয়েছে। সেই বাংলাদেশে এখন হিন্দুরা উপেক্ষিত।

    স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমার যখন স্কুলে যাওয়ার সময়, সেই সময় আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি। বাবা স্কুলের টিচার, গ্রামেই স্কুল, তার পরও কেন আমার স্কুলে যাওয়া হয়নি, তা আমি আজও বুঝতে পারি না। হয়তো দারিদ্‌র্‌য এর অন্যতম কারণ ছিল। স্কুলে যাওয়ার মতো পোশাক বা বই কেনার সামর্থ্য আমার বাবার মনে হয় তখন ছিল না। সে যে কী রকম দারিদ্‌র্‌য তা আমার ছেলেরা বা আমার ছোটো ভাই-বোন উপলব্ধিই করতে পারবে না। জমিতে ঠিকমতো ফসল হয় না, কৃষিকাজ ছিল নিতান্তই প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। বৃষ্টি হলে খেতে ধান বোনা হত, ঠিকমতো সার বা সেচের ব্যবস্থা ছিল না। অনেকটা দৈবের উপর নির্ভরশীল। নতুন ধান উঠলে আমাদের সে কী আনন্দ হত! নতুন ধানের ভাত, অন্য রকম স্বাদ। সংসারে প্রচুর লোক, বাবা ও কাকার একান্নবর্তী পরিবার। ঠাকুরদা, বড় পিসি সবাই একসঙ্গে। আমার এই পিসি বোবা, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই এই পিসিকে দেখছি আমাদের পরিবারে। অত্যন্ত সংবেদনশীল এই মহিলা আমাদের খুব ভালোবাসতেন, এখনও বাসেন। কারণ তিনি এখনও জীবিত। এক-একবার আমাদের চার সের চালের ভাত রান্না করতে হত। এত চালের জোগান কোত্থেকে আসে? বাবার যা বেতন তা দিয়ে সংসার চলত না। তাই আমরা এক বেলা রুটি খেতাম। তখন গমের দাম খুব কম ছিল। আমরা গমের ভাতও খেতাম। গম ছিল তখন গরিবের খাবার। হয়তো সেই কারণে আমি এখনও রুটির উপর বিরূপ। মনে হয় এটা গরিবের খাবার। এখন আমি সব চেয়ে দামি চালের ভাত খাই।

    আমার বাবা সর্বগুণে গুণী একজন মানুষ। আমার মতে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী। এমন কোনো বিষয় নেই যা বাবা জানে না। সংসারে এমন কোনো কাজ নেই যা বাবা জানে না। বাবা ভালো মাছ ধরতে পারত, মাছ ধরার যন্ত্রপাতি বাবা নিজে তৈরি করত। আমাদের বাড়িতে বাঁশ-বেতের ঝাড় ছিল। বাঁশ-বেত দিয়ে যা-যা বানানো যায়, বাবা সবই বানাত। বড়-বড় ধামা, কুলা, খালই, ঝুড়ি সব বাবাই বানাত। ঘর বা উঠান ঝাঁট দেওয়ার ঝাঁটাও। গরু বাঁধার দড়ি পাট দিয়ে তৈরি এখনও বাবাই করে। ঘরের চাল, ঘরের বেড়া এসব কাজ বাবাই করত। বাবা ভালো রান্নাও করতে পারে। মা মামাবাড়ি গেলে বাবাই আমাদের রান্না করে খাওয়াত। আমরা তখন বেশ বড় হয়ে গেছি, দিদি কলেজে পড়ত। তবু বাবা আমাদের দিয়ে রান্না করাত না। এ ছাড়াও বাবা আরেকটা কাজ করত, সেটা হল প্রচুর বই পড়ত বাবা, এখনও পড়ে। কাজের চাপে পাড়ার সময় পেত না। স্কুলে যাওয়ার আগে বাবা মাঠে খেতের কাজ করত, মাঠ থেকে ফিরে স্নান করে যখন খেতে বসত তখন বাবার বাঁ হাতে বই থাকত। আমাদের তো ডাইনিং টেবিল ছিল না, এখনও গ্রামের বাড়িতে পিঁড়িতে বসেই ভাত খায়। সেই অবস্থায় বাবা পড়ত। আমি আর দিদি সব সময় বাবার সাথে-সাথে থাকতাম। বাবার এসব কাজের সময়ই আমরা দু’বোন বাবাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতাম, বাবার অসম্ভব ধৈর্য, কখনো বিরক্ত হতে দেখিনি বাবাকে। আমাদের কখনো মারধর করেনি। প্রতিরাতে বাবাকে গল্প বলার জন্য বিরক্ত করতাম। কত যে গল্প শুনেছি বাবার কাছ থেকে! ‘বাঙালির হাসির গল্প’ কতবার যে আমাদের পড়ে শুনিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। শুধু আমরা নই, গ্রামের লোকেরা সন্ধ্যার পর আমাদের বাড়িতে চলে আসত, তারাও শুনত।

    যুদ্ধের পর গ্রামের লোকজনের মধ্যে কত মিল ছিল। সন্ধ্যার পর এক জায়গায় বসে হুঁকা খেত। এখন কিন্তু গ্রামের মানুষের মধ্যে সেই মিল মহব্বত নেই। নেই সেই সৌহার্দ্য। গ্রামের যে-সব মানুষকে এত আপন মনে হত তারা একে-একে গ্রাম ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে গেল, খুব খারাপ লাগত। এখন গ্রামে খুবই কম হিন্দু আছে। এখনও সেইসব দিনের কথা মনে হলে মন ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। বাবা কখনো দেশত্যাগের পক্ষপাতী নয়। বড় হওয়ার পর বাবাকে বলতে শুনেছি—‘দরকার হলে আমেরিকা ইউরোপ যাও, ইন্ডিয়া নয়।’ মূলত তখন থেকেই আমার মধ্যে আমেরিকা আসার একটা স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। আমি একা-একা বিভোর হয়ে কত যে কল্পনা করতাম সেই ছোট বয়স থেকেই। অনেক উদার একটা পরিবেশে বড় হয়েছি। ছেলেদের সাথে খেলাধুলা করতাম। দাঁড়িয়া বাঁধা আমার একটা প্রিয় খেলা ছিল। গ্রামের সব ছেলে-মেয়ে মিলে এই খেলা খেলতাম। আর খেলতাম মার্বেল। আমার সঙ্গে খুব কম ছেলে-মেয়েই পারত। এদিকে আমি বেশ বড় হয়ে গেছি। কিন্তু নিজে পড়তে পারি না। বাবাকে বললাম আমি স্কুলে যেতে চাই। বাবা বলল ঠিক আছে। একদিন একটা কাগজে বাবা আমাকে লিখে দিল ক, কা, কু, কূ, কি, কী আর বলল এগুলো পারলেই অন্য সব অক্ষরও পারবি। ২-৯ ঘরের নামতা লিখে দিল। আমি কয়েকদিনের মধ্যেই পড়তে পারলাম। বাবা আমাকে একবারে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করিয়ে দিল। ঐ ক্লাস থেকেই আমি ‘ঠাকুমার ঝুলি’ আর ‘বাঙালির হাসির গল্প’ বই দুটো শেষ করি। ছ’মাস পর আমি চতুর্থ শ্রেণীতে উঠে যাই। এই ক্লাসে ছয় মাস পড়ার পর পঞ্চম শ্রেণীতে উঠে যাই এবং ভালো রেজাল্ট করেই। এর পর আর আমাকে পায় কে? প্রত্যেক ক্লাস থেকে প্রথম স্থান অধিকার করি, পঞ্চম শ্রেণীতে স্কলারশিপ, অষ্টম শ্রেণীতে স্কলারশিপ এবং এস.এস.সি.-তে স্কলারশিপ পেয়ে কলেজে ভর্তি হই।

  • Manish | 59.90.135.107 | ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ ১২:০৬511101
  • মনোরম দেবী,
    আপনার লেখা খুব ভালো লাগছে। বাংলাদেশের স্বাধিনতা নিয়ে জানতে খুব ইচ্ছুক। এই ব্যাপারে এই বাংলর জনগনের জানকারি খুব একটা নেই। আপনি আরো লিখুন। চাতকের মতো অপেক্ষা করছি। কিন্তু লেখা দুবার কেনো আসছে।
  • Sujata | 203.197.123.130 | ১৪ ডিসেম্বর ২০১১ ১৬:৩১511102
  • খুব ভালো লাগছে।

    আমার দিদু-ও রুটির ওপর বিরুপ ছিলেন। দেশ ভাগের পর অনেক ক'টি ছেলে মেয়ে নিয়ে উদ্বাস্তু জীবনের কষ্ট সয়েছিলেন আরো অনেকের মতই। বড় হয়ে দিদুর কাছে সেই দিনগুলোর কথা শুনতে চাইলে কিছুতেই বলতে চাইতেন না। মনোরমার লেখা পড়ে মনে পড়ে যাচ্ছে দিদুর কথা -- দিদু রুটি এক্কেবারে ভালো বাসতো না।
  • kd | 59.93.211.113 | ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ ০০:৪৮511103
  • এমন লেখা আগে কোনদিন পড়িনি। একেবারে বুক নিংড়্রে লেখা।

    Thank you Monorama Biswas, thank you from the bottom of my heart
  • achintyarup | 59.93.243.128 | ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ ০৪:৩৮511104
  • মন দিয়ে পড়ছি মনোরমাদিদি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে। জানো কি, রানাঘাটের যেরকম ক্যাম্পে তোমরা থেকেছিলে, সেরকম পি এল ক্যাম্প (permanent liability camp) এখনও কয়েকটা রয়ে গেছে এ বাংলায়? সে সব ক্যাম্পে যারা থাকে অমানুষের মত জীবন তাদের। দেখলে চোখ ফেটে জল আসে।

    আরও লেখ তোমার কথা।
  • pi | 72.83.83.28 | ১৫ ডিসেম্বর ২০১১ ১৯:৫৯511105
  • মনোরমাদি, অপেক্ষায়।

    অচিন্তিদা, ক্যাম্প নিয়ে তোমার সেই লেখাটার বাংলা অনুবাদ করেছিলে ?
  • Mridha | 65.200.157.178 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ ০০:২২511106
  • মন দিয়ে পড়ছি লেখা,ভাল লেখা এটাকে বলা মনে হয় ঠিক নয়, আরো বেশি কিছু এটা, পড়ে ভাল লাগে না, আমাদের চেনা জগৎ অচেনা করে দেয়,আপনি আরো লিখুন....বাধ্য ছাত্রের মত পড়ব, নিজের জন্যই জানা উচিত, আরো অনেক লেখা পাবার আশায় রইলম আপনার কাছ থেকে। কাল আপনার এই লেখাটা পড়লাম, তার পরে তারা TV তে সকালের আমন্ত্রনে বাংলাদেশের বিজয়দিবস এর উপরে অনুষ্টান দেখে, ভাবছিলাম...... রাষ্ট্রের এই কাটা তারের বেড়া মাটির জীবনের কাছে কত অপ্রাসঙ্গিক.....কিন্তু কি ভয়ংকর ভাবে মানুষের জীবন ওলট পালট করে, বাংলাকে ভাঙা তার case study....... ইতিহাসের শিক্ষা।

  • achintyarup | 59.93.242.62 | ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ ০৪:০৬511107
  • পাই, ক্যাম্প নিয়ে বাংলায় কিছু লেখা হয়নি।

    মনোরমাদিদি, আরও লেখা কই?
  • Monorama Biswas | 71.167.46.249 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ ০৫:০৫511108
  • আমি এত ব্যস্ত যে লেখার সময় করে উঠতে পারছি না। ৬ দিন কাজ, কাজ শেষে বাসায় রান্না। অচিরেই এক দিন কাজ বাদ দিব। আমি বাঙ্গলাদেশের হিন্দু দের জন্য কিছু করতে চাই। শুরু করব আমাদের গ্রাম থেকেই। আমাদের দেশের হিন্দুদের মনোবল একটু কম।
    এ জন্যেই এত কাজ করি। এক টা মন্দির করা হয়েছে। একটা লাইব্রেরী, সব বাচ্চা দের লেখাপড়া নিশ্চিত করা- এ গুলো আমার প্রথম পদক্ষেপ।

  • pi | 128.231.22.133 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ ০৫:১৩511096
  • গ্রামে হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক এখন কেমন ?
  • Monorama | 71.167.46.249 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ ০৬:৫৬511097
  • আমি যে সময়ে অর্থাত ৭০-৮০ র দশকে গ্রামে বড় হয়েছি, ঐ সময় ভালই দেখেছি। এখন অত ভালো নেই। আমি ধর্ম নিয়ে মানুষের এই বিভাজন -একদম পছন্দ করিনে। এই জন্যেই দরকার শিক্ষা। হিন্দুরা রাস্ট্রীয় ভাবেই অনেক কিছু থেকে বনি্‌চত।
  • Biplob Rahman | 202.164.212.14 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১১ ১৯:৩৭511098
  • @ মনোরমা দিদি,

    একটু দেরিতে তোমার লেখাটি পড়লাম। যুদ্ধের বছরে আমার জন্ম, তাই নাম -- বিপ্লব। এক অর্থে বাংলাদেশের বয়স, আমার সমান বা আমি ও দেশ-- দুজনে সমবয়সী। ...

    তাই নিজে যুদ্ধের ভবহতা কিছুই নিজে দেখিনি, বইপত্রে পড়েছি, বড়দের কাছে শুনেছি, সিনেমায় হয়েছে আরো খানিকটা জ্ঞান। ..এই সব পরোক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্যে একটি কচি শিশুর চোখে দেখা তোমার এই লেখাটি খুব বেশী হৃদয়স্পর্শী...একেবারে পড়তে পড়তে চোখ ভিজে যায়। ...

    আমার অনেক শ্রদ্ধা জেনো। জয় বাংলা!
  • pi | 72.83.83.28 | ০৮ জানুয়ারি ২০১২ ১০:১৫511099
  • মনোরমাদি, তুলে দিলাম।

    গুরুর এই টইপত্তরের মূল পাতায় http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?font=unicode&portletId=8&porletPage=1 উপরের দিকে কিছু পাতার ন, অছে। সেখানে কিল্ক করে পাতার নিচে গেলে পুরানো টই পাওয়া যায়।
    আর নইলে গুগল সার্চ তো আছেই। সেখানে থ্রেডের পুরো নাম , কি কোন কী ওয়ার্ড বাংলায় লিখে , তার সাথে guruchandali লিখলে চলে আসবে।
  • মিলা | 134.155.204.47 | ১৫ জুন ২০১২ ১১:৫৩511100
  • এটা আরো লেখা হোক
  • .r2h | 162.158.119.46 | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৩:৩৫729743
  • কদিন আগে উদ্বাস্তু, অনুপ্রবেশকারী, ঘটি, বাঙাল, হাসি ঠাট্টা, বিদ্বেষ - এইসব নিয়ে কথা হচ্ছিল।
  • একলহমা | ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ১৭:৫৯729745
  • এই লেখা এর পরে আর এলনা! :(
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন