সব ব্যাপারে আদালতই শেষ কথা বলবে, এ অতি বিপজ্জনক ব্যাপার। আদালত যখন সমকামিতার পক্ষে রায় দেয়, তখন আমরা নাচি, যখন অযোধ্যা-বিবাদে একরকম করে বিজেপির পক্ষে রায় দেয়, তখন আমরা গেল-গেল রব তুলি, কিন্তু কথা হল, এগুলো আদৌ আদালতের বিচার্য কেন? আইন প্রণয়ন করা, সমাজকে সঠিক (অথবা বেঠিক) পথে চালনা করা, মানুষের বোরখা পরে ঘোরার অধিকার আছে, নাকি ন্যাংটো হয়ে, খুনে মৃত্যুদন্ড থাকবে না নয়, এগুলো দেখা আদৌ আদালতের কাজ নয়। ... ...
পরিস্থিতি অবশ্য এরকমই হবার কথা। নিজের ভাষা, নিজের জাতীয়তাকে রক্ষা করা একটা রাজনৈতিক কাজ, সেটাকে দশকের পর দশক ধরে উপেক্ষা এবং দুচ্ছাই করে যাওয়া হয়েছে। কংগ্রেস দিল্লির ধামা ধরেছে, সিপিএম বামফ্রন্ট সরকারকে চোখের মনির মতো রক্ষা করতে গিয়ে ৭৭এর স্মারকলিপি গিলে ফেলেছে, অশোক মিত্র সরকার ছেড়েছেন, আর তৃণমূল ঠিক কী চায় নিজেই জানে কিনা সন্দেহ। সবার উপরে অবশ্যই বিজেপি, যাদের অ্যাজেন্ডা, বস্তুত, বাংলাভাষী ধর আর বাংলাদেশে পাঠাও। বাংলাদেশী হটাও আর গরু-পাচার বন্ধ কর। অস্যার্থ, গরুরাই এপারে থাকবে, বাংলাভাষীরা সীমানার ওপারে। ... ...
এটা একবারের অভিজ্ঞতা হলে ছুটকো ছাটকা বিষয় বলে উড়িয়ে দেওয়াই যেত। কিন্তু ব্যাপারটা ধারাবাহিক। যখনই শাসক দলের কিছু সমালোচনা করা হয়, সিপিআইএম এর অনলাইন কিছু কর্মী দেখি ঝাঁপিয়ে পড়েন তার বিরুদ্ধে। না, সবাই না, বেশিরভাগও না, দক্ষিণ কলকাতার একটি অংশের কিছু উগ্র কর্মীবৃন্দ। এটা বহু সময় দেখেছি। বগটুইএর ঘটনায় নিজে লিখে দেখেছি। জয় গোস্বামীর 'দগ্ধ' বইটি আমরা প্রকাশ করেছি, তখন দেখেছি। ব্যাপর দেখে মনে হচ্ছিল বগটুই না, পশ্চিমবঙ্গে আলোড়ন ফেলা নিন্দনীয় একটাই ঘটনা ঘটেছে, যার নাম দগ্ধ। এই সব আক্রমণেরই মূল উপজীব্য একটাই। পছন্দমতো কেন প্রতিবাদ হচ্ছেনা। কেন 'শাসক দল' লেখা হচ্ছে। কেন ঘটনা দেখে দুঃখ হচ্ছে, 'প্রতিবাদে গর্জে উঠুন' কেন বলা নেই। সারা জীবনে বহু জিনিসে প্রতিবাদ ইত্যাদি করেছি। কিন্তু এই অদ্ভুত জিনিস কখনও দেখিনি, যে, যাঁরা সর্বস্তরের মানুষের কাছে প্রতিবাদের আহ্বান করছেন, তাঁদেরই কর্মীবাহিনীর একাংশ সেটাকে বানচাল করে দিতে চাইছেন। এই ঔদ্ধত্য, কে কী বলবে, ঠিক করে দেবার মানসিকতা, কোথা থেকে আসে বলা মুশকিল। হয়তো একরকম অন্তর্ঘাতও হতে পারে। আমার জানা নেই। ... ...
শুরুতেই জানব, আগে কীকরে মিল দেওয়া হত। ওসব ছিল, একদম মাপে-মাপ মিলিয়ে, দুলে-দুলে পড়ার মতো করে। রবিঠাকুর লিখেছিলেন, আমাদের ছোটো নদী চলে আঁকে বাঁকে/ বৈশাখ মাসে তাতে হাঁটুজল থাকে। শঙ্খ ঘোষঃ দুপুরে রুক্ষ গাছের পাতার কোমলতাগুলি হারালে/তোমাকে বকব ভীষণ বকব আড়ালে। জয় গোস্বামীরঃ নাম লিখেছি একটি তৃণে/ আমার মায়ের মৃত্যুদিনে। কিন্তু এগুলি একে বোরিং, তায় কঠিন, তদুপরি চটক কম। কাজেই বাজারে এসেছে নতুন নতুন পদ্ধতি। জেনে নিন পদ্ধতিগুলি। ... ...
পিএফআই যে ঠিক কী 'দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র' করেছে, খবরের কাগজ তন্ন তন্ন করেও খুঁজে পেলামনা। অবশ্য এখন গণতন্ত্রের কারবারই আলাদা। সেই উপকথার গপ্পে ছিল, 'তুই না, তোর বাপ জল ঘুলিয়েছিল', সেখান থেকে একটা জিনিস বোঝা যায়, যে, খুব বদ হলেও, রাজা-বাদশারা ইচ্ছে হলেই কারো মুন্ডু কেটে ফেলতে পারতেননা। অন্তত একটা ফালতু অভিযোগ খাড়া করতে হত। এখন দারুণ গণতন্ত্রে সেই চক্ষুলজ্জাও উঠে গেছে। এমন সব দুর্দান্ত আইন বেরিয়েছে, যাতে, সব গোপন। তদন্ত তো গোপন বটেই, বিচারও চুপি-চুপি, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে অভিযোগও গোপন। আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার ব্যাপারটা তো ক্রমে উঠেই যেতে চলেছে। খুব ইচ্ছে হলে করতেই পারেন, কেউ আটকাবেনা, কিন্তু আপনি কেন নির্দোষ সেটা বলবেন কীকরে, অভিযোগটাই তো জানা নেই। হয়তো বললেন, আমি তো চুরি করিনি, খুনও করিনি, কিন্তু তদন্তকারীদের খাতায় লেখা আছে, সুপ্রিম কোর্টের দিকে ট্যারা চোখে তাকিয়েছিলেন, ওইটাই অপরাধ। কিন্তু সেটা আপনাকে বলা যাবেনা। সে আপনি জানবেনই কীকরে, আর পাল্টা বলবেনই বা কীকরে। ... ...
গোদার নিয়ে বঙ্গীয় সিনেফিলদের আকুল হবার কোনো কারণ নেই, কারণ গোদার আমাদের রক্তে, একদম হিমোগ্লোবিনে ঢুকে ছানা কেটে দিয়েছেন। মারাদোনার বাঁ পা যেমন আমাদেরই বাঁ পা, চিনের চাউমিন যেমন আমাদেরই চাউমিন, বিলেতের কোহিনুর যেমন আমাদেরই কোহিনুর, গোদার তেমনই আমাদেরই ফরাসি আতর। প্যারিসে নাকি প্রবাদ আছে, "জনপ্রিয়তায় হাঁদাভোদার, পরেই আছেন জাঁ লুক গোদার"। গোদার আমাদের যৌবনের উপবন, বার্ধক্যের বৃদ্ধাবাস, গোদার আমাদের আরামের পান্তাভাত, গোদার আমাদের বাড়ি ফেরা। গোদারের বাড়িই আমাদের বাড়ি, গোদার বাড়ি। ... ...
কবিতা কৃষ্ণন নাকি টুইটে লিখেছেন, "সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল একনায়কতান্ত্রিক, সংসদীয় গণতন্ত্রের চেয়ে ঢের খারাপ"। আমি টুইটার দেখিনা। হিন্দু তে দেখলাম ( **লিংক লেখার নিচে) । টুইটারের আড়াই লাইনে এইসব তত্ত্ব লেখার কী মানে জানিনা, অবশ্য গোটা পৃথিবীতেই রাজনীতি এখন রেটোরিক সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব কিছু দেখিওনা, উত্তরও দিইনা। কিন্তু এইটা কবিতা কৃষ্ণন বলেই লিখতে হচ্ছে, কারণ, "প্রগতিশীল"রা একরকম করে আদর্শ পতাকাবাহক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরেই কবিতাকে উপস্থাপন করছেন। ফলে তাঁর বক্তব্যের কিছু ওজন আছে। এবং এটা ঠিক প্রেক্ষিতহীনভাবে একটা টুইট তুলে আনা নয়। হিন্দুতে দেখলাম, একই লাইনে কিছু কথাও বলেছেন। যেমন সোভিয়েত মডেলকে বিশ্বের খারাপতম একনায়কতান্ত্রিক মডেল হিসেবে দেখতে হবে। ... ...
বিলকিস বানোর ধর্ষকদের মুক্তি খুব স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয়, যে, ধর্ষকরা পরিষ্কারভাবেই দুই গোত্রের। এক দল নির্ভয়াকান্ডের ধর্ষক, বা হায়দ্রাবাদ কান্ডের অভিযুক্ত, যারা নিন্দিত, ধিকৃত, দেশজুড়ে ঘৃণার পাত্র। জেলের কয়েদিরাও তাদের পিটিয়ে দেয়, পুলিশ পারলে এনকাউন্টার করে দেয়। পাবলিক রাস্তায় নামে, পারলে থুথু দেয়, এবং দেশজোড়া উল্লাসের মধ্যে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, খুব এবং ধর্ষণে অভিযুক্তদের। আর আরেকটা গোত্র হল কাঠুয়াকান্ড বা বিলকিস বানোর ধর্ষকরা। তাদের সমর্থনে মিছিল হয়, পারলে বেকসুর খালাসই করে দেওয়া হত। কোনোক্রমে কারাগার অবধি পৌঁছলে সেখান থেকে কায়দা-কানুন করে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ফিরলে ফুলমালা দিয়ে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ... ...
অমিতাভ গুপ্ত একটা অসম্ভব ভালো লেখা লিখেছে রোব্বারের আনন্দবাজারে। য্দিও লেখাটার প্রতিপাদ্যের সঙ্গে আমি একমত নই, তার পরেও, বৈদ্যুতিন এবং সামাজিক মাধ্যম জুড়ে অজস্র চর্বিতচর্বণের মধ্যে, এ ধরণের বৌদ্ধিক লেখা পড়লে মগজের আরাম হয়। লেখাটা লম্বা, তবে তার যৌক্তিক মোটামুটি এইরকমঃ ১। ফেসবুক, বা সামগ্রিকভাবে সামাজিক মাধ্যমে অতি-দক্ষিণপন্থী দৃশ্য-শ্রাব্য-পাঠ্য বস্তুর সংখ্যা বাম-অতিবাম-মধ্য এদের যোগফলের চেয়েও বেশি। ২। এর একটা কারণ হল সামাজিক মাধ্যমের অ্যালগরিদম অতি-দ্ক্ষিণপন্থীদের সহায়তা করে বেশি (কেন, লেখক ব্যাখ্যা করেননি)। ৩। এর আরও একটা সম্ভাব্য কারণ আছে। একটা স্টাডিতে দেখা গেছে অতি-দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসীদের বৌদ্ধাঙ্ক, অর্থাৎ আইকিউ তুলনামূলকভাবে কম। সোজা বাংলায় বললে বোকাদের অতিদক্ষিণপন্থার দিকে টেনে আনা সোজা। কারণ, বুদ্ধি কম মানে পড়াশুনো কম, বহির্জগতে বীক্ষণ কম, চিন্তাভাবনার ক্ষমতা কম। ... ...