এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • নতুন স্বপ্ন  - ২ 

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১২১ বার পঠিত | রেটিং ৪.৩ (৩ জন)
  • 1 | 2
    জোরালো অ্যান্টিবায়োটিকের জোরে সুখির ঘা অনেকটা শুকিয়ে এসেছে। এখন হেঁটে হেঁটে এখানে ওখানে যেতে পারে। সেদিন সুভাষ গিরির বাড়ির দাওয়ায় গিয়ে বসল সকালবেলায়। সুভাষবাবু তখন খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছিলেন একটা পুরনো কাঠের চেয়ারে বসে। তিনি খবরের কাগজ কোলের ওপর রেখে সুখিকে বললেন, ‘ কিরে সুখি কেমন আছিস ? ‘
    সুখি শালকাঠের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বলল, ‘ ভাল আছি দাদা। এখন অনেক ভাল। বিজয় দাদা আমার জন্যে যা করেছেন ও: .... কি বলব .... আমি কোনদিনও ভুলব না ......’।
    এ এক অদ্ভুত সম্পর্ক। বাবাকে ডাকছে দাদা, আবার ছেলেকেও বলছে দাদা।
    সুভাষবাবু বললেন, ‘ এটাই তো আমাদের কাজ। পা দুটো জোরালো না হলে লড়াইয়ের সড়কে ছুটবি কি করে ?’
    সুখি কি বুঝল কি জানি, বলল, ‘সে চিন্তা করবেন না দাদা, বিজয় দাদার পাশে থাকব সবসময়। পতাকা ধরে থাকব শক্ত করে।’
    সুভাষবাবু নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সুখিরামের দিকে। তার চোখে মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তি ফুটে উঠল।
    প্রলয় বসাকের সুন্দর সুঠাম চেহারা। বয়সও অল্প। কলকাতায় কোন বেসরকারি কোম্পানিতে যেন কাজ করে। পরের দিন বিকেলে বাজারের কাছে দেখা হল। প্রলয় বলল, ‘ জেঠু কেমন আছেন ? ’
    — ‘ আরে প্রলয় যে ..... কি খবর, কেমন আছ ? আজকাল মোটে দেখা হয় না।’
    — ‘ ভাল আছি দাদা। আপনারা কেমন ? পার্টির খবর তো আজকাল কিছু পাই না। বাবা প্রায়ই জিজ্ঞাসা করে আপনাদের কথা, কিন্তু আমি তো কিছুই বলতে পারি না। বাবার শরীরও একদম ভাল না। একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। মাঝে একদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে বিকেলবেলার দিকে হাঁটতে হাঁটতে তালাবন্ধ বট অশ্বথ্থ গাছ গজানো পার্টি অফিসের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল। সেদিন আমার ছুটির দিন ছিল। সন্ধে হয়ে গেছে তখনও বাবা ফেরে না দেখে আমি বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে প্রাইমারি স্কুলের পাশে ভাঙাচোরা পার্টি অফিসের সামনে এসে দেখি পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে বাবা কাঁদছে। আমি বললাম, বাবা কাঁদছ কেন। বাবা বলল, ‘চোখের সামনে একটা সূর্য ডুবতে দেখলাম। আর বোধহয় উঠতে দেখা হবে না এ জীবনে। জীবন তো শেষ হয়ে এল ......।’ প্রলয় বসাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সুভাষবাবু স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাজারে বেচা কেনা জমে উঠেছে। হৈ চৈ উচ্চকিত হয়ে উঠছে ক্রমশ। সেই প্রাণবন্ত বাজারের মধ্যে দুটি অসমবয়স্ক মানুষ পরষ্পরের মুখোমুখি মৌন ও বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
    কিছুক্ষণ বাদে সুভাষ গিরি বললেন, ‘ বিজয়ের সঙ্গে একবার দেখা করো। ওরা পরশুদিন এই বাজারেই একটা জমায়েত ডেকেছে। ব্লক স্তরের সবাইকে খবর দেওয়া হয়েছে।’
    —-‘ অবশ্যই অবশ্যই .... ‘
    বলেই বিদায় নিল না। সুভাষবাবুর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে বকুলতলা পর্যন্ত এল। এখানে লোকজন খুব কম। ওখানে পৌঁছে দুজনে আবার দাঁড়াল। প্রলয়ের আরও কিছু বলার বোধহয় বাকি।
    সে হঠাৎ বলল, ‘ আচ্ছা জেঠু, বামপন্থা দক্ষিণপন্থা মধ্যপন্থা ...., এসব কি আর কিছু আছে ? সংসদীয় গনতন্ত্র তো এখন শুধু ক্ষমতা এবং সম্পদ দখলের লড়াই। যে কোন পন্থারই তো এখন এই একটাই লক্ষ্য।’
    সুভাষবাবু কোন উত্তর না দিয়ে মাথা নীচু করে কি ভাবতে লাগলেন।
    তারপর মৃদু কন্ঠে বললেন, ‘ মুশ্কিল হচ্ছে কি জান প্রলয় সব জেনে বুঝেও স্বপ্ন দেখা ছাড়তে পারি না। বুঝতে পারি সবটাই পুরো ফাঁকিবাজি। বামতন্ত্র ডানতন্ত্র এসব কিছু না। অঘোষিত ভোগতন্ত্র। কোন বিভেদ বা বৈষম্য নেই এ ব্যাপারে। রাস্তাগুলো সামান্য আলাদা। কেউ ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা কাজে লাগায়। কেউ কাজে লাগায় সহায় সম্বলহীন অগনন উপভোক্তামন্ডলীকে, আর কেউ কেউ কেউ এখনও ফিরি করে বেড়ায় অবুঝ শ্রেণী বিপ্লবের মায়াকাজল। যত মত তত পথ। কিন্তু মোক্ষ তো একটাই। যা আমরা বলি এবং যা আমরা করি সবই ফাঁকিতে মোড়া। ’
    বকুল গাছের ডালে ডালে কত পাখি চঞ্চল ওড়াউড়িতে ব্যস্ত এখন।

    দুপুরবেলায় খাওয়াদাওয়ার পর তার নানা অপরিচিত ভাবনার ঢেউ উঠতে লাগল। তার হাতের আঙুল নিশপিশ করতে লাগল মোবাইলের কনট্যাক্ট লিস্টে দীপঙ্কর মাইতির নামটা ছোঁয়ার জন্য। সবই তো ফাঁকিবাজি। অকারণ শূন্যগর্ভ আবেগ পুষে রেখে লাভটা কি ? শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেকে থামালেন। বিছানায় একদিকে কাৎ হয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন সুভাষ গিরি প্রবল মানসিক শ্রান্তির ভারে ক্লান্ত হয়ে।

    ফাঁকিবাজ হোক, বা না হোক স্বপ্ন দেখার লোকের অভাব নেই।স্বপ্ন ফেরি করার জন্য হাঁক পাড়তে হয় না। অকপট আবেগের ঢেউয়ে সওয়ারি হওয়ার জন্য কোথা থেকে সব উড়নচন্ডীরা ছুটে ছুটে আসে।ফাঁকিবাজ বেহিসেবীর দল।

    সকাল দশটা। রোদ্দুর জমজম করছে। বিকাশ পূণ্য পাবকশিখার মতো বীর্যবান পতাকাটা একহাতে তুলে ধরে দাঁড়িয়ে রইল।হাওয়ায় পতপত করে প্রাণবন্ত উজ্জ্বলতায় উড়ছে আগুনে নিশান।দ্রৌপদি বিকাশের পিছনে এসে দাঁড়িয়ে রইল। তার পাশে একে একে জমতে লাগল নানা বয়সী মানুষ। জমতে লাগল নারী, জমতে লাগল পুরুষ। বিকাশের কাঁধ ঘেঁসে ডান হাত মুঠো করে বাতাসে ঝাঁকিয়ে আকাশ বাতাস চিরে পুকার দিয়ে উঠল সুখিরাম — উঠুক আওয়াজ .... উঠুক আওয়াজ..... উঠুক ..... হো হো হো হো ......।

    প্রলয় এবং আরও কয়েকজন সুভাষবাবুকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। তিনি পেছন বাগে দাঁড়িয়ে সজলচোখে মনে মনে নিজেকে ঠাস করে একটা চড় মারলেন। অনুভব করলেন তার পাশে দাঁড়িয়ে কে একজন তার কাঁধে হাত দিল। বাঁদিকে চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন প্রলয়ের বাবা সৌরীন্দ্র তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনে একটুকরো প্রসন্নতা লেগে আছে। সৌরীন্দ্র বসাক নীচু গলায় বললেন— ‘ একেবারেই ফাঁকিবাজি নয়। আমরা ছিলাম, আছি, থাকব।’

    বাজারে বকুলগাছের নীচে একে একে নিশ্চিত গতিতে জমছে গুচ্ছ গুচ্ছ দুরন্ত আবেগের শ্বাস ভরা কলজেওয়ালা মানুষ।একজন দুজন তিনজন....... বহু বহুজন।
    পরেশ জানাকেও দেখা গেল ইস্কুল ছুটি নিয়ে চুপিসাড়ে ভিড়ের মধ্যে মিশে যেতে।

    ( শেষ )

    ********************************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    1 | 2
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ০১:৫৩530231
  • এই পর্ব আরও বড় হবে আশা করেছিলাম। সংঘর্ষের আখ‍্যান হবে বলে মনে হয়েছিল। ঠিক আছে। 
     
    আপনার লেখার হাত ভালো। পরের লেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
  • Anjan Banerjee | ০৪ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:০৮530234
  • অনেক ধন্যবাদ 
  • Katha Haldar | ১২ এপ্রিল ২০২৪ ০৬:৫৯530493
  • ভালো লিখেছেন।
  • Anjan Banerjee | ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ২২:২৭530584
  • ধন্যবাদ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় প্রতিক্রিয়া দিন