"জিন্দেগি বড়ি হোনি চাহিয়ে, লম্বি নেহি"। সত্তরের দশকের সুপারহিট সিনেমা "আনন্দ" - এর সেই বিখ্যাত সংলাপ। সেই যুগের স্বপ্নের নায়ক রাজেশ খান্না এক উঠতি নায়ক অমিতাভ বচ্চনকে বলছেন সেই সংলাপ। চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচয়িতার নাম গুলজার। "যব তক জিন্দা হুঁ তব তক মরা নেহি, অর যব মর গ্যায়া তো শালা ম্যায় নেহি, তো ডর কিস বাত কা?" সিনেমার প্রতিটি সংলাপ মনে রাখার মতো এবং সংলাপের পেছনের দর্শন সিনেমাটিকে একটি অনন্য পর্যায়ে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ব্যক্তিগতভাবে উপরিউক্ত সংলাপ দুটির সাথে আমার নিজস্ব জীবন - দর্শন মিলে যায়, তাই "আনন্দ" আজও আমাকে টানে।
আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যে কোনো কারণেই হোক, জীবন সম্পর্কে সঠিক কোনো দর্শন মননে অঙ্কুরিত হয়না। সেটা সমাজ ব্যবস্থার ত্রুটি হতে পারে অথবা শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি হতে পারে। একটি প্রাথমিক স্কুলের বাচ্চাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, তার জীবনের লক্ষ্য কি, তাহলে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর পাওয়া যায় বড় হয়ে ভালো চাকুরী করবে, নয় ইঞ্জিনিয়ার হবে, নয় ডাক্তার হবে ইত্যাদি। তারমানে নিশ্চিত ভবিষ্যত বেছে নিতে চায় সে। এরপরের ভাবনাগুলোও তারা মুখস্তের মত বলে দেয়, ইঞ্জিনিয়ার বা ডাক্তার হয়ে বা চাকুরী করে অনেক অর্থ রোজগার করবে, বাড়ী - গাড়ী - ব্যাংক ব্যালেন্স, নিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা। কিন্তু এতসব করে কি হবে? জীবনের কোনো নির্দিষ্ট যাপন পদ্ধতি কি তার মননে তৈরী হয়েছে? সারাদিন তো সে নিশ্চয়ই চাকুরী করবে না, সারাদিন ধরে তো সে নিশ্চয়ই টাকা গুনবে না। তাহলে কিভাবে যাপিত হবে তার জীবন?
এখানে একটা অনুগল্পের উল্লেখ করতেই হয়। ছেলে অনেক বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছিল বলে মা বকাবকি করছিলেন। এত বেলা অব্দি ঘুমাচ্ছিস, উঠে পড়াশুনা কর, ভবিষ্যত তোর অন্ধকার ইত্যাদি। ছেলে তার মাকে বললো, পড়াশুনা করে কি হবে? মা উত্তর দিল, ভালো চাকরি করবি, অনেক অর্থ রোজগার করবি। এবার ছেলে বললো, অনেক অর্থ রোজগার করে কি হবে? মা এবার উত্তর দিল, নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারবি, নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারবি। ছেলে তখন উত্তর দিলো, তাহলে এখন আমি কি করছি মা? নিশ্চিন্তেই তো ঘুমাচ্ছি। জীবন দর্শন এই গল্পে ঘেঁটে ঘ হয়ে গেছে। আসলে বহুকাল থেকেই আমাদের জীবন দর্শনে আত্মিক উন্নতি, গুণগত উন্নতির চর্চা ফিকে হয়ে গেছে। নিতান্তই স্থুলবাদী, ভোগবাদী চর্চার আকর হয়ে পড়েছে আমাদের জীবন দর্শন।
আসলে জীবনের গুণগত আর পরিমাণগত উদ্দ্যেশ্য, যাপন পদ্ধতি, দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা, কিন্তু সেটা আমাদের শেখানো হয়না। আমরা যেটা শিখি সেটা হলো, অর্থ রোজগার করতে হবে অনেক, তাহলেই সুখী জীবন যাপন করা যাবে। নাহলে সব ফক্কা। অর্থের সাথে তো ঘর করা যায়না, সারাদিন কেউ কাজ করে না, সারাদিন কেউ অর্থ রোজগারও করে না। জীবনে গুণগত যাপন পদ্ধতিটা কি? সেটা আমরা জানিনা। আশি, একশো বছর বেঁচে থেকে লাভ কি, যদি না বাঁচার রসদ থাকে? যদি না সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যায়? এই সুস্থ কথার অর্থ আমরা বুঝি রোগভোগহীন অবস্থা। কিন্তু এই সুস্থ কথার সঠিক অর্থ হলো সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি। গুণগত উৎকর্ষের সাথে বেঁচে থাকা। উৎকর্ষতার অভাবের কারণেই জীবন আমাদের আলুনি লাগে। ইউরোপ, আমেরিকার জীবন দর্শনের সাথে আমাদের জীবন দর্শনের পার্থক্য এখানেই। জীবনের পরিমাণগত উদ্দ্যেশ্য যেগুলো তার প্রতিটি ক্ষেত্রেই সময়সীমা নির্দিষ্ট থাকে। আমরা সমাজকে সেইভাবেই বেঁধে রেখেছি। স্কুল, কলেজের ডিগ্রী একটা নির্দিষ্ট বয়সের মধ্যে শেষ করতে হয় নইলে চাকুরীর বয়স পেড়িয়ে যায়, একটা বয়স অব্দি চাকুরী করা যায় তারপর অবসরের বয়স চলে আসে। একটা বয়স অব্দি শারীরিক কর্মক্ষমতা থাকে তারপরে বার্ধক্য আসে। অর্থ রোজগারের জন্য দিনের আট থেকে দশ ঘণ্টা সময় সীমিত, ঘুমের জন্য ছয় থেকে আট ঘণ্টা সময় সীমিত, সংসারের বিভিন্ন কাজের জন্য তিন থেকে চার ঘণ্টা সময় সীমিত। এর বাইরেও দুই থেকে সাত ঘণ্টা সময় পাওয়া যায় দিনে। সেই সময়ের যাপন পদ্ধতি আমরা শিখি না। আবার অভিনেতারা যেমন অভিনয় করতে করতে স্টুডিও বা মঞ্চেই নিজের জীবনের শেষ মুহূর্তটা দেখতে চান তেমনি আমরাও চাই জীবনের শেষ মুহূর্ত অব্দি অর্থ রোজগার করতে, বার্ধক্যের গ্রাসে না পড়তে। দু একজন ছাড়া এই অভিলাষ সকলের পূর্ণ হয়না। ফলে স্পষ্টতই আমাদের জীবন দর্শনের কারণেই আমাদের জীবন গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট হয়ে ওঠে না। গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট জীবনের স্থায়িত্ব আশি, একশো বছর না হলেও চলে। কারণ জীবন গুণগতভাবে উৎকৃষ্ট না হলে সেই জীবনের কোনো দাম নেই, নিজের কাছে, সংসারের কাছে বা সমাজের কাছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।