২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, 'ইকো ফিল্ম' এর পরিবেশনায়, এই ছায়াছবিটি নির্মিত হয় এবং মুক্তি পায়। আমি গতকাল ছবিটি, মুক্তি পাওয়ার নয় বছর পরে, ইউটিউবে প্রথমবার দেখি। বাংলায় আজকাল যে সব ছবি হচ্ছে, তার সংখ্যা নগণ্য এবং যা হচ্ছে তা দক্ষিণী অনুকরনের ব্যার্থ প্রয়াস। অবশ্য এই ছবিতেও তার রেশ থেকে পরিচালক অনিকেত চট্টোপাধ্যায় একেবারে মুক্ত হতে পারেন নি। পুলিশ অফিসারের নাম রজনীকান্ত রেখেছেন। নায়ক এক সাথে দশজনকে মেরে তক্তাপাট করার পরে, 'বাংলা ছবির দেবের মত' একদম, এ কথাও ডায়ালগে রেখেছেন। আর অমন মারামারি শুধু দক্ষিণেই সম্ভব হয়। তবুও এই ছবি একটু ট্র্যাডিশনাল।
যাই হোক, গল্পের প্লট পুরোন হলেও, অভিস্থাপনায় এবং অভিনয়ে - দর্শককে, প্রথম থেকেই ছবির প্রতি মনোযোগী করে তোলে। গল্পের শেষে কি হবে, সেটা সকল দর্শকের জানা, কিন্তু পরিচালক কেমন ভাবে তা করেন সেটাতে, সকলকে সাথে জুড়ে নিতে পেরেছেন। স্বাভাবিক জীবন যাপনের যা কিছু প্রসেস হয়, বিশেষত: এই সিনেমার পরিবেশে পড়লে, তা নিয়ে খুঁটিয়ে বিচার করা অপ্রোজনীয়, কারণ সিনেমার ভেতরে একটু আধটু অতিরিক্তের ছাড় দিতেই হয়, নচেত গল্প এগোয় না। হাতে তো দু-ঘন্টা মাত্র। চব্বিশ ঘন্টার অবস্থাকে দু ঘন্টায় দেখাতে গেলে, সেই সব অতিরঞ্জন সহজ ভাবেই ইগনোর করতে হয়।
উপগুপ্ত (অর্জুন চক্রবর্তী, এত ছোট ছিল, যে দূর্গেশগড়ের সাথে মেলাতেই পারছিলাম না), জয়েন্ট পরীক্ষায়, মেডিকেলে ১৭-তম স্থান পেয়েছে - কিন্তু সে ডাক্তারী পড়তে একেবারেই চায় না। তার লক্ষ্য এবং একমাত্র স্বপ্ন, গান কবিতা গীটার। বব ডিলন আর অঞ্জন দত্ত তার আইডল। বাবা(শঙ্কর রায়চৌধুরি) রঙের ব্যাবসা করেন, রেডিও সারান শখে। তার শালা মানে উপগুপ্তের মামার ভূমিকায় বিশ্বনাথ বসু চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। মামাকে ডেকে আনানো হয়েছে তার গ্রামের জমি জিরেত থেকে, ভাগনেকে রাজী করানোর জন্য - যাতে সে মেডিকেল পড়ে। বাবা-মা- মামার এই মিলিত আক্রমণ (কাউন্সেলিং) থেকে বাঁচার জন্য উপগুপ্ত, বাড়ির চাকরকে ঘুষ দিয়ে, চুপচাপ পালিয়ে যায়, শিলিগুড়ি - বন্ধুর বাড়ি।
মিমি (অমৃতা চট্টোপাধ্যায়) প্রেসিডেন্সি কলেজে ইকনমিক্স অনার্স নিয়ে পড়ে। দুম করে তাদের বাড়ির সাবেক জ্যোতিষি নিদান দেয়, চারদিনের মধ্যে এই মেয়ের বিয়ে না দিলে, বৈধব্যই বিধাতার বিধান। মিমির বাবা আছে। জয়েন্ট ফ্যামিলি। তার কর্তা হলেন মিমির জ্যেঠুমণি। তার কথাই এ বাড়ির শেষ কথা। তাই তিনি তারই ছেলেবেলার বন্ধু, তার ছেলের (যে না'কি অক্ষরে অক্ষরে কোলা ব্যাং) সাথে মিমির বিয়ে একেবারে পাকাপোক্ত করে ফেলেন। সেই বিয়ের রাতে, সকলে যখন বর নিয়ে ব্যাস্ত, মিমি বাড়ির ব্যালকনি থেকে, শাড়ি বেঁধে পালিয়ে যায়।
এই পর্যন্ত একেবারে স্বচ্ছ সুন্দর ট্র্যাডিশনাল বাংলা বই দেখছিলাম। ভালো লাগতে শুরু করেছিল।
লোকাল পুলিশ, থানা, কলকাতা পুলিশের ডিজি (খরাজ মুখার্জী) সকলকে ধমক ধামক দিয়ে খোঁজ পাঈয়া গেল যে, মিমি শিলিগুড়ি পালিয়েছে। ওদিকে উপগুপ্তর বাড়িতে চাকরটাও বলে দিয়েছে, বাবু শিলিগুড়ি গেছে বন্ধুর বাড়ি। মামাবাবুর ব্যাগ নিয়ে। ওই ব্যাগে আড়াই কোটি টাকার মহাকালী লটারীর টিকিট আছে। উপগুপ্ত এই সব জানে না। মামার ব্যাগ সুবিধামত লেগেছে, দুএকটা জামাপ্যান্ট ভরে সে তো পালিয়েছে। কিন্তু মামাবাবুর ব্যাগটা চাই। ফার্স্ট প্রাইজটা তার কপালে লেগে গেছে যে।
জ্যেঠুমণি, মিমির বাবা, কোলা ব্যাং জামাই আর সেই জ্যোতিষী এই চার জনের দল শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। বাড়ির জীপ নিয়ে।
উপগুপ্তের বাবা, মামা আর চাকর বাবাজীও (ছবিতে নাম ভূমিকায় লামা) শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়। বাইকে তিনজন। দুজনের মাথায় নর্মাল হেলমেট, লামার মাথায় অ্যালুমিনিয়াম হাঁড়ি। ভাগনে এবং লটারি টিকিট দুটোই চাই।
পুলিশের ডিজি-ও বেরিয়ে পড়েন - শিলিগুড়ি। পুলিশের গাড়িতে।
এদিকে এক ডাকসাইটে ক্রিমিনাল, ত্রিশটি দেশের পুলিশ যাকে খুঁজছে, সেই রাতে সেও শিলিগুড়ি পালাচ্ছিল। তার ছবি আর ছেলে মেয়েদের ছবি সব থানায় পাঠানো হয়েছে। কিন্তু ডি জি মশাই, ভুল করে, ক্রিমিনালের ছবির বদলে, স্টুডিওতে নিজের ভিলেন সেজে তোলা ছবি, তার অফিসারকে দেন, থানায় থানায় পাঠাতে। সেই অফিসার সেটা বলার চেষ্টা করেও বলে উঠতে পারে নি।
এর পরের ইঁদুর আর বেড়ালের খেলা আর বিস্তর ভুল বোঝাবুঝির হ্যাপা সকলকেই পোয়াতে হয় - যা সিনেমাহলে নি:সন্দেহে হাসির হুল্লোড় তুলেছে। আর তা শিলিগুড়ি ঢোকার আগেই চেকপোস্টে ঘটে - যার ইনচার্জ ছিলেন রজনীকান্ত (কাঞ্চন মল্লিক)।
ছবিটি মোটের ওপর ছিমছাম এবং পরিষ্কার। শেষটাও যুতসই হয়েছে। একবার অতি অবশ্যই বসে দেখা যায়, ভালোই লাগবে।
এবারে একটু ত্রুটিগুলো বলি।
যে ডাকসাইটে ক্রিমিনালকে নিয়ে লালবাজার কিংবা "র" এত চিন্তিত ছিল, মায় কলকাতার ডি জি পর্যন্ত, তার সম্বন্ধে ছবিতে কোন কিছু নেই। স্টুডিওতে তোলা ভিলেন মার্কা ডিজি-র ছবি, আর তার পরের কাটেই, "র"- এর খামে ভরা ক্রিমিনালের ছবি হাতে আসা - এইটে একটু কষ্ট কল্পিত। দ্বিতীয়টা ঘটলেও, প্রথমটা বড় বেশি প্ল্যানড সমাপাতন মনে হয়েছে।
যাত্রাপার্টির বাস সার্চ করার সময়, অফিসার নিজে না উঠে, একটা মাতালকে পাঠালেন চেক করতে। কেন? সে ছেলে মেয়ে দুটোকে চিনতে পারবে বলে। এদিকে, যাত্রাপালার লোকজন তাদের হুলিয়াই বদলে দিয়েছে, বাসের মধ্যেই - এটা পুলিশ ধরতে পারত, মাতাল নয়। অবশ্য গল্প তাহলে এগোত কি করে?
উপ আর মিমি গ্রামে দুদুটো বাড়িতে ঢুকলো। সাইকেল চুরি করল, গুন্ডাদের মুখোমুখি হয়ে, তাদের মেরে পাট করে, তাদের গাড়ি চুরি করলো। সহজেই। এগুলি সবই গল্পের খাতিরে। ধানের গোলার পাশে শুয়ে স্বপ্নের দৃশ্যটা বেশ লম্বা (চার বা পাঁচ বছরের লম্বা স্বপ্ন, কতগুলি বাচ্চা মিমির কোলে দেখানো হয়েছে, মনে আছে কারো)। সকালে গ্রামের বয়স্করা জাগার আগে কচি কচি শিশুরা উঠে পড়ে, ওদের দুজনকে দেখতে পায়। কোন চেঁচামিচি করে না। স্বর্গীয় দৃশ্য। কেষ্ট ঠাকুর রূপী মিমি, আবার ময়ূরের পালকটাও একটি বাচ্চাকে দান করে যায়,যেতে যেতে। গোবিন্দ, গোপাল।
এর পরের দৃশ্যে, রাস্তায় উঠে এসে, যখন পুলিশের(খরাজ বাবুর হাতে) কাছে, মিমিরা ধরা পড়ে যায়, তখনও ওরা বা খরাজ বাবু কলকাতা না ফিরে, বা ওদের বাড়িতে ফোন না করে, আবার কেন শিলিগুড়ির পথে পা বাড়ালেন, সেটা বোধগম্য হয় না।
আর এই সম্পূর্ণ ছবিটার আরো দুটো রহস্য আছে, যা পরিচালক একেবারেই সামনে আনেন নি।
১. আমার সাথে ওনার সম্পর্কটা জানেন তো? হাফ প্যান্ট পড়িয়ে.... বা মাথা ন্যাড়া করে আলখাল্লা পড়িয়ে গঙ্গার ধারে ওয়েটিং লিস্টে..... ইত্যাদি। এখন কথা হচ্ছে সেই "উনি" - টা কে? ডিজি-র ওপরের লেভেলের কেউ হবেন! আই জি?
২. একজন মহিলা, যিনি ফোনে ডিজি-কে এমন চমকালেন, ক্যানিং-এ হাফু পড়ে বাগদার মীন ধরবার কাজে লাগিয়ে দেবেন বললেন। কিন্তু সেই মহিলা কে? মুখ্যমন্ত্রী? আর তার কাজ তো খরাজ বাবু করলেনই না৷ ক্রিমিনাল তো শিলিগুড়ি পৌঁছে গেল? এটা কি হল?
যাই হোক, বাংলা সিনেমা এমনিতেই চলে না। এই ছবিটি চলুক, আমি তাই চাই। যদিও প্রায় দশ বছর পরে, এই রিভিউ এর কোন অর্থই নেই। যদি আমার মত চল্লিশ বছর পরে, কলকাতায় ফিরে আসা লোকজন থাকেন, যারা দেখেন নি, এই রিভিউ তাদের ছবিটি দেখার উৎসাহ জাগানোর জন্য।
অভিনেতারা সকলেই দারুণ অভিনয় করেছেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
কেবল প্রেম নকুলদানা গানটির সিকোয়েন্স এবং গানটি না থাকলে, আরোও সুন্দর হত। তবে কমার্সও তো দেখতে হবে। তাই না?