এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ইউরোপের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান!! পিটার হুডিস পাঠ

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২১ জুন ২০২৩ | ৪৮৪ বার পঠিত
  • পিটার হুডিসের বিখ্যাত প্রবন্ধ মার্ক্স এমং মুসলিমস পড়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রক্ষিতে সত্তরের বিখ্যাত স্লোগানটা আর একবার নতুন করে ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম। সত্তরে বলা হয়েছিল চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যন - চীনের পথ আমাদের পথ। তো উনবিংশ শতকে ওটা ছিল ইউরোপের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান - ইউরোপের পথ আমাদের পথ। শুনতে ঠাট্টা মনে হলেও শুধু কলোনির জয়গান গাওয়া ইউরোপীয় বা তাদের চেলা চামুণ্ডারা নয়, অত্যন্ত প্রগতিশীল মনীষার ভাবনাটা এরকমই ছিল। পিটার হুডিস তাঁর প্রবন্ধে এসবের খানিকটা ধরতাই দিলেন। আলো ফেললেন এ তাবৎ অনালোকিত অরণ্যে। জানা গেল হেগেল ভালো রকমের ইউরোসেনট্রিক ছিলেন। অবিশ্ব ইউরোপীয়করণ চাইতেন। এসিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকশনের তত্ত্ব লেখার সময় মার্ক্সও যথেষ্ট ইউরোসেনট্রিক। মনে করতেন কলোনির শাসনের ঐতিহাসিক প্রগ্রেসিভ ভূমিকা আছে। আঠারোশো পঞ্চাশের শেষ থেকে তিনি ইউরোপের বাইরের সোসিও ইকোনমিক ফর্মেশনগুলো সম্পর্কে অবহিত হতে শুরু করেন। জীবনে শেষে ১৮৮২তে দুমাস এ্যালজিয়ার্সে থেকে মুসলিম বিশ্ব/ইসলামী সংস্কৃতি সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল হন। কমিউনিজমের প্রতিপাদ্য উচ্ছেদকারীর উচ্ছেদ- নেতির নেতিকরণের পদ্ধতি সূত্রায়ণের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এটা ইসলামী দার্শনিক ইসমাইলি শিয়াপন্থী পারস্যের আবু ইয়াকুব আল সিজিস্তানি দশম শতকেই অন্য প্রেক্ষিতে সূত্রায়ণ করেন। ইনি আবার নিও প্লেটোনিক দার্শনিক প্লটিনাস প্রমুখের প্রভাবে নেতিকরণের পদ্ধতি ভায়া নেগেটিভা আয়ত্ত করেন। তাছাড়াও ইউরোপের যুক্তিবাদ যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত এক প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত এই ধারণা সত্যের অপলাপ । আল ফারাবি, ইব সিনা, এ্যাভেরস - ইবন রশদ প্রমুখের প্রভাব ইউরোপে যথেষ্টই ছিল। রেনে দেকার্তের 'আহৃত জ্ঞানমালা সংশয়ের বাণবিদ্ধ' করার তত্ত্বায়ন ইসলামী দার্শনিক হামিদ মুহম্মদ আল ঘাজালির কনফেশনের প্রত্যক্ষ প্রভাবে হয়। এ বিষয়ে বিস্তারে কাজ করেছেন ক্যাথরিন উইলসন তাঁর মর্ডান ওয়েস্টার্ন ফিলসফি বইতে।

    মার্ক্স ইউরোপীয় মানক ব্যবহার করে অ-ইউরোপীয় ভারত ও চীনের প্রাসঙ্গিক বিশ্লষণ ও এশিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকসনের উথ্থাপন করেন এ সমালোচনা করেছেন নেগ্রি ও হার্ড্ট এম্পায়ার বইতে। তাঁদের প্রশ্ন ইউরোপের পথই কেন ভারতের বা চীনের পথ হবে?( ইউরোপের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান!!) কিন্তু ওনারা শেষ জীবনে ইসলামী বিশ্ব ও অ-ইউরোপীয় দেশ বিষয়ে মার্ক্সের হাজার হাজার পাতা নোটগুলো খেয়াল করেন নি। অবশ্য ওই বিপুল অধ্যয়নের সাবুদ বই আকারে পাওয়া যায় না। ওই নোটসের পাহাড় থেকে মার্ক্সের কলোনিয়ালিজম, প্রযুক্তিতে পেছিয়ে পড়া দেশে জমির গোষ্ঠী মালিকানার ধরণ এসব নিয়ে অধ্যয়নের পদ্ধতি ও ধরণধারণের আঁচ পাওয়া যায়। ওনার অনেক ধারণাই - যেমন ভারতে পাশ্চাত্য কলোনিয়ালিজম সংক্রান্ত সদর্থক ধারণা আমূল বদলে যায়। ১৮৮৯ সালে লেখা নোটবুকস অন কোভালেভস্কি লরেন্স ক্রাডারের লেখা বই দ্য এশিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকশনের এ্যানেক্স হিসেবে জার্মান ভাষায় বেরয়। কোভালেভস্কির বই দ্য কমিউন্যাল পজেসন অফ দ্য ল্যান্ড বইটা সম্পর্কে এই নোটগুলো। লেখকের সঙ্গে যে বিষয়ে মার্ক্স একমত হন যে ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ যথাক্রমে উত্তর ভারত আর এ্যালজিরিয়ায় যৌথ মালিকানা ভিত্তিক দেশীয় ভূমি ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ঘৃণ্যতম কাজ করল। এর ফলে ওই সব দেশের সমাজ জীবনে নাভিশ্বাস উঠল এ ব্যাপারেও একমত হলেন মার্ক্স। “এদের কায়দার রকমফের হলেও, উদ্দেশ্য একটাইঃ সম্পত্তির দেশীয় যৌথ মালিকানার ধ্বংস সাধন (আর তার প্রগতিশীল রূপান্তরের সম্ভবনার) যাতে সম্পত্তিকে অবাধে কেনাবেচার বস্তুতে রূপান্তরিত করা যায় আর এই ভাবে সব যাতে ফরাসি ( বা ব্রিটিশ) উপনিবেশবাদীদের খপ্পরে পড়ে।” দ্বিতীয়ত, মার্ক্স দেশীয় যৌথ মালিকানাকে ভালো মনে করতেন কারণ সেটা ভবিষ্যতের উন্নত সামাজিক বিকাশের সহায়ক হতে পার। অর্থাৎ পূজিঁবাদী বিকাশের যন্ত্রণাময় পর্যায়কে এড়িয়ে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রার সহায়ক হতে পারে সম্পত্তির যৌথ মালিকানার দেশীয় ব্যবস্থা। মার্ক্স বললেন কোভালেভস্কি একদম ঠিকঠাক ভাবে ইংরেজদের সমালোচনা করছেন যে রাজা-বাদশাহর কখনই জমির আসলি মালিক ছিল না। আসলে এটা হলে ব্রিটিশরা তাদের হটিয়ে সব যৌথ সম্পত্তিরও আসলি মালিক বনে যাবে (ব্রিটিশরা এটাই করে ফরাসি ফিজিওক্র্যাটদের বুদ্ধি ধার করে)। এই মিথ্যে ধারণাটার প্রচার করা হয় ইঙ্গ-ফরাসি জঘন্য কলোনিয়াল স্বার্থ চরিতার্থ করতে। 

    কোভালেভস্কির সঙ্গে আর একটা ব্যাপারে একমত হলেন মার্ক্স যে ইউরোপীয় মানদণ্ড দিয়ে চোখ বুজে অ-ইউরোপীয় সমাজের মূল্যায়ন করা যাবে না । 
    কোভালেভস্কির সঙ্গে মার্ক্স দুই মত হচ্ছেন মোঘল ভারতে সামন্ততন্ত্রের উপস্থিতি সম্পর্কে। কোভালেভস্কি বলেছিলেন মুসলিম শাসনের সময় থেকেই (দিল্লী সুলতানশাহী -ইলতুতমিস) উত্তর ভারতে সামন্ততন্ত্রের যাত্রা শুরু। ইলতুতমিসের সময় থেকে মুসলিম সৈন্য, সেপাইসালার আর অভিজাতদের মধ্যে ইকতা অর্থাৎ পদ অনুযায়ী ছোট-বড় জমি খণ্ড বিলোন হত। মার্ক্স বললেন এটা ইকতা প্রাপক মুসলমানদের জন্য ঠিক যুক্তি কিন্তু হিন্দুদের জন্য আংশিক প্রযোজ্য। ইন্দো-মুসলিম শাসন কালের সামন্তবাদের অস্তিত্ব নিয়ে মার্ক্সের বেশ কিছু আপত্তি ছিল। ইকতা, ক্ষমতা ভাগাভাগির নানান প্রথা এইসবের মাধ্যমে কতটা পাশ্চাত্য ধাঁচের সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠা হচ্ছে তাতে উনি সন্দেহ প্রকাশ করছেন। মার্ক্স বলছেন যে কোভালেভস্কি অনেক কিছুর মতো ভুলে গেছেন ভারতে ভূমিদাস প্রথা নেই। সেটা কিন্তু সামন্ততন্ত্রের অন্যতম পূর্ব শর্ত। ইউরোপের মতো ভারতের কোথাও জমি খুব কিছু আভিজাত্যের প্রতীক - প্রাইজড অবজেক্ট নয় যে সাধারণ মানুষ তার অধিকার থেকে চির বঞ্চিত - এ ছিল তাঁর মত। উত্তরাধিকার প্রথায় ভারত ইউরোপের থেকে আলাদা ছিল। “ভারতীয় আইনে শাসন ক্ষমতা ছেলেদের মধ্যে ভাগ হয় না, এইভাবে ইউরোপীয় ধাঁচায় সামন্ততন্ত্র প্রতিষ্ঠা বাধা পায়” বলছেন মার্ক্স।

    শেষ জীবনে মার্ক্সের অপ্রকাশিত অগ্রন্থিত হাজার হাজার পাতা নোটসের মূল বিষয়ই ছিল অনুন্নত বিশ্বের সমস্যাবলী। সেসব অধ্যয়ন করে তিনি তৎকালীন কলোনির রমরমার যুগের মূল ইউরোসেন্ট্রিক প্রতিপাদ্য থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর যৌবনের ভারতীয় সমাজসহ অন্য অ-ইউরোপীয় সমাজ সম্পর্কে ইউরোসেন্ট্রিকতার অবসান হয় যদিও এখনও সেসব নেহাতই আজানাই রয়ে গেছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন