এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আগ্রাসী হিন্দুত্ব: অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ # পর্ব ১

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ মে ২০২৩ | ১১২৫ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • গত কয়েক দশক ধরে কেন্দ্রীয় ভাবে এবং একাধিক রাজ্য স্তরে গেরুয়া প্রভাব ও শাসনের বিস্তারের ফলে হিন্দুত্ববাদ তথা হিন্দু ধর্মের ক্রমশ প্রকট আগ্রাসী রূপ সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করা সমাজ কর্মী ও ভাবুকদের তরফে এই মুহূর্তের এক আদর্শগত দায় হয়ে পড়েছে। সাধারণভাবে আমরা হিন্দুধর্ম বলতে যা বুঝি এবং দেখি—ধর্ম সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী তর্ক আপাতত পাশে সরিয়ে রেখে বলছি—তার মধ্যে সাধারণত আগ্রাসক মনোভাব বা ভূমিকা খুব একটা দেখা যায় না। বরং এক বহুত্ববাদী উদার পরমত সহিষ্ণু ন্যূনতম আচার ভিত্তিক ধর্ম হিসাবেই এর পরিচয়। এর মধ্যেকার জাত ব্যবস্থার কঠোরতার মধ্যেই উপাস্য শৈথিল্য এক রকমের স্থিতিস্থাপক সামাজিক সম্পর্কের জন্ম দেয়। তার ভালো মন্দ এবং তার সামাজিক ঐতিহাসিক কার্যকারণ নিয়ে আলোচনা অবশ্যই চলতে পারে, চলা উচিতও—কিন্তু তার নিরীহ চেহারা নিয়ে বিতর্কের বা মতান্তরের সুযোগ এমনিতে খুব বেশি নয়।
     
    ঠিক এই জায়গাটাই সঙ্ঘ পরিবার এবং বিজেপি ১৯৯০-এর দশক থেকে তার রাজনৈতিক ক্রম-উত্থানের সুযোগ নিয়ে বেশ দ্রুত পালটে ফেলেছে। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি মন্দিরের নামে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার পর অনেকে বোধ হয় ভেবেছিলেন, এবার ওদের সুবুদ্ধির উদয় হবে এবং ধীরে ধীরে ধর্মীয় উন্মাদনার আড়ালে এক ধরনের গায়ের জোরের সংস্কৃতি যেটা মাথা তুলছিল তাকে ওরা নিয়ন্ত্রণ করে নেবে। মসজিদ ভাঙার নায়কদের অন্তত দুজন—লালকৃষ্ণ আদবানি এবং যশবন্ত সিনহা—যখন প্রায় রাজনৈতিক বাণপ্রস্থ নিয়ে সঙ্ঘের সিলেবাসের বাইরে গিয়ে মহম্মদ আলী জিন্নার সেকুলার অবস্থানের খোঁজে ব্যাপৃত হলেন, এরকম একটা বিভ্রম অনেকের মধ্যেই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু ভয়াবহ গুজরাত দাঙ্গার মধ্য দিয়ে নরেন্দ্র মোদীর এক ভয়ঙ্কর হিংস্র সাম্প্রদায়িক নেতা হিসাবে আবির্ভাব এবং ২০১৪ পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় শাসন ক্ষমতায় বসে আগ্রাসী হিন্দুত্বকে ক্রমাগত ধুনো দিয়ে চলা দেখে এখন নিশ্চয়ই তাদের ভুল ভেঙে গেছে। স্বভাবতই এই পরিস্থিতিতে একটা প্রশ্ন দেশের সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে, সঙ্ঘ পরিবার হিন্দুধর্মের এমন একটা আগ্রাসী আকার দিতে পারল কেমন করে? এ কি নিছকই ওদের রাজনৈতিক কলাকৌশল, নাকি, হিন্দুধর্মের স্বভাবের মধ্যেই এরকম একটা সুপ্ত বৈশিষ্ট্য আগে থেকেই ছিল, যা চারদিকের পরিবেশের চাপে নিজেকে খানিক গুটিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু এখন যাকে বিজেপি আরএসএস খুঁচিয়ে আবার সক্রিয় করে তুলছে?
     
    সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে তাই আমাদের এক প্রকার বাধ্য হয়েই হিন্দুধর্মের ইতিহাসে অবগাহন করতে হচ্ছে। নীচের অনুচ্ছেদগুলিতে সেই চেষ্টাই করব।

    || ১. হিন্দু নামে কোনো ধর্ম ছিল না ||
     
    প্রথমেই একটা কথা বলে নেওয়া দরকার, ভারতবর্ষের ইতিহাসে অতীতে হিন্দুধর্ম নামে কোনো ধর্মের অস্তিত্ব ছিল না। বর্তমান হিন্দুধর্ম যে ঐতিহ্য বহন করছে, প্রাচীন কালে তার পরিচয় ছিল সনাতন ধর্ম নামে। ঐতিহাসিকরা তাকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মও আখ্যা দিয়ে থাকেন। তবে সেও কোনো একটাই মাত্র ধর্মীয় বিশ্বাস আচার প্রথা প্রকরণের সমষ্টি হিসাবে বিদ্যমান ছিল না। প্রাচীন কোনো সংস্কৃত শাস্ত্রে, শ্রুতি স্মৃতি পুরাণে, কাব্যে নাটকে, হিন্দু নামক কোনো ধর্মের বা ধর্মীয় পরিচিতির উল্লেখ দেখা যাবে না। প্রাচীন ভারত ভূখণ্ডের বিভিন্ন অংশে কোথাও সে শাক্ত, কোথাও শৈব, অন্য কোথাও বৈষ্ণব, আর এক জায়গায় গাণপত্য, ইত্যাদি অসংখ্য নামে এবং সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। এছাড়াও ছিল বৌদ্ধ ও জৈনদের নানা শাখা প্রশাখা। সেই সব গোষ্ঠীর প্রত্যেকের উপাস্য দেবতা, উপাসনা পদ্ধতি প্রকরণ, মন্ত্রতন্ত্র, নৈবেদ্য, বিধিনিষেধ, খাদ্যাখাদ্য বিচার, বিবাহ প্রকরণ, মৃতের সৎকার প্রথা, ইত্যাদি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। ঊনবিংশ শতাব্দে যুক্তিবাদের দিশারী অক্ষয়কুমার দত্ত যখন এরকম বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের পরিচিতি সংগ্রহ করতে দেশ ব্যাপী এক দীর্ঘমেয়াদি সমীক্ষা চালিয়েছিলেন, এবং ১৮৭২ ও ১৮৮৩ সালে দুই খণ্ডে “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” শীর্ষক পুস্তকাকারে সেই সমীক্ষার বিবরণ সবিস্তারে প্রকাশ করেছিলেন, তাতে তিনি সর্ব মোট ১৮২টি এরকম ধর্মীয় সম্প্রদায়ের হদিশ পেয়েছিলেন এবং নথিভুক্ত করেছিলেন। [দত্ত ১৯৮৭ এবং ১৯৯০] তার মধ্যে হিন্দু নামে কোনো উপাসক গোষ্ঠীর উল্লেখ ছিল না।
     
    তাহলে হিন্দু ধর্মের এই নাম এল কোত্থেকে? শাক্ত শৈব বৈষ্ণব আদি সম্প্রদায় সমূহ আপন আপন পরিচিতি কার্যত হারিয়ে সকলেই এক হিন্দুধর্মের পতাকাতলে সমবেত হল কীভাবে এবং কবে থেকে?
     
    সেও এক চিত্তামোদক ইতিহাস।
     
    একটা বহুল প্রচলিত গল্প—যা দীর্ঘ এবং পৌনঃপুনিক ব্যবহারে প্রায় ঐতিহাসিক সত্যের আকার প্রাপ্ত হয়েছে—হচ্ছে এরকম: ইরান থেকে যারা এক কালে ভারতে আসা যাওয়া করেছে, তারা ‘স’-কে ‘হ’-এর মতো করে উচ্চারণ করত। তাদের কাছে সিন্ধু নদীর পূর্ব তটের সকলেই ছিল সিন্ধু, ওরফে, হিন্দু। তার থেকেই ভারতীয়দের হিন্দু পরিচয় জন্ম নিয়েছিল। স্বামী বিবেকানন্দের লেখাতেও এরকম বক্তব্য আছে।
     
    যাঁরা এই ‘স’-কে ‘হ’ গল্পটির স্রষ্টা, প্রচারক এবং গ্রাহক তাঁরা সকলেই খুব অদ্ভুতভাবে কয়েকটা অত্যন্ত সুপরিচিত তথ্যকে অনায়াসে অগ্রাহ্য করে যেতে পেরেছেন। যাদের দেশের নাম পারস্য, ভাষা হচ্ছে পার্শি বা ফারসি, যাদের একটা প্রদেশের নাম সিরাজ, একটা বিখ্যাত নগরের নাম বসরা, যাদের রাজাকে বলা হত শাহ, যাদের ভাষায় শহর, শরম, শাবাস, শাদি, শিকস্ত, শিকার, শের, সওগাত, সওদাগর, সওয়ারি, সবুজ, সরখেল, সরকার, সর্দার, সরেজমিন, সরঞ্জাম, ইত্যাদি শব্দসকল সগৌরবে আছে (আমি শুধু মাত্র সেই সমস্ত স-বাহক শব্দকেই স্মরণ করছি, যারা আবার আমাদের সুপ্রিয় বাংলা ভাষাতেও নিত্য ব্যবহৃত ও সুপরিচিত), যে দেশের খুব সাম্প্রতিক কালের নারীমুক্তি আন্দোলনের প্রথম শহিদের নাম মাহসা আমিনি, সেই আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ চলাকালীন সদ্য যে খেলোয়াড়কে ইরানের মৌলবাদী শাসকরা মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে তার নাম আমির নাসের আজাদিনি, সেই ইরানিরা নাকি সেকালে উচ্চারণ করতে না পেরে ‘স’-কে ‘হ’ বলত! সিন্ধু উচ্চারণ করতে গিয়ে তাদের ঠোঁট জিহ্বা কাহিল হয়ে পড়ে। এ সত্যিই এক আশ্চর্যজনক উদ্ভাবন।
     
    এই তত্ত্বকল্পটি অতএব বাতিল।
     
    বাস্তবে, ইরানের প্রাচীন অবেস্তার ভাষায় এমন অনেক শব্দের সন্ধান পাওয়া যায়, যেগুলি সংস্কৃতে ব্যবহৃত স-বাচক শব্দের অনুরূপ অথচ হ-বাচক। যেমন, সরস্বতী > হারাখাইতি; সপ্ত সিন্ধু > হপ্ত হেন্দু, অসুর > আহুর, ইত্যাদি। তার সঙ্গে ফারসি ভাষার সংযোগ থাকলেও শব্দমূলে সাদৃশ্য সামান্যই। এই কথাগুলি ভুলে গেলে মুশকিল।
     
    পক্ষান্তরে, কার্ল মার্ক্সের রচনায় পাওয়া হিন্দুস্তান দেশ-নাম, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের রচিত বইয়ের শিরোনামে A History of the Hindu Chemistry, Vols. I-II (১৯০২-০৯), আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের লেখা Positive Sciences of the Ancient Hindus (১৯১৫), ইত্যাদি, যাঁদের মধ্যে হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ থাকার বা স্থাপন করার কথা সুদূর কল্পনাতেও আনা যায় না, বিপরীত দিক থেকে একটা জিনিস দেখিয়ে দেয়: হিন্দু শব্দটির মধ্যে একটা বৃহত্তর স্থানবাচক সত্তার অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে।
     
    আধুনিক গবেষকদের এক অংশ দেখিয়েছেন, ইরানের লোকেদের কাছে হিন্দুস্তান ছিল এমন একটা জায়গা যেখানকার লোকেরা চুরি জোচ্চুরি করে, জাদু জানে, ইত্যাদি। সেই লোকগুলোকে তারা বলত হিন্দ্‌। অনেকটা আমাদের দেশের গোয়েন্দা কাহিনিতে যেমন এক কালে চোর ডাকাত জালিয়াত চরিত্র হিসাবে “চিনাম্যান”-দের হাজির করানো হত। অষ্টম নবম শতাব্দ থেকে আফঘানিস্তান বা পারস্যের মুসলিমদের মধ্যেকার যে সুফি মতাবলম্বী ধর্মপ্রচারক দরবেশ পির এবং ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য যে সওদাগররা ভারতে আসতে শুরু করেন, তাঁরা কোথায় যাচ্ছেন বা কোথা থেকে ঘুরে এলেন বোঝাতে হলে বলতেন হিন্দস্তান। একাদশ শতকে আল-বেরুনি যখন ভারত ভ্রমণ শেষে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর অভিজ্ঞতা লেখেন তখন সেই গ্রন্থের নাম দেন “তারিখ আল-হিন্দ্‌”। আরও পরে—দ্বাদশ শতাব্দের শেষভাগ থেকে যখন পশ্চিম এশিয়ার আফঘান, তুর্কি, মোগল ইত্যাদি সামন্তী রাজারা রাজ্য বিস্তারে বেরিয়ে ভারতে এসে ঢুকল, তারা এই নতুন রাজত্বকে বলল হিন্দুস্তান আর এখানকার অমুসলিম অধিবাসীদের বলতে লাগল হিন্দু। সেই সঙ্গে তারা নিজেদেরও বলত হিন্দী (মহম্মদ ইকবালের সেই প্রখ্যাত গানের কলি “হিন্দী হ্যাঁয় হম” স্মরণ করুন)। শব্দটির গায়ে লেগে থাকা পুরনো দোষবাচক অর্থগুলি ধীরে ধীরে জনমানস থেকে উবে যায়।
     
    আরও পরে, এই ভাষাকে অনেকে বলতেন হিন্দুস্তানি।
     
    ইস্কনের সঙ্গে যুক্ত একজন কৃষ্ণভক্ত আধ্যাত্মিক ব্লগারের লেখা থেকে জানা যাচ্ছে, “. . . a Persian dictionary titled Lughet-e-Kishwari, published in Lucknow in 1964, gives the meaning of the word Hindu as “chore [thief], dakoo [dacoit], raahzan [waylayer], and ghulam [slave].” In another dictionary, Urdu-Feroze-ul-Laghat (Part One, p. 615) the Persian meaning of the word Hindu is further described as barda (obedient servant), sia faam (black color) and kaalaa (black). So these are all derogatory expressions for the translation of the term hindu in the Persian label of the people of India.” [Cited by Knapp on-line] ভদ্রলোক অবশ্য এতে যারপরনাই অসন্তুষ্ট হয়েছেন।
     
    আজকাল আমরা যাকে উর্দু ভাষা বলি, তার আদি নাম ছিল এই হিন্দি বা হিন্দুস্তানি। আমীর খসরু ও অন্যান্য যাঁরা এই ভাষায় প্রথম সাহিত্য সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁরা নিজেদের হিন্দিভাষীই বলতেন। উর্দু শব্দটা ছিল তাচ্ছিল্য বাচক। সুলতান ও মোগল দরবারের আমীর ওমরাহরা নিজেরা ফারসি বা তুর্কিতে কথা বলতেন, লেখাপড়া করতেন, দলিলপত্র হুকুম ফরমান লিখতেন, তাঁরা আম জনগণের এই ভাষাকে খানিক অবজ্ঞার সুরে বলতেন উর্দু, মানে উর্দি পরিহিত অশিক্ষিত সৈনিকদের বোলচাল। আজও যদি কেউ উত্তর ভারতে যান, দেখবেন, উর্দুভাষীরা নিজেদের এখনও হিন্দিভাষীই বলেন। উল্টোদিকে, এটা তো আর নিছক সমাপতন নয় যে হিন্দি ব্যাকরণের একশ শতাংশই উর্দু ব্যাকরণের সঙ্গে মিলে যায়। দুঃখের কথা, মধ্যযুগের ভারত ইতিহাসের এই সমস্ত তথ্যগত উপাদান বর্তমান প্রজন্মের মানুষদের কাছে আর সুলভ্য নয়। তথ্যগুলি ধীরে ধীরে অনুল্লেখ ও অনুচ্চারণের মধ্য দিয়ে বিস্মৃতির গভীর অন্ধকূপে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবে হিন্দি ভাষা এবং হিন্দুস্তানি স্থানিক পরিচিতির মধ্যে ধর্ম কোনো জায়গাই পায়নি।

    || ২. হিন্দু (নামক) ধর্মের জন্ম ||
     
    হিন্দু নামের সঙ্গে ধর্মের স্পষ্ট যোগসূত্র স্থাপন শুরু হয় ইংরেজ বণিকদের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপনিবেশ স্থাপন ও বিস্তারের সময় থেকে। তারা এসে এই দেশে যে দুটি সুস্পষ্ট ধর্মীয় বিভাজন দেখতে পায়, তার এক দিকে ছিল সংখ্যায় ঊনতর একেশ্বরবাদী মুসলমান সম্প্রদায়, সাধারণ ভাবে হিন্দি (= উর্দু)-ভাষী, যারাই তখনও প্রধানত কেন্দ্রীয়ভাবে এবং অধিকাংশ অঞ্চলে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, আর অপর দিকে ছিল এক বিশাল সংখ্যক প্যাগান সম্প্রদায়, নানা ভাষিক গোষ্ঠী, যারা বহুদেববাদী এবং নানা রকম ট্রাইব্যাল আচার বিচারে আবদ্ধ জনগোষ্ঠী। এই দ্বিতীয় গোষ্ঠীভুক্ত জনমণ্ডলিকে তারা যখন হিন্দু বলে সনাক্ত করে, তার মৌল ভিত্তিতে থাকে এক ধর্মীয় পরিচয়।
     
    এই ভাবেই অষ্টাদশ শতকের শেষ ভাগ থেকে হিন্দুরা এক ধর্ম পরিচয় লাভ করতে থাকে। তথাকথিত হিন্দুধর্মের জন্ম হয়। বৌদ্ধ এবং শিখদের বাদ দিলে আঠেরো শতকোত্তর কালপর্বে দেশের মধ্যে যে সমস্ত পুরনো অমুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠির অস্তিত্ব আছে, তারা সকলেই এই হিন্দু ব্রাকেটের মধ্যে পড়ে। এমনকি জৈনরাও।
     
    এখানে বলা প্রয়োজন, ইংরেজ বণিকরা বাণিজ্য কুঠি বানাতে বানাতে যখন এই দেশকে তাদের বাণিজ্য ঘাঁটি তথা স্থায়ী উপনিবেশ তৈরি করবে বলে সিদ্ধান্ত নিল, তখন তাদের মাথায় একটা দুস্টু বুদ্ধি চাপল। মুসলমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অমুসলিম সমস্ত গোষ্ঠীকে এক সমসত্ত্ব ধর্মীয় বর্গে ফেলে এই হিন্দু মুসলিম ধর্মীয় বিভাজনকে রাজ্য শাসনের স্বার্থে ব্যবহার করা যায় কিনা দেখা। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে যখন তারা এদেশে কিছু কিছু আধুনিক স্কুল কলেজ স্থাপন করতে শুরু করল, তার ইতিহাসের সিলেবাসকে তারা তাদের লুটেরা মনের মাধুরী দিয়ে সাজাতে চাইল। বিশেষ করে, যখন থেকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক ও আদিবাসীদের বিদ্রোহ দেখা দিতে লাগল, অবশেষে ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের লগ্ন (তখন আসলে সম্ভাবনা) যত এগিয়ে আসতে লাগল, ততই কোম্পানির পরিচালকদের বুকে কম্পন ধরে গেল। তারা মরিয়া হয়ে উঠল ভারতীয়দের ক্রমস্ফুটমান জাতীয় ঐক্যে দীর্ঘস্থায়ী ফাটল ধরানোর মতো একটা সূক্ষ্ম পরিকল্পনা বয়ন করতে।   
     
    এগুলো আমাদের কোনো অনুমান বা আন্দাজে ঢিল নয়। উনিশ শতকের সরকারি নানা নথিতে এর অজস্র সাক্ষ্য প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। যদ্দুর জানা যায়, চার্লস গ্র্যান্ট তাঁর লেখায় ১৭৮৭ সালে প্রথম “হিন্দুধর্ম” শব্দটি ব্যবহার করেন। [Cited, Sweetman 2003, 56; also see, Jha 2018, 13] ১৮৬২ সালে ভারত সচিব উড ভারতের তৎকালীন বড়লাট এলগিনকে একটা চিঠিতে খোলাখুলি বলেন, “ভারতে আমরা ক্ষমতা দখল করে আছি ভারতীয়দের এক অংশের বিরুদ্ধে অপর অংশকে লেলিয়ে দিয়ে। আমাদের এরকমটাই করে যেতে হবে। সমস্ত অংশের মধ্যে ঐক্যভাব জেগে ওঠা ঠেকানোর জন্য যা পারবেন সবই করুন।” [Cited, Pandey 1984, 35] দশ বছর পরে যখন থেকে ব্রিটিশ রাজের তত্ত্বাবধানে ভারতে প্রথম জনগণনা শুরু হয়, তাতে হিন্দু এবং মুসলমান জনসাধারণকে দুই প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠী হিসাবে নথিভুক্ত করা হয়। ১৮৮৭ সালে এক ইংরেজ অফিসার বড়লাট ডাফরিনকে রিপোর্ট করেন, “This division of religious feeling is greatly to our advantage and I look for some good as a result of your Committee of Inquiry on Indian Education and on teaching materials.” [Cited, Ibid] পরের বছরে ভারত সচিব হ্যামিলটন বাংলার ছোটলাট কার্জনকে নির্দেশ পাঠান, “শিক্ষার পাঠ্যবইগুলি আমাদের এমন পরিকল্পিত ভাবে রচনা করতে হবে যে সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে মনোমালিন্য যেন বাড়তেই থাকে।” [Cited, Ibid]
     
    ১৮৬০-এর দশক থেকেই এলিয়ট, ডসন, রবার্টসন, গ্রান্ট, জেমস মিল, কানিংহাম, প্রিন্সেপ, উইলসন, ফার্গুসন, প্রমুখ ইংরেজ লেখকগণ শাসকদের অভিপ্রায় অনুযায়ী এরকম ইতিহাস বই লিখতে থাকেন। তাঁরা ভারতের ইতিহাসকে হিন্দু যুগ, মুসলিম যুগ এবং ব্রিটিশ যুগ—এই তিন পর্যায়ে ভাগ করে দেখাতে থাকেন: প্রথম পর্যায়ে হিন্দুরা তাদের নিজস্ব ধর্ম ও সংস্কৃতির অবাধ ও শান্তিপূর্ণ বিকাশ ঘটিয়েছে; সেটা ছিল তাদের এক গৌরবময় অতীত কাল, জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শনের চর্চা ও বিকাশের যুগ। দ্বিতীয় স্তর শুরু হল বহিরাগত মুসলমানদের আগমনের পর, যখন সেই নতুন শাসকগোষ্ঠী হিন্দুদের জবরদস্তি ইসলামে ধর্মান্তরিত করে, মন্দির ভেঙে মসজিদ বানিয়ে হিন্দুদের উপর নিষ্ঠুর ধর্মীয় নিপীড়ণ চালিয়েছে। অবশেষে এক সময় ইংরেজরা এসে মুসলমান শাসনের অবসান ঘটিয়ে হিন্দুদের আবার ধর্মীয় মুক্তির আস্বাদ এনে দিয়েছে। ভারতে আবার হিন্দুদের জন্য সুখের রাজ স্থাপন হয়েছে।
     
    দুঃখের কথা হল, ভারতের উদীয়মান জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই এই ঔপনিবেশিক বয়ানকে প্রায় নির্বিচারে মেনে নেন এবং তাঁদের নিজেদের প্রচারেও এই সব কথার অনুরণন চালাতে থাকেন। ব্রাহ্মদের উদ্যোগে ১৮৭০-এর দশক থেকে যে স্বদেশি মেলার আয়োজন করা হত, তাকে বাচ্যান্তরে হিন্দুমেলা বলা হত, এবং তার একজন অন্যতম উদ্যোক্তা নবগোপাল ঘোষ প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন, হিন্দু আর মুসলমান আলাদা জাতি, যা কিছু হিন্দুদের স্বার্থের অনুকূল, সেটাই এই দেশ ও জাতির স্বার্থ, এবম্বিধ। উত্তর ভারতে ১৮৭৫ সাল থেকে দয়ানন্দ সরস্বতীর উদ্যোগে যে আর্যসমাজ আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তাতেও কার্যত গোরক্ষার নাম করে এই হিন্দু পুনরুত্থানের আয়োজন চলতে থাকে।
     
    এর নিরতিবিলম্ব পরাবর্ত প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম সমাজের একাংশের মধ্যেও পালটা এক স্বতন্ত্র কৌমবোধ জেগে উঠতে থাকে। যা হিন্দুর সমস্ত ঐতিহ্য থেকে আলাদা। এইভাবেই এক সময় হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লিগের জন্ম হয় এবং সাম্প্রদায়িক দুই সমান্তরাল ধারায় রাজনীতির চোরাস্রোত বইতে থাকে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী প্রচার ও আন্দোলন প্রকাশ্যে সেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক লাইন থেকে কিঞ্চিত “চুল-ভেজাব-না” দূরত্বে বিচরণ করলেও মতাদর্শিক ক্ষেত্রে হিন্দু মহাসভা থেকে নিজেদের খুব বেশি স্বতন্ত্র বলে কখনই তুলে ধরতে পারেনি। হিন্দু ধর্মীয় ঐতিহ্যকেই জাতীয় ঐতিহ্য এবং হিন্দুদের ধর্মীয় আইকনগুলিকেই মডেল হিসাবে তুলে ধরতে থাকে। হিন্দুত্বের হ্রস্বতর অতীত শেষ হয়ে তার বর্তমান পর্যায় শুরু হয়।
     
    আরও অনেক ঘটনা আছে।
     
    বাংলায় দুটো পরিঘটনা খুব প্রোজ্জ্বলভাবে হিন্দুত্বের এই বর্তমান শরীর নির্মাণের গুরু দায়িত্ব পালন করেছিল। এক, বঙ্কিমের আনন্দমঠ; দুই, বিবেকানন্দের আন্দোলন। স্বল্প পরবর্তীকালে তিলক এবং গান্ধী বঙ্কিম-বিবেকানন্দের সৃষ্ট এই সংকীর্ণ ভাবাদর্শকে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের মূল ভিত্তি করে ফেলেন। What Bengal thinks today, India thinks tomorrow—গোখলের সেই অমৃতবাণীর একেবারে যেন হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল। ব্রিটিশ বিরোধিতার মধ্যেই মুসলমান বিদ্বেষ এবং দলিত ঘৃণা বাংলায় জন্ম নিয়ে অচিরেই এক ফল্গু স্রোতের মতো সারা দেশের জাতীয় চেতনার আধারে বা অন্দরে বইতে লাগল।
     
    এরই চূড়ান্ত পরিণাম হিসাবে ১৯২৫ সালে যখন আরএসএস-এর জন্ম হল, সে একেবারে গোড়া থেকেই এই চেতনায় ব্রিটিশ বিরোধিতার উপরে নির্মিত স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা উপাদানকে সম্পূর্ণ অপনোদন করে কেবল মাত্র মুসলিম বিদ্বেষ ও দলিত ঘৃণার উপরে তার সমস্ত কার্যক্রমকে সাজিয়ে ফেলল। তার থেকেই জন্ম হল এক সর্বগ্রাসী হিন্দুত্বের। যার এক ভয়াল এবং কদর্য রূপ এখন আমরা প্রতিদিন প্রত্যক্ষ করে চলেছি।   
     
    তবে তথ্যের খাতিরে এখানে এটা বলে যাওয়া দরকার, ১৯৩৯ সালে মুম্বাইয়ের শাপুরশাহ হোদিওয়ালা প্রথম ইলিয়ট প্রমুখর এই সমস্ত মিথ্যা ইতিহাস কথনকে চ্যালেঞ্জ করে সবিস্তার টীকা দিয়ে মিথ্যাচারগুলিকে উন্মোচন করে দেখান। তাঁর বইটির দ্বিতীয় খণ্ড ১৯৫৭ সালে মরণোত্তর প্রকাশিত হয়। [Hodivala 2018] পরবর্তীকালে জে এস গ্রেওয়াল এই বিষয়ে আরও নানা দিক থেকে আলোকপাত করেন। [Grewal 1970] আমরা অবশ্য এক দৃঢ়চেতা জাতির মতো সেই সব সত্য ইতিহাসকে সগর্বে দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি।
     
    [ক্রমশ]   

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • দীপ | 42.110.137.179 | ০৫ জুন ২০২৩ ১২:৪৩520238
  • দীপ | 42.110.137.179 | ০৫ জুন ২০২৩ ১২:৪৪520239
  • দীপ | 42.110.137.179 | ০৫ জুন ২০২৩ ১২:৪৫520240
  • নারী ও শূদ্রবিদ্বেষী বিবেকানন্দ!
  • দীপ | 42.110.137.179 | ০৫ জুন ২০২৩ ১২:৪৬520241
  • দীপ | 42.110.137.179 | ০৫ জুন ২০২৩ ১২:৪৮520242
  • সরফরাজ হোসেনকে লেখা বিবেকানন্দের চিঠির বঙ্গানুবাদ।
    অবশ্য এরপরও ইতরের মিথ্যাচারিতা বন্ধ হবেনা!
  • দীপ | 42.110.145.172 | ০৬ জুন ২০২৩ ১৯:০০520262
  •  
    "পলাশীর পরাজয়ের পর মুসলমানদের পতনের যে যাত্রা শুরু, বালাকোটের বিপর্যয় ও ১৮৫৭-এর মহাবিদ্রোহের ব্যর্থতার পর নিঃসীম অন্ধকার যে কাল রাত্রের যাত্রা শুরু, ইংরেজের জাতি বিধ্বংসী শতমুখে নির্যাতন-নিষ্পেষণে মুসলমানরা পিষ্ট হবার পর তা এ সময় জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসেছিল। উনিশ শতকের এ দুর্ভাগ্য দশা বিশ শতকের শুরুতে বঙ্গ-ভঙ্গের শক ট্রিটমেন্ট ও মুসলিম লীগের পত্তন পর্যন্ত পূর্ণ অবয়বে টিকে ছিল। 
    এ সত্ত্বেও ভূ-লুণ্ঠিত জাতি-সত্তাকে হিন্দু জাতিদেহে লীন করার চেষ্টা সফল হয়নি। তথাকথিত মানবতার নামে, মনুষ্যত্বের নামে, সমন্বয়ের নামে যে ষড়যন্ত্র মুসলিম জাতিকে হিন্দু জাতিদেহে লীন করার জন্য সচেষ্ট হয়েছিল, সে ষড়যন্ত্র মুসলিম জাতিদেহের অভেদ্য বর্ম ভেদ করতে পারেনি। রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্ম ধর্ম একজন মুসলমানকেও তার সাথে শামিল করতে সমর্থ হয়নি। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সমন্বয় চিন্তার দিকে মুসলমানরা চোখ তুলেও তাকায়নি। মুসলমানরা জাগতিক সব কিছুই হারিয়েছিল, কিন্তু হারায়নি চেতনা নামক মহামূল্যবান বস্তুটি।"
    (আবুল আসাদ, একশ বছরের রাজনীতি, পৃ. ৩৩।)
  • দীপ | 42.110.145.172 | ০৬ জুন ২০২৩ ১৯:০১520263
  • সবকিছুর জন্য দায়ী বঙ্কিম বিবেকানন্দ!
  • দীপ | 42.110.145.127 | ২৮ জুলাই ২০২৩ ১৮:৩২521827
  • "....তখন বঙ্গসাহিত্যেরও যেমন প্রাতঃসন্ধ্যা উপস্থিত আমাদেরও সেইরূপ বয়ঃসন্ধিকাল। বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয় বিকাশ করিলেন, আমাদের হৃৎপদ্ম সেই প্রথম উদ্‌ঘাটিত হইল। পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার,সেই একাকার, সেই সুপ্তি, কোথায় গেল সেই বিজয়-বসন্ত, সেই গোলেবকাগুলি, সেই-সব বালক-ভুলানো কথা-- কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সংগীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাঢ়ের প্রথম বর্ষার মতো "সমাগতো রাজবদুন্নত-ধ্বনিঃ'। এবং মুষলধারে ভাববর্ষণে বঙ্গসাহিত্যের পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সমস্ত নদী-নির্ঝরিণী অকস্মাৎ পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়া যৌবনের আনন্দবেগে ধাবিত হইতে লাগিল। কত কাব্য নাটক উপন্যাস কত প্রবন্ধ কত সমালোচনা কত মাসিকপত্র কত সংবাদপত্র বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাতকলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।আমরা কিশোরকালের বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে ভাবের সেই নবসমাগমের মহোৎসব দেখিয়াছিলাম; সমস্ত দেশ ব্যাপ্ত করিয়া যে-একটি আশার আনন্দ নূতন হিল্লোলিত হইয়াছিল তাহা অনুভব করিয়াছিলাম-- সেইজন্য আজ মধ্যে মধ্যে নৈরাশ্য উপস্থিত হয়। মনে হয় সেদিন হৃদয়ে যে অপরিমেয় আশার সঞ্চার হইয়াছিল তদনুরূপ ফল লাভ করিতে পারি নাই। সে জীবনের বেগ আর নাই। কিন্তু এ নৈরাশ্য অনেকটা অমূলক। প্রথম-সমাগমের প্রবল উচ্ছ্বাস কখনো স্থায়ী হইতে পারে না। সেই নব আনন্দ নবীন আশার স্মৃতির সহিত বর্তমানের তুলনা করাই অন্যায়। বিবাহের প্রথম দিনে যে রাগিণীতে বংশীধ্বনি হয় সে রাগিণী চিরদিনের নহে। সেদিন কেবল অবিমিশ্র আনন্দ এবং আশা, তাহার পর হইতে বিচিত্র কর্তব্য, মিশ্রিত দুঃখসুখ, ক্ষুদ্র বাধাবিঘ্ন, আবর্তিত বিরহমিলন-- তাহার পর হইতে গভীর গম্ভীর ভাবে নানা পথ বাহিয়া নানা শোকতাপ অতিক্রম করিয়া সংসারপথে অগ্রসর হইতে হইবে, প্রতিদিন আর সে নহবত বাজিবে না। তথাপি সেই একদিনের উৎসবের স্মৃতি কঠোর কর্তব্যপথে চিরদিন আনন্দ সঞ্চার করে। বঙ্কিমচন্দ্র স্বহস্তে বঙ্গভাষার সহিত যেদিন নবযৌবনপ্রাপ্ত ভাবের পরিণয় সাধন করাইয়াছিলেন সেইদিনের সর্বব্যাপী প্রফুল্লতা এবং আনন্দ-উৎসব আমাদের মনে আছে। সেদিন আর নাই। আজ নানা লেখা নানা মত নানা আলোচনা আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে-- আজ কোনোদিন-বা ভাবের স্রোত মন্দ হইয়া আসে কোনোদিন- বা অপেক্ষাকৃত পরিপুষ্ট হইয়া উঠে।
    এইরূপই হইয়া থাকে এবং এইরূপই হওয়া আবশ্যক। কিন্তু কাহার প্রসাদে এরূপ হওয়া সম্ভব হইল সে কথা স্মরণ করিতে হইবে। আমরা আত্মাভিমানে সর্বদাই তাহা ভুলিয়া যাই।
    ভুলিয়া যে যাই তাহার প্রথম প্রমাণ, রামমোহন রায়কে আমাদের বর্তমান বঙ্গদেশের নির্মাণকর্তা বলিয়া আমরা জানি না। কী রাজনীতি, কী বিদ্যাশিক্ষা, কী সমাজ, কী ভাষা-- আধুনিক বঙ্গদেশে এমন কিছুই নাই রামমোহন রায় স্বহস্তে যাহার সূত্রপাত করিয়া যান নাই। এমন-কি, আজ প্রাচীন শাস্ত্রালোচনার প্রতি, দেশের যে এক নূতন উৎসাহ দেখা যাইতেছে রামমোহন রায় তাহারও পথপ্রদর্শক। যখন নব শিক্ষাভিমানে স্বভাবতই পুরাতন শাস্ত্রের প্রতি অবজ্ঞা জন্মিবার সম্ভাবনা, তখন রামমোহন রায় সাধারণের অনধিগম্য বিস্মৃতপ্রায় বেদ-পুরাণ-তন্ত্র হইতে সারোদ্ধার করিয়া প্রাচীন শাস্ত্রের গৌরব উজ্জ্বল রাখিয়াছিলেন। বঙ্গদেশ অদ্য সেই রামমোহন রায়ের নিকট কিছুতেই হৃদয়ের সহিত কৃতজ্ঞতা স্বীকার করিতে চাহে না। রামমোহন বঙ্গসাহিত্যকে গ্রানিট-স্তরের উপর স্থাপন করিয়া নিমজ্জনদশা হইতে উন্নত করিয়া তুলিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র তাহারই উপর প্রতিভার প্রবাহ ঢালিয়া স্তরবদ্ধ পলিমৃত্তিকা ক্ষেপণ করিয়া গিয়াছেন। আজ বাংলা ভাষা কেবল দৃঢ় বাসযোগ্য নহে, উর্বরা শস্যশ্যামলা হইয়া উঠিয়াছে। বাসভূমি যথার্থ মাতৃভূমি হইয়াছে। এখন আমাদের মনের খাদ্য প্রায় ঘরের দ্বারেই ফলিয়া উঠিতেছে। মাতৃভাষার বন্ধ্যদশা ঘুচাইয়া যিনি তাহাকে এমন গৌরবশালিনী করিয়া তুলিয়াছেন তিনি বাঙালির যে কী মহৎ কী চিরস্থায়ী উপকার করিয়াছেন সে কথা যদি কাহাকেও বুঝাইবার আবশ্যক হয় তবে তদপেক্ষা দুর্ভাগ্য আর কিছুই নাই। তৎপূর্বে বাংলাকে কেহ শ্রদ্ধাসহকারে দেখিত না। সংস্কৃত পণ্ডিতেরা তাহাকে গ্রাম্য এবং ইংরেজি পণ্ডিতেরা বর্বর জ্ঞান করিতেন। বাংলা ভাষায় যে কীর্তি উপার্জন করা যাইতে পারে সে কথা তাঁহাদের স্বপ্নের অগোচর ছিল। এইজন্য কেবল স্ত্রীলোক ও বালকদের জন্য অনুগ্রহপূর্বক দেশীয় ভাষায় তাঁহারা সরল পাঠ্য-পুস্তক রচনা করিতেন। সেই-সকল পুস্তকের সরলতা ও পাঠযোগ্যতা সম্বন্ধে যাঁহাদের জানিবার ইচ্ছা আছে তাঁহারা রেভারেণ্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়-রচিত পূর্বতন এন্ট্রেন্স-পাঠ্য বাংলা গ্রন্থে দন্তস্ফুট করিবার চেষ্টা করিয়া দেখিবেন। অসম্মানিত বঙ্গভাষাও তখন অত্যন্ত দীন মলিন ভাবে কালযাপন করিত। তাহার মধ্যে যে কতটা সৌন্দর্য কতটা মহিমা প্রচ্ছন্ন ছিল তাহা তাহার দারিদ্র্য ভেদ করিয়া স্ফূর্তি পাইত না। যেখানে মাতৃভাষার এত অবহেলা সেখানে মানবজীবনের শুষ্কতা শূন্যতা দৈন্য কেহই দূর করিতে পারে না।
    এমন সময়ে তখনকার শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ বঙ্কিমচন্দ্র আপনার সমস্ত শিক্ষা সমস্ত অনুরাগ সমস্ত প্রতিভা উপহার লইয়া সেই সংকুচিতা বঙ্গভাষার চরণে সমর্পণ করিলেন; তখনকার কালে কী যে অসামান্য কাজ করিলেন তাহা তাঁহারই প্রসাদে আজিকার দিনে আমরা সম্পূর্ণ অনুমান করিতে পারি না। তখন তাঁহার অপেক্ষা অনেক অল্পশিক্ষিত প্রতিভাহীন ব্যক্তি ইংরাজিতে দুই ছত্র লিখিয়া অভিমানে স্ফীত হইয়া উঠিতেন। ইংরাজি সমুদ্রে তাঁহারা যে কাঠবিড়ালির মতো বালির বাঁধ নির্মাণ করিতেছেন সেটুকু বুঝিবার শক্তিও তাঁহাদের ছিল না।
    বঙ্কিমচন্দ্র যে সেই অভিমান সেই খ্যাতির সম্ভাবনা অকাতরে পরিত্যাগ করিয়া তখনকার বিদ্বজ্জনের অবজ্ঞাত বিষয়ে আপনার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করিলেন ইহা অপেক্ষা বীরত্বের পরিচয় আর কী হইতে পারে! সম্পূর্ণ ক্ষমতাসত্ত্বেও আপন সমযোগ্য লোকের উৎসাহ এবং তাঁহাদের নিকট প্রতিপত্তির প্রলোভন পরিত্যাগ করিয়া একটি অপরীক্ষিত অনাদৃত অন্ধকার পথে আপন নবীন জীবনের সমস্ত আশা-উদ্যম-ক্ষমতাকে প্রেরণ করা কত বিশ্বাস এবং কত সাহসের বলে হয় তাহার পরিমাণ করা সহজ নহে।
    কেবল তাহাই নহে। তিনি আপনার শিক্ষাগর্বে বঙ্গভাষার প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ করিলেন না, একেবারেই শ্রদ্ধা প্রকাশ করিলেন। যত-কিছু আশা আকাঙক্ষা সৌন্দর্য-প্রেম মহত্ত্বভক্তি স্বদেশানুরাগ, শিক্ষিত পরিণত বুদ্ধির যত-কিছু শিক্ষালব্ধ চিন্তাজাত ধনরত্ন সমস্তই অকুণ্ঠিতভাবে বঙ্গভাষার হস্তে অর্পণ করিলেন। পরম সৌভাগ্য-গর্বে সেই অনাদর-মলিন ভাষার মুখে সহসা অপূর্ব লক্ষ্মীশ্রী প্রস্ফুটিত হইয়া উঠিল।
    তখন, পূর্বে যাঁহারা অবহেলা করিয়াছিলেন তাঁহারা বঙ্গভাষার যৌবনসৌন্দর্যে আকৃষ্ট হইয়া একে একে নিকটবর্তী হইতে লাগিলেন। বঙ্গসাহিত্য প্রতিদিন গৌরবে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিতে লাগিল।
    বঙ্কিম যে গুরুতর ভার লইয়াছিলেন তাহা অন্য কাহারো পক্ষে দুঃসাধ্য হইত। প্রথমত, তখন বঙ্গভাষা যে অবস্থায় ছিল তাহাকে যে শিক্ষিত ব্যক্তির সকলপ্রকার ভাবপ্রকাশে নিযুক্ত করা যাইতে পারে ইহা বিশ্বাস ও আবিষ্কার করা বিশেষ ক্ষমতার কার্য। দ্বিতীয়ত, যেখানে সাহিত্যের মধ্যে কোনো আদর্শ নাই, যেখানে পাঠক অসামান্য উৎকর্ষের প্রত্যাশাই করে না, যেখানে লেখক অবহেলাভরে লেখে এবং পাঠক অনুগ্রহের সহিত পাঠ করে, যেখানে অল্প ভালো লিখিলেই বাহবা পাওয়া যায় এবং মন্দ লিখিলেও কেহ নিন্দা করা বাহুল্য বিবেচনা করে, সেখানে কেবল আপনার অন্তরস্থিত উন্নত আদর্শকে সর্বদা সম্মুখে বর্তমান রাখিয়া সামান্য পরিশ্রমে সুলভখ্যাতিলাভের প্রলোভন সম্বরণ করিয়া অশ্রান্ত যত্নে অপ্রতিহত উদ্যমে দুর্গম পরিপূর্ণতার পথে অগ্রসর হওয়া অসাধারণ মাহাত্ম্যের কর্ম। চতুর্দিকব্যাপী উৎসাহহীন জীবনহীন জড়ত্বের মতো এমন গুরুভার আর কিছুই নেই; তাহার নিয়তপ্রবল ভারাকর্ষণ-শক্তি অতিক্রম করিয়া উঠা যে কত নিরলস চেষ্টা ও বলের কর্ম তাহা এখনকার সাহিত্যব্যবসায়ীরাও কতকটা বুঝিতে পারেন, তখন যে আরো কত কঠিন ছিল তাহা কষ্টে অনুমান করিতে হয়। সর্বত্রই যখন শৈথিল্য এবং সে-শৈথিল্য যখন নিন্দিত হয় না তখন আপনাকে নিয়মব্রতে বন্ধ করা মহাসত্ত্বলোকের দ্বারাই সম্ভব।
    বঙ্কিম আপনার অন্তরের সেই আদর্শ অবলম্বন করিয়া প্রতিভাবলে যে কার্য করিলেন তাহা অত্যাশ্চর্য। বঙ্গদর্শনের পূর্ববর্তী এবং তাহার পরবর্তী বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে যে উচ্চনীচতা তাহা অপরিমিত। দার্জিলিং হইতে যাঁহারা, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখরমালা দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন সেই অভ্রভেদী শৈলসম্রাটের উদয়রবিরশ্মি-সমুজ্জ্বল তুষারকিরীট চতুর্দিকের নিস্তব্ধ গিরি পারিষদবর্গের কত ঊর্ধ্বে সমুত্থিত হইয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্রের পরবর্তী বঙ্গসাহিত্য সেইরূপ আকস্মিক অত্যুন্নতি লাভ করিয়াছে; একবার সেইটি নিরীক্ষণ এবং পরিমাণ করিয়া দেখিলেই বঙ্কিমের প্রতিভার প্রভূত বল সহজে অনুমান করা যাইবে।
    বঙ্কিম নিজে বঙ্গভাষাকে যে শ্রদ্ধা অর্পণ করিয়াছেন অন্যেও তাহাকে সেইরূপ শ্রদ্ধা করিবে ইহাই তিনি প্রত্যাশা করিতেন। পূর্ব-অভ্যাসবশত সাহিত্যের সহিত যদি কেহ ছেলেখেলা করিতে আসিত তবে বঙ্কিম তাহার প্রতি এমন দণ্ড বিধান করিতেন যে দ্বিতীয়বার সেরূপ স্পর্ধা দেখাইতে সে আর সাহস করিত না।
    তখন সময় আরো কঠিন ছিল। বঙ্কিম নিজে দেশব্যাপী একটি ভাবের আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রভাবে কত চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল, এবং আপন ক্ষমতার সীমা উপলব্ধি করিতে না পারিয়া কত লোক যে এক লম্ফে লেখক হইবার চেষ্টা করিয়াছিল তাহার সংখ্যা নাই। লেখার প্রয়াস জাগিয়া উঠিয়াছে অথচ লেখার উচ্চ আদর্শ তখনো দাঁড়াইয়া যায় নাই। সেই সময় সব্যসাচী বঙ্কিম এক হস্ত গঠনকার্যে এক হস্ত নিবারণকার্যে নিযুক্ত রাখিয়াছিএলন। এক দিকে অগ্নি জ্বালাইয়া রাখিতেছিলেন আর-এক দিকে ধূম এবং ভস্মরাশি দূর করিবার ভার নিজেই লইয়াছিলেন।
    রচনা এবং সমালোচনা এই উভয়কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতেই বঙ্গসাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।
    এই দুষ্কর ব্রতানুষ্ঠানের যে ফল তাহাও তাঁহাকে ভোগ করিতে হইয়াছিল। মনে আছে, বঙ্গদর্শনে যখন তিনি সমালোচক-পদে আসীন ছিলেন তখন তাঁহার ক্ষুদ্র শত্রুর সংখ্যা অল্প ছিল না। শত শত অযোগ্য লোক তাঁহাকে ঈর্ষা করিত এবং তাঁহার শ্রেষ্ঠত্ব অপ্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতে ছাড়িত না।
    কণ্টক যতই ক্ষুদ্র হউক তাহার বিদ্ধ করিবার ক্ষমতা আছে এবং কল্পনাপ্রবণ লেখকদিগের বেদনাবোধও সাধারণের অপেক্ষা কিছু অধিক। ছোটো ছোটো দংশনগুলি যে বঙ্কিমকে লাগিত না, তাহা নহে, কিন্তু কিছুতেই তিনি কর্তব্যে পরাঙ্‌মুখ হন নাই। তাঁহার অজেয় বল, কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠা এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস ছিল। তখন জানিতেন, বর্তমানের কোনো উপদ্রব তাঁহার মহিমাকে আচ্ছন্ন করিতে পারিবে না, সমস্ত ক্ষুদ্র শত্রুর ব্যূহ হইতে তিনি অনায়াসে নিষ্ক্রমণ করিতে পারিবেন। এইজন্য চিরকাল তিনি অম্লানমুখে বীরদর্পে অগ্রসর হইয়াছেন, কোনোদিন তাঁহাকে রথবেগ খর্ব করিতে হয় নাই।
    সাহিত্যের মধ্যেও দুই শ্রেণীর যোগী দেখা যায়, ধ্যানযোগী এবং কর্মযোগী। ধ্যানযোগী একান্তমনে বিরলে ভাবের চর্চা করেন,তাঁহার রচনাগুলি সংসারী লোকের পক্ষে যেন উপরি-পাওনা, যেন যথালাভের মতো।
    কিন্তু বঙ্কিম সাহিত্যে কর্মযোগী ছিলেন। তাঁহার প্রতিভা আপনাতে আপনি স্থিরভাবে পর্যাপ্ত ছিল না। সাহিত্যের যেখানে যাহা-কিছু অভাব ছিল সর্বত্রই তিনি আপনার বিপুল বল এবং আনন্দ লইয়া ধাবমান হইতেন। কী কাব্য, কী বিজ্ঞান, কী ইতিহাস, কী ধর্মতত্ত্ব যেখানে যখনই তাঁহাকে আবশ্যক হইত সেখানে তখনই তিনি সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া দেখা দিতেন। নবীন বঙ্গসাহিত্যের মধ্যে সকল বিষয়েই আদর্শ স্থাপন করিয়া যাওয়া তাঁহার উদ্দেশ্য ছিল। বিপন্ন বঙ্গভাষা আর্তস্বরে যেখানেই তাঁহাকে আহ্বান করিয়াছে সেখানেই তিনি প্রসন্ন চতুর্ভূজ মূর্তিতে দর্শন দিয়াছেন।
    কিন্তু তিনি যে কেবল অভয় দিতেন, সান্ত্বনা দিতেন, অভাব পূর্ণ করিতেন তাহা নহে, তিনি দর্পহারীও ছিলেন। এখন যাঁহারা বঙ্গসাহিত্যের সারথ্য স্বীকার করিতে চান তাঁহারা দিনে নিশীথে বঙ্গদেশকে অত্যুক্তিপূর্ণ স্তুতিবাক্যে নিয়ত প্রসন্ন রাখিতে চেষ্টা করেন, কিন্তু বঙ্কিমের বাণী কেবল স্তুতিবাদিনী ছিল না, খড়গধারিণীও ছিল। বঙ্গদেশ যদি অসাড় প্রাণহীন না হইত তবে "কৃষ্ণচরিত্রে' বর্তমান পতিত হিন্দুসমাজ ও বিকৃত হিন্দুধর্মের উপর যে অস্ত্রাঘাত আছে সে আঘাতে বেদনাবোধ এবং কথঞ্চিৎ চেতনা লাভ করিত। বঙ্কিমের ন্যায় তেজস্বী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ব্যতীত আর কেহই লোকাচার-দেশাচারের বিরুদ্ধে এরূপ নির্ভীক স্পষ্ট উচ্চারণে আপন মত প্রকাশ করিতে সাহস করিত না। এমন-কি, বঙ্কিম প্রাচীন হিন্দু-শাস্ত্রের প্রতি ঐতিহাসিক বিচার প্রয়োগ করিয়া তাহার সার এবং অসার ভাগ পৃথক্‌করণ, তাহার প্রামাণ্য এবং অপ্রামাণ্য অংশের বিশ্লেষণ এবং নিঃসংকোচে করিয়াছেন যে এখনকার দিনে তাহার তুলনা পাওয়া কঠিন।
    বিশেষত দুই শত্রুর মাঝখান দিয়া তাঁহাকে পথ কাটিয়া চলিতে হইয়াছে। এক দিকে যাঁহারা অবতার মানেন না তাঁহারা শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দেবত্বারোপে বিপক্ষ হইয়া দাঁড়ান। অন্য দিকে যাঁহারা শাস্ত্রের প্রত্যেক অক্ষর এবং লোকাচারের প্রত্যেক প্রথাকে অভ্রান্ত বলিয়া জ্ঞান করেন তাঁহারাও, বিচারের লৌহাস্ত্র দ্বারা শাস্ত্রের মধ্য হইতে কাটিয়া কাটিয়া কুঁদিয়া কুঁদিয়া মহত্তম মনুষ্যের আদর্শ অনুসারে দেবতা-গঠনকার্যে বড়ো প্রসন্ন হন নাই। এরূপ অবস্থায় অন্য কেহ হইলে কোনো এক পক্ষকে সর্বতোভাবে আপন দলে পাইতে ইচ্ছা করিতেন। কিন্তু সাহিত্যমহারথী বঙ্কিম দক্ষিণে বামে উভয় পক্ষের প্রতিই তীক্ষ্ণ শরচালন করিয়া অকুণ্ঠিতভাবে অগ্রসর হইয়াছেন-- তাঁহার নিজের প্রতিভা কেবল তাঁহার একমাত্র সহায় ছিল। তিনি যাহা বিশ্বাস করিয়াছেন তাহা স্পষ্ট ব্যক্ত করিয়াছেন-- বাক্‌চাতুরী দ্বারা আপনাকে বা অন্যকে বঞ্চনা করেন নাই।
    কল্পনা এবং কাল্পনিকতা দুইয়ের মধ্যে একটা মস্ত প্রভেদ আছে। যথার্থ কল্পনা, যুক্তি সংযম এবং সত্যের দ্বারা সুনির্দিষ্ট আকারবদ্ধ-- কাল্পনিকতার মধ্যে সত্যের ভান আছে মাত্র, কিন্তু তাহা অদ্ভুত আতিশয্যে অসংগতরূপে স্ফীতকায়। তাহার মধ্যে যেটুকু আলোকের লেশ আছে ধূমের অংশ তাহার শতগুণ। যাহাদের ক্ষমতা অল্প তাহারা সাহিত্যে প্রায় এই প্রধূমিত কাল্পনিকতার আশ্রয় লইয়া থাকে-- কারণ, ইহা দেখিতে প্রকাণ্ড কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অত্যন্ত লঘু। এক শ্রেণীর পাঠকেরা এইরূপ ভূরিপরিমাণ কৃত্রিম কাল্পনিকতার নৈপুণ্যে মুগ্ধ ও অভিভূত হইয়া পড়েন এবং দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলায় সেই শ্রেণীর পাঠক বিরল নহে।
    এইরূপ অপরিমিত অসংযত কল্পনার দেশে বঙ্কিমের ন্যয় আদর্শ আমাদের পক্ষে অত্যন্ত মূল্যবান। "কৃষ্ণচরিত্রে' উদ্দাম ভাবের আবেগে তাঁহার কল্পনা কোথাও উচ্চৃঙ্খল হইয়া ছুটিয়া যায় নাই। প্রথম হইতে শেষ পর্যন্ত সর্বত্রই তিনি পদে পদে আত্মসম্বরণপূর্বক যুক্তির সুনির্দিষ্ট পথ অবলম্বন করিয়া চলিয়াছেন। যাহা লিখিয়াছেন তাহাতে তাঁহার প্রতিভা প্রকাশ পাইয়াছে, যাহা লিখেন নাই তাহাতেও তাঁহার অল্প ক্ষমতা প্রকাশ পায় নাই।
    বিশেষত বিষয়টি এমন যে, ইহা কোনো সাধারণ বাঙালি লেখকের হস্তে পড়িলে তিনি এই সুযোগে বিস্তর হরি হরি, মরি মরি, হায় হায়, অশ্রুপাত ও প্রবল অঙ্গভঙ্গি করিতেন এবং কল্পনার উচ্ছ্বাস, ভাবের আবেগ এবং হৃদয়াতিশয্য প্রকাশ করিবার এমন অনুকূল অবসর কখনোই ছাড়িতেন না; সুবিচারিত তর্ক দ্বারা, সুকঠিন সত্যনির্ণয়ের স্পৃহা দ্বারা পদে পদে আপন লেখনীকে বাধা দিতেন না। সর্বজনগম্য সরল পথ ছাড়িয়া দিয়া সূক্ষ্মবুদ্ধি দ্বারা স্বকপোলকল্পিত একটা নূতন আবিষ্কারকেই সর্বপ্রাধান্য দিয়া তাহাকেই বাক্‌প্রাচুর্যে এবং কল্পনাকুহকে সমাচ্ছন্ন করিয়া তুলিতেন, এবং নিজের বিশ্বাস ও ভাষাকে যথাসাধ্য টানিয়া বুনিয়া আশেপাশে দীর্ঘ করিয়া অধিকপরিমাণে লোককে আপন মতের জালে আকর্ষণ করিতে চেষ্টা করিতেন।
    বস্তুত আমাদের শাস্ত্র হইতে ইতিহাস উদ্ধারের দুরূহ ভার কেবল বঙ্কিম লইতে পারিতেন। এক দিকে হিন্দুশাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম গ্রহণে ইউরোপীয়গণের অক্ষমতা, অন্য দিকে শাস্ত্রগত প্রমাণের নিরপেক্ষ বিচার সম্বন্ধে হিন্দুদের সংকোচ; এক দিকে রীতিমত পরিচয়ের অভাব, অন্য দিকে অতিপরিচয়জনিত অভ্যাস ও সংস্কারের অন্ধতা; যথার্থ ইতিহাসটিকে এই উভয়সংকটের মাঝখান হইতে উদ্ধার করিতে হইবে। দেশানুরাগের সাহায্যে শাস্ত্রের অন্তরে প্রবেশ করিতে হইবে এবং সত্যানুরাগের সাহায্যে তাহার অমূলক অংশ পরিত্যাগ করিতে হইবে। যে বল্‌গার ইঙ্গিতে লেখনীকে বেগ দিতে হইবে, সেই বল্‌গার আকর্ষণে তাহাকে সর্বদা সংযত করিতে হইবে। এই-সকল ক্ষমতাসামঞ্জস্য বঙ্কিমের ছিল। সেইজন্য মৃত্যুর অনতিপূর্বে তিনি যখন প্রাচীন বেদ পুরাণ সংগ্রহ করিয়া প্রস্তুত হইয়া বসিয়াছিলেন তখন বঙ্গসাহিত্যের বড়ো আশার কারণ ছিল, কিন্তু মৃত্যু সে আশা সফল হইতে দিল না, এবং আমাদের ভাগ্যে যাহা অসম্পন্ন রহিয়া গেল তাহা যে কবে সমাধা হইবে কেহই বলিতে পারে না।
    বঙ্কিম এই-যে সর্বপ্রকার আতিশয্য এবং অসংগতি হইতে আপনাকে রক্ষা করিয়া গিয়াছেন ইহা তাঁহার প্রতিভার প্রকৃতিগত। যে-কেহ তাঁহার রচনা পড়িয়াছেন সকলেই জানেন বঙ্কিম হাস্যরসে সুরসিক ছিলেন। যে পরিষ্কার যুক্তির আলোকের দ্বারা সমস্ত আতিশয্য ও অসংগতি প্রকাশ হইয়া পড়ে হাস্যরস সেই কিরণেরই একটি রশ্মি। কতদূর পর্যন্ত গেলে একটি ব্যাপার হাস্যজনক হইয়া উঠে তাহা সকলে অনুভব করিতে পারে না, কিন্তু যাঁহারা হাস্যরসরসিক তাঁহাদের অন্তঃকরণে একটি বোধশক্তি আছে যদ্দারা তাঁহারা সকল সময়ে নিজের না হইলেও অপরের কথাবার্তা আচারব্যবহার এবং চরিত্রের মধ্যে সুসংগতির সূক্ষ্ম সীমাটুকু সহজে নির্ণয় করিতে পারেন।
    নির্মল শুভ্র সংযত হাস্য বঙ্কিমই সর্বপ্রথমে বঙ্গসাহিত্যে আনয়ন করেন। তৎপূর্বে বঙ্গসাহিত্যে হাস্যরসকে অন্য রসের সহিত এক পঙ্‌ক্তিতে বসিতে দেওয়া হইত না। সে নিম্নাসনে বসিয়া শ্রাব্য অশ্রাব্য ভাষায় ভাঁড়ামি করিয়া সভাজনের মনোরঞ্জন করিত। আদিরসেরই সহিত যেন তাহার কোনো-একটি সর্ব-উপদ্রবসহ বিশেষ কুটুম্বিতার সম্পর্ক ছিল এবং ঐ রসটাকেই সর্বপ্রকারে পীড়ন ও আন্দোলন করিয়া তাহার অধিকাংশ পরিহাস-বিদ্রূপ প্রকাশ পাইত। এই প্রগল্‌ভ বিদূষকটি যতই প্রিয়পাত্র থাক্‌ কখনো সম্মানের অধিকারী ছিল না। যেখানে গম্ভীরভাবে কোনো বিষয়ের আলোচনা হইত সেখানে হাস্যের চপলতা সর্বপ্রযত্নে পরিহার করা হইত।
    বঙ্কিম সর্বপ্রথমে হাস্যরসকে সাহিত্যের উচ্চশ্রেণীতে উন্নীত করেন। তিনিই প্রথম দেখাইয়া দেন যে, কেবল প্রহসনের সীমার মধ্যে হাস্যরস বদ্ধ নহে; উজ্জ্বল শুভ্র হাস্য সকল বিষয়কেই আলোকিত করিয়া তুলিতে পারে। তিনিই প্রথম দৃষ্টান্তের দ্বারা প্রমাণ করাইয়া দেন যে, এই হাস্যজ্যোতির সংস্পর্শে কোনো বিষয়ের গভীরতার গৌরব হ্রাস হয় না, কেবল তাহার সৌন্দর্য এবং রমণীয়তার বৃদ্ধি হয়, তাহার সর্বাংশের প্রাণ এবং গতি যেন সুস্পষ্টরূপে দীপ্যমান হইয়া উঠে। যে বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যের গভীরতা হইতে অশ্রুর উৎস উন্মুক্ত করিয়াছেন সেই বঙ্কিম আনন্দের উদয়শিখর হইতে নবজাগ্রত বঙ্গসাহিত্যের উপর হাস্যের আলোক বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছেন।
    কেবল সুসংগতি নহে, সুরুচি এবং শিষ্টতার সীমা নির্ণয় করিতেও একটি স্বাভাবিক সূক্ষ্ম বোধশক্তির আবশ্যক। মাঝে মাঝে অনেক বলিষ্ঠ প্রতিভার মধ্যে সেই বোধশক্তির অভাব দেখা যায়। কিন্তু বঙ্কিমের প্রতিভায় বল এবং সৌকুমার্যের একটি সুন্দর সংমিশ্রণ ছিল। নারীজাতির প্রতি যথার্থ বীরপুরুষের মনে যেরূপ একটি সসম্ভ্রম সম্মানের ভাব থাকে তেমনি সুরুচি এবং শীলতার প্রতি বঙ্কিমের বলিষ্ঠবুদ্ধির একটি বীরোচিত প্রীতিপূর্ণ শ্রদ্ধা ছিল। বঙ্কিমের রচনা তাহার সাক্ষ্য। বর্তমান লেখক যেদিন প্রথম বঙ্কিমকে দেখিয়াছিল, সেদিন একটি ঘটনা ঘটে যাহাতে বঙ্কিমের এই স্বাভাবিক সুরুচিপ্রিয়তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
    সেদিন লেখকের আত্মীয় পূজ্যপাদ শ্রীযুক্ত শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর মহোদয়ের নিমন্ত্রণে তাঁহাদের মরকতকুঞ্জে কলেজ-রিয়্যুনিয়ন নামক মিলনসভা বসিয়াছিল। ঠিক কতদিনের কথা স্মরণ নাই, কিন্তু আমি তখন বালক ছিলাম। সেদিন সেখানে আমার অপরিচিত বহুতর যশস্বী লোকের সমাগম হইয়াছিল। সেই বুধমণ্ডলীর মধ্যে একটি ঋজু দীর্ঘকায় উজ্জ্বলকৌতুকপ্রফুল্লমুখ গুম্ফধারী প্রৌঢ় পুরুষ চাপকানপরিহিত বক্ষের উপর দুই হস্ত আবদ্ধ করিয়া দাঁড়াইয়া ছিলেন। দেখিবামাত্রই যেন তাঁহাকে সকলের হইতে স্বতন্ত্র এবং আত্মসমাহিত বলিয়া বোধ হইল। আর সকলে জনতার অংশ, কেবল তিনি যেন একাকী একজন। সেদিন আর-কাহারো পরিচয় জানিবার জন্য আমার কোনোরূপ প্রয়াস জন্মে নাই, কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়া তৎক্ষণাৎ আমি এবং আমার একটি আত্মীয় সঙ্গী একসঙ্গেই কৌতূহলী হইয়া উঠিলাম। সন্ধান লইয়া জানিলাম তিনিই আমাদের বহুদিনের অভিলষিতদর্শন লোকবিশ্রুত বঙ্কিমবাবু। মনে আছে, প্রথম দর্শনেই তাঁহার মুখশ্রীতে প্রতিভার প্রখরতা এবং বলিষ্ঠতা এবং সর্বলোক হইতে তাঁহার একটি সুদূর স্বাতন্ত্র্যভাব আমার মনে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। তাহার পর অনেক বার তাঁহার সাক্ষাৎলাভ করিয়াছি, তাঁহার নিকট অনেক উৎসাহ এবং উপদেশ প্রাপ্ত হইয়াছি, এবং তাঁহার মুখশ্রী স্নেহের কোমলহাস্যে অত্যন্ত কমনীয় হইতে দেখিয়াছি, কিন্তু প্রথম দর্শনে সেই-যে তাঁহার মুখে উদ্যত খড়ে্‌গর ন্যায় একটি উজ্জ্বল সুতীক্ষ্ণ প্রবলতা দেখিতে পাইয়াছিলাম, তাহা আজ পর্যন্ত বিস্মৃত হই নাই।
    সেই উৎসব উপলক্ষে একটি ঘরে একজন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশানুরাগমূলক স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোক পাঠ এবং তাহার ব্যাখ্যা করিতেছিলেন। বঙ্কিম এক প্রান্তে দাঁড়াইয়া শুনিতেছিলেন। পণ্ডিতমহাশয় সহসা একটি শ্লোকে পতিত ভারতসন্তানকে লক্ষ্য করিয়া একটা অত্যন্ত সেকেলে পণ্ডিতি রসিকতা প্রয়োগ করিলেন, সে রস কিঞ্চিৎ বীভৎস হইয়া উঠিল। বঙ্কিম তৎক্ষণাৎ একান্ত সংকুচিত হইয়া দক্ষিণ-করতলে মুখের নিম্নার্ধ ঢাকিয়া পার্শ্ববর্তী দ্বার দিয়া দ্রুতবেগে অন্য ঘরে পলায়ন করিলেন। বঙ্কিমের সেই সসংকোচ পলায়নদৃশ্যটি অদ্যাবধি আমার মনে মুদ্রাঙ্কিত হইয়া আছে।
    বিবেচনা করিয়া দেখিতে হইবে, ঈশ্বর গুপ্ত যখন সাহিত্যগুরু ছিলেন বঙ্কিম তখন তাঁহার শিষ্যশ্রেণীর মধ্যে গণ্য ছিলেন। সে সময়কার সাহিত্য অন্য যে-কোনো প্রকার শিক্ষা দিতে সমর্থ হউক ঠিক সুরুচি শিক্ষার উপযোগী ছিল না। সে সময়কার অসংযত বাকযুদ্ধ এবং আন্দোলনের মধ্যে দীক্ষিত ও বর্ধিত হইয়া ইতরতার প্রতি বিদ্বেষ, সুরুচির প্রতি শ্রদ্ধা এবং শ্লীলতা সম্বন্ধে অক্ষুণ্ন বেদনাবোধ রক্ষা করা কী যে আশ্চর্য ব্যাপার তাহা সকলেই বুঝিতে পারিবেন। দীনবন্ধুও বঙ্কিমের সমসাময়িক এবং তাঁহার বান্ধব ছিলেন, কিন্তু তাঁহার লেখায় অন্য ক্ষমতা প্রকাশ হইলেও তাহাতে বঙ্কিমের প্রতিভার এই ব্রাহ্মণোচিত শুচিতা দেখা যায় না। তাঁহার রচনা হইতে ঈশ্বর গুপ্তের সময়ের ছাপ কালক্রমে ধৌত হইতে পারে নাই।
    আমাদের মধ্যে যাঁহারা সাহিত্যব্যবসায়ী তাঁহারা বঙ্কিমের কাছে যে কী চিরঋণে আবদ্ধ তাহা যেন কোনো কালে বিস্মৃত না হন। একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি করিয়া তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন। পূর্বে যাহাতে কেবল স্থানীয় গ্রাম্য সুর বাজিত তাহা আজ বিশ্বসভায় শুনাইবার উপযুক্ত ধ্রুবপদ অঙ্গের কলাবতী রাগিণী আলাপ করিবার যোগ্য হইয়া উঠিয়াছে। সেই তাঁহার স্বহস্তসম্পূর্ণ স্নেহপালিত ক্রোড়সঙ্গিনী বঙ্গভাষা আজ বঙ্কিমের জন্য অন্তরের সহিত রোদন করিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তিনি এই শোকোচ্ছ্বাসের অতীত শান্তিধামে দুষ্কর জীবনযজ্ঞের অবসানে নির্বিকার নিরাময় বিশ্রাম লাভ করিয়াছেন। মৃত্যুর পরে তাঁহার মুখে একটি কোমল প্রসন্নতা, একটি সর্বদুঃখতাপহীন গভীর প্রশান্তি উদ্‌ভাসিত হইয়া উঠিয়াছিল-- যেন জীবনের মধ্যাহ্নরৌদ্রদগ্ধ কঠিন সংসারতল হইতে মৃত্যু তাঁহাকে স্নেহসুশীতল জননীক্রোড়ে তুলিয়া লইয়াছেন। আজ আমাদের বিলাপ-পরিতাপ তাঁহাকে স্পর্শ করিতেছে না, আমাদের ভক্তি-উপহার গ্রহণ করিবার জন্য সেই প্রতিভাজ্যোতির্ময় সৌম্য প্রসন্নমূর্তি এখানে উপস্থিত নাই। আমাদের এই শোক এই ভক্তি কেবল আমাদেরই কল্যাণের জন্য। বঙ্কিম সাহিত্যক্ষেত্রে যে আদর্শ স্থাপন করিয়া গিয়াছেন এই শোকে এই ভক্তিতে সেই আদর্শপ্রতিমা আমাদের অন্তরে উজ্জ্বল এবং স্থায়ীরূপে প্রতিষ্ঠিত হউক। প্রস্তরের মূর্তি স্থাপনের অর্থ এবং সামর্থ্য আমাদের যদি না থাকে, তবে একবার তাঁহার মহত্ত্ব সর্বতোভাবে মনের মধ্যে উপলব্ধি করিয়া তাঁহাকে আমাদের বঙ্গহৃদয়ের স্মরণস্তম্ভে স্থায়ী করিয়া রাখি। ইংরাজ এবং ইংরাজের আইন চিরস্থায়ী নহে; রাজনৈতিক ধর্মনৈতিক সমাজনৈতিক মতামত সহস্রবার পরিবর্তিত হইতে পারে; যে-সকল ঘটনা যে-সকল অনুষ্ঠান আজ সর্বপ্রধান বলিয়া বোধ হইতেছে এবং যাহার উন্মাদনার কোলাহলে সমাজের খ্যাতিহীন শব্দহীন কর্তব্যগুলিকে নগণ্য বলিয়া ধারণা হইতেছে, কাল তাহার স্মৃতিমাত্র চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট থাকিতে না পারে; কিন্তু যিনি আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বপ্রকার ভাবপ্রকাশের অনুকূল করিয়া গিয়াছেন তিনি এই হতভাগ্য-দরিদ্র দেশকে একটি অমূল্য চিরসম্পদ দান করিয়াছেন। তিনি স্থায়ী জাতীয় উন্নতির একমাত্র মূল উপায় স্থাপন করিয়া গিয়াছেন। তিনিই আমাদের নিকট যথার্থ শোকের মধ্যে সান্ত্বনা, অবনতির মধ্যে আশা, শ্রান্তির মধ্যে উৎসাহ এবং দারিদ্র্যের শূন্যতার মধ্যে চির-সৌন্দর্যের অক্ষয় আকর উদ্‌ঘাটিত করিয়া দিয়াছেন। আমাদিগের মধ্যে যাহা-কিছু অমর এবং আমাদিগকে যাহা-কিছু অমর করিবে সেই-সকল মহাশক্তিকে ধারণ করিবার পোষণ করিবার প্রকাশ করিবার এবং সর্বত্র প্রচার করিবার একমাত্র উপায় যে মাতৃভাষা তাহাকেই তিনি বলবতী এবং মহীয়সী করিয়াছেন।
    রচনাবিশেষের সমালোচনা ভ্রান্ত হইতে পারে-- আমাদিগের নিকট যাহা প্রশংসিত কালক্রমে শিক্ষা রুচি এবং অবস্থার পরিবর্তনে আমাদের উত্তরপুরুষের নিকট তাহা নিন্দিত এবং উপেক্ষিত হইতে পারে; কিন্তু বঙ্কিম বঙ্গভাষার ক্ষমতা এবং বঙ্গসাহিত্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছেন, তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গসাহিত্যে ভাবমন্দাকিনীর অবতারণ করিয়াছেন এবং সেই পুণ্যস্রোতস্পর্শে জড়ত্বশাপ মোচন করিয়া আমাদের প্রাচীন ভস্মরাশিকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছেন। ইহা কেবল সাময়িক মত নহে, এ কথা কোনো বিশেষ তর্ক বা রুচির উপর নির্ভর করিতেছে না, ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য।
    এই কথা স্মরণে মুদ্রিত করিয়া সেই বাংলা লেখকদিগের গুরু, বাংলা পাঠকদিগের সুহৃদ, এবং সুজলা সুফলা মলয়জশীতলা বঙ্গভূমির মাতৃবৎসল প্রতিভাশালী সন্তানের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করি, যিনি জীবনের সায়াহ্ন আসিবার পূর্বেই, নূতন অবকাশে নূতন উদ্যমে নূতন কার্যে হস্তক্ষেপ করিবার প্রারম্ভেই, আপনার অপরিম্লান প্রতিভারশ্মি সংহরণ করিয়া বঙ্গসাহিত্যাকাশ ক্ষীণতর জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর হস্তে সমর্পণপূর্বক গত শতাব্দীর বর্ষশেষের পশ্চিমদিগন্তসীমায় অকালে অস্তমিত হইলেন।"
     
    -রবীন্দ্রনাথ
     
     
     
         
     
         
     
     
     
  • দীপ | 42.110.145.127 | ২৮ জুলাই ২০২৩ ১৮:৩৪521829
  • বঙ্কিমের সৃষ্টি ও মনস্বিতা সম্পর্কিত রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন।
    এখন রবীন্দ্রনাথ না আবার হিন্দুত্ববাদী হয়ে যান!
  • দীপ | 42.110.145.127 | ২৮ জুলাই ২০২৩ ১৮:৩৬521830
  • অবশ্য এরপরও নির্লজ্জ মিথ্যাবাদীর প্রোপাগান্ডা বন্ধ হবেনা!
  • দীপ | 42.110.137.42 | ৩১ জুলাই ২০২৩ ২০:১২521966
  • দিলীপকুমার রায় তাঁর 'স্মৃতিচারণ' বইয়ে লিখেছেন - 
     
    আত্মমর্যাদার কথা বলতে একদিনের কথা মনে প'ড়ে গেল । আমি সেদিন তাঁর ওখানে সাউথ কেনসিংটনে ব'সে তাঁর সঙ্গে গল্প করছি এমন সময়ে কয়েকটি ভারতীয় ছেলে এল দরবার করতে । কী, না জালিয়ানওয়ালাবাগে হাজার বারোশো নিরস্ত্র নরনারী জেনারেল ডায়ারের গুলিতে মরেছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভায় তাঁকে সভাপতি হ'তে হবে । রবীন্দ্রনাথের গৌর আনন লাল হয়ে উঠল বিরক্তিতে । তিনি উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বললেনঃ "তোমাদের কি লজ্জা করে না একটুও ? জালিয়ানওয়ালাবাগে আমরা পশুর মত মার খেয়েছি - হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে অনেকে প্রাণ বাঁচিয়েছিল - এই কথা এখানে হাটে-বাজারে প্রচার করতে চাও ? - আমাদের চরম অপমানের কথা ঘোষণা করবে বড় গলা করে?...যাও তোমরা । দেশের গ্লানি ঢাক পিটিয়ে প্রচার করতেই যদি কোমর বেঁধে থাকো তবে সে ঢাকীদের মধ্যে আমাকে ভর্তি করবার মিথ্যে চেষ্টা কোরো না ।"
    কবির ক্রুদ্ধ রাঙা মুখ আজও মনে পড়ে । ... ওরা চ'লে যাবার পরে আমাকে বললেনঃ "দিলীপ, পেট্রিয়ট হ'লে কি জাঁক ক'রে বোকা বনতেই হবে ? আমরা এ-স্বাধীন দেশে এসেও কি আমাদের জাতীয় অগৌরব লজ্জা হীনতা ভীরুতা প্রচার ক'রে এদের আদর কাড়তে ছুটব ? ... এখানে এসে যদি ভারতের কথা বলতে হয় তবে আমরা যেন কেবল সেই সেই গুণ, সেই সেই সম্পদ, সেই সেই সাধনার কথাই বলি যাদের দৌলতে ভারত বড় হয়েছিল - যেমন বিবেকানন্দ বলেছিলেন । তাই তো তিনি এদের শ্রদ্ধাও পেয়েছিলেন । তিনি এদের এসে ডাক দিয়েছিলেন 'উত্তিষ্ঠত জাগ্রত' ব'লে- কাঁদুনি গান নি আমাদের হাজারো দুর্দশার কথা জানিয়ে । ... আমেরিকানদের সামনে এসে তিনি মাথা উঁচু ক'রেই বলেছিলেন ভারতের ধর্মতত্ত্বের কথা - যদি কেঁদে ভাসাতেন 'দুটি ভিক্ষে দাও গো' ব'লে, তাহ'লে না পেতেন ভিক্ষা, না সমাদর ।"
  • দীপ | 42.110.137.42 | ৩১ জুলাই ২০২৩ ২০:১৩521967
  • দীপ | 42.110.137.42 | ৩১ জুলাই ২০২৩ ২০:১৮521968
  • দীপ | 42.110.137.42 | ৩১ জুলাই ২০২৩ ২৩:২৪521975
  • মহাকবির দৃষ্টিতে ভারতের ইতিহাসে ও সমাজে বিবেকানন্দের অবদান।  পরিষ্কার বলছেন বিবেকানন্দের বাণী দেশের যুবককে ত্যাগের পথে, মুক্তির পথে প্রবৃত্ত করেছে। এই বাণী বুঝিয়েছে ছুঁৎমার্গ আসলে মানুষের আত্মঅবমাননা। বলেছে দরিদ্রের মধ্য দিয়ে নারায়ণ আমাদের সেবা পেতে চান।
     
  • দীপ | 42.110.137.42 | ৩১ জুলাই ২০২৩ ২৩:৩৪521976
  • অন্যদিকে মিথ্যাবাদী ইতর বিবেকানন্দের মধ্যে দলিত ও মুসলিম বিদ্বেষ খুঁজে পেয়েছে! 
    অবশ্য এরপরও মিথ্যাবাদী ইতর টি এইভাবে মিথ্যাচারিতা চালিয়ে যাবে!
  • দীপ | 42.110.145.174 | ১৩ আগস্ট ২০২৩ ১৯:৫৯522392
  • আমি স্বীকার করি অতীতের সকল ধর্মকে, উপাসনা করি সকলের সঙ্গে । ঈশ্বর যে নামেই আসুন তিনি আমারই ঈশ্বর । আমি যাব মুসলমানের মসজিদে, প্রবেশ করব খ্রীস্টানের গির্জায়, নতজানু হব পবিত্র ক্রুশের সামনে, শরণ নেব প্রভু বুদ্ধের, অরণ্যে যাব, বসব ধ্যানাসনে হিন্দুর সঙ্গে সেই আলোকের আকাঙ্ক্ষায় - যা দীপ্যমান সকল হৃদয়ে । 
    শেষ নয় সেখানে - আমি মুক্ত রাখব হৃদয়দুয়ার ভাবীকালের প্রবেশের জন্য । বর্তমানে অবস্থিত আমরা - উন্মুক্ত থাকব ভবিষ্যতের মুখে । ঈশ্বর-গ্রন্থের রচনা কি সমাপ্ত হয়ে গেছে - নাকি অবিরাম রচিত হচ্ছে আলোকিত পৃষ্ঠাগুলি ? অপূর্ব সে গ্রন্থ, বেদ বাইবেল কোরান-সহ অন্য পবিত্র গ্রন্থ তারই কিছু পৃষ্ঠা ছাড়া আর কিছু নয় । এখনো অপঠিত অগণ্য পৃষ্ঠা - খুলে যাক সে গ্রন্থ চিরকালের জন্য ।
    অতীতের সকল আচার্যকে নমস্কার । বর্তমানের মহীয়ানদের নমস্কার । ভবিষ্যতের পরিত্রাতাদের নমস্কার - নমস্কার ।
     
    মূল ইংরেজিতে -
    I accept all religions that were in the past, and worship with them all; I worship God with every one of them, in whatever form they worship Him. I shall go to the mosque of the Mohammedan; I shall enter the Christian's church and kneel before the crucifix; I shall enter the Buddhistic temple, where I shall take refuge in Buddha and in his Law. I shall go into the forest and sit down in meditation with the Hindu, who is trying to see the Light which enlightens the heart of every one.
     
    Not only shall I do all these, but I shall keep my heart open for all that may come in the future. Is God's book finished? Or is it still a continuous revelation going on? It is a marvellous book — these spiritual revelations of the world. The Bible, the Vedas, the Koran, and all other sacred books are but so many pages, and an infinite number of pages remain yet to be unfolded. I would leave it open for all of them. We stand in the present, but open ourselves to the infinite future. We take in all that has been in the past, enjoy the light of the present, and open every window of the heart for all that will come in the future. Salutation to all the prophets of the past, to all the great ones of the present, and to all that are to come in the future!
     
     
    -বিবেকানন্দ
  • দীপ | 2402:3a80:196c:435e:778:5634:1232:5476 | ২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১০523059
  • বাংলা দেশের চিত্ত সর্বকালে সর্বদেশে প্রসারিত হোক্‌, বাংলা দেশের বাণী সর্বজাতি সর্বমানবের বাণী হোক্‌। আমাদের বন্দে মাতরং মন্ত্র বাংলাদেশের বন্দনার মন্ত্র নয় - এ হচ্ছে বিশ্বমাতার বন্দনা - সেই বন্দনার গান আজ যদি আমরা প্রথম উচ্চারণ করি তবে আগামী ভাবী যুগে একে একে সমস্ত দেশে এই মন্ত্র ধ্বনিত হয়ে উঠবে।"
     
    - রথীন্দ্রনাথকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠি
  • দীপ | 2402:3a80:196c:435e:778:5634:1232:5476 | ২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১২523060
  • প্রসঙ্গত বন্দে মাতরমের প্রথম স্তবকে সুরারোপ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, পরবর্তী স্তবকগুলিতে তাঁর ভাইঝি সরলাদেবী! 
    হিন্দুত্ববাদী রবীন্দ্রনাথ! 
    অবশ্য এরপরও নির্লজ্জ মিথ্যাচার বন্ধ হবেনা!
  • দীপ | 42.110.139.57 | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৪৮523128
  • দীপ | 42.110.139.57 | ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৫১523129
  • রামকৃষ্ণ মিশন পরিচালিত ঝাড়গ্রাম একলব্য আবাসিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পরীক্ষার ফলাফল।
    এরপরও অবশ্য নির্লজ্জ মিথ্যাচার বন্ধ হবেনা!
  • দীপ | 42.110.146.157 | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:৫৬523509
  • "Sisters and Brothers of America,
     
    It fills my heart with joy unspeakable to rise in response to the warm and cordial welcome which you have given us. I thank you in the name of the most ancient order of monks in the world, I thank you in the name of the mother of religions, and I thank you in the name of millions and millions of Hindu people of all classes and sects.
     
    My thanks, also, to some of the speakers on this platform who, referring to the delegates from the Orient, have told you that these men from far-off nations may well claim the honor of bearing to different lands the idea of toleration. I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true. I am proud to belong to a nation which has sheltered the persecuted and the refugees of all religions and all nations of the earth. I am proud to tell you that we have gathered in our bosom the purest remnant of the Israelites, who came to Southern India and took refuge with us in the very year in which their holy temple was shat­tered to pieces by Roman tyranny. I am proud to belong to the religion which has sheltered and is still fostering the remnant of the grand Zoroastrian nation. I will quote to you, brethren, a few lines from a hymn which I remember to have repeated from my earliest boyhood, which is every day repeated by millions of human beings: “As the different streams having their sources in different paths which men take through different tendencies, various though they appear, crooked or straight, all lead to Thee.”
     
    The present convention, which is one of the most august assemblies ever held, is in itself a vindication, a declaration to the world of the wonderful doctrine preached in the Gita: “Whosoever comes to Me, through whatsoever form, I reach him; all men are struggling through paths which in the end lead to me.” Sectarianism, bigotry, and its horrible descen­dant, fanaticism, have long possessed this beautiful earth. They have filled the earth with vio­lence, drenched it often and often with human blood, destroyed civilization and sent whole nations to despair. Had it not been for these horrible demons, human society would be far more advanced than it is now. But their time is come; and I fervently hope that the bell that tolled this morning in honor of this convention may be the death-knell of all fanaticism, of all persecutions with the sword or with the pen, and of all uncharitable feelings between persons wending their way to the same goal."
     
    Words spoken by Swami Vivekananda in his first speech at the World Parliament of Religions at Chicago on 11th September, 1893.
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন