এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ   স্মৃতিকথা

  • একটি অরাজনৈতিক মৃত্যু

    যোষিতা 
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ১১ এপ্রিল ২০২৩ | ২৫৩৩ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • এখানে লিখব সেই মেয়েটির কথার বাইরেও অন্য কিছু ঘটনা 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • | ১১ এপ্রিল ২০২৩ ১৮:৫৫739966
  • কোন মেয়েটির? 
  • যোষিতা | ১১ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:২০739967
  • লিখছি...
  • যোষিতা | 194.56.48.120 | ১১ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:৩৫739968
  • এই লেখাটির চরিত্রদের নাম বদলে লিখলেও যা, না বদলালেও তা। ঘটনা সত্য। একটি চরিত্রও কাল্পনিক নয়।

    তবে লেখাটি শুধু একটা ঘটনার কথাই বলে, তা কিন্তু নয়, এতে অনেক খুচরো ব্যাপারও থাকবে। মূল ব্যাপারটা সেভাবে গোদা ভাষায় দেখলে অভিবাসন, আর খুঁটিয়ে দেখলে এই অভিবাসনে একটা বড়ো অংশ হিউম্যান ট্র্যাফিকিং।
    তবে কিনা, সব রকমের হিউম্যান ট্র্যাফিকিং এর চিত্র সমান দেখতে হয় না, এবং আমাদের আশানুরূপ গল্পের খাপে খাবে এমনও মাথার দিব্যি নেই।
    আমি নিজেও একবার প্রায় ট্র্যাফিকড হতে হতে বেঁচে গেছি ভাগ্যক্রমে, যদি না বাঁচতাম তাহলে আমার জীবন অন্যরকম হতো।
    তবে এখন যেসব ঘটনা বলব, তার একটাও আমার নিজের নয়, যদিও সেসবের মানসিক অভিঘাত অল্প বিস্তর ভোগ করেছি।
     
  • যোষিতা | 194.56.48.120 | ১১ এপ্রিল ২০২৩ ২০:১২739969
  • ২০১৮ সালের নভেম্বরের গোড়ায় বের্লিনে যাই, এক সপ্তাহের জন্য বেড়াতে যাওয়া, বিশেষ করে ৯ই নভেম্বরে ব্রান্ডেনবুর্গার টোর দেখার জন্যও বটে।
    আমরা হোটেলে ছিলাম, নিজেদের মতো ঘুরছিলাম। এছাড়াও আমাদের স্বল্প পরিচিত একজন বের্লিনে ছিল সেই সময়ে, তার সঙ্গেও প্রায় প্রত্যেক দিনই দেখা হয়েছে।
    বের্লিনে সেই মানুষটি প্রায় বছর তিনেক হলো রয়েছে, বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক হিংসার কারনে সে পালিয়ে এসেছে, পরে তার অন্য নিকট ব্যক্তিরা এসেছে ধীরে ধীরে।
    এই ব্যক্তিটির সঙ্গে নেট দুনিয়াতেই আলাপ, ইয়োরোপে শুধু নয়। বিদেশ বিভুঁইয়ে মাতৃভাষার বন্ধন, বড়ো বন্ধন। বিশেষ করে ইয়োরোপ এমন একটা জায়গা, যেখানে দুএকটা দেশ বাদ দিলে ইংরিজি তেমন চলে না। সবার নিজের নিজের ভাষা।
    যাইহোক, এই লোকটির নিজস্ব একটা অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ছিল। প্রায় পাঁচ ছ মাস তার সঙ্গে আমাদের আলাপচারিতা চলেছে ফোনে।
    সে বাংলাদেশ ছেড়ে জারমানি এসে রয়েছে বিনা কারনে নয়, তার ওপর অনেক প্রাণঘাতী হামলা হুজ্জৎ হয়েছে বলে সে জানালো, মাঝে দীর্ঘ দুবছর পালিয়ে কোলকাতাতেও থেকেছে বাড়ি ভাড়া নিয়ে। সর্বোপরি, সে দালালের হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে টুরিস্ট ভিসা নিয়ে আসে নি, "গলাকাটা" পাসপোর্ট ও নয়, মাঝরাতে পূর্বইয়োরোপের ঝোপ জঙ্গল নদী পেরিয়ে পায়ে হেঁটেও নয়। সে এসেছে এমিরাটসের বিজনেস ক্লাসে করে, সেই দোতলা বিমানে, যেখানে বিজনেস ক্লাসের বাথরুমে বাথটাবে স্নান করার দুর্লভ সুযোগ থাকে। এসে পৌঁছতেই তাকে অভ্যর্থনা করে ফুললি ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে দিয়েছে, মাসে মাসে খরচ দিচ্ছে তার ভরণপোষণের জন্য এক আন্তর্জাতিক সংস্থা, এবং তার ওপরে সবচেয়ে নামকরা একজন ইমিগ্রেশন লইয়ারের খরচ ও বইছে সেই সংস্থা এই ব্যক্তিটির সপরিবারে পোলিটিক্যাল অ্যাসাইলামের জন্য।
    এখানেই শেষ নয়, তাকে জার্মান শেখাচ্ছে, তার ছেলেপুলেদেরকে ইস্কুলে ভর্তি করা হয়েছে, বৌকে চাকরি দেওয়া যাচ্ছিলো না, শেষে বৌ নিজেই কাজ জোগাড় করে ফেলেছে। লোকটিকে মাঝে মধ্যে নানান জায়গায় লেকচার দিতে নিয়ে যায় এই সংস্থা ফার্স্ট ক্লাসের রেলভাড়া হোটেল ইত্যাদির খরচ তো দেয়ই, আরও এক মুঠো করে পারিশ্রমিকও দেয়।
    এইসব দেখে শুনে আমরা কিছুটা তাজ্জব এবং কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কেস টা কী?
    এই লোক কী এমন কাজ করেছে, যে তার এমন প্রাণের ভয় যে, তাকে খুঁজে পেলেই মৌলবাদীরা কুচি কুচি করে কেটে ফেলবে?
  • যোষিতা | ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০০:৫৫739971
  • যে মানুষটি প্রাণনাশের আশঙ্কায় নিজের দেশ ছেড়ে জারমানিতে এসেছে, যার নিজস্ব একটা সরকারি চাকরি ছিল শিক্ষা জগতে, একটি কলেজে, যাকে সুরক্ষা দেবার জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা সমস্ত ব্যবস্থা করেছে, সে এখন দোলাচলে রয়েছে যে তার অ্যাসাইলাম গ্রান্টেড হবে কি না। এই সংস্থাটি উকিলের খরচ জোগালেও, প্রতিটি শুনানির জন্য উকিলকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে বের্লিনে উড়িয়ে নিয়ে এলেও সমস্যা অন্যখানে। নিজের যাবতীয় কাগজপত্র এবং উদ্বাস্তু হবার জন্য প্রমাণ দেখাবার নথি সমস্তই বাংলা বা ইংরিজিতে। শয়ে শয়ে পাতার রেফারেন্স। ফাইনাল শুনানিতে জজ সাহেবের হাতে দশ পনের মিনিট বা বড়জোর আধঘন্টা সময় থাকবে। এত অল্প সময়ে সমস্ত কিছু গুছিয়ে জজসাহেবকে উকিল বোঝাবে ঐ সময়ের মধ্যে। অথচ এই লোক উকিলের সঙ্গে কথা বলতে পারে না। কোনও কমন ভাষা নেই। উকিল বাংলা জানে না, সে ইংরিজি জানে না, জারমানও প্রায় তিন বছরে কিছুই শিখে উঠতে পারে নি। 
    সে আমাদের সাহায্য নিয়েছিল। কোনও কোনও দিন পাঁচ ঘন্টা একনাগাড়ে তার বক্তব্য শুনে বুঝে জারমানে অনুবাদ করে লিখে লিখে তাকে পাঠিয়েছি আমরা। কখনও আরও বেশি সময় দিয়েছি। মাসখানেক তে বটেই আমরা এই আশায় খেটেছিলাম যাতে সে অ্যাসাইলাম পেয়ে যায়। 
    উকিল জারমানে অনুদিত তথ্যাবলী পেয়ে বেজায় খুশি জানা গেল। তবে ফাইনাল শুনানির দিনে নাকি সরকারি দোভাষী আসবে, যে বাংলা থেকে জারমান করবে তার কথা, এবং জজ সাহেব কিছু জিজ্ঞাসা করলেও তাকে বাংলায় জানাবে।
    তখনও আমরা বের্লিনে যাবার প্ল্যান করিনি। সম্ভবত এটা সেপ্টেম্বরের শেষে বা অক্টোবরের গোড়ার ঘটনা।
    তারিখ পড়ল। উকিল এলেন। সে পৌঁছে গেল ইমিগ্রেশন  ডিপার্টমেন্টের বিশেষ আদালতে।
    জুরিখ থেকে আমরা ফোনে খবর নিচ্ছি। সে আমাদের কী উত্তেজনা সেদিন। খবর পেয়েছি বের্লিন থেকে অ্যাসাইলামের অধিকাংশ মামলাই খারিজ হয়ে যায়। তবু আমাদের মনে আশা, ভাল উকিল আছে, লোকটাও জেনুইন। 
  • যোষিতা | ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০২:৪১739972
  • সে আসলে একা আসতে চায় নি প্রৎমে জারমানিতে। সঙ্গে তার প্রেমিকাকেও নিয়ে আসতে চেয়েছিল। 
    এ সমস্তই একটু একটু করে জানা হচ্ছিল আমাদের। সে বিবাহিত, দুজন টিনেজার জমজ সন্তান আছে এবং বাংলাদেশে পলিগ্যামি বেশ প্রচলিত, নিম্নবিত্তদের মধ্যে ভালই চলে। সে যদিও মোটামুটি উচ্চমধ্যবিত্তের দিকেই, তবে বৌয়ের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা হচ্ছিল না সম্ভবত।
    আরও পাঁচটা ব্লগারের মত তারও একটা ব্লগ ছিল বাংলাদেশে থাকাকালীন এবং সেই সূত্রেই সদ্য ইস্কুল পাশ করা এক হিন্দু মেয়ে তার ব্লগে যোগ দেয়। ভৌগলিকভাবে মেয়েটির বাড়ি নেত্রকোণা থেকে এর বাড়ি অন্ক দূরের জেলায় হলেও ক্রমশঃ সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
    ব্লগার শব্দটি অনেক মানুষের কাছেই সে সময়ে কুরুচিপূর্ণ ঠেকত সেসময়ে। এক শ্রেণীর মানুষ মনে করত ব্লগাররা নাস্তিক, তাদের ইমান নাই, কাফের এর সমতূল্য, তারা ঘৃণার বস্তু, ইত্যাদি প্রভৃতি।
    এই সময়েই অভিজিত রায়ের হত্যাকাণ্ড ঘটে একুশে বইমেলায়।
    এই লোকটির দাবী যে সে অভিজিতকে পার্সোনালি চিনত, তবে মুক্তমনা র সঙ্গে তার ডাইরেক্ট লেখাপত্রের আজাল প্রদান হয় নি। তবে সেও অনুরূপ ব্লগ চালাত যেখানে দুমদাম ঈশ্বর বা আল্লাহর এগেইন্সটে লেখালেখি চলত, ফলত সেও নাকি মৌলবাদীদের ক্ষোভের শিকার হয়। তাকে শারীরিক আঘাত কতটা করেছিল সে বিষয়ে বিশেষ জানা যায় না, তবে নেত্রকোণার মেয়েটি উৎসাহিত হয়ে এমন কিছু লিখে ফেলে যে সহজেই মৌলবাদী এবং গুণ্ডারা তাকে খুঁজে পেয়ে বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বেশ কিছুদিন মেয়ে এক নাগাড়ে গণধর্ষণের শিকার হবার পরে তাকে ফিরিয়ে দিয়ে যায় মৌলবাদীরা। তারা শাসিয়ে দিয়ে যায় যে, আর বাড়াবাড়ি করলে তার ছেট দুই বোনকেও অনুরূপ শাস্তি দেওয়া হবে।
  • যোষিতা | ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০২:৫৮739973
  • এই ঘটনার জন্য যারা মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছিল কেও শাস্তি পায় নি, মামলাই হয় নি। তবে খবর রটে গেছল। বাংলাদেশের গ্রামের হিন্দুঘরের মেয়ে যার দুটো ছোট বোন আছে, সে ব্লগে যতই সুন্দর প্রবন্ধ লিখুক না কেন, পুলিশের কাছে যেতে চায় নি। তার ইস্কুল মাস্টার বাবা ও ভয় পেয়ে মেয়েদের দূরে আত্মীয়বাড়ি পাঠিয়ে দেয় পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হবার আশায়।
    এই সময়ে এই লোকটি মাঝেমাঝেই নিজের বাড়ি থেকে উধাও থাকত দীর্ঘদিন। স্ত্রীকে সরকারি চাকরিতে ঢুকিয়ে দিয়েছিল কীভাবে সেসবও ক্রমে বলেছে।
    এখন শিক্ষাক্ষেত্রে নিয়োগ দূর্নীতির যে খবর আমরা পাচ্ছি পশ্চিমবঙ্গে, তার হুবহু কার্বন কপি কেস। সাদা খাতায় সই করে জমা দেওয়া। অর্থের বিনিময়ে চাকরি। সে চাকরিতে ঘুষের সুযোগও আছে।
    স্ত্রী ও সন্তানদের রেখে সে তার ঐ প্রেমিকাকে নিয়ে বর্ডার ক্রস করে কোলকাতায় চলে এলো। বর্ডারে রেট তখন জন প্রতি হাজার টাকা।
    কোলকাতায় বাসা ভাড়া করল সল্টলেক বা রাজারহাট এলাকায়। 
    মাঝেমধ্যে সে বাংলাদেশে যায়। আবার ফিরে আসে, ব্লগ চালু রয়েছে পুরোদমে আর আসছে নানান হুমকি।
    এটাই আদর্শ সময়ে পশ্চিমের দেশে অ্যাসাইলাম নেবার। সে যোগাযোগ করল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশানালের কাছে।
    এবার শুরু হল সংগ্রাম।
  • যোষিতা | ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০৩:২৯739974
  • অ্যামনেস্টি পাকা এবং পোড় খাওয়া অরগ্যানাইজেশন। টগবগে ফুটন্ত চালের একটা টিপেই যেমন রাঁধুনি বলে দিতে পারে ভাত হতে কত দেরি, এরাও সাহায্যপ্রার্থীদের উদ্দেশ্য বুঝে যায় নিমেষেই।
    তুমি বাংলাদেশে নিরাপত্তার অভাবে ভুগছ? তাহলে নেপাল কিংবা শ্রীলঙ্কায় ব্যবস্থা করে দিই?
    কেন? নেপালে যাবে না কেন? আচ্ছা তবে ইন্ডিয়াতেই থাকো, আমরা তোমার খরচের অর্থ বহন করব।
     
    সেও প্রচুর টাকা। মাসে মাসে। সে তখন টাকা নিয়ে ঘুরতে বেরোল। রাজস্থান, সাউথ ইন্ডিয়া, মুম্বাই, উত্তরাখন্ড। প্রেমিকা সবসময় সঙ্গে যেতে চায় না। সে মানসিক বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। 
    অনেকের সঙ্গেই সে যোগাযোগ করেছে, কখনো অভিজিতের স্ত্রী বন্যা, কখনো তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি চলে গেছে। বন্যা মুক্তমনার বাইরের লোককে হেল্প করেন না বলে তার দাবী। তসলিমা সেরম পাত্তা দেয় না। যতটুকু পাত্তা দেয়, তাতে করে ইয়োরোপ অ্যামেরিকার কথা পাড়া যায় না।
    তার ভাষায় "এরা খুব সেলফিশ ধান্দাবাজ"।
    অবশেষে ধরা খেল একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা। তাদেরও কোটা আছে,বছরে এতজন বুদ্ধিজীবিকে উদ্ধার করতে হবে ফ্রীডম অফ স্পীচ যারা পাচ্ছে না।
    এরা দুজনেই অ্যাপ্লাই করল।
    মেয়েটি চেয়েছিল কোলকাতার কলেজে ভর্তি হতে। কিন্তু তার কোনও লিগ্যাল কাগজ নেই। কলেজগুলো ওভাবে নিতে পারে না।
    প্রথমে এই লোকটির আবেদন মঞ্জুর হলো, মাস ছয়েক পরে মেয়েটির।
    ছমাসের ব্যবধানে দুজনে একই পাড়ায় প্রতিবেশী।
    রাস্তার মুখোমুখি দুটো বাড়ি। 
    তারপর চলে এলো ফ্রাঙ্কফুর্ট বুক ফেয়ার। উভয়েই আমন্ত্রিত সেখানে।
  • syandi | 81.109.139.131 | ১২ এপ্রিল ২০২৩ ০৫:৫৪739975
  • ভদ্রলোক কলেজে চাকরী করতেন অথচ উকিলের সাথে বাক্যালাপ চালানোর মত ইংরাজিটুকুও জানেন না ?
  • দীমু | 110.224.97.250 | ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১০:০৬739985
  • মারাত্মক
  • Kuntala | ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১১:২০739987
  • আরে! এ তো হুট করে শেষ হয়ে গেল। বাকিটুকু কই? 
    ঘোষিতা, আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকি, এদেশের অনিয়মিত অভিবাসনের চিত্রটা একটু আলাদা, আবার অনেকটাই একরকম। এখানেও ওইসব দেখি কিছু কিছু।
    মাঝে মধ্যে ভারতীয় অধ্যাপক হ্ওয়ার সুবাদে সরকারের নানা রকম কেসে 'বিশেষজ্ঞ মতামত ' দেওয়ার ডাক পড়ে, সে আবার আরেক কঠিন ব্যাপার। এত সব জটিল ও কখনও কখনও ভয়ংকর সম্পর্কের খেলা চলতে থাকে অভিবাসী মানুষের মধ্যে যে মতামত দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে।
  • যোষিতা | ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১১:২৬739988
  • আমার হাতে এবং কাঁধে যন্ত্রণা। প্রায় শয্যাশায়ী। ব্যাথা একটু কমলেই লিখছি।
  • জয় | ১৩ এপ্রিল ২০২৩ ১১:৩০739989
  • যোদি।
    জলদি ভালো হয়ে যান। কত শত অসাধারন সব লেখা লিখতে হবে যে! 
  • যোষিতা | ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:০২740019
  • সেই লোকটির ফেসবুকে ফ্রাঙ্কফুর্ট বুকফেয়ারের ফোটো দেখলাম। বিশাল ব্যাপার। কোলকাতার মত লোক গিজগিজ করছে না বটে, কিন্তু বইয়ের সম্ভার বিপুল, খুবই সাজানো গোছানো এবং মার্জিত রুচির বইমেলা।
    সেখানে একটি প্যাভিলিয়নে কোট পরা সেই মেয়েটির ফোটো। এত রোগা যে ফরাসী মডেলদের হার মানিয়ে দেবে। অত ঠাণ্ডার মধ্যেও গায়ে গরম পোশাক নেই। বেশ গম্ভীর চেহারা।
    তখন আন্দাজ করেছিলাম, পরে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, ইনিই সে। তবে জারমানিতে আসবার পরে মেয়েটির নাম পরিবর্তন করা হয়েছে সে খবর অন্ক পরে জানতে পারি।
    এসব পুরোন ঘটনা।
    যে নিয়ে কথা হচ্ছিল, সেই হিয়ারিং এর দিনের কথা।
     
    ইমিগ্রেশন তথা অ্যাসাইলামের কেস বাই কেস বিচারের আদালতের বর্ণনা শুনলাম টেলিফোনে। জাল দিয়ে ঘেরা ঘর। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ইচ্ছুক অ্যাসাইলাম সীকারদের পুলিশ নিয়ে এসেছে শুনানির জন্য। বাংলাদেশেরও কয়েকজন আছে, যারা পেশায় হয়ত কেউ সিএনজি চালক, ভাগ্যান্বেষণে চলে এসেছে জারমানি। মূলতঃ প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক কারনে মাইগ্র্যান্ট।
    নিজ নিজ পেশায় শিক্ষিত মাইগ্র্যান্টরাও তো অধিকাংশই বেশি রোজগারের আশায় পশ্চিমের দেশে পাড়ি জমায়। তা এদের দোষটা কোথায়?
    আমার মনে হয় মহাভারতের স্বর্গারোহণের গল্পটা।
    এত খেটে খুটে সারাটা জীবন সত্যবাদী হবার মত কষ্ট করে ধর্মপুত্র যুধিষ্টির নরক দর্শন করবার পরে স্বর্গে গিয়ে দেখল, যত রাজ্যের পাজি লোকেরা আগেই সেখানে উপস্থিত। যুধিষ্টিরের রাগ হয় না বুঝি?
    আমরাও সেকরম। যারা খেটেখুটে কষ্ট করে পড়াশোনা করে ভালো ভালো ডিগ্রি নিয়ে টাকার লোভে স্বর্গসম পশ্চিমের দেশে গিয়ে দেখি সেখানে লেখাপড়া ভালো করে না করা নানান উদ্বাস্তু দিব্যি বসবাস করছে।
    মুখে যতই ছদ্ম বুলি আওড়াই না কেন, টাকার লোভটাই আসল মোটিভেশন প্রত্যেকের। প্রাইমারী। বাকি যুক্তিগুলো সেকেন্ডারি। আমরা চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জোরে ভিসার পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করে গেছি, তাই আমরা লিগ্যাল তকমার অধিকারী। এরা সেটায় কোয়ালিফাই করে নি, তাই অন্য পথ। দোষটা কোথায়?
  • যোষিতা | ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:২৮740020
  • সত্তর আশির দশকেও পশ্চিম জারমানিতে বৈধ কাগজ নিয়ে পড়াশুনো বা চাকরি করতে আসা ভারতীয়দের দীর্ঘকাল থাকতে দিত না পশ্চিম জারমানির ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্ট। নানান ছুতো করে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে অস্বীকার করত। তখনও সেই উচ্চশিক্ষিতরা স্থানীয় কোনও মেয়েকে বিয়ে করে থেকে যেত। এমনকি সুইটজারল্যান্ড থেকে জারমানি গিয়ে থাকতে চেয়ে থাকতে পারছে না এমন সাদা সুইসকেও এমন বিয়ে করতে হয়েছে। "সুবিধের বিয়ে"। বিয়ে করলেই বৈধ। বিয়ের কি কম গুণ? সে যুগে অসংখ্য ভারতীয় এবং পাকিস্তানি বাংলাদেশি ইস্তক অনেক দেশের মানুষই জাস্ট থেকে যাবার তাগিদে এরকম "সুবিধের বিয়ে" করছে। কখনও প্রেমিকাকে তো কখনও অজানা কারওকে। এসবে দোষ ধরতে নেই। গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।
    তা যাই হোক, যে কথা হচ্ছিল। সেদিন সেই আদালতে একের পর এক কেস খারিজ হয়ে যাচ্ছে, এমন সময়ে পালা এলো এই লোকটির। জারমানির বিখ্যাত উকিল কাগজপত্র এগিয়ে দিলেন জজের টেবিলে। লোকটির জন্য দোভাষী এলো। দোভাষী বাংলা ভাল পারছে না। সে সম্ভবত ভারতীয় বংশোদ্ভূত, কিন্তু বাঙালী নয়।
    "প্রমিত বাংলা" কাকে বলে সে জানে না। মহাবিপদ।
    আমাদের লোকটি তখন উকিলকে কষ্ট করে বোঝায় যে দোভাষী বাংলা পারে না। উকিল যতই বড়ো উকিল হোক না কেন, সেও খুব ভাল ইংরিজি জানে না। এটাও জারমানির সমস্যা, ইংরিজি প্রায় কেউই পারে না। কেউ বলতে জারমানরা। বিদেষী অভিবাসীরা ইংরিজি জানতে পারে। তখন সময় কম। কী করা?
    কেসের জন্য অন্য তারিখ নেওয়া হলো।
    দোভাষী সম্ভবত এসব কাজের জন্য কয়েকটা কেস থাকলে ষাট ইউরো পায়। সে পয়সা না পেয়ে গজগজ করতে করতে চলে গেল।
    পরের তারিখ দশদিন পরে।
  • যোষিতা | ২২ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:৪৬740021
  • সমস্ত জেনে নিয়ে আমরা ঐ লোকটাকে কয়েকটা কথা, কিছু কিছু দরকারি শব্দ শিখিয়ে দিলাম। দু বছরের বেশি সময় কাটল, জারমানের হাল এত খারাপ কেন? দরকারে ইংরিজি দিয়ে ম্যানেজ করতে বলি। কিন্তু না, বাংলাদেশে ইংরিজির স্ট্যান্ডার্ড কলেজ পাশ করলেও ভাল না। কথা একদম বলতে পারে না। ওদিকে কলেজের লাইব্রেরিয়ান ছিল অন্ততঃ বিশ বছর ধরে।
    যাইহোক মাথা নষ্ট করে কাজ নেই, ধীরে সুস্থে দরকারি পয়েন্ট বোঝানো হলো।
    পরবর্তী শুনানিতে এই লোক বিনা দোভাষীতেই কাজ চালিয়ে নিল। এবং বের্লিনের মত শহরে, যেখানে অ্যাসাইলাম দেবার হার অসম্ভব রকমের কম, সে অ্যাসাইল্ম পেয়ে গেল।
    উকিল নাকি সওয়াল জবাবের সময় জজ সাহেবকে বুঝিয়েছিল যে এই লোকটির নাম হিট লিস্টের আশিজনের একটি। যাদের মৌলবাদীরা মারবার নোটিস/ফতোয়া জারি করেছে।
    সে বড়ই আনন্দের দিন। ডিসেম্বরে তারিখ পড়েছে তার বৌ ও ছেলেমেয়েদের শুনানির। সে তো নামমাত্র শুনানি হবে। পেপারওয়ার্কই আসল।
    বাকি রইল প্রেমিকা। তার জন্য এখনও তারিখ আসে নি।
    অক্টোবরের শেষে আমরা চললাম বের্লিনে।
    এর আগে যখন বের্লিন গেছি তখন তা ছিল দ্বিখণ্ডিত। এখন বের্লিন জুড়ে গেছে। টেগেল এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল, তারপর দিন গেলাম তার বাড়িতে। 
    আমি পুরোন বের্লিনের সঙ্গে নতুন বের্লিন মেলাতে ব্যস্ত।
    চিড়িয়াখানার নিকটে আগে ছিল সারি দিয়ে পীপ্ শো এর দোকান। এখন সেসব দোকানের নাম গন্ধ নেই, শুধু কাবাবের গন্ধ। টার্কিশ খাবারের সস্তার রেস্টুরেন্ট খুলেছে।
    সেখানেই দেখা করলেন এক নির্বাসিত বাঙালি কবি।
    গুন্টার গ্রাস যাকে এখানে নিয়ে এসেছিল।
    সেসব ঘটনা এই গল্পে অপ্রাসঙ্গিক।
    লোকটির বাড়িতে যখন আমাদের নিয়ে গেল, তখন দুপুর। আমাদের নেমন্তন্ন।
  • Nirmalya Bachhar | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১০:১৪740022
  • বাকিটা পড়ার ইচ্ছে রইল।
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৫:১৯740023
  • চমৎকার ওয়েল ফার্নিশড অ্যাপার্টমেন্ট। দুটো বড়ো বেডরুম, একটি ছোট রুম, বিশাল ড্রইং রুম, রান্নাঘর, দুটো বাথরুম, চওড়া করিডোর, ব্যালকনি।
    সম্ভবত তিনতলায়। একতলাতে নোটিস ঝুলছে, চেঁচামেচি রাত দশটার পরে বারণ করা হয়েছে, দেখে মনে হলো প্রতিবেশীদের অভিযোগ মোাতাবেক কর্তৃপক্ষ ঐ নোটিস ঝুলিয়েছে।
    অ্যাপার্টমেন্টে সে আমাদের সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল রেল স্টেশনে মীট করে।
    ব্যস, বাড়িতে ঢোকার পরক্ষণেই চেঁচামেচি চালু হয়ে গেল। লোকটি চুপ করে রয়েছে, বৌ গজগজ করছে একটু ফের চ্যাঁচাচ্ছে, সে পাত্তা দিচ্ছে না, ঘরে নিয়ে গিয়ে তার হারমোনিয়াম দেখালো, দেশ থেকে ডাকে আনিয়েছে। বইপত্র দেখালো। বছর ষোলোর জমজ পুত্রকন্যাও ঝগড়া করছে। সামান্য যা উপহার এনেছিলাম, দিলাম তাদের।
    সামনের আট তারিখ তাদের জন্মদিন। আমরা প্রস্তাব দিলাম ওদের জন্মদিন আমরা পালন করব, বের্লিনের একটা ভালো রেস্টুরেন্টে ডিনারের আমন্ত্রণ। ওরা চারজন, ওদের একজন চেনা সমাজকর্মী, আমরা দুজন, মোট সাতজনের জন্য টেবিল বুক করা থাকবে।
    এরপর খাবার ঘরে গেলাম, রান্নাঘরেই খাবার টেবিল। ছজনে বসেছি, গিন্নি চেঁচামেচি করছে। ঠাঁইঠাঁই করে বাসন রাখছে, আমাদের সঙ্গে কথা বলছে না, প্রায় মারপিটের পর্যায়ে পাছে চলে যায়, তার হাত ধরে জড়িয়ে ধরে থামালাম, তখন সে চেঁচিয়ে কেঁদে ফেলল। তারপর পালংশাকের কড়াইয়ে ভাত নিয়ে সেই কড়াই কোলে করে শুধু শাকভাত খেলো।
    বৌটিকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কী করব জানি না।
    আমরা চুপচাপ খাচ্ছিলাম।
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ১৯:৩৫740024
  • বৌটি গপাগপ খেয়ে নিয়ে তখনই বাসন ধুতে শুরু করে দিল। ছেলেও খেয়ে দেয়ে থালা সিঙ্কে রেখে উঠে কোথায় চলে গেল। বাবু এবং সেই লোকটি তারও একটু পরে খাওয়া শেষ করে উঠে গেছে পাশের ঘরে বই হারমোনিয়াম এসব নাড়াচাড়া করতে। কিশোরী মেয়েটি থালায় খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে, তাকে একা পেয়ে দুটো কথা নরম সুরে বলতেই সে হু হু করে কেঁদে ওঠে। 
    কিছু একটা সমস্যা তার রয়েছে, যা সে কারোকে বলতে পারছে না, বা হয়ত এতদিন কারোকেই বলেনি।
    আমরা জেনেছি যে, তার ভাই অন্য স্কুলে পড়ে, সেকেন্ডারি স্কুলে। দুজনেরই বয়স দুবছর করে কমিয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি করা হয়েছিল। মেয়েটি পড়াশোনায় ভাল ফল করায় তাকে গিমনাজিউম (গ্রামার স্কুল) এ পাঠিয়ে দিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ। এই দুজনের দুরকম স্ট্যান্ডার্ডের জন্য ওদের মধ্যে নিয়মিত মারপিট লাগে, ভাইবোনের মধ্যে রেষারেষির কারনে।
    মেয়েটিকে তার ইস্কুলের বন্ধুবান্ধব, পড়াশুনোর কথা জিজ্ঞাসা করতেই সে এত কাঁদল কেন বুঝলাম না। কিন্তু ব্যাপারটা স্বাভাবিক নয়। বাবা মা ভাই সবাই রয়েছে, সে আর যাই হোক হোমসীক নয়।
    আরেকটু নাড়া দিতেই বলল যে ইস্কুলে তার ভাল লাগে না, শিক্ষক শিক্ষিকারা ভাল না, বন্ধু নেই।
    — কেন ভাল নয়? কীরকম সমস্যা?
    সে গুছিয়ে বলতে পারছে না।
    তখন পাশের ঘর থেকে ওর বাবাকে ডেকে বললাম, কিছু একটা সমস্যা আছে।
    ওর বাবাকে দেখে বা আগে যেটুকু পরিচয় ফোনের মাধ্যমে কথা বলে, মনে হয়েছিল শান্ত লোক।
    বাবা দুটো একটা কথা বলতেই মেয়ে ফোঁস করে উঠে চিৎকার করে হিস্টেরিক হয়ে গেল। হাত পা ছুঁড়ে বাবাকে গালি দিতে লাগল — তুই কথা বলবি না! বদমাইস লোক, অন্য মাগীর সঙ্গে থাকিস! 
    আমরা বেশিক্ষণ থাকিনি। বেরিয়ে এসেছিলাম। মেয়েটার মনের কষ্ট,  বিশেষ করে একটা টিনেজার মেয়ে কী অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তা বুঝবার অবস্থায় আমরা নেই।
    ওদের মায়ের সেদিন বিকেলে ডিউটি। দূরে এক উকিলের অফিসে কাজ করে সে। বাথরুম পরিষ্কার, অফিসে ঝাড়া মোছা, ডিশওয়াশারে বাসন ধুয়ে গুছিয়ে রাখা। এই কাজের জন্য স্কিল্ড লেবার হবার যোগ্যতা লাগে না। এসব কাজ উদ্বাস্তু মহিলারাই বেশিরভাগ করে থাকে।
    ওখান থেকে বের হয়ে আসার পর, সেই লোকটি আমাদের তার প্রেমিকার বাড়ি নিয়ে গেল।
    প্রেমিকা বাড়ি ছিল না, তবে এর কাছে অ্যার্টমেন্টের চাবি ছিল।
    অপেক্ষাকৃত ছোট অ্যাপার্টমেন্ট। ছিমছাম, সাজানো। মস্ত বাথরুমে বিশাল বাথটাব। বসবার ঘরে ফুলদানিতে ফুল। টেবিলের ওপরে তার পাসপোর্ট পড়ে আছে। আমরা ওখানে বসে বিয়ার খেলাম তিনজনে। লোকটি মেয়েটির ঘরে টুকটাক কাজ করছিল। পাসপোর্ট খুলে দেখালো। কয়েকটা চিঠি এসেছে, সেগুলো নাড়াচাড়া করল। পাসপোর্টে মেয়েটির নাম ও পদবী দুটোই ভিন্ন।
    রান্নাঘরের ওপারে ব্যালকনিতে সিগারেট খেতে গিয়ে লোকটি আমাকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিল গর্ভধারণ না করবার পিল এদেশে কেমন করে কিনতে হয়। মেয়েটি  যত পিল এনেছিল সব শেষ হয়ে গেছে।
    বোঝা যাচ্ছে, সে চিন্তিত। এবং এসব কথা নিজের বাড়িতে জিজ্ঞাসা করতে পারবে না বলেই এখানে নিয়ে এসেছে।
    আমার জায়গায় অন্য কেউ হলে বিরক্তিতে এই প্রশ্নের উত্তরই দিত না। কিন্তু আমি বাবুকে ডেকে ওর কথাগুলো আবার বললাম। আমার নিজের এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা নেই।
    বেশিক্ষণ থাকি নি ওখানে।
    ওখান থেকে বের হয়ে স্টেশনের দিকে যেতে পথে একটা ফার্মাসি পড়ে। সেখানে ঢোকা হলো। এই লোক যেহেতু জারমানে বোঝাতে পারবে না, তাই আমরাই ওর হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। 
    সেখানে জানা গেল পিল দুই প্রকার। এক ধরণের পিল গর্ভধারণের সম্ভাবনা ঘটে গেলে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে খেতে হয়, তাতে শরীরের ক্ষতির সম্ভাবনা আছে। অন্যটা নিয়মিত খেতে হয়, তবে সেই গোত্রের পিলেরও রকমফের আছে, ডাক্তার যেটা বলবে সেটা খেতে হবে।
    কিন্তু যার প্রয়োজন, সে না এলে এসব পিল পাওয়া যাবে না।
    লোকটি মুখ ব্যাজার করে থাকে।
    আমাদেরও মেজাজ বিগড়ে যায়। নেহাৎ জন্মদিনের জন্য ব্যবস্থা করব বলে কথা দিয়েছি, তাই কটু কথা বলি না।
    দোকানের বাইরে বের হতেই দেখি সে মেয়েটিকে নাম ধরে ডাকে। মেযেটি স্টেশনের দিক থেকে আসছে। তার সঙ্গে আমাদের আলাপ করায়। মেয়েটি কেমন যেন বিরক্ত হয়। দায়সারা হাতজোড় করে ওখান থেকে পালাতে চায়। কিংবা খুব ক্লান্ত। জারমান ক্লাস করে সে ফিরছে। তার ঘরে এক টুকরে খাবার নেই।
    লোকটা তড়িঘড়ি একটা টার্কিশ টেক অ্যাওয়ে থেকে ওকে একটা র্যাপ কিনে দেয়। মেয়েটা চলে যায়।
    আমরা ট্রেনে উঠি, সে আমাদের সঙ্গে চিড়িয়াখানার স্টপ অবধি আসে। আমরা সান্ধ্য বের্লিনের পরিবেশ উপভোগ করতে একটা বারে ঢুকি, সেখানে সেই বৃদ্ধ নির্বাসিত বাঙালি কবিও আসেন। টুকটাক গল্প আড্ডার মধ্যেও আমার চিন্তা হয় লোকটি টিনেজার কন্যাটির জন্য, ওর কী এমন সমস্যা? কেন এত কাঁদল?
  • | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২১:০৩740025
  • কবি ত দাউদ হায়দার। আর অ্যাসাইলামপ্রার্থী এঁকেও সম্ভবত নেটসূত্রে চিনি। 
    বাচ্চাগুলোর জন্যই বড় খারাপ লাগে। 
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২১:৫০740026
  • মৌনং ...
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২২:২৮740027
  • এর পরের দিনগুলো আমরা নিজেরা বেড়াচ্ছিলাম। এর ২৯ বছর আগে দ্বিধাবিভক্ত বের্লিনে গেছি একা। সব কত বদলে গেছে। ব্রান্ডেনবুর্গার টোরে ছিল দুই বের্লিনের সীমানা। নীচে ছিল রেল স্টেশন এবং বর্ডার কাস্টমস ইমিগ্রেশন। সব মুছে গেছে। দেয়ালগুলো নেই। দেয়াল গুলো তুলে নিয়ে অন্য জায়গায় সাজিয়ে রেখেছে বহু বহু দূরে পূবে নদীর ধারে। সেখানে কোনও বর্ডারই ছিল না সেকালে। 
    আলেকসান্দরপ্লাৎসে বড়ো বড়ো শপিং মল বানিয়েছে, সেখান থেকেই সেরা বার্থডে কেকের অর্ডার দিলাম। কেক চলে যাবে সোজা রেস্টুরেন্টে। বের্লিম ওয়াল ভাঙার ২৯ বর্ষপূর্তির আগের দিন বাচ্চাগুলোর জন্মদিন।
    লোকটিকে জানিয়ে দিলাম কোনখানে আসতে হবে। রেস্টুরেন্টটাতে সেদিন দুপুরে গিয়ে আমরা দুজনে মধ্যাহ্নভোজও সেরে এলাম।
    হঠাৎ স্বপ্নের মত কেমন যেন মনে পড়ল বাচ্চা মেয়েটা যখন কথা বলছিল, কাঁদছিল, চেঁচাচ্ছিল, ওর গায়ে কাটাকুটি দাগ দেখেছি। গলায়? নাকি বুকে? না না, হাতে মনে হয়। মনে পড়ছে না। খটকা লেগে রইল মনে। ভুল করছি? আমি হ্যালুসিনেট করছি?
    সন্ধেবেলা রেস্টুরেন্টে গিয়ে দেখি তারা আগেই উপস্থিত।
    তাদের সঙ্গে সেই তরুণী জারমান সমাজসেবিকাও এসেছে। মেয়েটি সম্ভবত আনএম্পলয়েড, তাই খুচখাচ এসব কাজ করছে। সে জানালো সে ভেজিটেরিয়ান।
    এসব দেশে নব্য প্রজন্মের অনেকেই ভেজিটেরিয়ান হয়ে যায়। তবে আমার বিশ বছরের অভিজ্ঞতায় জানি, যে এদের মধ্যে অনেকেই অর্থাভাবে সাময়িক ভেজিটেরিয়ান। এই মেয়েটিও তেমন। ভেজিটেরিয়ান মেইন কোর্স তার জন্য অর্ডার করবার পরে সে যখন জানল যে তাকে খরচ করতে হবে না, তখন সে মাংস খেতে চাইল।
    লোকটির বৌ একেবারে অন্যরূপে। কী মিষ্টি মিষ্টি কথা। মেয়েটি পরেছে প্রিন্সেস স্টাইলের লেস দেওয়া ফুলহাতা সাদা ড্রেস। তার শ্যামবর্ণ চেহারায় খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। ছেলেটি রেবেল টাইপ। পর্ক খাবে। তাদের মা হালাল মাংস কি না বুঝতে না পেরে চিংড়ি, এছাড়া মুর্গী গোরু সবই আনা হলো। টেবিলের মধ্যিখানে ভোজনের শেষে আনা হলো মোমবাতি দিয়ে সাজানো বার্থডে কেক। সঙ্গে শ্যামপেন, বিয়ার, নরম পানীয়, সবই চলছে।
    সমাজসেবিকার কাছ থেকে জানা গেল পরিবারটি সমস্যাপূর্ণ। সমাজসেবিকার সঙ্গে বাবু কথা বলছিল জারমানে। জানা গেল এদের পরিবার গৃহহিংসায় পূর্ণ। 
    প্রতিবেশীরা চিৎকার চেঁচামেচির জন্য বিরক্ত হয়, নালিশও করেছে।
    তবে আর বেশিদিন নয়, তিন বছর পূর্ণ হলেই এই ব্যক্তির স্কলারশিপ শেষ হবে, তারপর এদের কোনও দায়িত্ব ঐ সংস্থার ঘাড়ে বর্তাবে না।  বৌটির অসংখ্য নালিশ আছে স্বামীর বিরুদ্ধে। তবে সে বোকা নয়, অপেক্ষা করছে অ্যাসাইলাম গ্র্যান্টেড হবার জন্য। সেটা হয়ে গেলেই যে যার পথ দেখে নেবে। তিন বছর হতে আরও কিছু মাস দেরি।
    বাচ্চা মেয়েটা আমার ডানপাশে বসেছিল। গোল টেবিল। আমার বাঁপাশে ওর বাবা।
    গল্প চলাকালীন বাবুকে বললাম ঐ সমাজসেবিকাকে বলতে যে মেয়েটির ইস্কুলের সমস্যা কেমন করে সমাধান করা যায়।
    এটুকু শুনতে পেয়ে মেয়েটা হাঁ হাঁ করে উঠল, আবার কান্না, টপটপ করে দুচোখ বেয়ে জল পড়ছে।
    এহ্ আমি এ কী করলাম? জন্মদিনে মেয়েটাকে কাঁদিয়ে দিলাম।
    সমাজসেবিকা উৎসুক — কী হয়েছে!
    বলতেই হলো, ইস্কুলে সম্ভবত বুলিইড হচ্ছে।
    ওর মা তখন নিজরূপ অল্প হলেও ধারণ করে বলল — ওতো মাঝে মাঝে ইস্কুলেই যায় না।
    অবাক কাণ্ড!
    আবার বাপমায়ে ঝগড়া শুরু করে দেয় আরকি! শত হলেও রেস্টুরেন্ট। আমি দৌড়ে ক্যাশে গিয়ে বিলটা মিটিয়ে এলাম।
    ওর বাবা কিছুই জানে না। সে অধিকাংশ রাতেই প্রেমিকার বাড়িতে কাটায়, বাড়ি ফেরে দুপুরে, বিকেলে।
    সে জানেই না যে মেয়ে ইস্কুলে যাচ্ছে না।
    মাঝেমাঝে মেয়েকে মারধোরও করে। মেয়েটার গলার নীচে এবার দেখলাম কাটাকাটা দাগ। যেন ব্লেড দিয়ে কাটা। ওর বাবা ওকে ব্লেড দিয়ে কেটে দিয়েছে নাকি?
    মেয়েটা ঝপ করে জামার গলার নীচটা ঢেকে নিল জামাটা টেনে দিয়ে।
    আবার পরিবেশ স্বাভাবিক হচ্ছে।
    মেয়েটাকে বললাম, রোজ ইস্কুলে না গেলে চলবে নারে মিষ্টি মেয়েটা। বড়ো হতে হবে না?
    আবার টপটপ করে চোখ্র জল।
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২২:৪৭740028
  • পরের দিন ব্রান্ডেনবুর্গার টোরে বিশাল উৎসব। ২৯বর্ষপূর্তি। দেখার মত অনুষ্ঠান।
    পরের দিন সন্ধেয় ফিরে এলাম জুরিখে।
    একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। আগের দিনের সন্ধায় রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে বেরিয়ে ঐ লোকটি ও আমি, সিগারেট খেয়ে আসছিলাম। ভেতরে ননস্মোকিং।
    তখন সে আমায় মোবাইল খুলে কিছু ইমেইল দেখালো।
    — দেখেন, এখনও থ্রেট দিয়ে মেল পাঠায়। এই দেখেন।
    ভুলভাল ইংরিজিতে প্রচুর গালাগালি দেওয়া ইমেইল। প্রাণনাশের হুমকিও রয়েছে।
    আমি বললাম — ব্লক করে দে!
    সে হাসে। অদ্ভূত হাসি।
    আমি তাকিয়ে থাকি। পরিষ্কার হচ্ছে না ব্যাপারটা।
    সে আমাকে বোকা ঠাউরেছে মনে হয়। কিংবা আমি আসলেই বোকা।
    — আরে ভয় নেই। অ্যাসাইলাম গ্রান্টেড হবার পরপরই থ্রেট মেইল স্টপ হয়ে গেলে এরা সন্দেহ করবে না?
    — মানে?
    — ওহ দিদি! আপনি আসলেই সরল। 
    — তার মানে তুই নিজেই নিজেকে এসব ইমেইল পাঠাস!
    — না না। আমার কি মাথা নষ্ট? লোক আছে। বাংলাদেশ থেকেই আসে। আইপি অ্যাড্রেস চেক করতে পারে না?
    — তার মানে পুরোটাই ভুয়ো?
    — না না! আমার ব্লগের জন্য মৌলবাদীরা আমাকে হিটলিস্টে রেখেছিল, আশিজনের লিস্টে আমার নাম। তিন চারজনকে মেরে ফেলছে...
    সিগারেট শেষ করে ভেতরে এসে আমি কারোকে কিছু বলতে পারি নি। স্পার্কলিং ওয়াইন খেতে খেতে চুপচাপ কিছুক্ষণ গোলটেবিলের প্রত্যেককে আলাদা করে পর্যবেক্ষণ করছিলাম। 
    বিশ্বাস করবার মত মানুষের সংখ্যা কি এত কমে যাচ্ছে এই পৃথিবীতে?
    বাচ্চাগুলো অ্যাসাইলাম পেয়ে গেলে কার সঙ্গে থাকবে? কত ইউরো পাবে মাসিক ভাতা তখন?
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:০১740030
  • বের্লিন থেকে ফিরে এসে আস্তে আস্তে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলাম ওদের সংস্পর্শ থেকে।
    কিন্তু ঐ যে, আমার সমস্যা আমি মুখের ওপর দাবড়াতে পারি না টোটাল তিতিবিরক্ত না হওয়া অবধি।
    ওর ওয়েবজিনের জন্য তখনও খেটে যাচ্ছি।
    তারপরে এলো সেই দিন, সম্ভবত বারোই ডিসেম্বর।
    কয়েকদিন আগে থেকেই সে ফোন করে বলছিল বারো তারিখে তার পরিবারের অ্যাসাইলাম হিয়ারিং। 
    এবার হয়ত বৌ ছেলেমেয়ের কাছ থেকে ক্রস কোয়েশ্চেন করে লোকটির তথ্যের বৈধতা জানতে চাইবে আদালত।
    বৌকে এ কদিন রাগানো চলবে না। বৌ ওখানে গিয়ে বেগড়বাঁই করলে মুশকিল। বৌকে অন্য বাংলাদেশিরা অনেক বুদ্ধি দিয়েছে, স্বামীকে কেমন করে জব্দ করা যায় জারমানির আইনে। তাই এ কদিন সে প্রেমিকার বাড়ি যাওয়া বন্ধ রেখেছে বলল।
    বারো তারিখ সকালে ঐ শুনানির আগে জানালো, আসবার পথে প্রেমিকার সঙ্গে দেখা হয়েছে। সেই মেয়েটি ওদের চারজনের দিকেই তাকিয়ে হেসেছে।
    বিকেলে ফোন করে জানালো, ফুল ফেমিলি অ্যাসাইলাম গ্রান্টেড। সে দারুণ খুশি! কাগজপত্র রেডি হতে হতে ২০১৯ হয়ে যাবে।
    প্রেমিকাকে সে ফোন করে সুসংবাদ দিতে চেয়েছিল, কিন্তু সেই মেয়ে ফোন ধরছে না।
  • যোষিতা | ২৩ এপ্রিল ২০২৩ ২৩:০৮740031
  • এর দুদিন পরে আবার ফোন। বাড়িতে প্রচন্ড চেঁচামিচি শোনা যাচ্ছে।
    — আবার কী হলো রে?
    — ঘরে শান্তি নাই।
    — ও বাড়িতে চলে যা।
    — সে ফোন ধরে না।
    — ল্যান্ড লাইনে কর।
    — কোনওটাতেই ধরে না। মোবাইল সুইচ অফ করে রাখছে।
    — তাহলে চলে যা।
    — আরে শোনেন না, সমস্যা অন্য। আমার মেয়ের স্কুল থেকে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে।
    — কেন? ইস্কুলে কামাই করে বলে?
    — হ। দুইমাস স্কুলে যায় না সে।
    — সেকী!
    — দুইমাসেরো বেশি। কাল ডাকছে।
    — হম্
    আমি বিস্মিত বোধ করি না আর।
    কিন্তু ঘটনা আরও অনেক বাকি ছিল।
  • kk | 2601:14a:500:e780:3f8d:4ab0:95cd:142c | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০২:৩১740032
  • পুরোমাত্রায় ডিস্টার্বিং
  • যোষিতা | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৩:২১740033
  • পরের দিন গভীর রাতে ফোন।
    — আবার কী হলো রে? আমার ভোরে অফিস।
    — দিদি, বিপদ হৈসে।
    — সংক্ষেপে বল।
    ঐ লোক সংক্ষেপে কিছুই বলতে পারে না, পনেরো বিশ মিনিট ধরে যা বলল, তা হচ্ছে তার মেয়ে এখন ঘুমায় মায়ের সঙ্গে ড্রইংরুমের ডিভানে। পুত্র ও পিতা মিলে কন্যার কম্পিউটার ও টেলিফোনের পাসওয়ার্ড ক্র্যাক করে অনেক তথ্য পেয়েছে। কন্যা একটি ভুলভাল গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত, তারা খুব খতরনাক গেম খেলে। আমি ভেবেছিলাম ভিডিও গেম কিংবা অনলাইন গ্যাম্বলিং , কিন্তু সে যা বলল তা সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। এই গেম আসলে কিছুটা ভার্চুয়াল কিছুটা রিয়্যাল, এবং সর্বোপরি ভয়ঙ্কর। 
    মূলতঃ অনলাইন প্রেজেন্স থাকে, কিন্তু খেলাগুলোয় একজন বস জাতীয় লোক থাকে, সে এই গ্রুপের মেম্বারদের চালনা করে নানানভাবে। টারগেট দেয়। ইমোশনালি মেম্বাররা বাঁধা থাকে বসের কাছে। তীদের প্রমাণ করতে হয় কে কত বেশি লয়্যাল। যেমন নিজের শরীরে ক্ষত সৃষ্টি করে কিছু লিখতে হয়, রক্ত চুঁইয়ে পড়া অবস্থায় ফোটো বা ভিডিও করে লীডারকে পাঠাতে হয়, লীডার তখন বলে ভেরি গুড। কখনও কোনও বাড়ির ছাদের কার্নিসের ওপর হাঁটতে বলবে, বা ট্রেন লাইনের ওপর। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ড্রেসের দোকানে গিয়ে চুরি করতে বলবে, ট্রায়াল রুমে গিয়ে ভিডিও করতে বলবে, না খেয়ে থাকতে বলবে, নানান রকমের ডিম্যান্ড। মেম্বাররা এগুলো করে।
    ওর মেয়ে কী করে এই দলে ভিড়েছে তা জানা নেই। পুত্র জানত, কিন্তু বলে নি। বোনের ইস্কুলে আজ বাপমা গেছল, সেখানে খবর ভালো নয়, তাই সে বাপকে সব বলে দিচ্ছে।
    ঘটনা শুনে আমার ঘুম উড়ে গেল।
    মেয়ে যে পরিবারে শান্তিতে নেই স্কুল তা জানে, মেয়ে নতুন ক্লাসে উঠতে পারে নি গত সেমেস্টারে। ফেল হবার রেজাল্ট সে বাপমাকে দেখায় নি। স্কুলে সে যায় নি প্রায় তিনমাস। স্কুল থেকে বাড়িতে চিঠি আসত, মেয়ে সেই চিঠি চিঠির বাক্স থেকে বের করে নিত। এই শেষ চিঠিটা সে সরাতে পারে নি।
    রোজ সকালে সে বেরিয়ে যেত ইস্কুলের নাম করে। মেয়ের মাকেও নাকি একজন পরিচিত বাংলাদেশি একবার জানিয়েছিল যে সে মেয়েটিকে একটা স্টেশনে বসে থাকতে দেখেছে। 
    ইস্কুল মেয়েকে জবাব দিয়েছে এবং কাগজে কলমে মেয়ের বয়স চোদ্দ বছর বলে বাপ মাকে বলেছে মেয়ের প্রতি যত্নবান হতে। নইলে সরকার থেকে মেয়েকে নিয়ে যেতে পারে।
    মেয়ে এখন ভায়ের ইস্কুলে যাবে, এবং এক ক্লাস নীচে।
    মা বলেছিল আর পড়াতে চায় না মেয়েকে, তাতে ইস্কুল কর্তৃপক্ষ আর্কবার বুঝিয়ে দিয়েছে যে এতে ফল ভাল হবে না।
    বাড়ি ফিরে মেয়ে চিৎকার করেছিল খুব, ফলে প্রতিবেশীরা বিরক্ত হয়। শেষে কেন জানিনা মেয়ে হিস্টেরিক হয়ে গেলে অ্যাম্বুলেন্স আসে, ডাক্তার দেখানো হয় হাসপাতালে। ডাক্তার মেয়েকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। তার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিচ্ছিল বাপ, মেয়ে বাবাকে মেরে গালি দিয়ে ফোন ফেরৎ চায়। ডাক্তার বলেছে যে ফোন কেড়ে নেওয়া যাবে না, মেয়ের প্রিভেসি আছে।
    তাই মেয়ে ঘুমোচ্ছে দেখে বাপ ব্যাটায় ফোন নিয়ে এইসব কাণ্ড উদঘাটন করেছে।
    দুনিয়ায় এরকম ব্যাপার হয়, তা আমার এতদিন্র অভিজ্ঞতায় জানা ছিল না।
    সংক্ষেপে বুঝলাম অশান্তিময় পরিবারের টিনেজারদের এরকম গেম এ টেনে আনা সহজ। 
     
  • যোষিতা | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৩:৪৫740034
  • এরকম চলল আরও বেশ কিছু দিন। চ্যাঁচানো মারপিট ধস্তাধস্তি বন্ধ বা সীমিত হয়েছে, পুলিশের ভয় আছে।
    ভাঙা সংসারের দুটো বাচ্চার একজন শক্ত, অন্যজন মানসিক চাপ নিতে পারছে না। 
    অ্যাসাইলামের কাগজ পেয়ে গেলে, তারা তৎক্ষণাৎ ডিভোর্স করে নেবে, সন্তানদ্বয়ের দায়িত্ব কেউই নিতে চায় না। তারাও বছর তিনেকের মধ্যে কোনও কাজ জুটিয়ে নেবে। 
    এইসব ড্যামাডোলে মোট চারপাঁচদিন কাটার পরে তার খেয়াল হলো যে প্রেমিকা তার খোঁজ নিচ্ছে না। মোবাইল সুইচ অফ করে রেখেছে। আমরা বের্লিন থেকে ঘুরে আসার পরেই প্রেমিকা তার কাছ থেকে ডুপ্লিকেট চাবিটা নিয়ে নিয়েছিল। ফলে সে সময়ে অসময়ে ঐ অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকতেও পারছে না।
    সে তখন তার সংস্থাকে জানালো যে অমুক মেয়েটির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছি না। সংস্থা তাকে বলছে — হয়তো সে কোথাও বেড়াতে গেছে, কদিন পরে খোঁজ নাও। ঠিক এসে যাবে।
    সে আমাদের রিকোয়েস্ট করল সংস্থাতে ফোন করতে। আমরা এখান থেকে ফোন করলাম, ওমুক নামের মেয়েটির কোনও খোঁজ খবর নেই, আপনারা কিছু করতে পারেন? পুলিশে খবর দিতে পারেন?
    সংস্থা আমাদের বলে, মেয়েটি স্বাধীন মানুষ, হয়ত না বলে কোথাও গেছেন, এতে চিন্তা করার কী আছে?
    এরও কিছুদিন পরে মেয়েটির বাবা, সেই গ্রামের ইস্কুলের শিক্ষক েএই লোকটির কাছে ইমেল করে, জানতে চায় মেয়ের খবর। সে ফেসবুকে কিছু লিখছে না, তার ফোন বন্ধ কেন? তার ফোনে মেসেজ যায় না কেন?
    মেজবোনের পড়াশোনার খরচের টাকা পাঠাতে দেরি করছে কেন সে?
    আমরা ভেবে চিন্তে বলি বাবা বরং সংস্থাকে জানাক। ভাঙা ভাঙা ইংরিজিতে বাবা সংস্থাকে ফোন করে কিছু বলে। 
    তখন সংস্থার এক কর্মী অতিরিক্ত একটা চাবি নিয়ে সেই অ্যাপার্টমেন্টে যায়।
    তারা এই লোকটিকে কিছু জানায় নি।
    এই লোকটি সে সময়ের কিছু পরে শহরের কোন খান থেকে বাড়ি ফিরছিল। সন্ধে সাতটা আটটা। 
    সে দেখে সেই বাড়িটার সামনে অ্যাম্বুলেন্স। সংস্থার মেয়েটিকেও দেখতে পায়। আর প্রচুর জল সে বাড়ির সিঁড়িতে, দরজায়, রাস্তায়ও জল পড়ে আছে।
    সে আমাকে ফোন করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে — দিদি! সে নাই! সব শেষ। এত পানি কেন ওর বাড়িতে? আমাকে ওদিকে যেতে দিচ্ছে না, পুলিশ ঘিরে রেখেছে ওর ফ্ল্যাট।
     
    হাউ হাউ করে সে কেঁদে যায়। আমিও। মেয়েটিকে অল্পক্ষণের জন্য দেখেছিলাম। কীভাবে মরল সে? এ মৃত্যু কি স্বাভাবিক মৃত্যু?
     
    এখানেই শেষ নয়। ঘটনা আরও বাকি আছে।
  • | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ০৯:১৬740035
  • ঐ গেমটার নাম ব্লু হোয়েল। ভারতেও কয়েকজন ভিক্টিম হয়েছিল। 
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ২৪ এপ্রিল ২০২৩ ১০:১৩740036
  • @দ, হ্যাঁ, ঠিক, ব্লু হোয়েল মাঝখানে খুব পপুলার হয়েছিল।
     
    @ যোশীতা খুব ভালো হচ্ছে লেখাটা। একটা ঘটনার যে কতগুলো পরত থাকে, তা বাইরে থেকে আঁচ করা অসম্ভব। ঘটনা প্রবাহের পরবর্তী অধ্যায়ের অপেক্ষায় রইলাম।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন