এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বিরলপাতার গাছ

    ইন্দ্রাণী লেখকের গ্রাহক হোন
    ০১ এপ্রিল ২০২৩ | ৭২০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • বিরলপাতার গাছ
    মৃণাল শতপথী
    ৯ঋকাল বুকস
    দাম ২৫০ টাকা

    সময়ের সঙ্গে, বয়সের সঙ্গে , বেঁচে থাকার যাবতীয় ঝুটঝামেলা অনুভূতিতে একটা সর ফেলতে থাকে। হাল্কা সর প্রথমে, না সরাতে পারলে, আর একটি সরের তল, তার ওপর আর একটি- সর জমে গাদ হয়ে যায়- সেডিমেন্ট- তখন অলীক এক অস্ত্রের সন্ধান করতে হয় যা একাধারে ধারালো, একটানে চেঁছে ফেলবে অনুভূতির ওপর জমে থাকা আস্তর, আবার একই সঙ্গে আশ্চর্য কোনো সঙ্গীত শোনার পরবর্তী অনুভূতির মতো হবে-  শিশুর মতো টলমল পায়ে অনুভূতির এ ঘর সে ঘর যাব- নতুন করে আবিষ্কার করব আমারই অশ্রু, আমারই আনন্দ।

    গুরুচণ্ডা৯র শারদ সংখ্যায় মৃণাল শতপথীর 'ডলফিন' পড়ে আমি সেই অলীক অস্ত্রের সন্ধান পাই যা বস্তুত মায়া। আলতো  নয়, তীব্র আর আচ্ছন্ন কারী সে মায়া থেকে বেরোতে পারি নি বহুদিন। জনে জনে পড়িয়েছিলাম গল্পটি।
    বইমেলায় মৃণালের গল্প সংকলনটি দেখেই কিনে ফেলি সঙ্গে সঙ্গেই। "But how could you live and have no story to tell? " দস্টয়েভস্কির উদ্ধৃতির পরে সূচিপত্র আসে। ১৩টি গল্প। অলংকরণ রয়েছে বই জুড়ে। আমি অক্ষরেই মনোযোগ দিয়েছিলাম। অন্য দিকে চোখ, মন ফেরাই নি।
    ডলফিন এ যে অস্ত্রটির সন্ধান পাই, প্রথম গল্পেই (নীল মানুষ) তাকে আবার পেয়ে যাই- সেই তীক্ষ্ণতা, সেই মারাত্মক মায়া। পরের গল্পর (স্যাঙাৎ) স্বাদ একেবারে আলাদা।  চরিত্রদের নাম নেই- ফুটো গেঞ্জি আর চেক জামা আর লেখক / অবলোকনকারী তাদের ঠিক পিছনে ক্যামেরা বসিয়েছেন। চরিত্রদুটির মুখ একবারও দেখা যাবে না, নামও নয়- গল্প তৈরি হচ্ছে দৃশ্য, শব্দ আর কিছু কথোপকথনে- বৃষ্টি নামলে শিলুটের ওপর ক্যামেরা ফ্রিজ করে। অনবদ্য ট্রীটমেন্ট। তৃতীয় গল্প অন্তরাত্মায়  মায়ার তরবারি ঝলসে উঠছে- এই সংকলনের সেরা লেখা সম্ভবত। চতুর্থ গল্প  'বিরল পাতার গাছ' এ সেই মায়াই কাজ করেছে- বাস্তব থেকে আপাতদৃষ্টিতে জাদুবাস্তবে যাওয়া, ফিরে আসা। স্বাদ অন্য। তীক্ষ্ণ হয়ে কাটে নি, বাস্তবকে ভুলিয়ে দিয়েছে কিছুক্ষণের জন্য-গল্পের চরিত্রর মতই। বিতংস গল্পটি আগে পড়েছিলাম - হাতী ছিল সে গল্পে, সমাপ্তিতে পাঠক আবিষ্কার করেছিল -ফাঁদ একটাই- মানুষ কী হাতির। অঝোর গল্পটিতে সেই আশ্চর্য মায়া আবার ফিরে আসে।
    সংকলনের গল্পগুলির পটভূমি ভিন্ন ভিন্ন-গ্রাম, নগর, পুরাণ, কিছু অলীক সংলাপে মহাকাব্যের পুনর্নির্মাণ। গ্রাম থেকে নগরে পৌঁছে যাওয়ার অ-সুখ, বিষাদের একটি সুর ধরা পড়ে, পড়া শেষ হলে। স্পষ্ট নয়, উচ্চকিত নয়। নিহিত। যেন একটি দীর্ঘশ্বাস।

    রমাপদ চৌধুরী লিখেছিলেন,  “রণক্ষেত্রের  দামামা বেজে উঠল। লক্ষ লক্ষ সিপাহী, সান্ত্রী, অশ্বারোহী সৈনিক ছুটে এল উন্মত্ত আক্রোশে। বিপরীত দিক থেকেও ঝাঁপিয়ে পড়ল লক্ষ লক্ষ যোদ্ধা। ... ঔপন্যাসিক তখন কোনো মিনারের চূড়ায় উঠে নোটবুকে টুকে নেবেন সমস্ত দৃশ্যটা। রাজার অঙ্গে লাল মখমলের পরিচ্ছদ, মাথার মুকুটে মণিমুক্তাহীরের জ্যোতি, সেনাপতির দুঃসাহসিক অভিযান, সৈন্যদের চিৎকার, এসবের একটা কথাও বাদ দেবেন না ঔপন্যাসিক। ... যুদ্ধ জয়ের পর সৈন্যদল দেশে ফিরবে যখন, তখনও পিছনে পিছনে ফিরবেন ঔপন্যাসিক। শঙ্খধ্বনি আর সমারোহের আনন্দ ছিটিয়ে আহ্বান জানাবে গ্রামীণা আর নগরকন্যার দল। তাও লিখবেন ঔপন্যাসিক, বর্ণনা দেবেন তাদের, যারা উলুধ্বনির আড়ালে কলরব করে উঠল।
    তারপর তিনি ছোটগল্প লেখককে দেখতে পাবেন পথের ধারে, একটি গাছের ছায়ায় বসে আছেন উদাস দৃষ্টি মেলে। এ কোন উন্নাসিক লেখক? — মনে মনে ভাববেন ঔপন্যাসিক। কোনো মিনারের চূড়ায় উঠল না, দেখল না যুদ্ধের ইতিবৃত্ত, শোভাযাত্রার সঙ্গ নিল না, এ কেমনধারা সাহিত্যিক! হয়ত এমন কথা বলবেনও তিনি ছোটগল্প-লেখককে। আর তখন, অত্যন্ত দীর্ঘ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ চেয়ে তাকাবেন ছোটগল্পের লেখক, বলবেন হয়ত, না বন্ধু, এসব কিছুই আমি দেখিনি। কিছুই আমার দেখার নেই। শুধু একটি দৃশ্যই আমি দেখেছি। পথের ওপারের কোনো গবাক্ষের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করবেন তিনি, সেখানে একটি নারীর শঙ্কাকাতর চোখ সমগ্র শোভাযাত্রা তন্নতন্ন করে খুঁজে ব্যর্থ হয়েছে, চোখের কোণে যার হতাশার অশ্রুবিন্দু ফুটে উঠছে — কে যেন ফেরেনি, কে একজন ফেরেনি। "


    এই সংকলনের ব্লার্বে মৃণালের লেখনী প্রসঙ্গে মূলত  এই কথা বলা হয়েছে সংক্ষেপে। যথার্থ।
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • hs | 2401:4900:1f25:3316:2df7:49bb:f623:71dd | ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১২:০০518112
  • ধন্যবাদ ঈন্দ্রাণী। লেখার জন্যে আর পড়ানোর জন্যেও। 
  • Subhadeep Ghosh | ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১২:০৯518113
  • ইন্দ্রাণীর গ্রন্থ-আলোচনা তাঁর গল্পগুলির মতই অনবদ্য। ট্রিটমেন্ট, হ্যাঁ, এখানেই দুর্বলতা দেখতে পাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। মৃণালবাবুর গল্পে সেই জায়গাটা অত্যন্ত দৃঢ় বুঝতে পারছি। ইন্দ্রাণীকে অনেক ধন্যবাদ, মৃণালবাবুর বইটি শীঘ্রই সংগ্রহ করব।
  • ইন্দ্রাণী | ০১ এপ্রিল ২০২৩ ১৩:০৪518115
  • ঠিক আলোচনা নয়।
    একটি বইয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য যতটুকু...
  • মৃণাল | 2401:4900:3bfa:7dd6:bdc1:f9ee:438b:998d | ০২ এপ্রিল ২০২৩ ১২:৪৪518157
  • অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। বইয়ের কথা এমন অপূর্ব করে বলা যায়!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন