এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১৬

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৫৪ বার পঠিত
  • আমাদের কী উত্তেজনা ! বারাসাতে শুধু দিগন্তই উন্মুক্ত নয়, কিছুদিনের জন্য জীবনটাও। দিন কয়েকের জন্য কোনও শাসন নেই। প্রতিটি মুহূর্তই নিজের মতো করে থাকা। প্রত্যেকটা দিন কেবলই উদযাপনের, একেবারে নিজের মতো করে। বারাসতের বাড়ি ঘিরে আছে গাছপালা, হাঁস চড়া পুকুর, ধানক্ষেত, ধুলোমাখা পথ আর আত্মীয়-স্বজন। আর তাছাড়া শুনেছি শান্তিনিকেতন থেকে মেজপিসি, ঝুমঝুম, ভজু'রা সব আসবে। দাদাভাই, বুলুদি, দুলু'রা তো আছেই।
    আমাদের যেদিন যাওয়ার ঠিক হয়, তার একদিন আগে ছোটকাকু চলে যান। আগেই জানিয়েছি ছোটকাকুও তখন বাবার সাথে একই অফিসে কাজ করেন। ছোটকাকু বারাসাত স্টেশন থেকে দুপুর বেলায় আমাদের বাড়িতে হেঁটে যান। রাস্তা একদম ফাঁকা। হাত-মুখ ধুয়ে ভিতরে খেতে বসেছেন। মেজপিসি ঝুমঝুম এবং ভজু'কে নিয়ে এর মধ্যে এসে গেছেন। চিনি-ঠাম্মাও এসে গেছেন রতন'কাকুকে নিয়ে। কাকুমণি তখন অফিসে। আমাদের চিনি-দাদু তখনও থাকতেন রংপুর জেলার হাতিবান্ধাতে, যেটা এখন বাংলাদেশে। হঠাৎ তিনজন যুবক, সবাই পরিচিত, আমাদের বাড়িতে এসে দাদুভাইকে বলে ছোটোকাকুকে বের করে আনতে। দাদুভাই তাদের বোঝান যে ছোটকাকু আসেনি, কিন্তু তারা বিশ্বাস না করে বলতে থাকে আমাদের কাছে খবর আছে সে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে ওরাও পুরোপুরি নিশ্চিত ছিল না। এরমধ্যে ছোটকাকু ছুটে উপরে চলে যান। উপরতলা তখনও পুরোপুরি তৈরী হয়নি। তিনটে ঘর তৈরী ছিল, একটা ঘর তখন অসমাপ্ত অবস্থায়। ছোটকাকু ঐ অসমাপ্ত ঘরটির জানালার উপর বসে নীচে ধানক্ষেতের উপর লাফ দেওয়ার কথা চিন্তা করছেন। পিছন পিছন চলে আসেন চিনি-ঠাম্মা। নীচে তখন ঠাম্মা, মেজপিসি, কুট্টিপিসি সবাই ভয়ে কাঁপছেন। চিনি-ঠাম্মা তখন ছোটকাকুকে কাকুমণির ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ  করে দেন এবং ভরসা দিতে থাকেন, 'আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি তোমার কেউ কিছু করতে পারবে না।' তখন নীচে ছেলেগুলি দাদুভাইকে বলে, ওনার বন্দুক নিয়ে আসতে। দাদুভাইয়ের কাছে আমি জন্মাবধি ঐ বন্দুকটি দেখেছি, বিছানার নীচে নিয়ে শুতেন। ঐ বন্দুকের নল তখন ওরা দাদুভাইয়ের বুকে রেখে বলতে থাকে, ছোটকাকুকে বের করে দিতে - নাহলে দাদুভাইয়ের উপর বন্দুক চালিয়ে দেবে। ভিতরে তখন কান্নার রোল পড়ে গেছে। ঐ একইসময় শীতলকাকু (খুড়তুতো কাকু) ছিলেন দাদুভাইয়ের সাথে। উনি বিয়ের ব্যাপারেই কোনো পরামর্শের জন্য এসেছিলেন। থাকতেন উল্টোডাঙার কাছে ফুলবাগানে। উনিও ওয়েস্ট বেঙ্গল পুলিশে কাজ করতেন, কিন্তু এই ছেলেগুলি বোধহয় সেটা জানত না। শীতলকাকু তখন দাদুভাইয়ের বুক থেকে বন্দুকের নল সরিয়ে ওনার বুকে রাখেন এবং বলেন, 'আপনারা আমাকে মারুন, আমার জ্যাঠামশাইকে নয়। উনি সত্যি কথা বলছেন, ওনার ছোটছেলে আসেননি।' সৌভাগ্যক্রমে ছেলেগুলি ততক্ষণে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে তাদের পাওয়া খবর হয়ত সত্যি নয় এবং দাদুভাইয়ের বন্দুক নিয়ে চলে যায়।
    সেই রাত কীভাবে সবার কাটে সেটা ওনারাই জানেন। ফুলপিসির বিয়ে হয়েছিল মধ্যমগ্রামে। কাকুমণি বলেছিলেন ছোটকাকুকে মধ্যমগ্রামে গিয়ে রেখে আসবেন। কিন্তু কাকুমণির কয়েকদিন পরেই বিয়ে, দাদুভাই রাজি হন না। গভীর রাত থাকতেই ছোটকাকুকে নিয়ে দাদুভাই বেরিয়ে পড়েন মধ্যমগ্রামের উদ্দেশে। তখনও বাস চলাচল শুরু হয়নি। চাপাডালি থেকে একটি রিক্সাতে করে নিয়ে যান মধ্যমগ্রামে। চিন্তাগ্রস্ত মনে ফেরার সময় পড়েন দুর্ঘটনায়। একটি রিক্সা ধাক্কা মেরে রাস্তায় ফেলে দেয়। রাস্তার কাঁকর-নুড়ির উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে হাত-পা ছড়ে যায়।
    পরের দিন বিকেলে আমরা বারাসাতে পৌঁছই। আমরা এইসব ঘটনার তখন কিছুই জানি না। শিয়ালদহ থেকে লোকাল ট্রেনে আসার সময় আমাদের সাথে পাড়ার কিরীটিকাকু আসেন। উনি অবশ্য কিছুই জানতেন না, কারণ পাড়ার কাউকেই জানানো হয়নি কিছু। কিন্তু উনি কোনো আভাসই দেননা যে, বাবার এখন বারাসাতে যাওয়া উচিত নয়। আমরাও স্টেশন থেকে বীরদর্পে রাস্তা ধরে বাড়ি পৌঁছই। কিন্তু দেখতে পাই রাস্তা একদম খালি, নিস্তব্ধ। পরে বুঝতে পারি, ভাগ্য ভালো - বাবাকে কেউ দেখেনি। বাড়ি পৌঁছে দেখি, সবাই বাবাকে দেখে আঁতকে উঠেছে। দাদুভাই বিছানায় শোয়া। কপাল, হাত, পা'তে  ব্যান্ডেজ। আর কোনো উপায় না দেখে, দাদুভাই কাকুমণিকে বলেন দুটো সাইকেল করে তখুনি বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়তে মধ্যমগ্রামের উদ্দেশে। তখনকার মায়ের মুখ আজও চোখে ভেসে ওঠে। কাকুমণি না ফেরা পর্যন্ত মুখ কালো করে বসে ছিলেন একটি ঘরে।
    আজ ভাবি, দাদুভাইয়ের সারা জীবনের কর্মফল, এত লোকের আশীর্বাদ-শুভেচ্ছা  - সেই দিন বাঁচিয়ে দিয়েছিল একটা বিরাট অঘটনের থেকে। 
    কাকুমণির রসাত্মক চরিত্রের পরিচয় পেয়েছি অনেকটা বড় হয়ে। শৈশবে এবং ছোটবেলায় কাকুমণিকে দেখেছি একজন বেশ গাম্ভীর্যপূর্ণ মানুষ হিসেবে। আমরা ভাই-বোনেরা ওনাকে বেশ ভয়ই পেতাম ছোটবেলায়। কাকুমণির যখন বিয়ে হয় তখন আমি সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। বোধ-বুদ্ধি কিছুটা হয়েছে। শুনেছিলাম কাকুমণির বিয়ে করার কোনো ইচ্ছে নেই। কিন্তু দাদুভাই আর ঠাম্মার চাপে  বিয়ে করতে রাজি হন। পরে যদি আবার মতের পরিবর্তন হয়, তাই দাদুভাই-ঠাম্মা গরমকালেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, এবং তখন ছিল এমন একটা সময়কাল - বাংলাতে সবাই ভয়ে তটস্থ থাকতো নকশাল কার্যকলাপের জন্য, আর বারাসাত প্রায় ভরে গিয়েছিল পূর্ব বাংলার শরণার্থী ক্যাম্পে।
    বিয়ের আগেই বাবা আর ছোটোকাকুকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল মধ্যমগ্রামে ফুলপিসির বাড়ি। প্যান্ডেলবিহীন দোতলায় নির্মাণাধীন বারান্দায় দিনের বেলায় বৌভাতের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ের আয়োজন এবং নিয়মপালন সবই হচ্ছে, কিন্তু দেখতে পেয়েছিলাম বড়দের সবার মুখে একটা ত্রাসের ছায়া। আমাদের ভাই-বোনেদের আনন্দ আর হৈ-হুল্লোড়ে একটা বিষাদের ছাপ। আর এই ম্রিয়মাণ পরিবেশে, কাকিমণিকে পেলাম আমরা একজন পরিত্রাতা হিসেবে। বেশ হাসিখুশি, গাম্ভীর্য্যবিহীন। ছোটবোন হিসেবে বেশ আদরে মানুষ ওনার বড়ভাইদের এবং মায়ের সান্নিধ্যে। কলকাতা কলেজে পড়াশুনা করেছেন। নাম অপর্ণা, ডাকনাম আলো। নামের সার্থকতা বজায় রেখে, আমাদের পরিবারে প্রবেশ দ্বিতীয় বউ হিসেবে, এক আলোর ঝলকানি নিয়ে। গৃহপ্রবেশ এবং মেয়েলি আচারের পরেই যখন আমরা ছোট ছোট ভাই-বোনেরা সব ওনাকে ঘিরে মাটিতে বসে আলাপ করছি, আমাদের হাতে বেশ কিছু টাকা দিয়ে বললেন, 'তোমরা এরকম বিষণ্ণ হয়ে রয়েছো কেন - সবাই মিলে দুপুরের শোতে সিনেমা দেখে এসো।' আমাদের কী আনন্দ তখন !     ( ক্রমশ )

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন