চিরশ্রী দেবনাথ
হেমন্তের খাতা
বেশ কয়েক বছর পর একজন কবি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে।
এ উপলক্ষে আজ সকালেই হেমন্ত খুঁজে পেল দুটো নতুন রকমের নক্সাকাটা প্রজাপতি, ঘাসের ডগায় দুলছে।
এ তবে পৃথিবীর আনন্দ উৎসারণ। কোথাও নতুন কিছু সৃষ্টি হলে, আনন্দের কিছু হলে পৃথিবী উপহার দেয়। হয়তো যে
উপহার পেয়েছে সে জানলই না, তার জন্য জমা হয়েছে
শিশিরের চিঠি।
টি ভির খবরে বার বার ভেসে এসেছে কবির নাম, যেন কোথাও অর্ন্তদহনের রেজাল্ট বেরিয়েছে।
সেই কবি কেমন কবিতা লেখে তা জানে না হেমন্ত। হেমন্তও কবিতা লেখে। তার কবিতার ভাষা অনাধুনিক। বহু পুরনো শব্দ ব্যবহার করে পুরনো ঢং এ লেখা লাইন। এইসব লাইন বৃষ্টি থেকে পাওয়া, দুগ্ধলালিত, নরম পলির আলপথের মতো। চারপাশে মাঠ, দূরে দূরে বাড়ি, একটি মাত্র পিচ ঢালা রাস্তা আর একজন অনিয়মিত ডাক্তার সহ গ্রামীন স্বাস্থ্য কেন্দ্র, দুর্বল গ্রাম্য স্কুল, ভুল উচ্চারণে ছাত্ররা শেখে প্রিয় মাতৃভাষা, মায়ের কাছে যেমন শিশুর ভাষা লেপ্টে থাকে ধুলোর মতো সহজ হয়ে।
এ গ্রামের কোন নবীন যুবা আয়ত্ত করতে পারেনি নতুন ভাষা, বুক ফেটে বেরিয়ে আসা ঝিনচাক নেশাগ্রস্থ শব্দ। হেমন্তের কাছে কবিতা মানে রবীন্দ্রনাথ, কবিতা মানে মাঠে জমে থাকা হাঁটুজল, পাশের বাড়ির কল্যানী নামে মেয়েটির অগোছালো মুখ, কাল রাতে যার বাবা বলেছে তার বিবাহ ঠিক হয়েছে। সেই থেকে কোথাও একটি ঝর্ণা রোপিত হয়েছে, নোনা জল গড়িয়ে যাবে আজন্ম এমনই প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তাকে মাটি দিয়ে গড়া এক ক্ষয়িত জরায়ু।
হেমন্তের কবিতার খাতা রুলটানা কাগজের। সাদা সুতো দিয়ে সেলাই করা, বাইরে যত্নে লাগানো মলাট, স্কেচপেনে লেখা নাম,
"হেমন্ত সরকারের কবিতার খাতা "
এই ঠিকানা নৌকোর ছই এর মতো, যার ভেতর রাখা আছে দু বস্তা আতপ চাল, তাজা সব্জি, পান সুপুরি আর অবকাশ।
কবিতা শোনাতে তাকে যেতে হয় নদীর কাছে।
সেখানে গরু চরায় কানাই।
কানাই হেমন্তের কবিতা শোনে।
পৃথিবীর বুকে তখন একজন লেখক, তার নাম হেমন্ত। একজন শ্রোতা, তার নাম কানাই।
হেমন্ত লিখেছে,
"ধান মারাই শেষ হলে তুমি নিয়ে এসো ধূপ
আমি জ্বালাবো বাতি, তোমার চোখে ধারা "
কানাই মাথা নাড়িয়ে বলে, কি সুন্দর লিখেছো দাদা, তা এবার মনে হয় ভালো ধান হবে, কত টাকার সার লেগেছে জানো?
হেমন্ত খাতা থেকে মাঠে আসে, ঝাপসা চোখে ভাবে, বন্যা না হলেই ভালো। ফসলের দাম উঠুক।
কানাই এর তিন ছেলে, পড়াশোনা শেখে গ্রামের স্কুলে, তাদের জন্যও নতুন কবিতা লেখা দরকার।
কিন্তু হেমন্তের যে নতুন কবিতা আসে না, তার শরীর ফেটে কেবলি ভাসে বহু মথিত ভাব। তার কাছে নতুন পংক্তি নেই,
জমাট বাঁধা স্বপ্ন নেই, আবেগের প্রকৌশুলীজনিত প্রচার নেই।
সে যেন গ্রামের সন্ধ্যার কীর্তন, হরির লুট কিংবা বহুদিন আগে যে দূরদর্শনে শুরু হতো সকালের প্রথম খবর, তার মতো।
কত কবি কত কিছু নাকি লেখে, সভা হয়, পাঠ হয়, বাক্য ঝরে
বিশ্ব চেতনা নিয়ে,
গভীর সুখ আর নিজের সৃষ্ট হীনম্মন্যতার পতাকা নিয়ে হেমন্ত সরকার লেখে,
"পৃথিবীর কত ক্ষতি হলো, আজ ধীরেন কাকা চলে গেলো।
একমাত্র কাকা জানতো, আমন ধানের উপচে ওঠার কৌশল,
কাকা-ই জানতো, বিড়ি পাতার পোড়া গন্ধে, আমি লিখি জাহানারার নাম "
নীচে লিখল, ধীরেন দাস স্মরণে
গ্রামের নাম : আলপনা
নদীর নাম : লক্ষ্মীপুর
শরৎকাল, দুর্গা পুজো আসন্ন
কুয়াশা পড়া এখনো শুরু হয়নি
তারিখ : তেইশ আশ্বিন, ১৪২৭ বঙ্গাব্দ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।