এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  বাকিসব   নেট-ঠেক-কড়চা

  • বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় - একশ বছর পার

    কল্লোল
    বাকিসব | নেট-ঠেক-কড়চা | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ১৭২৩ বার পঠিত
  • বীরেনদার সাথে আমার পরিচয় ১৯৭৩ বা ৭৪ সালে। তখন কলেজে পড়ি। এপিডিআর-এ সক্রিয় ভাবে আছি। সে সময় একমাত্র এপিডিআর সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের (দলমত নির্বিশেষে) মুক্তির দাবীতে পথে নামতো। আমরা মিছিল করে কলকাতার রাস্তায় স্লোগান তুলতাম। পথচলতি লোকজন, ট্রামে বাসের লোকজন চমকে তাকাতেন। চোখের ভাষায় সহানুভুতি, সমর্থন পড়তে ভুল হয়নি কখনো। হাত বাড়িয়ে সাগ্রহে আমাদের প্রচার পত্র নিতেন। সময় তখন দমবন্ধ করা। সে সময় আমি ও আমার বন্ধু দেবাশিস নানান বামপন্থী দলের দপ্তরে ঘুরে বেড়াতাম। আরএসপি, আরসিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক - এদের দফতরে ঘুরতাম, এমনিই আড্ডা মারতে। ফরোয়ার্ড ব্লকের ভক্তিবাবু এপিডিআরে সক্রিয় ছিলেন, আরএসপিতে ক্ষিতিদার সাথে আড্ডা হতো, আরসিপিআইতে বিমলেন্দুবাবুর সাথে। ক্ষিতিদার সাথে আড্ডা মারতে গিয়ে চটি বইটা চোখে পড়ে - মুন্ডহীন ধড়গুলো আহ্লাদে চিৎকার করে - কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সেই প্রথম পরিচয়। প্রথম দেখা ৭৭এ বন্দীমুক্তির মিছিলে। সেও এক ঘটনা। সুগত (যতদূর নামটা মনে আছে - ব্যক্তিগত পরিচয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র) মিছিলে ছিলো। ওর সাথে আমায় পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আমাদেরই এক বন্ধু বলে ফেলেছে "সৌমিত্র'র ছেলে"। সে ছেলে খচে ব্যোম। ঠিকই তো, এটা কোন পরিচয় হলো!! সেও তো অন্যদের মত মিছিলে এসেছে আমাদের কমরেড। বীরেনদা সামনে ছিলেন। উনি শান্ত করেন সুগতকে। আমাদের খুব বকেন। সেই আলাপ। এর অনেক পর ৭৯ সালে আমাদের গানের দলের মহলা হতো, বীরেনদার ঢাকুরিয়ার বাসায়। বীরেনদার এক মেয়ে কেয়া, আমাদের সাথে গাইতো। তখন বীরেনদার বাসায় আমাদের তুমুল আড্ডা। তবে তাতে বীরেনদা মোটেই থাকতেন না। ওনার বড় ঘরে লম্বা করে চৌকি পাতা। তাতে সরোজলাল, মণিভূষণ, সমীর রায়, সাগর চট্টপাধ্যায়, এঁরা সব গম্ভীর আড্ডা মারতেন। আমাদের ওসব পোষাতো না। আসা যাওয়ার পথে কখনো - কেমন চলছে - গোছের কথা হতো। বা - সেদিন ঐ গানটা বেশ ভালো হচ্ছিলো - এরকম। একবার শুধু আমার কাছে বিড়ি চেয়ে ছিলেন। তাতে বৌদি খুব বকেন, আমায় না, বীরেনদাকে।
    তবে ওনাকে ঠিকঠাক বুঝেছিলাম মৃত্যুর মাসখানেক আগে। এসময় পত্রিকার থেকে অধ্যাপিকা সুমিতা চক্রবর্তি ওঁর সাক্ষাতকার নেন। তখন জেনে গেছেন সময় সীমিত। একটা মানুষ কি ভারহীনভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পারেন - সে এক বিস্ময়। নিজের ভুল, ক্ষুদ্রতা, ঈর্ষা স্বীকার করে নেওয়া অকপটে - এর আগে আমার অভিজ্ঞতায় ছিলো না।
    খবর এল বীরেনদা আর নেই। আমরা অ্যাভেন্যু ক্লাবের রকে, সামনের ফুটপাথ জুড়ে বসে গেলাম পোস্টার লিখতে – ওনার নানা কবিতার পংক্তি। কত মানুষ কোথা থেকে যে চলে এসেছেন তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে, টেনে নিচ্ছেন কাগজ তুলি, লিখছেন, কবিতা কবিতা কবিতা...। কিনে আনা হল নানা রঙের কাপড়, তাই দিয়ে তৈরি হল পতাকা। রাসবিহারী মোড় থেকে কেওড়াতলা শ্মশানের রাস্তার দুপাশের গাছ, রেলিং সেজে উঠল নানা রঙের পতাকা আর কবিতায়। সে যেন এক উৎসব। হ্যাঁ, উৎসবই তো। মৃত্যুই জীবনের শেষ উৎসব, আমরা সেভাবেই ভেবেছিলাম, এখনও ভাবি। যে চলে গেছে তার জন্য শোক নয়, তাকে স্মরণ করব প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত কবিতায়, গানে, রঙে, আনন্দে। এরই মধ্যে শিল্পী গৌতম বসু এঁকে ফেলেছে এক মানুষপ্রমাণ প্রতিকৃতি। সেটি রাখা হয়েছিল রাসবিহারী আর সদানন্দ রোডের মুখে। যেন বীরেনদা নিজে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর শেষ যাত্রার সাথীদের জন্য অপেক্ষায়, মুখটি আকাশের পানে ঈষৎ তুলে।
    সেদিন শ্মশান থেকে ফিরে, নাকি শ্মশানে বসেই বিপুল লিখেছিল,
    এতদিন তাঁর বুকে ছিল আগুন
    আজ আগুনের বুকে তিনি।
    বীরেনদার কথা উঠলেই যে ছবিটা ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রসদনের উল্টোদিকের মাঠে বইমেলার মহেঞ্জোদারো যুগ। সে সময় একটা ২০ x ৩০ ঘেরা জায়গায় ছোট পত্রিকারা যে যেমন পারতো বসতো। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তো নেই। আজ এখানে তো কাল ওখানে, দস্তুর ছিলো। কেউ দেরীতে এলে সকলেই তাকে জায়গা করে দিতে ব্যস্ত হয়ে যেতো। সে এক আদিম সাম্যবাদী আবহাওয়া। সেইখানে বীরেনদা ছিলেন গোষ্ঠীপতি। কাঁধে কাপড়ের ঝোলাটি কিঞ্চিত বেশীই ভারি। সেটি আমাদের টোটেম। তাতে অল্প নাম জানা, এক্কেবারে না জানা পত্রিকা আর কবিতার বই। ঐ দূর থেকে দেখা গেল শঙ্খ ঘোষ আসছেন। বীরেনদা হাঁক পেড়েছেন - অ শঙ্খবাবু আসেন দেখি। সে ডাক অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। কাছে আসতেই গোটা দশ বারো বই-পত্রিকা হাতে বলতে থাকেন - দ্যাখেন এইডা নূতন ছেলে, বড় ভালো ল্যাখে। এইডা দ্যাখেন খুব খেটে করে পত্রিকা বাচ্চারা। এই রকম বকবকের মধ্যে শঙ্খবাবুর হাতে গোটা পাঁচেক বই ও পত্রিকা চালান হয়ে গেলো। হ্যাঁ, তইলে আপনার হলো গিয়া ষোলটাকা, আপনে পনেরই দ্যান। এই বলতে বলতে - এই যে ওনিল। তোমরা তো আর ত্যামন লিটল নাই। অনুষ্টুপ সেবার নিজেদের স্টল দিয়েছে। অনিলদা লাজুক মুখে - না না বীরেনদা, সেকি কথা......এসবের মাঝে এখানেও কুড়িটাকার বই ও পত্রিকা চালান হয়ে গেলো। দূরে সমীর রায় ও রঞ্জিত গুপ্তকে দেখেই হাঁক। অ সমীর অ রঞ্জিত আর কটা বই দিয়া যাও। ফুরায়ে গেল যে.........
    এরপর বীরেনদা মাঠ ঘুরতে বের হবেন, ও পরিচিতজনকে নানান পত্রিকা বই কেনাবেনই। ওনার বই!! ভুলেও ওনার ঝোলায় তাদের ঠাঁই হতো না।
    বীরেনদা রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছেন। আমাদের রেলা দ্যাখে কে!! আরেঃ ও তো আমাদের কেয়ার বাবা। ওনার বাড়িতেই তো আমরা রিহার্সল দেই। এটা বোধহয় ওনার কানে গেছিলো। ওনার সরকারী সম্বর্ধনা একাডেমী অফ ফাইন আর্টসে। তার আগে অশোক মিত্র মশয় এসেছেন ওনার কাছে আর্জি নিয়ে- ঊনি বেকার জীবনের পাঁচালী কবিতাটি সম্বর্ধনায় পড়তে চান। ব্যস বীরেনদাকে পায় কে! আপনে পড়বেন এ আর কওয়ার কি আছে। তবে এই বাচ্চারা বড় ভালো গায়। অরা আমার কবিতার গান গাইবো। ব্যস। আমরাও ঝমঝম করে গেয়ে দিলাম, একাডেমীতে। গান ভালোই হয়েছিলো। তারপর যত সম্বর্ধনা হয়েছে সবেতেই আমরা গেয়েছি।
    ওনার শেষের দিকের একটা কবিতা -
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সম্বিৎ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০২:০৮732596
  • কেয়া বাত, কল্লোলদা! 

    গানের সুর কার?

  • সম্বিৎ | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১১:১৬732598
  • একশ বছরে আমিও আমার সেলাম ঠুকে দিলাম আরেকবার।

  • সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায় | 122.163.22.221 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৩:১৩732599
  • আমার কুর্ণিশ ! 

  • রঞ্জন | 182.69.147.189 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:২৩732600
  • আহ , মনটা ভরে গেল। 

    কল্লোল ও সম্বিৎকে বধাই।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন