এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • বিনিদ্র নগরী থেকে উপন্যাসের মৃত্যুপুরী

    সাগ্নিক দাস লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১০ এপ্রিল ২০২০ | ২৫৮১ বার পঠিত
  • বেশ কয়েকদিন আগে, একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। পর্তুগিজ সাহিত্যিক হোসে সারামাগোর " Blindness" । উপন্যাসটি এক বিশেষ প্রকারের মহামারী নিয়ে। পর্তুগালের একটি শহরে আচমকাই এক মহামারীতে নাগরিকরা তাদের দৃষ্টি শক্তি হারাতে শুরু করে। এই অজানা রোগে সকলেই অন্ধ হয়ে যায়। এই মহামারীর মধ্যে, মানুষের বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছে নিয়েই তৈরি উপন্যাসটি। যখন পড়েছিলাম, তখন কি আর জানতাম, যে এই উপন্যাস কখনও বাস্তবে পরিণত হবে।

    নিউ ইয়র্ক শহর এখন প্রায় সারামাগোর বর্ণিত পর্তুগালের সেই নামহীন শহরের মতন। উন্মাদনার শিখরে থাকা এই শহরে এখন যেন শ্মশানের শান্তি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দোকান ও ওষুধের দোকান বাদ দিয়ে প্রায় সবই বন্ধ। পাঁচ তারা ইতালীয় রেস্তোরাঁ হোক কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা কোন অভিবাসীর ঠেলা গাড়িতে করে বিক্রি করা হট ডগের দোকান, সবই অনির্দিষ্টি কালের জন্য বন্ধ। ওয়াশিংটন স্কোয়ার পার্ক থেকে সেন্ট্রাল পার্ক, জন এফ কেনেডি বুলেভার্ড থেকে ফিফথ এভিনিউ, সমস্ত রাজপথেই শুধু ধেয়ে চলেছে এম্বুলেন্স। গণপরিবাহন চললেও, যাদের কাজে যেতে হচ্ছে, তাঁরা অনেকেই রাস্তা ঘাট ফাঁকা থাকার দরুন গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছেন। কিন্তু সেও তুলনামূলক ভাবে নগন্যই বলা চলে। কোনদিন জনমানুষ শূন্য ম্যানহ্যাটানের ছবি দেখবো, ভাবিনি। যারা এই শহরে এসেছে, এই শহরকে চেনে, তাদের কাছে এই চিত্র অবিশ্বাস্য।

    বর্তমানে (৬ই এপ্রিল) শুধুমাত্র নিউ ইয়র্ক শহরে করোনাতে আক্রান্তের সংখ্যা ৬৭,৫৫১ ও মৃতের সংখ্যা ৩০৪৮। স্কুল, কলেজ মোটামুটি বন্ধ হয়ে গেছে মার্চের ১২ তারিখ থেকে। আর সরকারি ভাবে লকডাউন শুরু হয়েছে ২০শে মার্চ থেকে। আসলে এরম পরিস্থিতি হতো না, যদি আর একটু আগে লকডাউনটা শুরু হতো। প্রায় ৫ দিন দেরি করে দিয়েছে নিউ ইয়র্ক সরকার। ১২ই মার্চ ক্যালিফোর্নিয়া ও ওয়াশিংটন স্টেটের তুলনায় নিউ ইয়র্কে আক্রান্তের সংখ্যা কিন্তু প্রায় সমান ছিলো, খুব বেশি তফাৎ ছিলো না। আর আজ, গোটা ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫,১৫৮ ও মৃতের সংখ্যা ৩৫০। ক্যালিফোর্নিয়া সঠিক সময় লকডাউন করে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছে, কিন্তু দেরি করে দেওয়ায় নিউ ইয়র্ক পারেনি।

    নিউ ইয়র্ক শহরকে ৫টি বোরোতে ভাগ করা যায়। ম্যানহ্যাটান, ব্রুকলিন, কুইন্স, ব্রনক্স ও স্টেটেন আইল্যান্ড। এই ৫টি বোরোর মধ্যে, সব চাইতে বেশি করোনা আক্রান্ত মানুষ কুইন্স বোরোতে। আর একটু খতিয়ে দেখলে, কুইন্স এ আক্রান্তের সংখ্যা সব চাইতে বেশি জ্যাকসন হাইটস, ফ্লাসিং ও কাকতলীয় ভাবে করোনা নামক একটি অঞ্চলে। এই তিনটি অঞ্চলেই কিন্তু প্রচুর বাংলাদেশীদের বাস। বিশেষ করে জ্যাকসন হাইটস। করোনা ও ফ্ল্যাসিং এ বাংলাদেশি সহ চীনা ও ল্যাটিন আমেরিকানদের সংখ্যা বেশি। কুইন্স বোরোর পরেই স্থান ব্রুকলিনের। ব্রুকলিনের ওইলিয়ামসবার্গ অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা ৬০০ র কাছাকাছি। ওইলিয়ামসবার্গ খুবই বিশ্বজনীন জায়গা, তাই সেখানে যে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবে, সেটা আশ্চর্যের নয়। এ ছাড়া ব্রুকলিনের যেই অঞ্চলে আক্রান্তের সংখ্যা সব চাইতে বেশি,যেমন বোরো পার্ক, সেখানে প্রায় ৮০% নিবাসী ইহুদি। আবার বেনসনহার্স্ট অঞ্চলের প্রায় ৪০% নিবাসী পূর্ব এশীয়।

    সত্যি বলতে, প্রথম প্রথম যখন নিউ ইয়র্কে করোনা ধরা পড়ার কথা শুনি, বিশেষ পাত্তা দিইনি। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি যে হতে পারে, তার আশঙ্কা টুকুও করিনি। মেট্রোতে, রাস্তা ঘাটে চাপা উৎকণ্ঠা খেয়াল করেছি ঠিকই, কিন্তু তখন মনে হয়েছিল যে উন্নত দেশের লোকেরা অল্পতেই ভয় পায়। কিন্তু ক্রমশ এই ভয় ধীরে ধীরে সকলের মধ্যেই প্রবেশ করতে শুরু করলো, সকলেই আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পরতে লাগলো। কোথাউ কেউ হাঁচলে বা কাশলেই, লোকে একটু শিউরে উঠছে। ১২ই মার্চ কলেজ, ইউনিভার্সিটি ছুটি দেওয়ার আগে, আমার মতন অনেকেই চাইছিল যেন ছুটি দিয়ে দেয়। রোজ বাসে ট্রেনে করে উনিভার্সিটি যাওয়া, পড়াতে কলেজে যাওয়া যেন জীবন বাজি রেখে যাওয়ার মতন হয়ে গেছিল। তবুও এই সংক্রমণের ভয়াবহতা ঠাউরে উঠতে পারিনি। সারামগোর উপন্যাসের সাথে তুলনা করলে, মহামারীর শুরুতে যেমন থাকে, এক প্রকার ভয় মিশ্রিত অবিশ্বাস, তখন পরিস্থিতিটা তাই ছিলো।

    সারামগোর উপন্যাসটিতে মহামারী ও তার সাথে সাথে মানুষের চিন্তন ও ব্যবহার বিভিন্ন অধ্যায়ের মধ্যে দিয়ে যায়। প্রথমে আসে অবিশ্বাস, বর্তমান পরিস্থিতিকে অস্বীকার করবার এক করুন প্রচেষ্টা। তারপর আসে হতাশা, বিকারগ্রস্ততা। কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার আদিম ইচ্ছার দরুন, তৈরি হয় কঠিন পরিস্থিতে সংবদ্ধ ভাবে লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিকার খোঁজার চেষ্টা। হতাশার অধ্যায়ের পরের অধ্যায় এইটি। বিচার করে দেখলে, বর্তমানে, নিউ ইয়র্ক এই হতাশা ও সংবদ্ধ ভাবে বেঁচে থাকার, লড়াই করবার ইচ্ছার মাঝামাঝি একটি অধ্যায়তে রয়েছে। একদিকে মৃতদেহ বয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আইসক্রিম ট্রাকে আর অন্য দিকে ৭৫০০০ অবসর প্রাপ্ত স্বাস্থ্যকর্মী স্বেচ্ছায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। একদিকে বসন্তের ফুলে ঢাকা সেন্ট্রাল পার্কে অস্থায়ী হাসপাতালের করুন চিত্র, অন্যদিকে দাঁতে দাঁত চেপে, নিদ্রাহীন অবস্থায় লড়াই করে যাচ্ছে স্বাস্থ্যকর্মীরা। যথেষ্ট পরিমান মাস্ক নেই, পিপই নেই, স্বাস্থ্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে,পর্যাপ্ত পরিমান ভেন্টিলেটর নেই, তবুও এই শহর লড়ছে, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও লড়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর কেমন চাপ পড়তে পারে, তাই নিয়ে একটি গণনা করেছে হার্ভার্ড গ্লোবাল হেল্থ ইনস্টিটিউট। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ম্যানহ্যাটানে বর্তমানে ১৪,৮৩৪ টি হাসপাতাল বেড আছে যার মধ্যে আপাতত ৩,০৫৯ টি বেড খালি আছে। আইসিইউ বেড আছে ১,৪২৭টি, যার মধ্যে ৬১৬টি বেড খালি আছে। হার্ভার্ড গ্লোবাল হেল্থ ইনস্টিটিউটের গবেষণা অনুযায়ী, আগামী ১২ মাসে, এই ১৪,৮৩৪টি বেডের মধ্যে, ৮,৯৪৬টি বেড খালি থাকতে পারে ও ১,৪২৭টি আইসিউ বেডের মধ্যে সম্ভাব্য ১,০২১ টি বেড খালিপাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এই আগামী ১২ মাস যদি করোনা চলতে থাকে এবং তাতে ম্যানহ্যাটানে বসবাসকারী ২০% মানুষ যদি করোনাতে আক্রান্ত হয়, তাহলে ম্যানহ্যাটানে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ৮,৩৪,৬৮৭ এবং এদের মধ্যে হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন পরবে ১,৭২,৩৩২ জনের ও আইসিইউ প্রয়োজন পরবে ৩৬, ৬৭৮ জনের। যদি ৪০% ম্যানহ্যাটান নিবাসী আক্রান্ত হন, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে ১৬,৬৯,৩৭৫, যাদের মধ্যে হাসপাতালে যেতে লাগবে ৩,৪৪,৭৪৪ জনের ও আইসিইউ লাগবে ৭৩,৩৫৭ জনের। এই পরিসংখ্যানগুলি দেখে বুঝতেই পারছেন কি ভয়াবহ আকার নিতে পারে করোনা এবং তার ফলে স্বাস্থ্য পরিষেবার উপর কিধরণের চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এই পরিস্থিতে যাতে না যায়, তাই মরণপণ লড়াই করে চলেছে স্বাস্থ্য কর্মীরা।

    এত দূর অবধি সারামাগোর উপন্যাসের সাথে সাদৃশ্য পেলেও, আশা করবো ভবিষ্যতে যেন আর সাদৃশ্য না থাকে। কারণ উপন্যাস অনুযায়ী, মহামারীর পরের অধ্যায়গুলি ভয়ংকর। নিউ ইয়র্কের মতন শহরে লকডাউন করলে, তার অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রায় অকল্পনীয়। বহু সাধারণ, খেটে খাওয়া মানুষের রুটি রুজি নির্ভর করে এই শহরের দৈনিক কার্যকলাপের উপর। এই মানুষগুলিও কিন্তু এক প্রকার, দিন আনি দিন খাই। আমেরিকার সরকার সকল আমেরিকার নাগরিকদের ১২০০ ডলার দেবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু নিউ ইয়র্কের মতন শহরে $১২০০ ডলারে বাড়ি ভাড়াও মেটে না। তাই এই দিন আনি দিন খাই মানুষগুলি কতদিন বাড়িতে বসে চালাতে পারবে তার ঠিক নেই। তাছাড়া প্রচুর ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে প্রচুর মানুষ কাজ হারাচ্ছেন। গত তিন সপ্তাহে, ৪,৫০,০০০ নিউ ইয়র্কবাসী বেকার ভাতার জন্য দরখাস্ত করেছে। অনেকেরই ধারণা নিউ ইয়র্ক মানেই ঝাঁ চকচকে ওয়াল স্ট্রিটে চাকরী করা সুট বুট পরাহিত কোন পুরুষ বা মহিলা। কিন্তু এই সংখ্যক মানুষ খুবই মুষ্টিমেয়। এক বিরাট সংখ্যক মানুষ আছেন যারা বিভিন্ন ছোট খাটো ব্যবসা, বাণিজ্যের সাথে জড়িত। নিউ ইয়র্ক স্টেট, ডিপার্টমেন্ট অফলেবারের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারি মাসে গোটা নিউ ইয়র্ক শহরে যতজন মোট কাজে নিযুক্ত, তাদের মধ্যে ১.১% নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত।প্রায় ৪% নিযুক্ত রেস্তোরাঁ ও পানশালার বিভিন্ন কাজে।৪% নিযুক্ত খুচরো ব্যবসায়, যাকে ইংরেজিতে বলে রিটেল ট্রেড। সব আর্থিক সংস্থান ধরলেও, তাতে নিযুক্ত ৫.৫%। শতাংশের হিসেবে কম হলেও, মন্দার কারণে, সব চাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে খুচরো ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ ও পানশালার ব্যবসায় নিযুক্ত যাঁরা। আর্থিক সংস্থায় চাকুরীরা কিন্তু সাধারণত মধ্যবিত্ত বা অবস্থাপন্ন খুচরো ব্যবসায় নিযুক্ত বা রেস্তোরাঁ-পানশালায় নিযুক্ত যাঁরা তাদের তুলনায়।আর্থিক সংস্থার চাকুরীদের চাকরির আশ্বাসন ও বেশি। খুচরো ব্যবসা ও রেস্তোরাঁ- পানশালায় নিযুক্ত মানুষের সংখ্যার হিসেব ধরলে, প্রায় ৭,০০,০০০ মানুষ এই ব্যবসগুলিতে নিযুক্ত, আর ওদিকে আর্থিক সংস্থাগুলিতে নিযুক্ত ৪,০০,০০০ মতন। করোনার তৈরি অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এই ৭,০০,০০০ মানুষের কর্মহীন হওয়ার আশঙ্কা অনেকবেশি ৪,০০,০০০ আর্থিক সংস্থার কর্মীদের তুলনায়। এই ধরণের অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে খুব স্বাভাবিক ভাবেই সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এক সময় নিউ ইয়র্ক ছিলো আমেরিকার সব চাইতে অপরাধ প্রবন শহরগুলির মধ্যে অন্যতম। সেখান থেকে অনেকটাই উন্নতি করেছে। কিন্তু এই অর্থনৈতিক মন্দার কারণে, খুব স্বাভাবিক ভাবেই অপরাধ প্রবণতা বাড়ার সুযোগ থেকেই যায়। এই সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হওয়া উপন্যাস অনুযায়ী চতুর্থ অধ্যায়। আইনের শাসন ভেঙে পরা। আশা করবো চতুর্থ অধ্যায়তে ঢোকার আগেই, এই ভয়াবহ পরিস্থিতির সমাপ্তি ঘটবে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১০ এপ্রিল ২০২০ | ২৫৮১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ঃ( | 172.69.134.194 | ১০ এপ্রিল ২০২০ ১৪:১২92132
  • কী ভয়াবহ ছবি!৷ বাংলাদেশের অনেকে মারা গেলেন।
    ফ্লাইট কবে বন্ধ হয়েছিল? চিন থেকে আসা লোকজনের স্ক্রিনিং আইসোলেশন হয়নি?
  • | ১০ এপ্রিল ২০২০ ১৫:২২92134
  • খুবই ভয়ানক অবস্থা।
  • নিউইয়র্কের বাংলাদেশী প্রবাসীরা | 162.158.166.22 | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ১০:১৩92255
  • ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে স্বামী রতন চৌধুরী ও স্ত্রী সুজাতা চৌধুরী সন্তানসহ এসেছিলেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়।
    ভালোই চলছিল তাঁদের সংসার। স্বামী-স্ত্রী কাজ করেন, দুই সন্তান স্কুলে যায়।
    করোনার বিপদসংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বামী ছুটি নিয়ে বাড়ি ঢুকলেন। সন্তানরাও বাড়িতে।
    সুজাতা চৌধুরী নিজের অজান্তেই ভাইরাস বাড়ি এলেন কর্মস্থল থেকে। স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ হওয়ার আগে স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লেন।
    দুই সন্তানও আক্রান্ত হলো ভাইরাসে। হাসপাতালে জায়গা না পাওয়ায় বাড়িতেই চিকিৎসা চলছিল।
    ডাক্তারের নির্দেশনায় তিন বেডরুমের বাড়িতে স্বামী-সন্তানদের আলাদা রুমগুলো ছেড়ে দিয়ে সুজাতা নিজে জায়গা করে নিলেন ড্রইং রুমে। মধ্যরাতে রুমে রুমে গিয়ে চেক করেন, কে কেমন আছে।
    ১১ এপ্রিল ভোরে স্বামীর রুমে ওষুধ দেওয়ার জন্য ঢুকে কোনো সাড়া পেলেন না স্ত্রী। যা বোঝার বুঝে নিলেন তিনি। বাইরে থেকে রুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে সন্তানদের ডেকে তুললেন। সন্তানদের বললেন সবকিছু।

    সুজাতা নিজেই ৯১১ নম্বরে কল করলেন। উত্তর পেলেন তাদের আসতে দেরি হবে।
    সারা দিন তিনজন অসুস্থ মানুষ বসে রইলেন তাঁদের অতি প্রিয়জনের মৃতদেহ নিয়ে। বিকেল চারটায় তিনজন স্যোসাল ওয়ার্কার এলেন। সঙ্গে এল না মর্গের গাড়ি বা কোনো সরঞ্জাম।
    তাঁরা জানালেন, তাঁদের অসহায়ত্বের কথা। সরঞ্জামের ঘাটতি আছে।

    মর্গ বা অস্থায়ী ট্রেলারের মর্গে আছে জায়গার অভাব। কিছু মৃতদেহ মাটিচাপা দেওয়ার পর মর্গ কিছুটা খালি হলে তাঁরা নিয়ে যাবে মৃতদেহ।
    প্লাস্টিকের ডাবল বডি ব্যাগে রতন চৌধুরীর দেহ ভরা হলো।

    স্ট্রেচারে বেঁধে স্প্রে করে রুমেই রেখে বন্ধ দরজায় 'নো এন্ট্রি' সাইন ঝুলিয়ে চলে গেলেন তিনি স্যোসাল ওয়ার্কার।
    এক রুমে প্রিয় স্বামীর মৃতদেহ, আর অন্য রুমে একই রোগে আক্রান্ত তিনজন মানুষ বসে আছেন।

    ২)
    সিলেটের খন্দকার মোছাদ্দিক আলী ব্রংকসে থাকতেন। নিউইয়র্ক, নিউজার্সিতে বসবাসরত বিশাল অভিবাসী পরিবারের সদস্য। নিজের তিন ছেলের একজন ডাক্তার।
    দুজন নিউইয়র্ক পুলিশের ট্রাফিকে কর্মরত। আমেরিকায় কোনো পুলিশ বিভাগের সর্বোচ্চ পদের বাংলাদেশি এই পরিবারের সদস্য। ট্রাফিকে কর্মরত সন্তানের হাত ধরে ঘরে করোনার প্রবেশ।

    পরিবারের সবাই আক্রান্ত। ছেলে খন্দকার আব্বাসের শরীর নাজুক হতে থাকলে হাসপাতালে ভর্তি হন। একপর্যায়ে চরম শারীরিক সংকট দেখা দেয়। ঘরের অন্যরা কম-বেশি অসুস্থ।

    অসুস্থ বাবা জায়নামাজে বসে সদ্য বিবাহিত সন্তানের রোগমুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ জানাতে থাকেন।
    জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে আব্বাস ঘরে ফেরেন।
    খন্দকার মোছাদ্দিকের শরীর খারাপ হতে থাকে।
    ১১ এপ্রিল ভোরে হাসপাতালে নেওয়ার পরই তিনি মারা যান। আত্মীয়-স্বজন কেউ তাঁর কাছে যেতে পারছেন না।

    সব প্রক্রিয়া শেষ হয়ে এই প্রবাসীর দাফন কখন হবে, স্বজনেরা তা মৃত্যুর ১২ ঘণ্টা পরও জানাতে পারছেন না।

    ৩)
    এর আগে নিউইয়র্ক পুলিশ বিভাগের (এনওয়াইপিডি) ডিটেকটিভ জামিল সারোয়ার জনির পরিবারে ঘটেছে মর্মান্তিক ঘটনা। কর্তব্য পালনকালে তাঁর শরীরে ঢুকেছিল করোনাভাইরাস।
    যখন পজিটিভ ধরা পড়ল, ততক্ষণে সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেছে। ঘরে আক্রান্ত হন তাঁর বাবা।
    তাঁর বাবাকে সেবা দিচ্ছিলেন মা।
    মারাত্মক অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালের নেওয়ার পর গত বুধবারে তাঁর বাবা অ্যাডভোকেট সারোয়ার হোসেন পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মা অধ্যক্ষ রেনু সুলতানাও অসুস্থ।
    বাবার মৃত্যুর খবর শুনে কাঁদতেও পারছেন না জনি। একদিকে মা , অন্যদিকে তাঁর পেশাগত জীবন।

    --
    এই গল্পগুলো নিউইয়র্কে বাংলাদেশী প্রবাসীদের জীবনের।
    ঘরে থাকুন। যে যেখানে আছেন।

    [সূত্রঃ প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার নিউজ]
  • আচ্ছা | 172.69.135.15 | ১৩ এপ্রিল ২০২০ ১৬:২১92268
  • বাংলাদেশী ভারতীয় বা আমেরিকানদের মধ্যে আক্রান্ত বা মৃতরা কি অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণী বেশি?  নাকি উপরের উদাঃ গুলির মত অবস্থাপন্ন ঘর বেশিরভাগ?   হাসপাতালে গেলে চিকিতসা ফ্রি? 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন