এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রিমোট কন্ট্রোল

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৮ মার্চ ২০২০ | ২১৬৪ বার পঠিত
  • আজ বিশ্ব নারী দিবস।

    শশাঙ্ক বিরক্ত হয়ে খেঁকিয়ে ওঠে,
    ‘ আ :, এত নড় কেন তুমি ? একটু চুপচাপ শুতে পার না। যখনই একটু ধমকি আসছে ওলোট পালোট খাচ্ছ। এতো মহা ক্যাঁচাল হল .... ‘
    মাধু গুটিসুটি মেরে জড়সড় হয়ে শোয়। কি করবে ? সারারাত ঘুম নেই। শুধু উসখুস করে। গরমে হাঁসফাঁস। ঘুপচি গরম পড়েছে। মাঝে মাঝে একঝলক হাওয়া বইছে। তাতে জানলার কোল ঘেঁসে খোলা গাটারের দুর্গন্ধ খোঁচা খেয়ে হাওয়ায় ভেসে ঘরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে। বিয়ে হয়েছে বছর দুয়েক হল। বিবাহিত জীবনের রসকস কিছু টের পায়নি এই দুবছরে। শশাঙ্কর মতো রগচটা লোক সে বাপের জন্মে দেখেনি। অবশ্য মাধু কতটুকু আর দেখেছে এই ছোট্ট জীবনে। বয়স তো মোটে বাইশ। মা মরেছে মাধুরীর জ্ঞানগম্যি হওয়ার আগেই। তার আগে আরও একজনের জন্ম দিয়ে গেছে। মাধুর দিদি গৌরী। পিঠোপিঠি দুই বোন। বাপ কালীধন কলের মিস্ত্রি। মাসে তিন হাজার টাকার বেশি কামায় না। আগে তো আরও কম কামাত। কি করে যে মাতৃহীনা দুই মেয়েকে বড় করে তুলল কে জানে।গৌরীর বিয়ে হয়েছিল ষোল বছর বয়সে। আঠারো বছরেই বিধবা। বর বোম্বে রোডে আচমকা লরী অ্যাক্সিডেন্টে মরল। শ্বশুরবাডির লাথিঝাঁটা সহ্য করতে না পেরে একটি পুত্ররত্ন কোলে করে আবার বাপের ঘাড়ে এসে পড়ল। কি করবে ? কোথায় আর যাবে ! দুই বোনে আবার এক হয়ে পরস্পরকে আগলে রাখতে লাগল। কিন্তু চিরকাল তো আর একভাবে যায় না। সময় নিজের খেলা খেলতে থাকে। একসময়ে কালীধন ছোট মেয়ে মাধুরীকে পাত্রস্থ করল।
    পাত্র শশাঙ্ক জবরদস্ত মরদ বটে। যোশেফ বিশ্বাসের অ্যাকশান স্কোয়াডের দরকারী নাটবল্টু এরা সব। তবে নাটবল্টুতে মরচে ধরে গেলেই ফেলে দিতে হয় বা দুনিয়া থেকে হাফিস করে দিতে হয়। এহেন শশাঙ্ক মাধুরীকে শুধু একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় মননহীন আসবাবই মনে করত। মেয়েমানুষের শরীর সে অনেক ঘেঁটেছে। তাদের ইচ্ছেয় বা অনিচ্ছেয়। শশাঙ্কর ধারণা— মেয়েছেলের আবার ইচ্ছে অনিচ্ছে কি ? তাদের জন্মই হয়েছে পুরুষের সেবা করার জন্য। যেমন হরিণের জন্ম হয় বাঘের খাদ্য হবার জন্য । তবে নিজের পোষা পাঁঠার ওপর অন্য লোক কোপ বসাতে চাইলে যেমন পাঁঠার মালিক রুষ্ট হয় তেমনই বাস্তব কর্ত্তব্য কর্মবোধ তারও ছিল মাধুরী সম্বন্ধে। কেবল সে-ই মাধুরীর মালিক, এ ব্যাপারে সে সদা সজাগ। আর কারও দখলদারি নেবার ঝোঁক দেখলে তাকে সে রেহাই দেবে না। পাঁঠার মালিকের কর্তব্য তার নিজস্ব পাঁঠার নিরাপত্তা বিধানের। যাতে তার মাংসে অন্য কেউ দাঁত বসাতে না পারে। পারলে, সেটা তার চরম বেইজ্জতি। মাধুরী নারী প্রজাতির চিরাচরিত ধারায় সংসার আগলায়। মানে, তার শ্রেণীর নারীর সনাতন ধারাক্রম রক্ষা করে চলে । বছর ঘুরতে না ঘুরতে সন্তান আসে। আদিম বাৎসল্য রসের সুগন্ধে তার বুক ভরে থাকে। গু মাখা কাঁথা সাফ থেকে কপালের এক কোণে কাজলের টি প অথবা স্তন্যপান পর্যন্ত সমস্ত কিছুই যথাযথ প্রযত্নে পালিত হতে থাকে। শশাঙ্কের নিয়মিত অবহেলা বহুদিনই গা সওয়া হয়ে গেছে। বেশিরভাগ রাত্রে শশাঙ্কর যৌন ক্ষিধেও থাকে না। ঘরের বাইরে তো আর নারী-মাংসের অভাব নেই। এ সবও গা সওয়া হয়ে গেছে। যেদিন যেদিন রাতদুপুরে অ্যাকশান থাকে সেদিন মাধুরী ঠি ক টের পায়। সকালবেলায় কালীমন্দিরে গিয়ে পুজো চড়িয়ে আসে। বারণ টারণ সে ভুলেও কখনও করতে যায় না। স্বামীকে শোধরাবার কথা কল্পনাতেও আনার সাহস তার নেই। এসব আদিখ্যেতার অবকাশই নেই তার জীবনে।
    যোশেফ বিশ্বাসকে মাধুরী কখনও চোখে দেখেনি। তবে চ্যালা শশাঙ্ককে দেখেই আন্দাজ পায় যে গুরুটি কেমন ধাতের হতে পারে। অবশ্য গুরু না বলে প্রভু বা মালিক বলাই ভাল। একটু পান থেকে চুন খসলেই শশাঙ্ক যে রূপ ধারণ করে, তার চেয়ে হাজার গুণ ভারি মহাপুরুষ যোশেফ বিশ্বাসের রকম সকম কেমন হতে পারে তা সহজেই আন্দাজ করতে পারে মাধুরী। একটা কথা ভুলে গেলে চলবে না। শশাঙ্ক যখন কালীধনের মতো কলের মিস্ত্রির মেয়েকে ঘরণী করেছিল তখনও সে যোশেফের দলে ভেড়েনি। তবে মহত্ত্ব তো সে অবশ্যই দেখিয়েছে।অনেক কিছু সহজলভ্য হয়ে যাবার পরও শশাঙ্ক মাধুরীকে বেসাহারা করে উদোম বাজারে ছেড়ে দেয়নি। দানাপানি দিয়ে পুষছে তাকে এখনও ।

    *************
    চৈত্র পড়তে না পড়তেই বাতাস হল্কা ছড়াতে শুরু করেছে।আকাশ সিসে রঙে লেপটা লেপটি হয়ে নির্লিপ্ত গা এলিয়ে পড়ে আছে। জলদ মেঘকে নেমন্তন্ন পাঠাবার কোন গরজই নেই এখনও আকাশের। সন্ধেবেলা রাস্তার দুই ধারে সার বেঁধে বসা আনাজওয়ালারা পটলে ঝিঙেতে জল মারছে তাদের টাটকা জোয়ান করে রাখার ধান্দায়। শশাঙ্ক চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে বসে রাস্তার লোকজন, আনাজপাতি বেচাকেনা দেখছিল। প্রায় হপ্তা দুয়েক ধরে তার কোন কাজ নেই। মার্কেট ডাল। ভেতরে ভেতরে ভীষণ উসখুস করছে। হপ্তা দুয়েক আগে লাস্ট অপারেশান করেছে। মাঝেরহাট ব্রীজের নীচে। ছোট অপারেশান। সে একাই করেছিল। প্রায় শুনশান ব্রীজের নীচে রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ হীরন্ময় বাগচীকে ‘বিলা’ করে। কোন রিস্ক নেয়নি। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেণ্জ থেকে পিস্তলের ট্রি গার টানে। সাইলেন্সার লাগানো ছিল। শুধু ফুঁ-উ-স্ করে একটা আওয়াজ উঠল। ব্যস্। ব্যাটাকে কি কারণে হাফিস করা হল তা সে জানে না। অর্ডার ছিল। তামিল হল। ফুরিয়ে গেল। অন্ধকারে ভুঁইফোঁড় হয়ে তাকে আবির্ভূত হতে দেখে হিরন্ময় বাগচী— কলকাতার এক কলেজের লেকচারার চমকে উঠেছিল শুধু। তারপর আঁ পর্যন্ত করার ফুরসত পায়নি। পরদিন ভোরের আলো ফোটবার পর যখন লোকজন জানাজানি হল, তার আরও আট দশ ঘন্টা বাদে পুলিশের লোক ধুরের মতো কুকুর টুকুর নিয়ে এসে হাজির। কুত্তাটা বিজ্ঞের মতো স্পটে লাশ শোঁকাশোঁকি করে এদিকে ওদিকে কায়দা করে ঘুরে ফিরে গাড়ির পাটায় গিয়ে উঠে পড়ল। এসব ন্যালকানি দেখলে শশাঙ্কর বহুৎ লগড় হয়। চোখের সামনে শশাঙ্ক বিন্দাস ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। তাকে লোকে দেখেও দেখছে না। তাদের নজর কুত্তার ওপর । কুত্তার ওপর ডিউটি দেওয়া হল তাকে পাকড়াবার। মানুষেরই শুধু ব্রেন আছে ? কুত্তার নেই ? তারাও চালাকি জানে।তারাও কায়দা শিখে গেছে এই চক্করে দিনের পর দিন লাট খেতে খেতে । একটু এদিক ওদিক ঘোরা ফেরা করে, ‘ না: কিচ্ছু করা গেল না ‘ — এই ভঙ্গীতে ডিউটিতে খ্যামা দিয়ে গাড়ির পাটায় গিয়ে বসে পশুরাজের স্টাইলে।
    শশাঙ্ক দেখতে পেল একজোড়া ছেলেমেয়ে পাশের স্টলে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা বোতল খাচ্ছে। ছেলেটার পরণে ব্যাগিজ প্যান্ট , সাদা কটন টি শার্ট। মেয়েটা পরেছে ঢোলাঢালা আর্দি গোছের পাতলা স্ট্রাইপড কাপড়ের শার্ট আর ফেডেড জিনসের প্যান্ট। একুশ বাইশ বছর বয়স দুজনেরই। নরম পাতলা চিকন শরীর মেয়েটার। ডানহাতে নিটোল কব্জিতে স্টীল ব্যান্ডের হাতঘড়ি। মসৃন গ্রীবায় রুদ্রাক্ষ টাইপের, বুটির হার।দুজনে ক্যাচর ব্যাচর করে ইংরীজিতে কথা বলছে। মাঝে মধ্যে দু’একটা বাংলা ভাষার চেরিফল। এসব মারধাক্কা বিলিতি ব্যাপার দেখলে শশাঙ্কর রক্ত গরম খেয়ে যায়। সে নির্লজ্জভাবে একদৃষ্টে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইল।
    ওরা পয়সা চুকিয়ে দিয়ে দুজনে কাঁধের ওপর কিটস ব্যাগ ফেলে পরিপার্শ্ব সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করতে করতে রাস্তা ধরে সোজাসুজি খানিকটা হেঁটে গিয়ে রিক্সা স্ট্যান্ডে একটা রিক্সায় গিয়ে বসল।শশাঙ্কর ঘাড়ে কানে জ্বালা ধরে গেল। কুরঙ্গীর চিন্তা এসে গেল মাথায়।
    শশাঙ্ক ধীর গতিতে হেঁটে বাস রাস্তায় এল। বাস স্টপের উল্টো দিকে পানের দোকান থেকে তিনশো এক জর্দা দেওয়া একটা পান কিনে মুখে পুরল। বাসে উঠে দক্ষিণ কলকাতার এক প্রত্যন্ত জায়গায় এসে নামল, তারপর রাস্তা পার হয়ে ওপারে নানা অলিগলি বেয়ে পৌঁছে গেল তার গন্তব্যে।
    **************
    বুড়ো আসিফ একেবারে লোলচর্ম হয়ে পড়েছে। বয়েসও তো অঢেল হল। তা নব্বই বিরানব্বই হবে। হাত পায়ে বল কমে এলেও চোখ কান এবং মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ এখনও রীতিমতো তীক্ষ্ণ। টকটকে ফর্সা রঙ। ছ ফুট লম্বা শরীর এখন নুয়ে পড়েছে সময়ের ভারে। সেই কোনকালে আব্বার হাত ধরে ফিরোজপুর থেকে কলকাতায় এসেছিল সে যেন স্বপ্নের মতো গত জন্মের কথা বলে মনে হয়। মা বোন ফুফা ফুফি সব পড়ে রইল গাঁয়ে। বাবার সঙ্গে চলে এসেছিল ছোট্ট আসিফ। তখন ব্রিটিশ জমানা। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ্ লক্ষ্ণৌ থেকে পালিয়ে কলকাতায় এল সাঙ্গোপাঙ্গো নিয়ে। এসে মেটিয়াবুরুজে শেকড় গেড়ে দিল হাত পা ছডিয়ে মৌজ করে বসে। তারই ডালপালা তখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে মেটেবুরুজময়, যখন আসিফ কলকাতায় গঙ্গার পারে এইখানে এসে উঠল আব্বার হাত ধরে।
    নীচু পাঁচিলে জাফরির কাজ। মাঝখানে নকশা করা। ফুল নকশায় ভরাট সেগুন কাঠের জাঁদরেল সাবেকি দরজা। দরজা ঠেলতেই ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ ওঠে। ঢুকতেই ফাঁকা সাফসুতরো নি:ঝুম উঠোন। শেষবেলায় কাকেদের মিটিং বসেছে। একপাশে নীচু পাঁচিলের কোল ঘেঁসে একটা রাধাচূড়া, একটা কাঞ্চন ফুলের গাছ। ঝরে পড়া হলুদ ফুলে আঙিনা আকীর্ণ। সামনেই নীচু ছাতের দুখানা ঘর। দুখানাতেই তক্তপোষ পাতা। এখানে হাজির হলে কামুক শশাঙ্করও নিজেকে কেমন বিবাগী লাগে। এসব ধান্দা আর ভাল লাগে না। সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে কোথাও উধাও বেপাত্তা হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।
    আসিফ মহম্মদ উৎকর্ণ হয়ে শশাঙ্কর পায়ের আওয়াজ শোনে। কম্পমান কন্ঠে সওয়াল করে— ‘ কৌন হ্যায় ভাই.... ক্যা মাংতা জি ?..... এ গুলশন, দেখ তো জারা..... ।’ তক্তপোষ থেকে ওঠে না নিজে। থুম মেরে বসেই থাকে । হাওয়া পাক খায় রাধাচূডার পাতায় পাতায় । দুটো ঘন শ্যাম ছাগলছানা লাফালাফি করছে উঠোনে।
    শশাঙ্ক আওয়াজ দেয়, ‘ আমি—আমি শশাঙ্ক, সাহেব। কিছু মেশিন দরকার, তাই .....।’
    ঘরে ঢুকে চৌকিতে বসে শশাঙ্ক। আসিফ মিয়াঁর চোখে মুখে দাড়িতে ফতুয়ায় যেন ইতিহাসের ঘোর লেগে আছে।
    সেই কোনকালে কলকাতায় এসে উঠল দেশ গাঁ ছেড়ে । তারপরে একসময়ে দেশ স্বাধীন হল। পার্টিতে পার্টিতে ছেয়ে গেল দেশ। ওপার থেকে নিরুপায় হয়ে লোকজন এসে এপার ভরিয়ে দিল। শুরু হল এক এক ছটাক জমি দখলের জন্য কামড়াকামড়ি
    । ফড়ে, দালাল, চামচা, নেতাদের জমি পোক্ত করার ভরভুর মওকা। বাড়ল দুশমনি, খুনখারাপি, ঈর্ষা, বিদ্বেষ, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা। শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য দরকার পড়ল মেশিন, চেম্বার— মানে, অস্ত্রশস্ত্র সাপ্লাইয়ের । এই সাপ্লাইয়ের কারবার যারা ধরে নিতে পারল তারা। লাল হয়ে যেতে লাগল। খুনখারাপির ময়দানে অফুরান মেশিন সাপ্লাই দিয়ে যাও শুধু । আসিফের আব্বাজান নূর মহম্মদ রুজির পথ না পেয়ে অকুল সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল। সর্ষেফুল দেখছিল ভিনদেশে এসে। কালের বিবর্তনে এই মানুষ মারার কল ফাঁদার সন্ধিক্ষণে সে হাতে স্বর্গ পেয়ে গেল। পুরোদস্তুর কাজে লেগে গেল একেবারে। বাপের পর ছেলেও যথাযথ তৎপরতায় লাইন ধরে নিল। সেই হাতবোমা, একঘরা পিস্তল, ভোজালির কাল থেকে ক্রমে ক্রমে আর ডি এক্স, নাইট্রো-গ্লিসারিন, জিলেটিনে এসে পৌঁছেছে। সঠিক জায়গায় সঠিক আঁতাত বজায় রেখে যুগের পর যুগ স্বচ্ছন্দ তালে নানা খরস্রোত ঠেলে এতদূর চলে এসেছে সে।
    — ‘ আসিফ সাব, ... এই এটা ছিল। যোশেফ স্যার পাঠিয়েছে...’
    শশাঙ্ক কুচকুচে কালো কুমীর ছানার মতো একটা রিমোট কন্ট্রোল হ্যান্ডসেট বার করে।
    ‘..... আপনার যদি দরকার থাকে...’ , শশাঙ্ক হ্যান্ডসেটটা বাডিয়ে ধরে আসিফের দিকে।
    —‘ ইয়ে ক্যা চিজ হ্যায় ? ‘
    — ‘ এটা একটা রিমোট কন্ট্রোল। একশো কিলোমিটার দূর থেকেও টারগেট ব্লাস্ট করা যাবে। খুব কাজের জিনিস সাহেব। তিন লাখের মতো দাম আছে । রেখে দিতে পারেন। ‘
    আসিফ রিমোটটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, ‘ কামালকা চিজ হ্যায় লাগতা। কামপে আ সকতা .... গুলশন, এ গুলশন .... রাখ লো ইসে... .হাঁ যোশেফকো বুলায়া করো তিন চার দিনকা বাদ....বাকি সব ঠি ক হ্যায় না ? সামহালকে রহনা ...আঁ...ঠি ক হ্যায় জি ...’
    আসিফ চৌকি থেকে গা তোলে ভেতরের ঘরে যাবার জন্য।

    ওখান থেকে ট্যাক্সি ধরে শশাঙ্ক গিয়ে পৌঁছল ম্যাংগো লেনে। ট্যাক্সি অবশ্য শশাঙ্ককে ধরতে হয়নি । ট্যাক্সিই সযত্নে তুলে নিয়েছে শশাঙ্ককে। আসিফ মিয়াঁর চৌহদ্দিতে সব কিছুই ফিট করা থাকে। উকিল থেকে ট্যাক্সি পর্যন্ত।
    হাই কম্যান্ডের কখন কি ইরাদা থাকে বলা মুশ্কিল । হয়ত ট্যাক্সির কারবুরেটরেই মাইক্রো ডিটোনেটর ফিট করা আছে। কোথা থেকে কে রিমোট কন্ট্রোলে আঙুল ঠেকাল, সে আর ড্রাইভার সুদ্ধু ট্যাক্সি উড়ে গেল । কাকে কখন ঝেডে ফেলতে চায় ওরা আগাম আন্দাজ করা অসম্ভব।এরকম কেস তো গত দুবছরে দুটো হল। শশাঙ্কর আজকাল কেমন গা শিরশির করে।
    যোশেফ বিশ্বাসের উথ্থান-চমক বোম্বাই ফিল্মের কাহিনীকেও হার মানায়। কি ছিল, আর কি হয়েছে ! সবই তো শশাঙ্কর চোখের সামনেই ঘটল। শালা সোসাইটি সিনেমার সামনে টিকি ট ব্ল্যাক করত। নিজের বাপের ঠি কানা তার কাছে অজানা— শশাঙ্ক মনে মনে ভাবে। আর অাজ উঁচুতলার ইংরিজি বুলি বলা মসৃন মেয়েরা তার সঙ্গে বকবকম করছে। আদিখ্যেতায় নমনীয় আইসক্রীমের মতো গলে যায়। কত আর দেখবে শশাঙ্ক ! সে তো আজতক যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। কাঁচা নর্দমার ধারে।

    ******** ******* *******
    কাল রাত দুটো থেকে কারেন্ট নেই। কোথায় নাকি ট্রান্সফর্মার ফেটে গেছে। গৌরী সেই কখন থেকে হাতপাখা টেনে টেনে কাহিল। ছেলেটা হাঁটতে শিখেছে । মোটে গরম সহ্য করতে পারে না। বোনের বাড়ি এসেছে প্রায় মাস দুয়েক বাদে। বাপের ঘরে একপেটা খেয়ে কোনরকমে ছেলেটাকে নিয়ে পড়ে আছে। বাপ চোখ বুজলে কোথায় আশ্রয় হবে কে জানে। এসব ভাবলে কষ্টে বুক ফেটে যায় মাধুরীর । কিন্তু কি করবে সে। মাঝে মাঝে এখানে এনে বাবাকে দিদিকে পেটভরে ভালমন্দ খাওয়ায় চারবেলা। কাছে রাখতে ভরসা পায় না। দিনের দিনই সন্ধ্যের মুখে তাদের রওনা করিয়ে দেয়। কোন ভরসা নেই শশাঙ্ককে।তার তো গুণের কোন ঘাট নেই। তার দিদি গৌরীর যৌবন এখনও অটুট। সে প্রতি মুহূর্তে খেয়াল করে একথা। শশাঙ্ক নানা কাজে অহরহ ব্যস্ত থাকায় এখনও গৌরীর শরীরের দিকে নজর দেবার সময় পায়নি। তাই যতখানি পারে আড়ালে আড়ালে আগলে রাখে দিদিকে।
    বেলা প্রায় এগারোটা বাজল। রোদের তাত বাড়ছে। বাচ্চাটা আপনমনে দুটো খালি কৌটো নিয়ে খেলছে। মাধুরী পটল ভাজছে ছ্যাঁক ছোঁক করে ছেলে কোলে নিয়ে বসে। গৌরী গায়ের আঁচল ফেলে দিয়ে পা ছডিয়ে বসে হাতপাখার হাওয়া টানতে টানতে পাঁচকথা গল্পগাছা করছে। কথা আর কি ? তাদের দুনিয়া তো এইটুকু। কথা সবই ওই সাংসারিক অভাব অনটন এবং বৃদ্ধ কালীধনের বয়সঘটিত ভীমরতি সম্পর্কিত বিষয়ে। যদিও মাধুরী অসহায় কালীধনের সমালোচনা একদম পছন্দ করে না।
    — ‘ কি করবে বল দিদি, সারা জীবন ধরে কম বোঝা তো টানল না। এখন তো বুড়ো মানুষটা একটু বিশ্রাম চায়। মাধুরী বলে রান্না করতে করতে।
    — ‘ সে তো নিশ্চয়ই। কিন্তু যত বুড়ো হচ্ছে ততই যেন কান্ডজ্ঞান লোপ পাচ্ছে। কোন কিছুর আগা মাথা কিছু নেই।কার সামনে কি বলতে হয়....। ‘
    মাধুরী আবার স্নেহের স্বরে বলে, ‘ সে তো বয়সের ধর্ম দিদি... আমরা সকলেই একদিন এরকম.... ‘
    এদিকে গৌরী তার বাপের নামে অভিযোগ করে যেতেই থাকে— ‘ আরে শোন না তুই আগে। সেদিন একঘর লোকের সামনে আমার ছেলেটাকে গাল দিয়ে উঠল হঠাৎ— আরে মর মর শুয়োরের বাচ্চা। যমেরও অরুচি সব....।’
    মাধুরী তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘ বুড়োমানুষের এসব কথা ধরতে নেই দিদি। অনেক আঘাত পেয়ে পেয়েই তো লোকটা এমনধারা হয়ে গেছে। ‘
    গৌরী গুম মেরে বসে হাতপাখা টানতে থাকে। তার যৌবন ফুরোতে এখনও অনেক বাকি। তার দেহে মনে অনেক জ্বালা। সে লোলুপ নয়নে পুরুষ্টু পটলভাজাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।
    শশাঙ্ক ডিউটিতে বেরিয়েছে। আজ বোধহয় আবার নাইট ডিউটি আছে। তাই গৌরীর একটু রাত করে বাড়ি ফিরলেও চলবে। আসলে গৌরীও রগচটা শশাঙ্ককে বেশ ভয় পায়। যে শ্বশুরকে চড় চাপড় মারতে পারে সে তো সবকিছুই করতে পারে।
    দুপুরবেলা গৌরী চেটেপুটে মৌরলা মাছের বাটিচচ্চড়ি খেল ভাতে মেখে । ঘটি তুলে ঢকঢক করে জল খেল। পরিতৃপ্তির ঢেকুর তোলে বুকে হাত চাপা দিয়ে।
    অা-হা, খাওয়াতেই যেন পৃথিবীর সব সুখ। সব অশান্তি জুড়িয়ে যায়। পেটের জ্বালায় সময় সময় তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়। খালি মনে হয় শুধু পেটভরে খেতে পাওয়ার জন্য যে কোন লোকের কেনা বাঁদী হয়ে থাকতে পারে সে। একটা খাওয়ানোর মালিক পেলে যেন বেঁচে যায় সে।

    ******* ******* *******
    বিকেল পাঁচটা। পুষ্পরেণু চট্টোপাধ্যায় ঘোষপাড়া পার্কের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন। ইতিমধ্যে আরও চারজন সংস্কৃতিবান সেখানে বৈঠক জমিয়ে তুলছে। কোণের ফুটপাথের স্টল থেকে চা আসে, মুচমুচে ঘরোয়া বিস্কুট আসে।
    ‘ এ: বাবা, এ কি মুখে দেওয়া যায় নাকি ! ক ফুটের চা বাবা ?’— ড: ঘোষ বলে ওঠেন।
    পুষ্পরেণুবাবুর সমর্থন পান তিনি অতি দ্রুত— ‘ এর বেশি কিছু আশা করবেন না মশায়, এর বেশি কিছু আশা করবেন না।’ বলে তিনি আরও গূঢ় সমাজতাত্ত্বিক থিওরি আবিষ্কার করেন— ‘ এ দেশের সবকিছু ডিজেনারেটেড হয়ে গেছে গোবিন্দর ওই চায়ের মতো। ইজ ইট নট ?‘
    অনুপ রায় রাষ্ট্রবিজ্ঞাণের অধ্যাপক। এদের তুলনায় বয়সে খানিকটা তরুণ। মন্তব্য করে— ‘ একটা জাতির ব্যাকবোনই ফ্র্যাজাইল হয়ে পড়ে যখন তার এইট্টি পারসেন্ট পপুলেশানের ইনডিভিজুয়াল কালচার সিনেমা ওরিয়েন্টেড এবং ট্র্যাশ টি ভি সিরিয়াল অ্যাডিক্টেড হয়ে যায়।’
    সঙ্কর্ষণ মিত্র মৃদু প্রতিবাদ করেন— ‘ এটা একটু এক্সাজারেট করা হল অনুপ। এইট্টি পারসেন্ট পপুলেশন সিনেমা ওরিয়েন্টেড ....এতটা বলা, ইয়ে হল গিয়ে ঠিক না.... ‘
    অনুপ হার মানে না— ‘ তা কি করে বলছেন সঙ্কর্ষণদা । এই তো কবে যেন পেপারে দেখলাম বলিউড ফিল্মস্টারদের বিকিনি থেকে সানগ্লাস পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ টাকায় নিলামে বিক্রি হচ্ছে । তার মধ্যে টাডায় অ্যারেস্ট হওয়া স্টারের গারমেন্টও আছে। এর পরেও আপনি..... ‘
    পুষ্পরেণুবাবু অবশেষে হাল ধরেন। মধ্যস্থতা করেন— ‘ দেখ অনুপ তুমি যে একেবারে ভুল বলছ তা নয়। গ্ল্যামার ওয়ার্লডের ওপর দুর্বার আকর্ষণ সংযত করা ইজ রিয়েলি এ আপহিল টাস্ক।তবু দেখ আমাদের মতো কিছু লোকও তো এখনও আছে।এই দেখ না—‘
    অনুপ রায় তার যুক্তিতে অনড় থাকে। ‘ সেই জন্যই তো বলেছি এইট্টি পারসেন্ট। সেন্ট পারসেন্ট তো বলিনি। আপনার আমার মতো লোক তো টোয়েন্টি পারসেন্টের বেশি নয়। .....এই কাশ্মীর সমস্যার কথাই ধরুন না। কোন ভায়াবল্ সলিউশনের কথা কেউ ভাবছে ? আর্টিকেল থ্রি সেভেনটি কাশ্মীরে কেন ইমপোজ করতে হল তা কি কেউ জানে ? ওই সময়ে জহরলাল নেহেরু মারা না গেলে হয়ত অন্যরকম কিছু..... ওখানে আফসপা কন্টিনিউ করাটাও মোস্ট প্রোব্যাবলি অ্যাডভার্স লোক্যাল সেন্টিমেন্ট ক্রিয়েট করছে। অ্যান্ড ইট বিকামস ফেটাল হোয়েন ..... ‘
    —‘আরে, নেহেরু আর জিন্নার জন্যেই তো দেশভাগ হল। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভ। গান্ধীজি তো এর ডেড এগেনস্টে ছিলেন। তিনি তো বলেছিলেন....’
    সুদর্শন চক্রবর্তী এতক্ষণ চুপ করে বসে সিগারেট টানছিলেন। হঠাৎ বললেন, ‘ ওই দেখুন , ওই যে যাচ্ছে।’
    সবাই বাঁ দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল পার্কের দক্ষিণ দিকের রাস্তা দিয়ে শশাঙ্ক যাচ্ছে। মাথা নীচু করে কি যেন ভাবতে ভাবতে যাচ্ছে । তাদের থেকে শশাঙ্কর দূরত্ব অন্তত ত্রিশ গজ। তবু সংস্কারমূলক কথাবার্তা বলা অনুপ রায় চাপা গলায় মন্তব্য করল— ‘ এইসব এলিমেন্টের জন্যেই তো.... দে শুড বি— ‘
    পুরোটা শেষ করতে দিলেন না সুদর্শন চক্রবর্তী । অনুপের হাঁটুতে চাপ দিয়ে বললেন, ‘ চেপে যাও, চেপে যাও। শুনতে টুনতে পেলে আবার....।’ তখনও ওদের থেকে শশাঙ্কের দূরত্ব পনের গজের মতো। জুজুর ভয়ে চার বাক্যবাগীশ যে যার খোলার মধ্যে শামুকের মতো গুটিয়ে গেল।

    শশাঙ্কর আজ নাইট অ্যাকশান ক্যানসেলড হয়ে গেছে। এরকম বিকেলবেলায় বাড়ি ফেরে সে বছরে বড় জোর দুদিন। আজকে আচমকা ফিরে এল। এসে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত থতমত খাওয়া বড় শালিকে দেখতে পেল। বয়সে অবশ্য শশাঙ্কর চেয়ে ছোট। শশাঙ্ক হাঁ করে গৌরীর দিকে তাকিয়ে রইল। তার মাথা থেকে দুশ্চিন্তার মেঘ কেটে যাচ্ছে। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই প্ল্যান ছকতে লাগল। সে ভেবে পায় না, খেতে না পেয়েও এরা কি করে এমন নধর গতর ধরে রাখে। এমনি একটা মেয়েই চাইছিল কুরঙ্গী। তার বড় শালীর কথা তার মাথাতেই আসেনি একেবারে। কুরঙ্গী এমনি হাঘরে টাইপের মেয়েই চাইছে একটা। এদের পোষ মানাতে অনেক সুবিধে । শশাঙ্ককে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে দেখে গৌরী আরও হকচকিয়ে গেল। মিয়োনো গলায় অতি সন্তর্পনে বলল,
    ‘ শশাঙ্কদা ভাল ? ‘
    শশাঙ্কর তাল কেটে গেল। চোখ সরিয়ে নিয়ে জামা খুলে গামছা দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বলল,
    ‘ হুঁ, এই আর কি—।’
    মাধুরী শশাঙ্কর আগাপাস্তলা চেনে। গৌরীর দিকে শশাঙ্কর তাকানো দেখে অজানা আশঙ্কায় তার বুক গুরগুর করতে লাগল। আগুনে পোকায় তার মগজ কুরে কুরে খেতে লাগল। ভোলাভালা অসহায় চিরদু:খী দিদিটার জন্য মমতায় তার চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম হল। শশাঙ্কর এ চোখ সে চেনে। কিছুই তার নজর এডায়নি। অ দৃষ্টির ভয়ঙ্কর পরিণাম ভেবে গৌরীদিদির জন্য ব্যথায় তার বুক টনটন করতে লাগল। মাধুরী মনে মনে ছটফট করতে থাকে। তার সরল সাদা, একটু খেতে পেলেই বর্তে যাওয়া দিদি তো কিছুই আঁচ করতে পারছে না। সলজ্জভাবে বলল,
    ‘ মাধু আজ আসি রে, শশাঙ্কদা আসছি— ।’
    শশাঙ্ক খাটে বসে মাথা নীচু করে বলল, ‘ হুঁ, আচ্ছা।’ বলে, অপসৃয়মান গৌরীর পেছন দিকটা বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল।এটাও মাধুরীর চোখ এড়াল না।
    ********* ****** *******

    কুরঙ্গী কে ?
    যোশেফ বিশ্বাসের রাখেল। সোফায় শরীর একটু এলিয়ে দিয়ে বসে। ধূমপানের বিরাম নেই। চেন স্মোকার। ঠোঁটে লিপস্টিক ঘসে না। শুধু লিপগ্লস লাগায়।
    শশাঙ্ক চোস্ত পাজামা এবং কলার তোলা কচি কলাপাতা পাণ্জাবী পরেছে। রাত প্রায় আটটা বাজে। কলিং বেলে চাপ দিতেই ভেতরে পাখির কিচিরমিচির শোনা গেল। কুরঙ্গী নিজেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে। পরনে মেরুন রঙের সার্টিনের পাজামা এবং ভয়েলের টপ। কোন অন্তর্বাস নেই। চিকন গ্রীবায় সোনার সরু চেন।
    ‘ একটু বিয়ার নাও। নাকি হার্ড কিছু নেবে ? ও: হো, তুমি ভীষণ আনমাইন্ডফুল থাক আজকাল। যোশেফের রাখেল এইভাবেই কথা বলে শশাঙ্কর সাথে। কাকে দিয়ে যে কার খিদে মেটে .....। খাদ্য খাদকের প্রচলিত ধারণাটা এখানে উল্টে গেছে। এখানে শশাঙ্ক খাদ্য । কুরঙ্গী খাদক। যোশেফের অাজকাল আর কুরঙ্গীতে রুচি নেই তেমন। তাই লাগাম আলগা করে দিয়েছে। ল্যান্সডাউন রোডে আলাদা ফ্ল্যাট করে দিয়েছে মনোমতো স্বাধীন জীবন যাপনের জন্য। শশাঙ্ক একদিন এখানে এসেছিল বছরখানেক আগে যোশেফের ফরমাসে ফ্ল্যাটের ফার্নিচারগুলো পৌঁছে এবং সাজিয়ে দিতে।
    ঠি ক সেদিন থেকেই শশাঙ্ক কুরঙ্গীর মন পসন্দ্। পরুষ মেয়েলি কন্ঠস্বরে ইংরিজি-বাংলা মেশানো সোহাগী আলাপে প্রথম দিনই শশাঙ্কর পৌরুষ শুষে নিল এক দীর্ঘ উন্মাদ আসঙ্গে। শশাঙ্কর গায়ের গন্ধ নাকি তার কাছে ভীষণ ‘এক্সাইটিং’ । তারপর থেকে মাঝেমাঝেই ডাক পড়ে শশাঙ্কর। যেতেই হয়। উপায় কি ? কুরঙ্গীর প্রতিপত্তি এবং পরাক্রম এখনও প্রবল।
    হঠাৎ প্রচন্ড বর্ষণ শুরু হল। জলের তোডে চারদিক দিশাহারা। তার সঙ্গে ঘন ঘন মেঘগর্জন ও বিদ্যুৎ চমক। কুরঙ্গী কিন্তু আদৌ দিশাহারা হয়নি। তার ঘরকন্না এক বিষময় জগতের সঙ্গে। সেখানে বৃষ্টির রোমান্টিকতা সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক।
    সে নখে নেলপালিশ লাগাতে লাগাতে প্রভুসুলভ নির্লিপ্ততায় ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে, ‘ পাখি কালেকশান হল ? ওটা কিন্তু আমার পরশুদিন চাই। ফ্রেশ অ্যান্ড ক্লিন গার্ল চাই। এজ খুব কম না হলেও চলবে। সাড়ে পাঁচ কেজি টাট্টুর মাল আছে । বর্ডারে যাবে । কিছু না, যোশেফেরই কাজ। খুব রিস্কি কিন্তু, মাইন্ড ইট। ধরা পড়লে লাইফ টার্ম।’
    শশাঙ্ক গায়ে পাউডার ঢালতে ঢালতে বলল , ‘ হ্যাঁ , জানি। হয়ে যাবে।’

    ******* ******* ********
    মাধুরী যখন আসিফ মহম্মদ খানের সাকিনে গিয়ে পৌঁছল তখন বিকেলবেলা। সেই একই ছবি। রাধাচূড়ার হলুদ ফুল ঝরছে, কাকের দল উঠোনে সভা বসিয়েছে, দুটো ঘনশ্যাম ছাগলছানা আপনমনে লাফালাফি করছে। তফাত শুধু এইটুকু— অথর্ব আসিফ তক্তপোষের ওপর বসে নেই। ঘরের দরজার মুখে একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে। অহরহ সজাগ শ্রবণ এবং মস্তিষ্ক। সেই একই সওয়াল করে মাধুরীর পায়ের আওয়াজ পেয়ে— ‘ কৌন হ্যায় ভাই ? ক্যা মাংতা জি ? এ গুলশন দেখ তো জারা.... ।’
    মাধুরী উদ্বেগাকুল অস্ফুট কন্ঠে বলে, ‘ আমি... আসিফ চাচা....মাধুরী—।’
    আসিফ খান সন্দিগ্ধ কন্ঠে আবার শুধোয় — ‘ কৌন....কৌন মাধুরী ভাই ?’
    — ‘ আমি মানে, শশাঙ্কবাবুর....ইয়ে.... মাধুরী। গতবছর মহরমের পরবের সময়ে আপনার এখানে এসেছিলাম ...’
    — ও আচ্ছা... হাঁ জি। ইয়াদ আয়া। তুম উও শশাঙ্ক্-কা সাথ.... হাঁ হাঁ... ইয়াদ আয়া। ক্যায়সে আনা হ্যায় বোলো বেটি।’
    — ‘ আমার বড় বিপদ চাচা....’ বলতে বলতে গলা ধরে আসে মাধুরীর। আসিফের পায়ের কাছে বসে পড়ে সে হাঁফাতে থাকে।
    ‘ আমার দিদিকে আপনি বাঁচান চাচা। তাকে ....ওরা.... ওরা....’ , বলতে বলতে মাধুরী কেঁদে ফেলে এতক্ষণের আবেগ উৎকন্ঠা আর ধরে রাখতে না পেরে।
    — ‘ কিঁউ, ক্যা হুয়া উনকি ?’
    অত:পর মাধুরী অশ্রুসজল নয়নে, অকৃত্রিম আবেগে তার বিপুল ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রহ করা কুরঙ্গী শশাঙ্ক বিরচিত নারকীয় মাদক পাচার পরিকল্পনা বৃত্তান্ত বর্ণনা করে। হলুদ ফুল আপনমনেই ঝরে যেতে লাগল। মাধুরী করুণ প্রত্যাশায় বুড়ো আসিফের মুখের দিকে চেয়ে রইল তার হাঁটুর কাছে বসে।
    সর্বাঙ্গে ইতিহাসের গন্ধ মাখা প্রাচীন আসিফ মহম্মদ খান বুকের ভেতর এক দুর্মর জলপ্রপাতের শব্দ শুনতে পেল।ফিরোজপুর থেকে কলকাতা— বিস্তীর্ণ সময়ের তীব্র স্মৃতির আলোছায়ায় সহসা ভয়ানক হয়রাণ হতে লাগল বুড়ো আসিফ। কালের পর কাল, যুগের পর যুগে বয়সের পাথর ফেলে এসে হঠাৎ এক পলকে মাধুরী মন্ডলের চোখের জলে ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে এই দন্ডে তার মস্তিষ্কে এক কালবৈশাখী তুফান জেগে উঠল।
    —- ‘ গুলশন, এ গুলশন, কাঁহা গ্যয়া রে.... এক কুরসি লা দে জারা ইয়ে বেটি কে লিয়ে.... ব্যায়ঠো ব্যায়ঠো। পরেশান মাত হোনা। তুমহারা কোই ফিকর নেহি। ম্যায় যো হুঁ না। আরাম সে ব্যায়ঠো.... লো পানি পিও।

    ********** ******** *******
    ধূর্ত আসিফের চালাকিতে বহুদিন বাদে যোশেফ আর কুরঙ্গী এক হয়েছে। শালবনীর উপকণ্ঠে যোশেফ এবং কুরঙ্গী সমেত একটা কনটেসা গাড়ি বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটায় চরাচর বিদারী বিস্ফোরণে চূর্ণ বিচূর্ণ হয়ে গিয়ে প্রচন্ড বেগে উৎক্ষিপ্ত হয়ে নদীর জলে, বনের গাছে, ক্ষেতের ধানে গিয়ে পড়ল। দেহাতের আকাশ বাতাশ ঘন কৃষ্ণ উৎকটগন্ধী ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে গেল।
    গাড়ীর মাটগার্ডে একটা ডুমুরের সাইজের ডিটোনেটর সাঁটানো ছিল। তা খোদা রসুল ছাড়া এক ওই বুড়ো আসিফই জানে। ঘোলাটে জলকাটা চোখে কুচকুচে কালো কুমীর ছানার মতো রিমোট কন্ট্রোলের হ্যান্ডসেট হাতে করে বেতের কেদারায় গা এলিয়ে বসে বসে যে ভাবছে জীবন সীমান্ত আর কতদূর ....।কেউ জানুক আর না জানুক আসিফ মনকে ঢাকা দেয় কি দিয়ে ! যোশেফ বিশ্বাস তো সেই কবে রক্ত মাংসের দলা হয়ে এ দুনিয়ায় এসে পড়েছিল তারই রক্তবীজ শরীরে ধরে নাজায়েজ এক অভাগা হয়ে।

    *****************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | 162.158.167.17 | ১০ মার্চ ২০২০ ১০:০৫91363
  • হুমম বেশ টানটান লেখা
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন