এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • কেন্দুলি সন্ধান

    অতনু ব্যানার্জী লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ১১৩৩ বার পঠিত
  • ।।১।।

    জয়দেব মেলা...কেন্দুলি... জয়দেব... জয়দেব...ছাড়ছে এক্ষুনি...খালি আছে ... আসুন ...আসুন...জয়দেব


    ...রিক্সা থেকে নামতেই দেখলাম বোলপুর বাসষ্ট্যান্ডের মুখে লড়ঝড়ে বাসের কন্ডাকটার গায়ে কালচে সবুজ সোয়েটার আর মাফলা জড়িয়ে চিৎকার করছে আর বাসের গায়ে থাবা মারছে। রিক্সাওয়ালাকে টাকাপয়সা মিটিয়ে ছুট্টে বাসে চড়তেই দেখলাম একটাও সিট খালি নেই, অগত্যা হ্যান্ডেল ধরা শ্রীচৈতন্য ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে বাসের ঝাঁকুনি খাওয়াই ভবিতব্য বুঝে নিলাম; বাসটা অনেকক্ষণ থেকে গরর গরর করে ফুঁসছিলো। এবারে চলতে শুরু করলো; বাসজুড়ে ভিড় তীর্থযাত্রীর। কাল ভোরে মকরস্নান। পুন্যার্থীরা গীতগোবিন্দের রচয়িতা জয়দেব তীর্থে এসে এই মকরসংক্রান্তির দিনে স্নান করে পুন্য হন। আর তিন দিনের এই আনন্দমেলায়, বসে বাউল-ফকির আর কীর্তনীয়াদের গানের আসর।


    এই তো সেদিন বাড়িতে, পরিচিত এক দিদির ফোন ভরদুপুরে। ঝলমলিয়ে বললো "শান্তিনিকেতন থেকে ঘুরে এলাম; রাঙামাটির একটা আলাদা ফ্রেশনেস আছে জানো তো?'। ব্যস, উঠলো বাই তো মক্কা যায়। ইন্টারনেট ঘাঁটতে লাগলাম শান্তিনিকেতন ঘোরার নাড়ি নক্ষত্রের খোঁজ পেতে। একজায়গায় দেখলাম এই ২০১১ এর ১৪ই জানুয়ারী পৌষের শেষদিনে জয়দেব মেলা শুরু হচ্ছে। পরদিন মকর স্নান। ধার্মিক আচার আচরণে আগ্রহী না হলেও এই মেলা যে বাউলদের এক মহান মিলন মেলা তা জানতাম অনেক আগে থেকেই। আর বাউলের গানের শব্দেরা অবাক করে দেয় গভীর দার্শনিক উপলব্দিতে। কেটে ফেললাম ই-টিকিট। শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে। মেলায় যাওয়ার আগের দিন অফিসে বসে ডাউনলোড করে ফেললাম প্রায় শ পাঁচেক বাউল গানের কথা...


    বোলপুর থেকে বাস চলেছে ঝাঁকুনি দিতে দিতে। বাসের মাথায়ও মানুষের ভিড়। বাসের হ্যান্ডেল এক হাতে ধরে পড়তে পড়তে চললাম সেই বাউল দর্শনের পাতাগুলো; এক একটা বাউলগান পড়ছি আর কানে এসে ভিড় করছে কখনো কোনো নির্জনে শোনা গানের সুর; সেই কথা আর সুরের সিম্ফনী ভুলিয়ে দিচ্ছে বাসের একটানা গোঁ গোঁ শব্দ, ভিড়ের পরিমান ক্রমশ বেড়ে আসার ঠেলা আর কন্ডাকটারের একটানা বাসে প্যাসেঞ্জার ওঠানোর সেলসম্যানশীপ। ঘন্টাখানেকের মধ্যে এভাবেই পৌঁছে গেলাম কেন্দুলী গ্রামের ধুলোভরা মাঠের মধ্যিখানে। এটাই এখানকার বাসষ্ট্যান্ড। এই সন্ধ্যেবেলা অবশ্য আরো অনেক বাস জটলা করছে এই মাঠেই। পিল পিল করে লোক নামছে বাস থেকে। ভিড় চলেছে অজয় নদীকে বাঁয়ে রেখে জয়দেবের মন্দিরে। হেঁটো ধুতিতে ঢাকা আধখোলা পা, ডিপ খয়েরী মাঙ্কিটুপীতে ঢাকা মুখের অনেকটা, অল্পদামী পাঞ্জাবীর পঞ্চাশোর্ধ থেকে না-চকচকে জামা প্যান্টে ঢাকা গ্রাম্য-মফস্বলী যৌবনের পাশে চলেছে আধমোচড়ানো শাড়ী বা না-শহুরে সালোয়ার কামিজের নানা বয়সের মেয়েরা, তাদের হাতে ধরা কচিকাঁচাদের নিয়ে; ভিড়ে মিশে গেলাম আমিও। আর লক্ষ্য করলাম আরো অনেক শহুরে পোষাক ভিড়ে মিশে আছে ইতি উতি; আবার অনেক বিদেশীও। হাতে বড় বড় ক্যামেরা নিয়ে।



    রাস্তায় চলতে চলতে দেখছিলাম দুধারের মেলা। সবে মেলা বসছে আজ। আজ সারারাত ধরে পুন্যার্থীরা আসবে; কাল ভোরে মকরস্নান। কালকেই আসল ভিড়। পরশুও। তবে পরশু মেলা শেষ হবার একটা করুন সুর তো থাকবেই। বিজয়া দশমীর মতো। পথের দুধারে অস্থায়ী দোকানীরা পসরা সাজিয়েছে। শঙ্কর মাছের চামড়ায় বাত ভালো করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে কেউ হেঁকে চলেছে হাজারো বিজ্ঞাপন, কারো বা দোকানে হাঁড়ি, খুন্তী, কড়া, চাকী বেলনার উপচে ওঠা ভিড়, কোথাও আবার ডুগডুগির মেলা, কোথাও বা মাছ ধরার জাল; আরো দেখলাম রঙবেরঙা চুড়ি, কালোচশমা, গাঁজার কলকে, হরেক রকম জ্যোতিষ ছোঁয়া পাথর আর সাথে হরেক রকম খাবারের দোকান। তার সাথে বেগুনী,চপ-মুড়ি থেকে,পাঁপড়, লবঙ্গ লতিকা-রসগোল্লা হয়ে, শক্তিগড়ের ল্যাংচার উজ্জ্বল উপস্থিতি দোকানের হলুদ বাল্বের ছটায়। তার সাথে জুড়েছে মোগলাই, চাউমিন,কাটলেটের শহুরে নকলিয়ত ও। ভিড় ঠেলে পৌঁছলাম রাধামাধব মন্দিরে। এই মন্দিরের রাধামাধবের পূজাতেই জয়দেবের গীতগোবিন্দের সুর লেগে আছে। যদিও এখন অনেক বিতর্ক আছে জয়দেবের জন্ম ও গীতগোবিন্দ রচনাস্থল এই কেন্দুলি না ওড়িশা তা নিয়ে। সে বিতর্কের ভাবনা ছেড়ে পা বাড়ালাম মেলা দেখবো বলে।


    মেলার পথে দোকানীদের পসরা...


    লাল ধুলোর পথের দুধারে কীর্তনীয়াদের সারি সারি অস্থায়ী প্যান্ডেল। প্যান্ডেলে একটু একটু ঢুঁ মেরে দেখলাম কালো কালো চুলো মাথাদের ভিড় আকুল ভক্তিতে শুনে চলেছে কীর্তনের নানা ভক্তিরসের সুর। আর পুরুষ ও নারী মেশা এই কীর্তনীয়াদের পোষাকও বেশ আকর্ষনীয়। কেউ কৃষ্ণবেশী, কেউ রাধার শাড়ীতে। কেউ বা ধুতি পাঞ্জাবীতে। কেউ সাধারন পোশাকেই। আজ সকালে শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেসে চড়ে বোলপুর আসার পথে আমার পাশের সিটে বসে থাকা হাওড়া জেলার পাঁচগ্রামের নিকুঞ্জ মন্দিরে এক বৈষ্ণব গুরু গোবিন্দদাস বাবাজী বলছিলেন, "আসলে এই জয়দেব মেলায় বাউল কীর্তনীয়া বা বাউল শিল্পীরা নিজের পয়সা "দিয়ে' গান গায়। এই মেলায় তাদের "কন্ঠের' প্রচার হয়। এই মেলায় গান শুনে অনেকেই বরাত দিয়ে চলে যান কীর্তনীয়া বা বাউলদের অনুষ্ঠানের। মেদিনীপুর, বীরভূম, বাঁকুড়া, বর্ধমান , মুর্শিদাবাদে খুব জনপ্রিয় এই কীর্তনীয়া বা বাউলের আসর। বড় বড় বাউল শিল্পীদের কথা আলাদা; তারা প্রাণের আনন্দে আসেন নতুন বাউল গানের সন্ধানে বা গান শুনিয়ে আনন্দ দিতে। তবে আগের চেয়ে এই মেলায় কীর্তনীয়ার ভিড় অনেক বেশী। গোবিন্দদাস বাবাজীও যাচ্ছিলেন কেন্দুলীর পথে। ওখানে উঠবেন "ভোলাগিরি আশ্রমে'। ওনার কাছেই শুনলাম এই মেলার তিন দিনের গল্প। পৌষের শেষদিনে এই মেলার শুরু। সেদিন হলো "অধিবাস'। পরেরদিন অর্থাৎ মাঘের প্রথম শুরুতে মকর স্নান করে সাধু, সন্ন্যাসী, বৈষ্ণব ভক্ত ও অন্যান্যেরা মেলা দর্শন করে, ঘুরে ঘুরে। এদিন হলো "নাম'। মানে অস্থায়ী আশ্রমের প্যান্ডেল গুলোতে রাধা গোবিন্দের নামগান হয় সারা দিন রাত। আর বাউল ফকিরেরাও নিজেদের আনন্দমেলায় ডুবিয়ে রাখেন নেচে গেয়ে এসময়। আর শেষ দিন "ভোগ'। সাধু, সন্ন্যাসী, ভক্তদের মাটির মালসায় ভোগ খাইয়ে "সেবা' করা হয় নানা অস্থায়ী আখড়াগুলোতে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম অজয়ের তীরে। নদীর বুকে অনেকটা পর্যন্ত চড়া। নদীর পাশে রুপালী জোরালো আলো চড়ায় পড়ে দেখা যাচ্ছে চড়ার বুকে ইতি উতি ভিড় একগুচ্ছ যুবকের। শুনেছি এই মেলায় অনেকে আসে "নেশার' সন্ধানেও! আর দৈনিক প্রায় লক্ষ মানুষের ভিড় হয়। নদীর জল কালো দেখাচ্ছে। ওপারের বাড়ীগুলোও সোনালী আলো নিয়ে মিটমিটাচ্ছে। অজয় নদীকে বাঁ হাতে ধরে এগোলাম মেলার দিকে। ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। মেলায় পেটে পাক খাচ্ছে ইয়াব্বড় নাগরদোলা। খুব হৈচৈ হট্টোগোল সেদিকে। মাইকে মাইকে প্রবল চিৎকার কীর্তনীয়াদের। সুরে ও বেসুরে। ইতিমধ্যেই খেয়ে ফেলেছি একথালা কোঁকড়ানো চাঁদের মতো তেলচুপচুপে পাঁপড় ভাজা, বেগুনী আর সাথে রাজভোগ আর এত্তোবড় একটা ল্যাংচা।

    সকালে ট্রেনে গোবিন্দদাস বাবাজী বলছিলেন আসল সাধু কে সেটা "ভেক' কি আর বোঝা যায়! কপালে চন্দন তিলক কেটে হরিনাম কীর্তনের সুরে মানুষকে মজিয়ে রাখলে , জটাজুটধারী গাম্ভীর্যে সন্ন্যাসীর দূরত্ব বজায় রাখলে কিংবা বাউলের গেরুয়া পোষাক পরে একতারার তালে গানে শ্রোতাকে পাগল করলেও আসল "সাধু' পাওয়া দুষ্কর। সে-যে কোন পোশাকে লুকিয়ে আছে কে জানে। মেলায় যারা গান করে তারা "শিল্পী'। শিল্পী মানুষ শিল্প করে "খায়' বা আমোদ পায় কিন্তু "শিল্পের' ভাবনাকে কজনই বা নিজের জীবনে জারিত করে। এই বৈষ্ণব মানুষটির সঙ্গে কথা বলে খুব আনন্দ পেয়েছিলাম সকাল বেলা, ট্রেনের একঘেয়ে দুলুনির মাঝে। বড় প্রাণের কথা, যুক্তির কথা বলেন। জোর করে ধম্মো কম্মের দোহাই দিয়ে অযথা কঠিন করে তোলেননা জীবনের কথা বলতে গিয়ে।


    গোবিন্দদাস বাবাজী ও আমি...



    একগুচ্ছ ভাবনাদের গোলযোগ মনের মধ্যে ধরে আর মনের বাইরে কীর্তনের আস্ফালনের দোলনায় দুলতে দুলতে ঢুকে পড়লাম "মা তারা সেবাশ্রমের' অস্থায়ী আখড়ায়। এক অন্ধ শিল্পী বাউল-গান ধরেছে। সঙ্গে পোঁ ধরেছে উচ্চকিত-তবলা, অযথা সিন্থেসাইজারীয় ভাঁজ আর হারমোনিয়ামের । কিন্তু মনে ধরলো না সে গান। কোথায় দেহতত্ত্বের গভীরতা, কোথায় আত্মতত্ত্বের খোঁজ। এতো নিজের জীবনের দু:খের গল্প বলা বাউল গানের সুরে। মেলার পথে পরিচিত হওয়া নানা মানুষের কাছে শুনছিলাম এই বাউল গাইয়েদের কথা। বাউল গান করে অনেকেই, শিল্পের জন্য বা পেট চালাবার জন্য। কিন্তু সেই ভাবকে নিজের জীবনে সাধনা করা কৃচ্ছসাধক-বাউলেরা আজ সংখ্যায় ভীষণ কম। লালনের পথে জীবন চালনায় যা গভীরতা সেই ভাব ধারন করার সামর্থ্য আছে কজনের! বরং সাধক বাউলে সাধন সঙ্গিনী সহযোগে উল্টো-পথে চালানো দেহতত্ত্বের সাধনায় ঢুকেছে বেনোজল। সাধনের নামে অনেক জায়গায় চলে স্বেচ্ছাচারিতা, মুক্ত সহবাস। মুক্ত সহবাসের ভূমিকা বাউল তত্ত্বে এসেছে রিপুর লোভ থেকে মনকে নিজের দেহেই "মনের মানুষ' খোঁজার সাধনায়। কিন্তু কালের গতিতে তা হয়ে উঠেছে যৌনক্ষিদে মেটানোর নানা উপায়, তত্ত্বের আড়ালে। বিদেশে গান গাওয়ার লোভ আর প্রচার পাওয়ার বাসনা আজ অনেক বাউলেরই জীবন সাধনায় চলে এসেছে। এসবই শুনলাম সেই সমস্ত মানুষদের কাছে যারা বাউলদের গেছেন দিনের পর দিন আদর্শকে বুকে নিয়ে। কিন্তু অনেকেই হতাশ অনেক পরিচিত বাউলদের নানা অন্ধকার দিকগুলো নিয়েও।


    আসলে বাউল গানের সত্যিকারের গভীরতা আসে সাধক বাউলদের জীবন চর্চায়। আখড়ায় সাধনসঙ্গিনীর সহযোগীতায় "দমের খেলায়' বীর্যকে দেহভান্ডের বাইরে পড়তে না দিয়ে "উলটো পথে' চালিত করে ছয় রিপুকে নিয়ন্ত্রনে রাখাই বাউলদের অন্যতম জীবন চর্চা। গুরুমুখী এই চর্চার বেশীরভাগই বাইরের মানুষ জানতে পারে না কারন আখড়ার সেই গুরুমুখী "মনের মানুষ' অন্বেষণ সাধক বাউলদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। সাধক বাউলের জীবন কাটে এভাবেই আর সে পথে তাদের আশ্রয় হলো আপাত সহজ সরল বাউল গান আর মন ভোলানো একতারা বা দোতারা ছোঁয়া নাচ, আনন্দ লহরীর ঝঙ্কার, যার গভীরতায় ডুবে গেলেই আনন্দ।


    ঘরের নয় দরজায় নয় দুয়ারী

    তারা সদাই বেড়াই ঘুরি

    ছয় ডাকাতে জেগে থাকে

    তারা কখন করে চুরি।

    ঘরের মনিকোঠায় দিয়ে চাবি

    মনের সুখে নিদ্রা যাবি

    রবে না ছয় ডাকাতের ভয়ভাবনা

    সুখে রইবি মনকালা।


    এখান থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়লো "ভোলাগিরি আশ্রমের তাঁবু'... এখানেই গোবিন্দদাস বাবাজীর আসার কথা; উঁকি দিয়ে দেখলাম খড় বিছানো মাটিতে সার সার দিয়ে শুয়ে আছে মানুষ। রাত তখন অনেক। চোখে পড়লো অনুকূল চন্দ্রের আশ্রমও। ঘন্টা দুয়েক ধরে ঘুরেই চলেছি এই বিশাল মেলায়। কিন্তু যে জন্য এসেছি তাই পাচ্ছি না। বাউল কোথায়...সেই মন কেমন করা বাউলের সুর কোথায়? সর্বত্র প্রচারের তোড়ে থাকা কীর্তনীয়া আর বাউল গানের অখ্যাত গাইয়েরা; সেই একতারা হাতে ঘুরে বেড়ানো ভবঘুরেদের সাথে মিশতে, ওদের ভাব শুনতেই তো এসেছি এই মেলায়, খুঁজে বেড়াচ্ছি রাত জেগে। হঠাৎ চোখে পড়লো রামকৃষ্ণ আশ্রমে চলছে গীতগোবিন্দ পাঠ। এক মহিলা তার গাইয়ে দলবল নিয়ে সুরে সুরে গীতগোবিন্দ ব্যাখ্যায় ব্যস্ত। বসে পড়লাম একটা চেয়ার নিয়ে। রাধা কৃষ্ণের প্রেম বর্ণণাকে ভক্তির সাথে মিশিয়ে জয়দেব গীত গোবিন্দকে গড়ে তুলেছিলেন। শুনলাম সেই প্রচলিত বিশ্বাসের কথা, কৃষ্ণ এসে রচনা করেছিলেন গীতগোবিন্দের এক পদ। জয়দেব আর তাঁর স্ত্রী পদ্মাবতীর প্রেম যেন রাধা মাধবের প্রেমের পরিপূরক। ভক্ত আর ভগবানের এক হওয়ার আকুতি। এই নিয়েই গীত গোবিন্দ। মনের মধ্যে গুনগুন করছিলো কয়েকটা লাইন... একটু আগেই আরেক আখড়ায় এক অল্পবয়সী যুবতীয় গলায় শোনা ...


    পরজনমে হোয়ো রাধা

    বনমালী গো

    পরজনমে হোয়ো রাধা

    কাঁদিও কাঁদিও আমারি মতো

    তুমি কাঁদিও

    বনমালী

    বিরহ কুসুমমালা নিরালায় গাঁথিও

    বুকে নিও চিরতরে ব্যাথা

    পিয়া গো হোয়ো রাধা


    রাধামাধব মন্দিরের সামনে...


    রামকৃষ্ণ আশ্রমেই খেলাম রাতের খাবার। সারি সারি মানুষ বসে গেলো মিশনের ধূলোভরা উঠোনে সতরঞ্জী পেতে। পাশে টালি ঘেরা রান্নাঘরে মাটির বড় বড় উনুনের গনগনে আঁচে বড় বড় হাঁড়ি কড়াতে বসানো খিচুড়ী আর আলুর তরকারী। আমার ঠিক পাশে কামারপুকুরের পাঁচকড়ি মন্ডল। ম্যাট্রিক পাশ নি:সন্তান ষাটোর্ধ এই মানুষটা প্রতি বছর কোন এক অদৃশ্য টানে আসেন এই মেলায়। ওঁর ভাষায় "ভগবান টানেন'! শালপাতার পাতে পড়লো গরম গরম পাঁচমেশালী খিচুড়ি আর আলুর একটা তরকারী। খিদের মুখে আমার প্রাণটা জুড়িয়ে গেলো। কিন্তু ঘিয়ে রঙা শাল আর ধুতি পাঞ্জাবী আর মাঙ্কীটুপি ঢাকা পাঁচকড়ি মন্ডল রামকৃষ্ণ আশ্রমের এক আশ্রমিককে মুখের ওপরে বলেই দিলেন "বাড়িতে হলে এমন খেঁচুড়ি মোটেই খেতাম না! আলু সিদ্ধ হয় নি মোটেই! কিন্তু সবই ভগবানের দয়া; এও এক শিক্ষা; সার সার পাত পেড়ে খেয়ে চলেছে উঁচু নীচু ঘরের নানা মানুষ কাঁধে কাধ মিলিয়ে! এও এক শিক্ষা বটে'। আমি রামকৃষ্ণ আশ্রমের এক সাধুকে জিজ্ঞেস করলাম শোবার একটু জায়গা পাওয়া যাবে কিনা। ঠাঁই পেলাম এক অর্ধনির্মিত স্কুল ঘরে। সঙ্গে পাঁচকড়ি মন্ডল আর তার এক খুড়তুতো দাদা যার বাড়ি ডানকুনিতে। এক আশ্রমিক ছোকরা ভদ্রলোককে দেখিয়ে বললো "উনি কোইলকাতা হাইকোর্টের উকিলবাবু বটেক'! তা সেই উকিলবাবুর খুঁতখুঁতানি দেখে আমার বেশ আমোদ হচ্ছিলো। বড় দুশ্চিন্তায় ভদ্রলোক, কোথায় গরম জলে মুখ ধোয়া যায় এই রাত্তিরে! কোথায় পায়খানা করা যায় সকাল সকাল এসব নিয়ে খুব ভাবিত আর রীতিমতো আলোচনায় ব্যস্ত পাঁচকড়ি মন্ডলের সঙ্গে! অবাক হচ্ছিলাম এই ভেবে যে, নানা মানুষের স্রোতে মিশে যাওয়ার আনন্দ ছেড়ে দৈনন্দিন "অভ্যাস' কে এখনো প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে এই নানারঙা মানুষের মেলায় এসেও! পাটাতনের এক আধভাঙ্গা চৌকিতে চোখের ওপরে রাতজাগা হলুদ বাল্বের আলো নিয়ে ছিটকিনিহীন দরজার ঘরে শুয়ে পড়লাম আমি; অনেক রাত অব্দি ওদের দুই ভাই-এর গল্পো কানে আসছিলো আর মাঝে মাঝে উড়ে আসছিলো অবাক অবাক সব প্রশ্ন "আপনি চাদর আনেননি!! শোবেন কি করে!!' "সকালে নদীর ধারে "সারতে' যেতে পারবেন তো'!! "ওমা জুতো পরে শুলেন যে বড় !! খুলে শোবেন না!!'। ...দেঁতো হাসিতে পাশ কাটাতে হচ্ছিলো এসব অ-দরকারী প্রশ্নের; ফাউ হিসেবে পাচ্ছিলাম সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধ। বাইরে তখনও আনন্দমেলা। মানুষের ভিড়ের কলকল শব্দ। অস্থায়ী আখড়ায় আখড়ায় তীব্র নাম সংকীর্তনের ভক্তিরস। নানা ছাউনিতে ঘুমিয়ে থাকা মকর স্নানের অপেক্ষায় থাকা মানুষ। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়ালই নেই! স্বপ্নে দেখি, বিশাল বড় এক মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছি। জিলিপি, পাঁপড়ভাজার দোকানের পাশেই ঝাঁ চকচকে মাদার ডেয়ারীর দুধের কাউন্টার! সিমেন্টের ধাপিতে বসে আছে আমার এক বন্ধু। আমি গিয়ে তার হাত ধরলাম, বসলাম তার পাশে। আমরা দুজনে দেখছিলাম তাকিয়ে তাকিয়ে মেলার চারিদিক। এক জায়গায় চোখ স্থির হয়ে গেলো বেশী ভিড় দেখে; একটা মাংসের দোকানে একটা লোককে পিছমোড়া করে বেঁধে বেদম মারছে একটা লোক। গা কেটে যাচ্ছে মারের চোটে , রক্ত পড়ছে দরদর করে। আমার বন্ধু বললো "এটাই নিয়ম এখানকার'! খুব রাগ হয়ে গেল; চিৎকার করতে গিয়েও পারছিলাম না; ঘেমে উঠছিলাম; ধড়মড় করে উঠে বসলাম চৌকিতে।দেখি পাশের চৌকিতে ফুক ফুক করে বিড়ি ফুঁকছে পাঁচকড়ি মন্ডল। "কী ব্যাপার, কিছু খারাপ স্বপ্ন নাকি?' আমি উত্তর না দিয়ে হাসলাম; বেরিয়ে গেলাম ঘর থেকে; রাত তখন সাড়ে তিনটে। অবাক হচ্ছিলাম এই ভেবে স্বপ্ন কি অদ্ভুত একটা ভাব যেখানে সদ্য বা বিগত ভাবনারা কত সহজে একে অপরের সাথে মিশে তৈরি করে জটিল চিত্রনাট্য!



    হাঁটতে লাগলাম অজয় নদীর দিকে। ভিড় এখন পথ ধরেছে অজয় নদীর দিকে। বালি ঢাকা অজয়ের তীরে যখন হাজির হলাম দেখলাম মকরস্নান শুরু হয়ে গেছে। পিল পিল করে লোকজন জামাকাপড় ছেড়ে নেমে পড়ছে নদীতে; বিশ্বাস যাই হোক বড় অদ্ভুত সেই দৃশ্য। কত দূর দূর থেকে লোকজন পুণ্য করার লোভে আসে এই তীর্থে। কাল রাতে কিছুক্ষণ বসেছিলাম মোটা-গাছের-গুঁড়ি-আগুনে-পুড়িয়ে-ধোঁয়া-ওঠা এক তাঁবুতে; লাল কৌপিন পরা এক সাধুর চারপাশে কলকে হাতে গাঁজা ফোকার দল নেশায় বুঁদ। আমি দেখছিলাম এই সাধুকে...বড় দামী কথা বলছিলেন হরিদ্বারবাসী এই জটাজুটধারী সাধু। চাররকমের ভক্তেরা ছড়িয়ে আছে মানুষের মধ্যে। "আর্ত' ভক্ত ঈশ্বরকে প্রার্থনা করে নিজের অসুস্থ শরীরকে সুস্থ করতে! "অর্থ' লোভী ভক্ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে "অর্থ'; "জি"¡সু' ভক্ত প্রশ্ন করে তার আত্মাকে ...তার স্বরূপ জানার জন্য; আর ""¡নী' ভক্ত , জেনে ফেলেছে অনেকটাই নিজের স্বরূপ, তাও নিজেকে তৈরি করে চলেছে নিজের "আত্মার' সাথে মিশে যাবার জন্য! যাকে বাউলেরা বলে "মনের মানুষ' খুঁজে পাওয়া। নদীর ধারে জ্বলছিলো কাঠ আর খড়পোড়া আগুন আর চারধারে গোল হয়ে বসে থাকা নানা মানুষ। সেরকম এক আগুনের জটলায় হাত সেঁকতে সেঁকতে ভাবছিলাম এতো এতো পুণ্য সঞ্চয়ের ইচ্ছাধারী মানুষেরা কে কোন "ভক্ত' তবে? কিইবা চলছে মানুষগুলোর মনে এখন?


    ভোররাত্তিরে মকরস্নান...



    আস্তে আস্তে আকাশ কালো থেকে আকাশী হচ্ছে; কুয়াশার ধোঁয়ায় সামনের মানুষটাকেও হাতড়াতে হচ্ছে। এবার ফেরার পালা বোলপুরে। হোটেলে মালপত্র রেখে এসেছি। ওখানে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে আবার চলে আসবো বিকেলের দিকে। কালকে নানা আখড়ায় ঘুরে তেমন বাউল গান শুনিনি। এদিক ওদিক কিছু বাউল শিল্পীর গান কানে থেকে গেলেও প্রখ্যাত বাউল শিল্পীরা আসর জমান আজ থেকেই; আমায় একথা বললো নদীতীরের আগুনের জটলায় হাত স্যঁ¡কা খাঁকি পোষাকি পুরুষ ও মহিলা পুলিশের দল। অজয়ের পার থেকে লাল মাটির রাস্তা বেয়ে সাতসলাকের ভিড় ঠেলে এগোলাম বাসষ্ট্যান্ডের দিকে, হাঁটতে হাঁটতে। মনে গুনগুন করছিলো কানে লেগে থাকা কিছু কথা আর তাদের সুর...


    মন যদি হয় নড়বড়ে কি ধন পাবা গেলে সেই পাড়ে

    হাড় গরল হও রে সরল বেড়াস না আর দৌড় পাড়ে

    কাছে আছে ধন চেনো না রে মন

    গয়া গঙ্গা তীর্থ কাশী কেমন মনের ভ্রম।

    এদেশ ওদেশ করো উদ্দেশ কি পাবে মানুষ ছেড়ে...

    ।।২।।



    পরদিন আবার ঠিক বিকেল বেলা এসে পৌঁছুলাম কেন্দুলির জয়দেব মেলায়। আরো ভিড় বেড়ে গেছে। অনেক বেড়ে গেছে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি বাসষ্ট্যান্ডের এদিকে ওদিকে কাপড়ের দেওয়াল টাঙিয়ে অনেকেই খেতে বসে গেছেন শালপাতার থালিতে। লোকে লোকারন্য অজয় নদীর ধার। নদী পারে উঠে দেখি অনেক দল পিকনিক করতে এসেছে। এ যেন মানুষের মেলা বসে গেছে চারিদিকে। ধাক্কা খেলাম সারা শরীরে লোহার তীর বেঁধানো এক খালি গায়ের যুবককে দেখে। ওকে পয়সা দিয়ে এগোলাম ভিড় ঠেলে। আশে পাশে নানা অস্থায়ী আশ্রম আর দোকানপাট পেরিয়ে হাজির হলাম বীরভূম জেলা সংস্কৃতি দপ্তরের বাউল ম®'। মঞ্চে তখন জেলার সরকারী প্রশাসকদের মাঝে এক বাউল। একদল শিল্পী লোকগীত পরিবেশন করছেন। কিছুক্ষণ দেখে হাঁটতে লাগলাম "মনের মানুষ' আখড়ার দিকে। এই নামে সুনীল গাঙ্‌গুলীর এক উপন্যাসের আধারে তৈরি হওয়া এক সিনেমা "মনের মানুষ' –এর প্রশংসা মুখে মুখে ফিরছে। এই শব্দ যুগল "মনের মানুষ' হলো বাউলের আর্তি থেকে মুক্তির সোপান, এক গুরুমুখী সাধনা। এই বাউলদের সাধনা তো দেহাত্মবাদী সাধনা। জীবন যেখানে মিলিত হতে চায় জীবনের সঙ্গে,একটি শরীর যেমন প্রাকৃতিক নিয়মেই কামনা করে আরেকটি শরীরকে, তার মধ্যে দিয়েই শুরু হয় বাউলদের সাধনা। দেহকে কেন্দ্র করে তাদের যোগ সাধনাদির যাবতীয় প্রক্রিয়া।নিজের এই দেহের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আরেক মানুষ যে প্রেমময়, কল্যানময়, আনন্দস্বরুপ। সেই মানুষই বাউলদের "মনের মানুষ'। বাইরের কোনো মানুষ নয়। নিজের ভেতরের সেই "অচিন পাখি'র খোঁজে বাউল গান বাঁধে, নাচে,সাধনা করে।


    ক্ষ্যাপারে দেহ জানলে তবে জানবি বস্তুধন

    আগে জেনে আয় আমার মন

    মিছে করো রে কেন ভ্রমণ

    এই ভব মাঝে বারে বারে করো যে ভ্রমণ

    এই ভব মাঝে বারে বারে করো রে ভ্রমণ

    আগে জেনে আয় আমার মন

    ওরে দেহ জানলে পরে জানবি বস্তুধন।



    এসে পৌঁছলাম "মনের মানুষ' আখড়ায়। সাধন দাস বৈরাগীর এই "মনের মানুষ' আখড়া দেশ বিদেশে ভীষন সমাদৃত, বেশ কয়েক বছর ধরেই। অস্থায়ী প্যান্ডেলে লাগোয়া খড়ের চাল ছাওয়া মাটির বাড়ীগুলো একে অপরের হাত ধরে আছে। দেওয়ালে নানা আল্পনা কাটা। গাছগাছালির ভিড় আশেপাশে। প্রচুর বিদেশী ও বিদেশিনীরদের ভিড়ও আশেপাশে। আর এদিক ওদিক সবদিকেই নানা বাংলা চ্যানেলের সাংবাদিকেরা "বাইট' নেওয়ার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেখলাম কবি সুবোধ সরকারও হাজির সেখানে। অনেক ছোট ছোট খড়ের অস্থায়ী ছাউনি আখড়ার মধ্যে এদিক ওদিক। নাম্বার লাগানো। শুনলাম এই ঘরগুলোতে মেলা উপলক্ষ্যে আগত অতিথিরা থাকছেন। বেশীর ভাগই নানা চ্যানেলের সাংবাদিক, বিদেশী অতিথিরা আর আখড়ার পূর্ব পরিচিতরা। আখড়ার একটা কুটিরের বারান্দায় শালপাতায় খাওয়াদাওয়া করছিলেন সাদা দাড়ির রবিঠাকুরের মতো অনেকটা দেখতে সাধন দাস বাউল। এই আখড়ার হোতা। পাশে আখড়াবাসিনী তিন জাপানী মহিলা। শুনলাম ওরাও কারো না কারো সাধনসঙ্গিনী। সুদুর জাপান থেকে এসে এদেশের গুরুমুখী এই গুপ্ত সাধনায় তারা আগ্রহ পেয়ে রয়ে গেছেন আখড়ায়। এই সাধন দাস বাউল মানে সাধন ক্ষ্যাপা যখন যুবক তখন জাপানে গিয়ে বাউল শুনিয়ে আসার আমন্ত্রণ পান। জাপানে প্রবাসী বাঙালীদের ভিড়ে মিশেছিলো অনেক জাপানী মানুষও। এক সদ্যযুবতী নারী মেতে ওঠেন সুরের নেশায়, সাধন ক্ষ্যাপার কন্ঠের গভীরতায়। সাধন ক্ষ্যাপা বাংলায় ফিরে এলেও সেই জাপানী যুবতী মাকি-কাজুমী ভুলতে পারেনি ভারতীয় এই বাউলকে। একদিন দেশ ছেড়ে, প্রিয়জনদের ছেড়ে হাজির হন এই বাংলায়, সাধন ক্ষ্যাপার খোঁজে। শুরু হয় নতুন জীবন। বিবাহিত সাধন ক্ষ্যাপার সাধন সঙ্গিনী হয়ে যান মাকি-কাজুমী। সেদিনের সেই যুবতী আজ মনের মানুষ আখড়ার গুরু মা। কুটিরের বারান্দায় সাধন ক্ষ্যাপার ঠিক পাশে যে জাপানী স্নিগ্ধ চেহারার মহিলা বসে খেয়ে চলেছেন , তার চুলে আজ সামান্য পাক ধরেছে। "মনের মানুষ' পেয়েছেন কি? জিজ্ঞেস করা হয়নি ওনাকে।


    "মনের মানুষ' আখড়ায় সাধন দাস বাউল ও মাকি-কাজুমী (পাশাপাশি) ...


    আলাপ হলো স্বর্ণাভ'র সাথে। ওর সাথে ওর রুমানিয়ার এক বান্ধবী। স্বর্ণাভ একটি মার্কেটিং ফার্মে কনসাল্টেন্সী করে আর ঘুরে ঘুরে বেড়ায়... ওর ভাষায় "নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছি'। আলাপ হলো মাইকেলের সাথে। স্পেনের এই যুবক একজন প্রফেশনাল সিঙ্গার। বাউল গানের সুরে মজেছেন। ভারতে আসেন বাউল গানে ডুব দিতে। একটি বাংলা চ্যানেলের আয়োজনে বসে গেলো একটি বাউল ফিউশনের আসর। এক বাউল ধরলেন সুর একতারায় টান দিয়ে আর সাথে গীটারে মাইকেল; স্বর্নাভের রুমানিয়ান বান্ধবীর হাতে তাল দিচ্ছে ঝুমঝুমি। জমে গেল আসর। মাইকেল গান করলো ... কাϾট্র বিটস এ। সঙ্গে একতারা বাজালো গেরুয়া আলখাল্লার বাউল। এ যেন চাঁদের হাট। সুবোধদা পুরো অনুষ্ঠানটা পরিচালনা করলেন। সন্ধ্যে নেমে এসেছে তখন। চললাম প্যান্ডেলের দিকে। বসবে বাউলের আসর। সারারাত ধরে। বুঁদ হয়ে শুনবো, বাউলের সুরে ডুব দেবো বাউল সাগরে, আজ রাত্তিরে।


    বাউলের একতারার সুরে , মাইকের গীটারের তালে...পাশে স্বর্ণাভ খঞ্জনী হাতে...


    পাগল মন রে মন কেন এত কথা বলে

    সে যেন কোথায় রয়েছে কতদূরে

    মন রে মন কেন এত কথা বলে।

    আমি বা কে

    আমার মনটাই বা কে

    আজো পারলাম না আমার মনকে বুঝাইতে...


    বাউল মঞ্চে বসে আছেন বাউলেরা । শুরু হবে গানের আসর। বিখ্যাত অখ্যাত বাউলেরা ঠিক এই মেলার আকর্ষনে হাজির হন কেন্দুলি গ্রামে জয়দেবের মেলায়। দক্ষিণ বীরভূমের বৈষ্ণব কবি জয়দেব গোস্বামী তাঁর রচিত শ্রী শ্রী গীত গোবিন্দম কাব্যে বর্ণনা করেছেন "মারাঙ্ক' নামক বিপরীত রতিক্রিয়ার লীলাকাহিনী। তাইতো তিনি সমগ্র বাউল সমাজের আদি গুরু। তাঁর সন্মানেই তো মকর সংক্রান্তিতে বাউল সমাজের আনন্দমেলা। আমার ঠিক সামনের বাঁশঘেরা জায়গায় সাংবাদিকেরা ক্যামেরা উঁচিয়ে বসে আছে। বাইরে রাখা ওবি ভ্যানের মাধ্যমে মানুষের ঘরে ঘরে এই বাউল মেলার আনন্দ ছড়িয়ে দিতে। আলাপ হলো শ্রীকান্ত পন্ডিত এর সাথে। ও এক বাউল শিল্পী। মাটির ওপরে খড় আর পলিথিনের চাদর বেছানো দর্শকাসনে আমার ঠিক পাশে বসে। হুগলীর আরামবাগের মানিকপাট গ্রাম থেকে এসেছে বছর ত্রিশের ছেলেটা, স্ত্রী-পুত্র-ভাইকে নিয়ে মেলা দেখতে। ও দিনে চাষবাস করে আর রাতে বাউল গান চর্চা করে। ওর দলের সাথে রিহার্সাল করে হপ্তায় একবার। আমার ঠিক সামনে বসে দুই মহিলা যাদের একজন বছর পাঁচেক ধরে বাউল শুনতে আসেন, পরিচয় হলো ওনার সঙ্গে। আর পরিচয় হলো অশোকবাবুর সাথে। অনেকদিন বাউলদের সাহচর্যে ছিলেন। এখন সংসার করতে গিয়ে আর বেশী সময় দিতে পারেন না। তবে এই মেলা নেশার মতো,প্রতি বছর চলে আসেন বাউল গান শোনার টানে। ওদের কাছেই শুনছিলাম এই সময়ের বিখ্যাত বাউলেরা হলেন দয়াল ক্ষ্যাপা, কার্তিক দাস বাউল, ভজন ক্ষ্যাপা, পবন দাস বাউল, স্বপন দাস বাউল, নিতাই দাস বাউল। এদের মধ্যে ওরাই চিনিয়ে দিলো মঞ্চে বসে থাকা বাউল শিল্পীদের সাথে। পবন দাস বাউল তখনো অবধি পৌঁছন নি। আর দেখলাম সহজ-মা আর তার ক্ষ্যাপা উৎপলদাকে। মঞ্চ আলো করে আছে "মনের মানুষ' আখড়ার গুরু সাধন দাস বাউল আর তাঁর সাধন-সঙ্গিনী গুরুমা মাকি-কাজুমী। আছে আরো দুই জাপানী মহিলা। আছে সাধন ক্ষ্যাপার গুরু পঁচাত্তরি যুবক অনন্ত দাস বাউল। আরো অনেক শিল্পী। শুনছিলাম, এই সময়ে দাঁড়িয়ে আখড়ায় সাধন ভজন চর্চায় দিন কাটানো বাউলের সংখ্যা ভীষন কম। বেশীর ভাগই বাউল শিল্পী। বাউল গান শিখে সুরের মায়ায় দর্শককে আবিষ্ট রাখে। নিজের নিজের সংসার আছে বেশীর ভাগেরই। নিজের নিজের পেশাও আছে নিজের মতো করে। শুনলাম ,কেন্দুলীর বাউল মেলায় "মনের মানুষ' আখড়ার এত কদর কারণ এই আখড়ায় এক্কেবারে নিয়ম মানে বাউল গান গাওয়া হয়ে থাকে। দর্শককে আনন্দ দানের জন্য আজকালকার অনেকের মতো সস্তা চটুল কথা বা সুরকে বাউল সঙ্গীতের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয় নি। প্রকৃত বাউলভক্তরা ঠিক হাজির হয়ে যায় এখানে, প্রতি বছর। এছাড়া ধ্র¦পদী বাউল গানের মনোগ্রাহী আসর বসে "মনোহর বাবার আশ্রম' আর "হালাকাঁপা বাবার আশ্রমেও'। ঠিক করলাম অনেকটা রাত "মনের মানুষে'ই কাটাবো কারণ নামী দামী সব বাউল শিল্পীই এখানে আছেন। আসরে শুরু হলো বাউল গানের বন্যা। বর্ধমানের মুক্তিপুরের আখড়া থেকে আসা মতিবিবির আগ্রাসী গলায় যেন আগুন ঝরছে বাউলের তত্ত্বে। সামনে মাইক্রোফোন হাতে নাচছেন এক বিদেশিনী। আমার সামনের মহিলা বললেন এই জার্মান মহিলা বাউলে পাগল। আঠারো বছর পরে এলেন আবার এদেশে। ভালো বাংলা বোঝেন ও বলেন। মঞ্চে অনন্তদাস বাউলের একতারা যখন বাউলের সুরে থামতে চাইছিলোনা, বৃদ্ধ বাউল রতন ক্ষ্যাপার গলায় মিষ্টি রসের ফোয়ারা ঝরে পড়লো...


    খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়

    তারে ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতাম তাহার পায়...



    সারা প্যান্ডেল স্তব্ধ , বাউলে মন্ত্রের ছোঁয়ায়। এরপর এলেন চাঁদবিবি, শাড়ীর ওপরে মাথায় কালো ওড়না। নিজেও নাচলেন খুব আর দর্শক নাচালেনও খুব। হুগলীর শেষ প্রান্তে মেদিনীপুর ছোঁয়া মাটির বিখ্যাত তবলিয়া কৃষ্ণসুদাম মান্নার যোগ্য শিষ্য তবলচি সুকুমার বাবুর হাতে বাঁয়া-তবলা যেন কথা বলছিলো কলবলিয়ে। যুবক দয়াল ক্ষ্যাপার গানে তো রীতিমত আধুনিকতা। ইংরেজী শব্দেরা খেলা করছে দার্শনিকতার গভীর ভাবনাগুলোকে নিয়ে সহজ সহজ শব্দকে আশ্রয় করে। তাই দেখে তাল দিয়ে দিয়ে ভাব জানাচ্ছেন এই আসরের সবচেয়ে বয়স্ক বাউল একশ পনের বছরের দয়াল বাবা। স্বপন বাউল এসে আনন্দলহরীর সঙ্গে তবলার যুগলবন্দীতে শ্রোতাদের এনে দিলো ভাবসমুদ্রে। সাধন ক্ষ্যাপা দেখলাম আনন্দে নাচছেন মঞ্চে। স্বপন দাস বাউল ভালো ভালো গানও শোনালেন। নিতাই দাস বাউলের গানে খুঁজে পেলাম এক শিক্ষগুরুর পরিবেশন। বাউল দেহতত্ত্ব, আত্মতত্ত্বের নানা গান গাইলেন রসিয়ে রসিয়ে ব্যাখ্যা করে করে। এলেন কার্তিক দাস বাউল । তবলা শিল্পী তন্ময় বোসের তালতন্ত্রের নানা অনুষ্ঠানে কার্তিক ক্ষ্যাপাকে দেখা যায় বাউল গাইতে। তৈরি গলা এক্কেবারে। মঞ্চ কেঁপে গেলো সাধন ক্ষ্যাপার যোগ্য শিষ্যা সহজ-মায়ের রেওয়াজী বাউল গানে। সঙ্গে উৎপল দিলো ক্ষ্যাপামির সুর। পবন ক্ষ্যাপার জন্য অপেক্ষা করছিলাম।


    বাউল মঞ্চে এখন সহজ-মা ...


    অনেক শুনেছি পবন দাস বাউলের নাম। চাক্ষুস দেখলাম প্রথম। দরবেশ বেশে একমাথা সাদা চুলের পবন দাস বাউল যখন গান ধরলেন , মনে হলো চারিদিকে বৃষ্টি পড়ছে! এতো শান্ত, ধীর প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ছে এই রাত পেরোনো ভোরে। নেই উচ্চকিত তবলার ঠেকা, নেই নেচে ওঠার উদ্দামতা , আছে শুধু সুর, ভাবনা আর মন কেমন করা বিষন্নতা।


    গুরু তোরে কি ধন দিলো

    চিনলি না মনা

    রাং দিলো কি সোনা দিলো

    পরখ করে দেখলিনা...।


    পবন দাস বাউল...



    বেরিয়ে এলাম প্যান্ডেল থেকে; ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে তিনটে। বিখ্যাত বাউলদের গানের পালা শেষ। এবারে অন্যান্য বাউলেরা গাইবেন। অশোকবাবু আর আমি হাঁটতে লাগলাম মেলার মাঠ বরাবর। গেলাম হালাকাঁপা বাবার আশ্রমে। ঠিক পাশেই অজয় নদী। মানুষের ভিড়ে ভরা মেলাঙ্গন। ওখান থেকে হাঁটতে লাগলাম বাসষ্ট্যান্ডের দিকে। ঘড়ির কাঁটা বলছে ভোর সাড়ে চারটে। বোলপুরের বাস ছাড়বার সময় হল। আজ ফেরার পালা কলকাতায়। আবার শান্তিনিকেতন এক্সপ্রেস। আবার কাল থেকে মিশে যাবো কলকাতার জনারণ্যে... একা একা। কেবল গুনগুন করবে গানের কিছু কলি...


    আমি কোথায় পাব তারে

    আমার মনের মানুষ যেরে।

    হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশ্যে

    দেশ বিদেশে বেড়াই ঘুরে

    আমি কোথায় পাব তারে

    আমার মনের মানুষ যেরে...


    -সমাপ্ত-


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ | ১১৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে প্রতিক্রিয়া দিন