এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • কোরপান এর হত্যা ঃ মূল্যবোধের চেনা ছক ভেঙ্গে কিছু অচেনা প্রশ্ন

    pi
    অন্যান্য | ২০ নভেম্বর ২০১৪ | ৭৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • pi | 24.139.221.129 | ২০ নভেম্বর ২০১৪ ২১:৫৮652080
  • রাতুলের এই লেখাটা রইলো।

    'কোরপান এর হত্যা : মূল্যবোধের চেনা ছক ভেঙ্গে কিছু অচেনা প্রশ্ন

    কোরপান শাহ থমকে দিয়েছে আমাকে, আমাদের... খুন অথবা গণপিটুনিতে মৃত্যু মাঝেমাঝেই ঘটে, তবু এন আর এস - কোরপান কোথাও যেন অনেকটা আলাদা, অনেক বেশি ধাক্কা দিয়েছে আমাদের ‘মধ্যবিত্ত’ মননে... কারণ টাও অবশ্য খুব স্বাভাবিক, এখানে ‘সংগঠিত হত্যাকারীরা’ আমাদের শ্রেণী তথা বর্গের অন্তর্গত... ‘আমি’ মুর্শিদাবাদের কোন এক অজ গ্রামের গণপিটুনিতে চিন্তিত কম হই, কারণ ‘আমি’ ‘ওদের’ সাথে নিজেকে জুড়তে বা জড়াতে সচ্ছন্দ নই হয়তো ... আর দ্বিতীয়ত এখানে হত্যাকারীরা ছাত্র বিশেষত ডাক্তারি ছাত্র, যাদের থেকে আমাদের ‘মানবিকতা মূল্যবোধের’ আশা একটু বেশিই...
    এহেন নারকীয় গণহত্যার ঘটনার নানা জটিল মনস্তাত্বিক ব্যাখা হাজির করছেন মনবিদ ডাক্তার বাবুরা... ‘mob psychology’, ‘shared interest’ সব জটিল জটিল ব্যাপার স্যাপার...। হয়ত ঠিকও, কিন্তু এটা কোরপান না হয়ে ওই মুহূর্তে ধরা পড়া কোনো ‘বেশভূষা’ সম্পন্ন যুবক হলে কি হত? আমি নিশ্চিন্ত তখন ওই shared interest বা মব psychology এক ভাবে কাজ করত না... এখানেই শ্রেণী বা বর্গ সম্পর্ক জড়িয়ে থাকে এই সব mob expression এ ... আর শুধু রাষ্ট্র বা পার্টি নয়, তথাকথিত ‘জনগন’ও কখনও সখনও regimented হয়ে আগ্রাসী অবদমনকারি ক্ষমতার (power) ‘mob’ হয়ে ওঠে নির্দিষ্ট ঘটনার প্রেক্ষিতে, এই ধরনের ক্ষমতার প্রতিটা অবদমনে লুকিয়ে থাকে শ্রেণী, জাতপাত, বর্গ বা লিঙ্গের প্রশ্ন...
    এই ঘটনার পরে অনেকেই মূল্যবোধ মানবিকতা এসবের অধঃপতনে নিয়ে খুবই চিন্তিত দেখছি। ‘মূল্যবোধ’ জিনিসটা কোন সয়ম্ভু বস্তু নয়, বিহারের গ্রামে নিচু জাতের মেয়েকে সংগঠিত ভাবে ধর্ষণ করাটা এই একবিংশ শতকেও উঁচু জাতের মূল্যবোধে রয়েছে, তার পাল্টা মূল্যবোধ তৈরি হয়েছে দলিত সংগ্রামের মধ্যে দিয়েই, অযাচিত ভাবে বিয়ে করলে অনার কিলিংটা খাপের মূল্যবোধে আছে, যেমন আছে বিভিন্ন গোষ্ঠীর moral policing, ওগুলোকে আটকাতে গেলে সংগ্রাম লাগে। ঠিক একই ভাবে কোরপানদের অধিকারও কোন স্বয়ম্ভু ‘মানবিক মূল্যবোধ’ দিয়ে রক্ষিত হবে না, ওর জন্যও সংগ্রামই লাগবে…. ভুল হলে রিকশাওয়ালাকে চড় মারা বা ‘কাজের মেয়েকে’কে শাস্তি দেওয়া ‘আমাদের’ জন্মগত অধিকার, ওটুকু তো করতেই হয় system চালানোর জন্য... আমি আমার সাপ্তাহিক ছুটি নিয়ে খুব চিন্তিত, কিন্তু ড্রাইভার বা কাজের লোকের ছুটির দাবি অস্বাভাবিক ঠেকে আমাদের দৈনন্দিনতায় ... সংগ্রাম লাগবে এই মূল্যবোধটার বিরুদ্ধে, তীব্র সংগ্রাম, শুধু (আনন্দ)বাজারীয় সচেতনতা দিয়ে ঘুচবে না এটা কখনও ...।
    ঘটনাটার পড়ে অনেক ফোন ও এস এম এস পেয়েছি। সবাই খুব চিন্তিত ডাক্তাররা এত ‘অমানবিক’ কিকরে হয়... ২৪ ঘণ্টার অনুষ্ঠান সঞ্চালিকা খুব চিন্তিত ভাবে প্রশ্ন করলেন ‘এর ফলে ডাক্তারির মতন মহান পেশাটা কলুষিত হল না...’ মহান পেশা ঠিক কাকে বলে বলুন তো? অতীতে এই পেশায় যে দায়বদ্ধতা জড়িয়ে ছিলো, সেটা নির্দিষ্ট সামাজিক সম্পর্কের কারণেই ছিলো, সেই সম্পর্ক কেই আপনারা ‘মহান’ বলেছেন। আগে একজন ব্যাক্তি ডাক্তার অনেকটাই তার উদ্যম উদ্যোগ এর উপর ভিত্তি করে পেশাটা চালাতে পারতেন। ওষুধ থেকে পরীক্ষা নিরীক্ষা সবেতেই তার নির্ধারক ভূমিকা ছিলো অনেকটাই বেশী। আর বাকিটা চলতো সরকারী হাসপাতালের উদ্যোগে। মানুষ নির্ভর ছিলো ব্যাক্তি ডাক্তারের উপর, বিনিময়ে অনেকটা সম্মান পেতেন তারা। কিন্তু বর্তমান চিকিতসা ব্যাবস্থায় ব্যাক্তি ডাক্তারের এই নির্ধারণের ক্ষমতা কমেছে বহুগুনে তাই ‘মানবিকতা মহানতা’ আজ এই পেশায় খুব superficial একটা construct, কিছুটা ব্যাক্তিগত সত্যাগ্রহের মত ... ডাক্তারের কাছে গেলে সে যে টেস্ট করতে দেবে, যে ওষুধ লিখবে যেখানে ভরতি হতে বলবে অপারেশান করাতে বলবে সেই means গুলো পুঁজির নিয়মে চলে, চলে profit maximization এর লজিক এ, সেখানে ব্যাক্তি ডাক্তারের সত্যাগ্রহ গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু খুবই নগন্য... আর আজকের যুগে অন্য কোন ‘পেশা’ যখন সত্যাগ্রহে নামেনি তাহলে এই সব ডাক্তাররাই বা নামবে কেন একা একা, কোন বিকল্প স্বাস্থ্য আন্দোলন ছাড়া, আপনাদের ভাষায় ‘মহানতা’ থুড়ি পুরানো সম্পর্কটা রাখার তাগিদটা কোত্থেকে আসবে... সেই কবে দাড়িওয়ালা বুড়ো communist manifesto তে লিখেছিল ‘It has resolved personal worth into exchange value, and in place of the numberless indefeasible chartered freedoms, has set up that single, unconscionable freedom — Free Trade.... The bourgeoisie has stripped of its halo every occupation hitherto honoured and looked up to with reverent awe. It has converted the physician, the lawyer, the priest, the poet, the man of science, into its paid wage labourers.’ বিগত দেড় দশকে আমাদের দেশে ডাক্তারি পেশার দ্রুত রুপ বদল দেখলে বুড়োর observation কে কুর্নিশ জানাতেই হয়, কী বলেন ... বর্তমান ভারতীয় সামাজিকঅর্থনৈতিক পরিসরের যেভাবে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে প্রতিদিন, তাতে এই ব্যাবস্থায় সমস্ত পেশার শেষত end একটাই, নিছক আর্থিক সম্পর্ক। যখন professional success টা corporate capital এর লজিক এ মিলেমিশে যায় তখন কে মহান আর কে শয়তান... স্বাস্থ্য ব্যবস্থা টাকে corporate capital অবাধ চলাচলের জন্য health – industry তে পরিণত করবেন আর তাতে থাকা ডাক্তারদের ‘মানবিকতা’ নামক ডুমুরের ফুল চলে গেলো বলে নাঁকি কান্না কাঁদবেন, এই ভাবের ঘরে চুরি আর কতদিন!!! যদি ঐ ‘মানবিকতা’ও বাচাতে চান তবে রাস্তায় নামুন স্বাস্স্থ্য ক্ষেত্রের corporatization এর বিরুদ্ধে....

    প্রথমে বেশ অবাক লাগছিলো কিছু ছেলে নয় মারছিলো, কিন্তু এত বড় হোস্টেল এত ছাত্র সেখানে তারা সব কোথায় গেলো? মারার পর ও কেউ গেলো না কোরপান কে দেখতে?? অথবা ঐ ঘটনার পরও হোস্টেল এর সবার সব যেন ঠিক চলছে। কী অদ্ভুত নৈ:শব্দ, কী অদ্ভুত ignorence.... মনে পড়ছিলো নিজের ডাক্তারি শিক্ষার সাড়ে ছয় বছরের অভিজ্ঞতা। ‘শরীর শরীর তোর মন কোথায়’ – বইয়ের পাতায়, ক্লিনিকস এর ক্লাসে হাতড়ে বেড়িয়েছি সেই মন, মানুষ তো এখানে শুধুই শরীর, জটিল anatomy, physiology, pathology এর নির্মান। হাজার হাজার মেডিকেল বইয়ের পাতায়, হাজার ঘন্টা ক্লাসের কতটুকু ব্যয় করি আমরা ‘মানুষ’ জীবটার সুখ, দুঃখ, সমাজ সমস্যা নিয়ে, মানুষ প্রায় একটা মেশিন আমাদের কাছে দেকার্তে যেমন বলেছিলো, আর আমরা তার খুঁত মেরামত করি। ওয়ার্ডে গিয়ে প্রতিটা আর্তনাদ কে আমরা ignore করতে শিখি,কারণ ঐ আর্তনাদ দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেই সরকারী হাসপাতালে। আমার ব্যক্তিগত সংবেদনশীলতা ওখানে টিকে থাকার জন্য একটি নেতিবাচক অভিযোজন, কারণ শুধু ওটা দিয়ে মিটবে না কোনো আর্তনাদ, শুধু শুধু আর্তনাদ বাড়বে আমার মনেও। নতুন ইন্টার্নরা যখন জরুরী বিভাগে যায় তখন তাদের ট্রেনিং নিতে হয় ‘ব্যাটিং’ শেখার। ‘ব্যাটিং’ মানে আগত রুগীকে ছলে বলে কৌশলে শান্তি বজায় রেখে ভর্তি না নিয়ে বিদায় জানানো। ভর্তির জন্য বেড খালি ৬ টা আর ভর্তির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে রুগী আসবে ৬০ টা, এরকম ক্ষেত্রে একটা মানসিকতাই তোমাকে বাচাঁতে পারে, ignorance... অভিরামপুর গ্রাম থেকে ১০০ টাকা দিয়ে ভ্যানে তারকেশ্বর রুরাল হাসপাতাল, সেখান থেকে refer হয়ে চুঁচুড়া ইমামবাড়া, সেখানেও সামলানো গেলো না তাই refer মেডিকেল বা এন আর এস বা অন্য apex হসপিটাল, অজস্র টাকা সময় ব্যয় করে ভর্তি প্রত্যাশী রোগীর আত্মীয় যখন মেডিকেল কলেজ গুলোয় পৌছয় তখন তাদের উত্কন্ঠা ভরা চোখ গুলোর সামনে ‘regreat, no bed vacant’ লিখতে ‘অমানবিকতা’ নিয়ে groomed হতে হয়েছিল, নিজেকে অভিযোজিত হতে হয়েছিল ignorance এর defence এ। আমাদের ডাক্তারি শিক্ষার পাঠক্রম আমাদের অনেক জ্ঞানের সাথে নিঃশব্দে ঐ ignorance ঐ অমানবিকতার ট্রেনিং টাও দেয়, আর এই ignorance consent দেয় violence কে ... তাই বোধহয় কোরপান এন আর এস এর ছাত্র গুলোর জীবনে আর একটা ‘স্বাভাবিক’ ignored কেস....স্বাস্থ্য ক্ষেত্রের ignorance এর এই স্বাভাবিকত্বটাকে ভাঙ্গতে হবে, আর ওটাকে ভাঙ্গতে গেলে লাগবে হাজার পাগলের হাজার কোরপানদের বিস্ফোরণ...
    বি.দ্র. ঘটনার পরে একটাও ছাত্র এখনও গ্রেফতার হয় নি, কিন্তু আটক হয়েছে ক্যান্টিনের দুজন কর্মচারী... হোস্টেলএর ‘ক্ষমতা কাঠামোয়’ ওরাই সবচেয়ে নীচে থাকে তো, ঘটনায় হয়তো বা যুক্ত না থাকলেও তাই ওরাই সবচেয়ে সহজ শিকার রাষ্ট্রের, আমাদেরও... Class always matters, তাই না.... '
  • pi | 24.139.221.129 | ২০ নভেম্বর ২০১৪ ২২:০৫652081
  • আজ এপিডিআর এন আর এসে প্রতিবাদ সভা করেছিল। আবারো করছে। অনেক কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে। কল উলুবেড়িয়ায় কোরপানের বাড়িতে যাওয়া হবে।
    কাল মেডিক্যাল সার্ভিস সেন্টারের সাথে যুক্ত লোকজন সি আইটি রোডে চিত্তর লেডিস পার্কে টিউবারকিলোসিস হলে সাড়ে তিনটেতে একটা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছেন।
    ২৪ তারিখ ৪ টের সময় নাগরিক সমন্বয় মঞ্চের প্রতিবাদ সভা, এ আর এসের গেটের সামনে।
    ২২ তারিখ কলেজ স্কোয়ার মিছিল, একটা থেকে।
  • pi | 192.66.29.151 | ২২ নভেম্বর ২০১৪ ০১:০৮652082
  • অনীকের লেখা।

    Anik Chakraborty

    আমরা যারা ডাক্তারি পড়ে উঠেছি বা পড়ছি এখনও তাদের একটা দায়িত্ব খুব জোরের সাথে পালন করতে হবে।তা হ'ল NRS এ ঘটে যাওয়া ঠান্ডা মাথায় খুনের বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার জানানো।ডাক্তারি পড়া প্রাথমিকভাবে এক superiority complex এর জন্ম দেয়,যা বিভিন্ন কারণে খুব দ্রুতই বদলে যায় inferiority complex এ।অন্য সমস্ত শ্রেণীর মত ডাক্তাররাও একটা শ্রেণী, তাদেরও নিজস্ব দ্বন্দ্ব ,সংগ্রাম আছে।এবং পরিলক্ষিত ভাবে শ্রেণীবিদ্বেষ আছে।পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লোকটি আমিই এবং পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভালো থাকার,সুখযাপনের অধিকার আমারই-এ ধারণা বড্ড মারাত্মক।তা মানুষকে মানুষ, পৃথিবীকে পৃথিবী জ্ঞান করার পক্ষে বড্ড বেশিরকমের অন্তরায়।এবং শ্রেণী হিসেবে সে ধারণা পোষণের অন্যতম সাংঘাতিক ফলই হল কোরপানের নিথর মৃতদেহ।
    আমি একজন ডাক্তার ও নাগরিক হিসেবে NRS এর পৈশাচিক ঘটনার তীব্র নিন্দা করছি ও দোষীদের কঠোরতম শাস্তির দাবি জানাচ্ছি।
    যে খুনিরা গা ঢাকা দিয়ে MB 'মারাচ্ছো' তারা আত্মসমর্পন এর কথাটা একবার ভেবে দেখতে পারো।তুমি ইতিহাস পাল্টে ফেলার মত কোন মানবদরদী ডাক্তারটা হবে ,সেটা সভ্যতা খুব ভালোভাবে জানে।মানুষের থুতু অর্জন করাটা আর যাই হোক,ডাক্তারদের কাজ নয়?'
  • সিকি | 131.241.127.1 | ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ১৩:২৯652084
  • কোরপানের ঘটনাটার পর থেকেই মাথায় অনেক দিনের পুরনো একটা ঘটনা ঘুরছে, মনে ভাবছিলাম, উত্তরবঙ্গে জুড়ে দেব, নাকি এখানেই লিখে দেব। তা ভাবছি, এখানেই লিখে দিই।

    জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। সালটা বোধ হয় ১৯৯৭। কলেজ সোশ্যাল ফেস্ট হচ্ছে - জেকল্যাট। সেই বছরেই প্রথম অনেক সাধ্যসাধনা করে হুই পাহাড় থেকে এলসিড্যার্জ-এর কিছু হুরীপরী নেমে এসে আমাদের ধন্য করেছেন, যেমনি তাঁদের গায়ের রং, তেমনি তাঁদের ত্বকের জেল্লা।

    এলসিড্যার্জ মানে, লোরেটো কনভেন্ট দার্জিলিং। তার সাথে অন্যান্যরা তো এসেছেই, শিলিগুড়ি ডন বস্কো, আরও কিছুমিছু কলেজ, জলপাইগুড়ি এবং কুচবিহার থেকে। সমস্ত কলেজ থেকেই ছেলেরা আসে, কেবল এলসিড্যার্জদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল প্রিন্সিপালের বাংলোটা। আমাদের কলেজে দীর্ঘদিন কোনও প্রিন্সি ছিল না, ইলেকট্রিকালের হেড ডিপ প্রিন্সির কাজ চালাতেন, তিনি থাকতেন নিজের কোয়ার্টারে।

    হস্টেলের নাইট গার্ড ছিল বিজলিদা। রাত এগারোটায় গেট বন্ধ হত দু নম্বর হস্টেলের, ভোর পাঁচটায় খুলত। তার মধ্যে কারুর আসা বা যাবার থাকলে বিজলিদাকে ডাকাডাকি করতে হত। বিজলিদা কাছেই কমন রুমে ঘুমোত। এ ছাড়া লোকটা জনটাকে ভিটামিন জি-র সাপ্লাই ইত্যাদি দেবার কাজও চলত বিজলিদার মাধ্যমেই।

    বিজলিদা কবে থেকে হস্টেলের গার্ড কেউই জানি না, মাঝবয়েসি লোক। তো, সেই ১৯৯৭ সালের সোশালে ফিরে যাই। মেয়েদের জন্য প্রিন্সিপালের বাংলো থাকলেও ছেলেদের রাতে রাখা হত আমাদের হস্টেলের কমন রুমে। সোশালের কদিন কমন রুম বন্ধ থাকত সেই কারণে।

    দু নম্বর হস্টেলের কমনরুমে শোয়া বাইরের কলেজের ছেলেদের কারুর একটা প্যান্ট থেকে পুরো মানিব্যাগটা খোয়া যায়। সোশালের শেষদিনে জানা যায়। খবরটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, ফোর্থ ইয়ারের দাদারা, যারা সোশালের দায়িত্বে থাকে, তারা চলে এল হুড়মুড়িয়ে। মেনলি সোশাল কমিটির ছেলেরা।

    কলেজ ভর্তি বাইরের ছেলেমেয়ে, স্পেশালি এলসিড্যার্জ এবার প্রথমবার এসেছে - পুরো কলেজের প্রেস্টিজে নাকি গ্যামাক্সিন হয়ে যাবে যদি এই ছেলেটির মানিব্যাগ না পাওয়া যায়। কীভাবে কীভাবে যেন জানা গেল, শেষ কমনরুমে ঢুকতে এবং বেরোতে দেখা গেছে বিজলিদা-কেই।

    সেদিন, জানুয়ারি মাস, হাড়কাঁপানো শীতে হস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে বিজলিদার পেটানো দেখেছিলাম আমরা। পেটাচ্ছে ফোর্থ ইয়ারের ছেলেরা। বল্‌ বিজলি, টাকা কোথায় নিয়েছিস - সাথে গদাম করে একটা ঘুঁষি বা থাপ্পড়। গালে, মুখে, পিঠে। বিজলিদার আলোয়ান ছিঁড়ে ফর্দাফাঁই। মাঝে মাঝে লাথি খেয়ে পড়ে যাচ্ছে পিচঢালা রাস্তার ওপরে। তাকে আবার কলার ধরে টেনে সোজা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে অন্য কেউ।

    না, মানিব্যাগ পাওয়া যায় নি। বিজলিদাকে দিয়েও স্বীকার করানো যায় নি সে আদৌ নিয়েছিল বলে। মারের মধ্যে সে খালি বিড়বিড় করে হাতজোড় করে বলছিল, কী বলব বলেন, কার নাম নিব বলেন। আমি জানি না কিসু।

    কত ঘণ্টা সেই একতরফা মার চলেছিল, জানি না। রাত দুটো আড়াইটে নাগাদ বিজলিদাকে ছাড় দেওয়া হয়।

    পরদিন সোশাল শেষ, সোশাল কমিটির তরফ থেকে বাইরের কলেজের ছেলেটিকে কিছু টাকা দেওয়া হয়, কেউই কোনও ঝামেলা আর করে নি, আগের রাতের সেই মারধোর দেখে।

    এলসিড্যার্জেরও সেই শেষবার আসা। আর আসে নি তারা, অন্তত আমরা থাকাকালীন।

    এর পর খবর পৌঁছয় সেই অ্যাক্টিং প্রিন্সির কাছে, তিনি মারধোরে নিযুক্ত ছেলেদের গার্জেন কল করার সিদ্ধান্ত নেন, এবং পরে সেসব থেকে বিরত থাকেন, কারণ তাঁকে বোঝানো হয়েছিল, কলেজে এসে বাইরের একটা ছেলের প্যান্ট থেকে পার্স চুরি, এটা কলেজের রেপুটেশনের ওপর গ্যামাক্সিন ছড়ানোর মতন কাজ। তাই আমরা উত্তেজিত হয়ে ওকে পিটিয়েছি, আমরা আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।

    সব শোধবোধ হয়ে যায় এর পর। দুদিন পরে বিজলিদা আবার হস্টেলে ফিরে আসে, মুখচোখনাকহাত বীভৎসভাবে ফোলা, কাটা সমেত। আমরা, তখন সেকেন্ড ইয়ার, কিছুদিন এড়িয়ে চলি বিজলিদাকে। তারপর সব স্বাভাবিক হয়ে যায়।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন