এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • এক গঞ্জের ইতিবৃত্ত এবং কিছুটা স্মৃতিমেদুরতা - ৮

    সুকি
    অন্যান্য | ২৯ ডিসেম্বর ২০১২ | ৬৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুকি | 212.160.16.11 | ২৯ ডিসেম্বর ২০১২ ১২:৪৭579271
  • এর আগের সাতটা পর্ব পুজো ইস্পেশাল ২০১১ - প্রথম ভাগে আছে। জানি না কেউ পড়েছিলেন কিনা। এটা তার পর থেকেঃ
    -------------------------------------------------------------------------
    তোমার মুঠোর ভেতরে একাগ্র বিষাদ (অষ্টম পর্ব)

    মহুয়ায় জমেছে আজ মৌ গো

    কোন এক অজ্ঞাত কারণ বশতঃ উপরিউক্ত গানখানি আমাদের গ্রামে বালকবেলায় খুবই জনপ্রিয় ছিল। মহুয়া ও মৌ দুজনেই তখন ক্লাশ টেন। এত দরদী থাকা সত্ত্বেও মৌ-এর মহুয়ায় জমে থাকার কারণটি আমরা তখনও ব্যখ্যা করতে পারিনি – যেমন পারিনি – “অলিরও কথা শুনে বকুল হাসে”। অবশ্য বকুল এমনিতেই খুব হাসত। যাই হোক ফ্রয়ডীয় মেকানিজম্‌ আবছাভাবে কানে আসার পর ব্যাপারটা পরিষ্কার হতে শুরু করল। সবাই যাকে বলে যৌবন জ্বালা – লেস্‌বিয়ান কেস্‌। রিলেটিভিটি ও সাম্যবাদ বাদ দিয়ে একমাত্র ফ্রয়ডীয় মেকানিজ্‌মের ব্যবহার ও অপব্যবহারই সমাজজীবনে প্রবল ছিল – পুলিসবর্গ এই থিওরীর সাহায্যে অসংখ্য ক্রাইম কেসের শিকড়ে পৌঁছতে পেরেছিল বলে দাবী।

    “এসো ফ্রাউলিন / বুকজোড়া আমাদের রাত্রি – অমনিবাস,
    আমি চেটে নিই ঠোঁট তার, / গাঢ় ঘাম,
    বিরহ ।।। বিন্দু বিন্দু প্রেম”।

    ফ্রাউলিন কি জিনিস আমরা জানতাম না, জানার কথাও ছিল না – কারণ আমরা কর্ণফ্লেস্ক দিয়ে ব্রেকফাষ্ট করতাম না। তাই ফ্রাউলিন আমাদের কাছে “ফাউ – লিন” এই টাইপই ছিল। আমাদের কোন লোগো না থাকলেও, মোটো ছিল খুবই সাধাসিধা – “মেরেছ কলসীর কানা, তা বলে কি প্রেম দেবনা”! আমরা প্রেম বিলিয়েই চলেছিলাম। এই ব্যাপারে আমাদের ডেডিকেশন নকশাল আন্দোলনের সমতুল্য বলেও গ্রামের গুণীজনেরা রায় দিয়েছিলেন। প্রচলিত পুস্তকের সাথে আমাদের তাবৎ ছেলেছোকরাদের জাতি দুশমনি ছিল – অপ্রচলিত পুস্তকের মধ্যে প্রথম স্থানধিকার করেছিল দফা ৩০২ নামে একখানি ধারাবাহিক পত্রিকা।

    “আমি এক ভিনদেশী মহিলার প্যান্টিলাইন / স্মৃতির ভিতরে রাখি –
    অস্ফুট এ্যলবাম আমার, / যেখানে ধূসর বেড়াল এসে
    নিরীহ থাবার মাঝে নখ লুকিয়ে / হঠাৎ মানবিক হেসে ওঠে
    আমি তার নিরীহ খাঁজগুলো / দেহের ভাঁজগুলো ।।।”

    দফা ৩০২ –এ বিদেশী মহিলা নিয়ে আলোচনা হত কিনা এত দিন পর আর আমার মনে পড়ছে না, তবে অপর্যাপ্ত ভাবে খাঁজগুলো ও ভাঁজগুলো আলোচিত হত। এই ব্যাপারে আমার এ্যালবাম কোনভাবেই অস্ফুট নেই – এই এখনো। তবে আমাদের এইটাই দূর্ভাগ্য ছিল যে, যে বাংলা গানকে আশ্রয় করে আমরা যৌবন তরীতে উঠবার চেষ্টায় রপ্ত ছিলাম, সেই গীতিকারদের আর্ট-এর পর্যায়ভুক্ত করা হয় নি। তা না হলে পরশুরাম, শিবরাম ও সঞ্জীবের মধ্যে কোন জেনারেশন গ্যাপের চান্সই ছিল না – এগ্‌জাম্পেল,

    “একটা দেশলাই কাঠি জ্বালাও তাতে আগুন পাবে”

    আপনি কি অন্য কিছু আশা করছিলেন দেশলাই কাঠি থেকে? অবশ্য দাঁত খুঁচানো ছাড়াও দেশলাই কাঠির সর্বপ্রধান অলটারনেট ব্যবহার ছিল আমাদের ওখানে সিগারেটে গাঁজা ভরা। এই কাজে আমাদের গ্রামে অনেকেরি সিদ্ধিলাভ করলেও সিদ্ধিদাতা (আক্ষ্রিক অর্থে) ছিল রেজাক মাষ্টারের ছোটছেলে সেলিম। কোয়াণ্টাম মেকানিক্সের ইলেকট্রন, বোসন, মিউ ও পিওন ছাড়া যাকে একই সময় দুই জায়গায় দেখা পাবার সম্ভাবনা প্রবল ছিল। আর তা ছাড়া কোয়াণ্টাম মেকানিক্সের মত সেলিমকেও বুঝিয়াও বোঝা যেত না – হেতু তোতলাম। এতদ সত্ত্বেও সেলিম গ্রামের যাত্রায় নামার জন্য অকুণ্ঠ পরিশ্রমে রাজী ছিল। অনেক আলাপ আলোচনার পর “ভোরের শিউলি” যাত্রায় সেলিমকে একটা রোল দেওয়া হল – একমাত্র সংলাপ – “বাবু, আপনার টেলিগ্রাম”।

    এই সংলাপ মুখস্ত হেতু একমাস যাবৎ সেলিম রাতজাগা শুরু করল তাড়া তাড়া বিড়ি সহযোগে। শীতের রাত্রে ঘরের ধোঁইয়া বাড়ির অনেকের জিনা হারাম করে দিয়েছিল।

    “তোমার উর্বর ঠোঁঠ সমস্ত কৃষির ভেতরে যাতনাহীন
    কী দারুণ অমিতভাষণ ভালোবাসে!
    নবনীত বুক থেকে সোনালী উদ্ভাসে / ঢলে পড়া রোদ
    আমাদের চাষের গহীনে।।।”

    আর একটি জিনিস আমাদের জিনায় ব্যথা জাগাত, সেটি হল এই চাষ নিয়ে টেনশন। এই চাষের ক্ষেত্রেই কামারদের বেচা-দা এক যুগান্তকারী বিপ্লব ঘটালো। বেচাদা তার বোম্বেবাসী সোনারূপার কারীগর ভাইয়ের কাছ থেকে ঘুরে এসে প্যান্ট পরে মাঠে যাওয়া শুরু করল। তার আগে প্রধানত লুঙ্গী পরেই মাঠে যাওয়ার চল ছিল। খোলা ও পরার ব্যাপারে প্যান্ট ভার্সেস লুঙ্গীর লড়াইয়ে কে জিতবে সেটা চোখ বন্ধ করে বলা গেলেও, মাঠে প্যান্টের প্রচলনের ঘটনা সোসিওলজির দিক থেকে দেখতে গেলে ভারতবর্ষে আলুর প্রচলনের মতই ইক্যুয়াল ম্যাগনিচ্যুয়ডের। আমাদের গ্রামে কোন আত্মীয় ঢুকলেই স্ট্যাণ্ডার্ড প্রশ্ন ছিল – “তোমাদের ওদিকে আলু কত করে যাচ্ছে?” সেই তখন থেকেই স্বাস্থ্যের থেকে আলুর ইমপর্টেন্স আমাদের কাছে প্রকট হতে শুরু করেছিল। যে সিজিনে আলুর দাম ভালো পাওয়া যেত সেই সিজিনে আলুদোষের চান্সও বেড়ে যেত এবং তার বাইপ্রোডাক্ট হেতু শরীর খারাপ। এস।টি।ডি ডায়াগোনেসিস ওয়ালাদের বিজনেস তাই ডাইরেক্টলি আলুর সাথে সম্পর্কিত ছিল।

    “নারীরা ঘুমিয়ে থাকে / যেভাবে প্রণয় জেনেছে নীলাভ,
    আধো – আধো ছায়া মেখে / দেহ থেকে তার জ্যোৎস্নারা খুলে আসে ।।।
    পেয়ালার ঢাল বেয়ে নেমে গেছে
    সকরুণ ।।। / মৌনতা যার নাম!”

    আলুর সিজিনের জোৎস্নার দেহের কদর বেড়ে যেত আর বেড়ে যেত নীলাভ ফিল্মের ডিমান্ড। সিজিন শেষে নেমা আসত অনেকের ঘরেই একরাশ মৌনতা – সকরুণ যার রঙ!

    তবে আমরা বাংলায় অকুতভয় এবং ইংলিশে ডেস্‌পারেট ছিলাম – কারণ আমাদের বীজমন্ত্র স্বরূপ শেখানো বুলি – “হারিলেও ঘরের ভাত, জিতিলেও ঘরের ভাত”। টেনশন ম্যানেজমেণতের এমন অব্যর্থ বুলি ডেল কার্ণেগীর বইতেও পরে দেখিনি। বিনা টেনশনে আমরা অলি, কলি, বকুল, শিঙি, শোল, কলাবাগান, সর্ষেক্ষেত ও বাঁশঝাড়ের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলাম। তবে অনেক জরুরী কথা অনেক সময় বলা হয় না – যেমন বলা হয় নি – আমাদের গ্রামের নাম নিমো। এই নামে আমাদের গ্রামে একটা ছোট্ট স্টেশনও আছে। স্কুল লাইফ পর্যন্ত স্টেশনবিহীন বন্ধুরা ইনফিরিওটি কমপ্লেক্স হেতু ‘নিমো জাংশন’ বলে ক্ষ্যাপানোর ব্যর্থ চেষ্টা দিত।

    “প্রদক্ষিণে ভুল মাঠ / স্বপ্নের সংজ্ঞাম ও বালক হৃদয়,
    যেন অমল স্মৃতিবাহী ট্রেন / ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আছে দাঁড়িয়ে
    শৈশবের রোদঝরা কোন নিবিড় স্টেশানে”

    নিবিড় স্টেশন জানলাম – নিবিড় ভাবে বসে থাকা। আমাদের কৃষিপ্রধান গ্রামের ছেলেদের (এবং মেয়েদের) মস্তিষ্ক প্রেম বিষয়ে উর্বর করে তুলতে এই স্টেশনের অবদান অনেকখানি ছিল বলেই আবার গুনীজনেরা রায় দিয়েছিলেন। আমাদের গুণীজনেরা কলকাতাবাসী পাবলিক দের মত সবজান্তা না হলেও সেই প্রাক কেব্‌ল টিভি যুগেও বেশ অনেক বিষয়েই মতামত জ্ঞাপন করত। কোন মেয়ে এই স্টেশনে কোন ছেলের হাত ধরে নামলে (বা ভাইস ভার্সা) তাদের প্রেমিক – প্রেমিকা বলা হতে লাগল। ওদিকে কলেজের ক্লাস বয়ে যায় আর এখানে প্রেমিকার কোলে লাল কৃষ্ণচূড়া ভরে ওঠে! কিন্তু বালক হৃদয় কি জিনিস? গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের নতুন ম্যাডামকে ‘প্যাটিস’ খাব বলে দুলুর ছেলে খুব মার খেয়েছিল। আমি একনো ঠিক বুঝতে পারি নি ‘প্যাটিস’ খেতে চাওয়ায় খামোকা দিদিমণি রেগে উঠেছিল কেন!

    বেচাদার ভাই গ্রামের বাইরে কাজ করতে যাবার অনেক পর দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসাবে আমি ভারতের সিলিকন ভ্যালিতে সিলিকোন টিউব নিয়ে কিছু নাড়াঘাঁটার কাজে ব্যপ্ত হয়েছিলাম। তবে পামেলা আন্ডারসন এবং বে-ওয়াচ সিরিয়ালের দৌলতে পাবলিক সিলিকোন সম্পর্কে সম্যক ধারণা লাভ করে ফেলেছিল ততোদিনে। সায়েন্সরা সিলিকোন ও আর্টসা জেলি বলত।

    “জেলি ভরা স্তনের পাশে / আমাদের কামনা / মুছে যাক ।।।
    মুছে মুছে যাক / আর পাখিরা জানুক / শীত কখনোই কোন
    প্রতিশব্দ ছিল না প্রণয়ের ।।।”

    আমাদের ওখানে অন্ততঃ প্রণয়ের সাথে শীতের বেশ একটা মাখোমাখো সম্পর্ক ছিল। সিজিন লাভ্‌ - শীত পড়লেই ক্রিকেট আর প্রেমে পড়ার হার রীতিমত বেড়ে যেত। কোন প্রেমেই মহীরূহের পর্যায়ে না পৌঁছলেও সুন্দর বনসাই আমি হামেসাই দেখেছিলাম। অনেক সময় সেই বনসাইকে কেটে ছেঁটে শেপ্‌ দিতে আমি অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখেছিলাম। প্রণয় অত্যন্ত ভারী শব্দ বিবেচনা হওয়ায় ভালোবাসা করা সহজ ভাবে প্রকাশিত হল এবং আরো সংক্ষেপে ‘নাং’ করা। চর্যাপদের যুগে ‘নাং’-য়ের চল ছিল কিনা জানা নেই – তবে মঙ্গলকাব্য পারিয়ে চৈতন্যযুগে প্রবেশকালে ‘নাং’ জিনিস্টা প্রায় বাংলার গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভ্যাগিস ফ্রয়েড তখনো জন্মাননি বা সমকামীতা সংক্রান্ত ব্যাপারগুলো তখনো সঠিকভাবে ঘোলাটে হয় নি – তাই তো জগাই-মাধাই কেস্‌টা এখনো শুধু ঈশ্বর প্রেমেই থেকে গেছে! এই একবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় বন্ধুবর্গের সাথে নরম ঘাসে শুয়ে থাকা সামাজিক ভাবে নিরাপদ ছিল – এখন আর নেই। তবে সন্ধ্যার সাথে সাথে দুপুরগুলো কিন্তু অন্যভাবে ধরা দিয়েছিল আমাদের কাছেঃ

    “জলের আয়নায় ভাঙ্গা রোদ, কার্ণিশে দুপুর –
    ছাদের কোণায় ঝিমগ্ন লাটিমও – ম্লান হেলে ধীরে
    মোরগের ঝিমুনি টুটে গেলে
    আচমকা দুপুর কোন সুড়ঙ্গে ঢুকে যায়”

    ঘোষপাড়ার লাটিম-দা প্রায়শঃই ছাদের কিনারে ঝি-মগ্ন থাকত বলে জনশ্রুতি। এবং এক দুপুরে বৌদির ঝিমুনি টুটে গেলে লাটিমদার মগ্নতা লাটিমদার সুড়ঙ্গেই ঢুকে গিয়েছিল বলে প্রবাদ। তবে দুপুর প্রসঙ্গে মনে পড়ল – প্রাক মোবাইল যুগে প্রণয়ের সাথে সাথে ছাদের একটা দুষ্টু-মিষ্টি সম্পর্ক ছিল। প্রায় চারশো মিটার দূর থেকে পুকুরের একপাড়ে ছাদে ঘোষপাড়ার বুড়ি অন্যপাড়ে পালপাড়ার নন্তুর সাথে কম্যুনিকেট করত। মুখ না খুলে হস্তসঞ্চালনের মাধ্যমে মনের ভাব প্রকার করায় এরা যেরূপ দক্ষতা অর্জন করেছিল তাতে করে মনে হয় এরা ওড়িশি নাচের লাইনে গেলে কেলুচরণ খানদুই ডেডিকেটেড শিষ্য পেতেন।

    চৈতন্যভাবের একটা জিনিস খুবই মনোগ্রাহী হয়েছিল আমাদের কাছে – সেটা হল কৃষ্ণপ্রেলে মাতাল হয়ে লাইনেন্স টু ফেইন্ট! পাড়ার যায় শালুক, শিমূল ও নিমসুন্দরীদের অ্যাকসেস করতে এই টেকনিক অব্যর্থ – মালসাভোগের সাথে সাথে মোচ্ছেব! তবে এখানেও সেই দুপুর –

    “পশ্চিমে গুটানো দুপুর / কিশোরীর কৌণিক স্তন থেকে
    কৌতুকের মত / আলগোছে বিভ্রম ঝরে গেছে”

    কৌণিক স্তন ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার হয়েছিল পরবর্তীকালে কারিগরীবিদ্যা পড়তে গিয়ে – ফিটিং, ফোর্জিং এবং কারপেন্ট্রি ক্লাসে প্রায় অবলুপ্ত শ্রেণীর ইঞ্জিনিয়ার মেয়েদের আইসোমেট্রিক ভিউতে এমন স্তনই পরিস্ফুট হয়ে উঠত। এমন কৌণিক স্তনের উদাহরণ তো আরও ছড়িয়ে ছিল পুকুরঘাটে। বহুজ্ঞানী গুনী জনদের দুপুরবেলা পুকুরঘাটে বসে থাকা হবি হিসাবেই দেখা হত। আহা মরি মরি – এমন ঘাটে আমাদের মন্দাকিনী, আমাদের রাজকাপুর – আমাদের সিক্তবসনা – হেমেনীয় পট থেকে উঠে আসা দুপুরগুলো –

    “নির্ধারিত দুপুরের আগে আমার পাপাচার
    গ্রন্থিতে নিভৃত সুর হয়ে বাজে,
    নিস্তরঙ্গ, পুকুরঘাট দেখে - / ক্ষায়ার্ত সাবান ঠোঁঠ নিয়ে
    দাঁড়কাক উড়ে গেছে, উড়ে গেছে প্রতিবেশী কোন ঘাটে”।

    আসলে আমাদের গ্রামে প্রধান অসুবিধাগুলোর মধ্যে একটি ছিল ছেদ, যতি ইত্যাদি চিহ্নের ব্যবহারের বেহিসেব। আমাদের সংলাপ প্রায়শঃই শুরু হত অনাবশ্যক জায়গায় স্ট্রেস সিয়ে – এগজাম্পেল (কারণ বাংলার দূর্গা স্যার ও ভূগোলের লক্ষীবাবু বলেছিলেন সর্বদাই উদাহরণ দিবে) – রবির দাদু মারা যাবার পর অন্য শহরে থাকা রবির কাকা লকু কে খবর দেওয়া হচ্ছে ফোনে –

    - লকু, সেই দিন তো তিরিশ বোতল মত দেশী লাগল রে।।।
    - অসময়ে এত দেশী! এখন তো কালিপূজা নয়!
    - না তা নয়, আসলে তোর বাবাকে শ্মশানে পোড়াতে নিয়ে গিয়ে সবাইকে দিতে লাগল তো!

    এই সব নিয়েই আমাদের গ্রাম ছিল – আমাদের যৌবন কাল ছিল, ছিল বালকবেলাও – এখনও তার থেকে অনেক দূরে মাঝে মাঝে অনুভব করতে থাকি সেই ফেলে আসা দিন –

    “তোমার মুঠোর ভেতরে একাগ্র বিষাদ / আমি খুঁজি / আশ্চর্য ঘাস ওই
    সমস্ত সবুজ যে ক্রমশঃ মরে আসে
    অনেক ঘাসের মাঠ, রোদমগ্ন ।।।”

    [এখানে ব্যবহৃত কবিতা পঙতিগুলি আমার এক প্রিয় কবি আন্দালীবের লেখা বিভিন্ন কবিতা থেকে নেওয়া। কবিতাগুলির নাম যথাক্রমে –

    শুলেমিথ (অন্যপর্ব), মিমিক, তোমার কৃষিজাত এ্যানসার্ডিটির ভেতরে, সিরামিক, নিবিড় স্টেশনে, নখাগ্রে, ভোর্টেক্স, ইরেকশনের আগে, প্রকৃতস্নান, অনেক ঘাসের মাঠ]

    ।।। ক্রমশঃ
  • RANJAN ROY | 24.96.62.150 | ২১ জানুয়ারি ২০১৩ ০১:১২579272
  • কোথায় গেলেন সুকি? অপেক্ষায় থেকে থেকে তুলেদিলাম।
  • siki | 132.177.62.20 | ২১ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:৩১579273
  • যা তা হচ্ছে লেখাটা। জাস্ট যা তা।
  • সুকি | 168.161.176.6 | ২২ জানুয়ারি ২০১৩ ০৮:০১579274
  • রঞ্জনদা, সিকিদা,
    অনেক ধন্যবাদ। আসলে বুঝতেই তো পারছি না যে লেখা কেউ পড়ছে কিনা! ভাবছি যে শুধু শুধু স্পেস নষ্ট করছি, আর সেই ভেবে ল্যাদ খেয়ে লেখা নেই আর ঃ)
  • ঐশিক | 132.181.132.130 | ২২ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:১৪579275
  • কে বলে আপনার ল্যাখা কেউ পড়ে না? আমার তো বেশ ভালো লাগলো, আপনের আগের ল্যাখা গুলো ও মাঝে মাঝে খুজেপেতে পড়ি তো !!
  • I | 24.96.103.12 | ২২ জানুয়ারি ২০১৩ ১১:৩৬579276
  • সুকি। আগে বলা হয় নি। বড় ভালো লেখেন।
  • সুকি | 212.160.16.52 | ০৫ মে ২০১৩ ১৫:২২579277
  • এক গঞ্জের ইতিবৃত্ত এবং কিছুটা স্মৃতিমেদুরতা - ৯

    তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি
    ----------------------------------------------------------------------------------
    প্রত্যেক যুগের সন্ধিকালেই কিছু কন্‌ফিউজড পাবলিক থাকে – তা সে কুচযুগ বা প্রযুক্তি যুগ যাই হোক না কেন। মোবাইল কালচার যুবক-যুবতী হেন কিশোর-কিশোরীর শোনিতে ঘুঁষে যাবার পর প্রেম আদানপ্রদানে প্রভূত পরিবর্তন এসেছে কলিকালে। যে সমস্ত গবেষকগণ কনটেমপোরারি রিসার্চ টপিক হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন, যে সমস্ত খবরের কাগজ পাতা ভরাবার জন্য মুচমুচে ও মুখোরোচক আনন্দের সন্ধানে বিনি পয়সায় লেখক নিযুক্ত করেছিল তাদের সবার মুসকিল আসান হতে লাগল আস্তে আস্তে। এটা প্রায় সবারই জানার কথা যে মোবাইল প্রচলনের পর প্রেমঘটিত আত্মহত্যার রেট খুবই আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। আগে বিরহ স্থায়ী হত – কবিরা কবিতা ও গদ্যলখকের জমকালো ছোটগল্প উপহার দিত আমাদের পাতে সেই বিরহজনিত ভাব থেকেই। সুরঞ্জনা ওইখানে যাবে কি যাবে না – সেই নিয়ে পাবলিক কনফিউজড্‌ থাকত। অপেক্ষা, আরো অপেক্ষা – সুরঞ্জনা এলো না, ওপাড়ার বিলু ফট্‌ করে আত্মহত্যা করে বসল সেই টেনশন আর নিতে না পেরে। এখন এ জিনিস সম্ভাবনা শূন্য – মোবাইল জানিয়ে দিচ্ছে কারো না আসা, কারো চলে যাওয়া। আর তা ছাড়া মোবাইল কুল-ডাউন পিরিওডকে বেশ শর্ট করে দিয়েছে। আগে বিরহ জানতে হলে সম্মুখ সাক্ষাত বা পাশের বাড়ির মাইডিয়ার টেলিফোনই ছিল ভরসা – বিরহ জমা আর বেশী জমে সেলফ ইগনিশন হবার ফাঁকটাতেই আত্মহত্যার পরিমাণ বেশী থাকত।

    আমাদের গ্রামের স্টেশন প্রেমিকযুগলদের আত্মহত্যার প্রকৃষ্ট স্থানের শিরোপা পেয়েছিল সেই কালে। আমাদের বাল্য ও কৈশোরকালে প্রায়শঃই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটত স্টেশনের আশেপাশে। বিচক্ষণ যুগলেরা রেলপোষ্টের গায়ে চকখড়ি দিয়ে নিজেদের নাম ঠিকানা লিখে রেখে যেত মরার আগে। এর ফলে রেলপুলিশের বডি হ্যান্ডওভার করতে ও শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গকে নিমো ভারত সেবক সমাজের স্বান্তনা প্রদানে সুবিধা হত।

    “বাঙালী কৌমের কেলি কল্লোলিত কর কলাবতী
    জানতো না যা বাৎসায়ন, আর যত আর্যের যুবতী”

    আরো বড় হবার পর মনে প্রশ্ন জাগতে লাগল নিষ্কাম প্রেমে বাৎসায়নের হাত কতটুকু? যারা সুইসাইড করত তারা আর্য যুবতী নাকি অনার্য? আমাদের গ্রামের পাশে মালঞ্চ পার্কে ঘন্টা হিসাবে ঘর ভাড়া দেবার শুরু ও মোবাইলের ইনকামিং কল ফ্রী হওয়া প্রায় একই সময়সীমায় হওয়ায় এদের মধ্যে কার প্রভাব বেশী সুইসাইড রেট কমানোয় সেই নিয়ে বিজ্ঞজনেরা দ্বিধাবিভক্ত ছিল তৎকালীন। তবে এটুকু আমরা হলফ করে বলতে পারি রেলে কাটা পড়া মেয়ে কতখানি কৌমের কেলি বা কতখানি কলাবতী তা বোঝার ক্ষমতা বাৎসায়নের বাবারও থাকার কথা নয়!

    রেলে কাটা পড়া দেহের সাথে রোড এক্সিডেন্টের বডির পার্থক্য আছে। সুনির্দিষ্ট ভাবে কাটা যাবে এই ভেবেই পাবলিক রেললাইনে বডি থ্রো করত। রেলের চাকা ঠিকমত পিস্‌ করতে পারলেও বাদ সাধত ইঞ্জিনের সামনে নীচের দিকে থাকা নেটটা। ওই নেটে আটকা পড়ে গেলে কালাম কাকার প্রবচন মত বডি ঝুড়ি করেই কুড়াতে হত। মড়া পোড়ানোর ব্যাপারে যেমন বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে সিদ্ধিলাভ করা যায়, রেলে কাটা পরা মড়া কুড়ানোর ব্যাপারে তেমনই দক্ষতা অর্জন করেছিল আমাদের করিম চাচা।

    আমাদের বাল্যবন্ধু আলমের ছোটকাকা করিম যে ঠিক কোন ব্যবসা যৌবনকালে করত তা কেউই জানত না। এখন বয়স বাড়ার পর নিমো স্টেশনের কাছে চায়ের দোকান দিয়েছে। করিম চাচার যৌবনকালের নানা হবির মধ্যে প্রধান ছিল তার খালাত ভাই রশিদের সাথে ঝগড়া। সেই ঝগড়া মারামারি পর্যন্ত এগুতে আমরা কোনদিনই দেখি নি। ঝগড়ার ক্লাইমেক্সে করিমচাচা প্রায় জংধরা একটা তরবারি বের করত এবং অন্যেরা চাচাকে পিছন থেকে টেনে রাখত। হিন্দু পোলাপানদের ধারণা ছিল যে সেই তরবারী দিয়েই নাকি ঈদের সময় গরু কাটা হয় – অফ সিজনে তাই জং থাকে।
    দুচোখে রাঙাবো বোকাদের চোখে

    "দুহাত ঘুরিয়ে সময়ের স্রোত দেবো তাল ঠুকে।
    কিন্তু এখন ভাবতেই দেখি ছুটে গেছে রং
    ভেঙে গেছে সব মিথ্যে মোহের অকেজো ভড়ং"

    তবে করিমচাচার কোন কাজকে ভড়ং বলা বা তার হিম্মত নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা আমাদের এক্তিয়ারের বাইরে ছিল। করিম চাচা নির্বিকার ভাবে রেলে কাটার হাত কুড়াচ্ছে, পা-এর এক পিস্‌, কব্জি কুড়িয়ে ঝুড়িতে রাখছে আর আক্ষেপ করছে যে এরা এত জায়গা থাকতে নিমোতেই মরতে আসে কেন! যাঁরা ভাবছেন রেলপুলিশ না আসা পর্যন্ত বডিতে হাত লাগানো বেআইনি – তাঁরা ঠিকই ভাবছেন। তবে পার্থক্য ততটুকুই যতটুকু হল ভিডিও গেমসের যুদ্ধুর সাথে সত্যিকারের যুদ্ধের।

    শেষবার এই ভাবেই করিমচাচা ঝুড়িতে তুলেছিল কুমারবাড়ির ছোটবাবুকে। রেলে ভালো চাকুরী করে রিটায়ার্ড করার পর রেলেতেই কেন সে ঝাঁপ দিতে গেল তা নিয়ে বাজারে নানা মতামত চালু আছে। আমার প্রাণের বন্ধু পিন্টুর খবর অনুযায়ী এর পিছনে আছে পিতা-পুত্রের প্রেমের রেসারেষি! কামারবাড়ির মিনতিই নাকি এর মূলে। পিন্টুর সমস্ত কথাই প্রথমে অবাস্তব মনে হয় – কারণ গোপন খবর দেবার ব্যাপারে পিন্টু সময়ের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। আমি গত ১৭ বছর গ্রাম ছাড়া কিন্তু আমার গ্রামে ঘটে যাওয়া বা এখনও না ঘটা ফিসফাসও আমার অজানা নয় – সেও ওই পিন্টুর দৌলতে। আকারে, প্রকারে, ও প্রকৃতিতে ঋতুপর্ণীয় হবার জন্য মহিলা মহলে পিন্টুর চিরকালীন অবাধ এ্যাকসেস – এই এখনও। সঠিক ট্রেনিং পেলে এবং বছর আশি আগে জন্মালে পিন্টু মাতাহারিকেও বেগ দিতে পারত।

    পিন্টুর খবর অনুযায়ী কুমার বাড়ির ছোটবাবু, তস্যপুত্র ও মিনতীর ল্ভ্‌ ট্র্যাঙ্গেল নতুন কিছু নয়। রিটায়ার করার পর সেই অ্যাকসেস প্রবলেম। বয়সকালের মিনতীর পিছনে ডিভোশনটা আমরা বুঝতে পারতাম – কিন্তু বয়স বেড়ে যাবার পর? মিনতীর বয়স আমাদের কাছে বেড়ে গিয়েছিল – আত্মহত্যার পর বোঝা গেল ছোটবাবুর কাছে নয়!

    “দেখেছি সব নারীই যৌবনের স্থায়িত্ব সমন্ধে নির্বাক
    অথচ প্রায় মিটে যাওয়া একটি সনেটের জন্য
    এমনভাবে চুল বাঁধলে, মনে হলো
    কবিতাকে নিভিয়ে ফেলতে তুমি
    শত সন্তানের জননী হবে”।

    কুমারদের ছোটবাবুর তস্যপুত্রের নাম ছিল কাশী – মনে পড়ছে না যে কাশীর বউয়ের নাম কবিতা ছিল কিনা! ছোটবাবু যে প্রায় মিটে যাওয়া একটি সনেটই ছিল সেই ব্যাপারে আমাদের কারো সন্দেহ ছিল না। কাশীর প্রথম বউ সম্পর্কে পিন্টুর মতামত ছিল “বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা”। তা সেই মুক্তোর মালা কাশী দ্বারা এক কন্যা প্রাপ্ত হয়ে যখন ডিভোর্সী হল তখন পিন্টুর মতে এর পিছনেও মিনতীর কালো হাত। যৌবন যত গড়াতে লাগল, মিনতীর কাপড়ও ততো আলুথালু – জননী সে হতে পারে নি তাই কাশীর দরকার হল দ্বিতীয় পক্ষের। এবার এক সাঁওতাল কন্যের প্রবেশ ঘটিল বৈশ্যকুলে – গ্রামের বয়ষ্করা যাকে এখনও মাগী বলেই ডাকে। তা সেই মাগীর প্রবেশে গ্রামের যুবক সম্প্রদায়ও উত্তাল হল – ধীরে রজনী ধীরে বলবারও কেউ রইল না। কাশীর ফ্যামিলি থেকে যুবকদের সোনার বাংলা ক্লাব কোনদিনি সাড়া পায়নি তেমন – তা সে অর্থনৈতিক বা সামাজিক যাই হোক না কেন। নতুন বৌদি, কাশীর মাল, উরফে সাঁওতাল মাগী ক্রমশঃ তা পলটাতে থাকল। কালো কন্যার প্রতি আসক্তি এক বিপদজনক পর্যায়ে গেল এবং কন্যাদায়গ্রস্ত পিতাদের মনে প্রায় লুপ্ত হওয়া আশা পুনরজ্জীবিত হল। সকালের আমতলার আড্ডা, সন্ধ্যের স্টেশনের ওভারব্রীজ কোন জায়গাতেই কাশীর বউ অনুল্লিখিত না থেকে দিন এগুত না।

    “তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি
    দেবে কি গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ?
    যেখানে পাখী নেই রক্ত দ্রুতগামী
    তোমার নাভি দেখে হাঁটছি একা আমি
    মধ্যযুগী এক যুবক গোস্বামী
    দেহেই পেতে চায় পথের নির্দেশ
    তোমার নাভিমূলে দেখেছি একা আমি
    নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ”।

    কুমারদের বাড়ির ভিতরেই টিপকল ও বাথরুম থাকার জন্য কাশীর বউয়ের নাভি অনুসরণ করা একটু কঠিন থাকলেও যুবক সম্প্রদায়ের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না। কাশীর বউ বাইরে শাড়ী ও বাড়িতে আলখাল্লা স্বরূপ ঢোলা ম্যাক্সি পড়ত, সেই ছোট্ট সাইকেল, তার শাড়ী পরিহিত চালিকা, দখিনা বাতাস – কে বলল নাভি দেখায় না কোনো পথনির্দেশ!

    তবে গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ দেখতে পাবার লাকি ড্র কে কে জিতেছিল সেই ব্যাপারে বাতাসে আশকথা পাশকথা ভেসে বেড়াত। আমার কাছে আসা খবর অনুযায়ী জেলেবাড়ির পচা সেই লাইনের ফ্রন্ট রানার ছিল। পচাদার ক্যারিয়ার গ্রাফ কর্মচারী হিসাবে ঢুকে কোম্পানীর সিইও হতে পারার মতই ঈর্ষনীয়। ক্ষুদ্র চাষী, স্টেশনারী দোকানের কর্মচারী, ঔষধের দোকানের মালবাহক, ডাক্তারের কমপাউণ্ডার থেকে নিমো ভারত সেবক সমাজ ক্লাবের বাড়তি ঘরে ডঃ কৈর্বত্ত্যের নাম লেখা পর্দা ঝোলা চেম্বার। কষ্ঠীপাথর সাইকেল থেকে নামল, পাঁচিলের গায়ে সাইকেল ঠেস, চেম্বারের পর্দা পড়ে এল। কারো বুক চিনচিন, কারো ভ্রুকুটি – এখানে পাখী নেই এখন, তাদের ঘরে ফেরার নিঃস্তব্ধতা অনেক যুবকেরই রক্ত দ্রুতগামী করে তুলেছে। ডাক্তারের কাছে নাকি কিছু লুকাতে নেই – আমরা সেই সূত্রে ধরে নেই পচাদা দেখে নিচ্ছে নাভিমূল – বসন্তের পেটগরম।

    বর্ধমান জেলা মার্কবাদীয় লালদূর্গ হবার জন্য আমরা বহুকালই সাম্যবাদে বিশ্বাসী। কমরেড, তুমি পথের নির্দেশ পেয়েছ ভালো কথা, গোপন পাখী দেখেছ আরো ভালো – কিন্তু প্লীজ একা হেঁটো না। আমাদের এই দোদূল্যমান অবস্থায় কৃষ্ণ সানুদেশ দেখার খবর কনফার্ম করল এক সহযোদ্ধা। রাতে পেচ্ছাপ বসতে উঠে নাকি সে কুমারদের ছোটবাবুর বাড়ির থেকে পচাদাকে বেরোতে দেখেছে। সেই আকাঙ্খিত দেহ তার স্তাবক হারাল!
    “কখন যে কোন মেয়ে বলেছিল হেসে
    নাবিক তোমার হৃদয় আমাকে দাও,
    জলদস্যূর জাহাজে যেয়ো না ভেসে
    নুন ভরা দেহে আমাকে জড়িয়ে নাও”।

    অশ্রুতে চোখ লবণাক্ত হয়ে আসা আমাদের কাছে মধ্যযুগীয় প্রথা তখন, তবে কেবলই প্রেম সংক্রান্ত ব্যাপারে। সেই কৈশোর কালে আমাদের বাপেদের ক্যালানি দেখলে রাজতন্ত্রে বিশ্বাসী আত্মারা যুগধর্মে ভরসা ফিরে পেতেন। আমাদের উপরে হয়ে যাওয়া সেই ভালোবাসা মাখানো নির্যাতনের ভিডিও ফুটেজ দেখলে আজকালকার ফেসবুকে পোষ্টকারী পশুপ্রেমীরা ঈষৎ লজ্জা পেতেন বলেই আমার ধারণা! মোদ্দা কথা আমাদের স্টেশন আত্মহত্যা করার প্রকৃষ্ট জায়গা প্রমাণিত হলেও ভালোবেসে আমাদের মধ্যে খুব কম জনই ক্ষুদিরাম হয়েছিল। তবে ক্ষুদিরাম বিষয়ক জোকগুলি শহুরে বলেই আমাদের ধারণা ছিল। কারণ আমাদের আশেপাশে এর খুব একটা বেশী প্রয়োগ দেখি নি। আর তাছাড়া ক্ষুদিরাম নিয়ে পুংলিঙ্গ রসিকতা করা গেলেও স্ত্রীজাতিকে কভার করা অতো সহজ ছিল না।

    কোন মেয়ে আমাদের সাথে হেসে কথা বলছে সেটাই স্বপ্নের ব্যাপার। আর জড়িয়ে ধরা, তা যে মেদ বা নুন যাই ভরা দেহ হোক না কেন – এটা এক অলীক কল্পনা ছিল – জুল ভার্ণের গল্প বা দেশীয় ঠাকুরমার ঝুলি। হৃদয় দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে বিয়ে বাড়ির জুরি ছিল না। যারা ওরই মধ্যে একটু সিরিয়াস তারা পূজা পার্বণ পছন্দ করত। প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্র হিসাবে বিয়েবাড়ি টি-২০ হলে, আমাদের গ্রামের শিবের গাজন ছিল ৫০ ওভারের ম্যাচ। সেই সব ছোট বড় ম্যাচের চিরস্থায়ী এফেক্ট বলতে দুটো মাত্র উদাহরণ আমাদের সামনে ছিল – প্রথমতঃ, বিটুর মাসীর মেয়েকে নাচ দেখাতে গিয়ে বামুনদের রিন্টুর পায়ে চোট, যার জন্য এখনও সে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটে। দ্বিতীয়তঃ, মনু তার দাদার শালীকে পটাতে সমর্থ হওয়া। তবে মনু তার চাওয়ার থেকে একটু বেশীই পেয়েছিল – দাদার শালীকে বউ বানিয়ে।

    হিন্দু বিয়ে রাতের বেলা হবার জন্য কিছু সুবিধা ও অসুবিধা দুই ছিল। ইলেকট্রিক আলো এবং জেনেরেটর আসার আগে হ্যাজাকের আলোয় ব্যাপারটা বেশী ভালো জমত। জানালার ফুট দিয়ে আসা আলোয় অপর দেওয়ালে আলছায়া খেলা না দেখে হ্যাজাকের আলোয় লাইভ সেই শো দেখলে সত্যজিতের আলোর কারসাজি বিষয়ক কৌতূহল যে আরো বেশ কয়েকগুণ বেড়ে যেত তা হলপ করেই বলা যায়। অন্ধকার সাম্যবাদকে জোরালো ভিত্তি দেয় – পার্থক্য একটাই, একটি অলীক কল্পনা অন্যটা ফ্যাক্ট। আমাদের ছেলে বেলা তাই হ্যাজাগী আলোর শ্রীদেবী আর মাধুরীতে ভর্তি ছিল। ক্রমশঃ নিভে আসা গোলাপফুল, খসে যেতে থাকা বেলকুঁড়ির মেলা, ল্যাকমের গাঢ ছোপ – বেশ কিছুদিন অবশ করে দিত। নামে কি আসে যায়? সাহসীরা বড় জোর সিঁড়ির কোন, প্যাণ্ডেলের পিছনের দিক – খিলখিল আর ফিসফাস চাপা পড়ে আসা – তবে ওই, রাতের বেলা অসুবিধার মধ্যে সাপের ভয়টাও ধরা উচিত।

    “তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
    খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
    শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
    তারো বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ
    সলাজ সাহস নিয়ে ধরে আছি পট্টময় শাড়ি
    সুকণ্ঠি কবুল করো, এ অধমই তোমার মরদ”।

    এর মধ্যে কোন ‘র’ ব্যাপার নেই। দিনের বেলায় বিয়েবাড়ি হলে মাঠের দিকে ঘুরতে যাওয়াটাই রেওয়াজ ছিল। এমন বিয়েবাড়ি বিষয়ে বিটুর প্রগাঢ় অভিজ্ঞতা থেকে এটা জানা গিয়েছিল দিনের বেলা ডিপ্‌ কালারের রঙ নাকি আকর্ষণে সাহায্য করে। সেইমত ওর একসেট প্রাইমারী কালারের জামা ছিল। লাল, সবুজ, বা হলুদ রঙের সাথে নাকি পরিবেশিত সরবতের এক ঐক্যতান ছিল। লাল জামা পরা বিটু সবুজ প্লাষ্টিকের গ্লাসে হলুদ সরবত খাচ্ছে – এটাও মেলোড্রামা নয়, ক্টহিন বাস্তব। তবে এই ক্ষেতের আড়ালে শস্যের সপক্ষে যৌবনকে চেতাগ্নি দিয়ে গিয়ে আলমের বিয়েতে বিটুর আক্ষরিক অর্থেই পিছন মারা গিয়েছিল। কোন এক জরির পাড়ওয়ালীকে নাকি বিটু আন্তরিক ভাবেই রতির দরদ বোঝাচ্ছিল – তা সেই অনুরাগ একটু বেশী হয়ে গেলে দর্দ জনিত সুকন্ঠে ক্ষেতের আশেপাশে পাবলিক সচেতন হয়ে যায়। প্যান্ট নামানো থাকায় শিব ভক্ত বিটু নিজেকে জরিওয়ালির মরদ প্রমাণে অক্ষম হয়। অতঃপর প্রকৃত মরদদের হাতেই শাস্তিস্বরূপ পিছনের দিক থেকে বিটু তার কুমারত্ব হারায়।

    তবে চারিদিকে দিগন্ত জোড়া ক্ষেত যদি থাকে, তাহলে ফ্রেস বাতাস খেয়ে নাকি মানুষের হৃদয় আরো উন্মুক্ত হয়, উদার হয়, অ্যাকসেপ্টেন্স লিমিট বাড়ে। হক্‌ কথা – আমাদের গ্রামে এই হাইপোথিসিসের নানা উদাহরণ ছড়িয়ে ছিল। নরেনের বউয়ের সাথে রমেশের, প্রভাতের বউয়ের সাথে ডিলার লাল্টুর – এইসব আশনাই আমাদের সময়ে ক্ষমাসুন্দর চোখেই দেখা হত।

    “আলোটা উসকে দিই? বললো সে। বললাম থাক।
    আধাঁরে কিসের গন্ধ আমাকে বুঝতে দাও জেগে
    একটু নীরব থেকে দেখা যাক কিসের আবেগে
    মানুষের ঘুম পায়। যাও তুমি। পৃথিবী ঘুমাক”।

    আলো নেভানো থাকে – জোছনা যদি আড়ি না করে তাহলে আবছায়া, আধো শরীর উপকথা তৈরী করে। কার বাড়ির পিছনে শোনা যায় নিশুতি রাতে পায়ের খসখস – তবে অন্ধকার শুধুই বিড়ির গন্ধ বয়ে আনে। মানুষ ঘুমিয়ে পড়লে অলীক মানুষ জাগে – বামুনদের অশোকের মনোহারী দোকানে ঢুকে পড়ে জেলে বাড়ির তপতী। দিনের বেলায় দোকান থেকে বিনা পয়সায় পাওয়া চাল আলুর ঋণ শোধ করে দেই ঈষৎ আবেগ। চোখ কথা কয় না এমন প্রেক্ষিতে, শরীর বলে – বয়স নিজেকে যাচাই করে নেয়।

    অথচ আমরা অবিচলই থাকি। আম গাছ, গাব গাছের ছায়ায়, মোড়লদের বাগানে, তালের গেঁজে যাওয়া রসে সম্পৃক্ত আমাদের দৈনন্দিন আলোচনায় রতি আসে ঘুরে ফিরে। রসিকতা – নির্বিষ কটাক্ষ জীবনে মজিয়ে নেয় ততোধিক উদাসীন কিছু বেঁচে থাকতে চাওয়াকে। ষষ্টির মন্দির ভেঙে পড়ে আর তার প্রাচীরের গায়ে সন্ধ্যা নামে। ক্ষেতের দিকে এগিয়ে যায় তপতী – আরো কিছু পরে আমাদের ফেরার সময় হবে –

    “কখনো সে বসে থাকে ঠেস রেখে পুরানো প্রাচীরে
    দু’পাশ ছড়ানো থাকে ধসে পড়া ইঁট কাঠ চুন
    এভাবেই সন্ধ্যা নামে, সব পাখী ফিরে যায় নীড়ে
    দেহ ছুঁয়ে নাচে তার মিটি মিটি জোনাকি আগুন”।

    [এখানে ব্যবহৃত কবিতা পঙতিগুলি আমার এক প্রিয় কবি আল মাহমুদ-এর লেখা বিভিন্ন কবিতা থেকে নেওয়া। কবিতাগুলির নাম যথাক্রমে –
    সোনালী কাবিন, স্বীকারোক্তি, সত্যরক্ষার তাগাদা, শোণিতে সৌরভ, সমুদ্র-নিষাদ, সোনালী কাবিন, রাত, প্রতিকৃতি]

    - ক্রমশঃ
  • DB | 125.187.35.164 | ০৫ মে ২০১৩ ১৫:৫৭579278
  • এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম লেখাটা । হাতে রইল পরবর্তী পর্বের জন্য অধীর প্রতিক্ষা
  • siki | 132.177.251.70 | ০৬ মে ২০১৩ ০৭:১৮579279
  • সুকির চটি চাই আস্‌ছে বইমেলায়।

    এ কথাটা আগে কেন মনে হয় নি?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন