এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  অন্যান্য

  • আরেকটা কলকাতা

    Achintyarup
    অন্যান্য | ৩১ অক্টোবর ২০১১ | ৪২২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • achintyarup | 59.93.244.114 | ১২ নভেম্বর ২০১১ ০৫:৪৩504842
  • রাজার ঘরে যে ধন আছে, টুনির ঘরেও সে ধন আছে। শহরে বৌবাজার আছে বলে কি গাঁয়ে থাকতে নেই? পোড়ো নীলকুঠি আর চুনুরিপাড়া বাঁহাতে রেখে পশ্চিমমুখো একটু এগোও, ডানদিকে পড়বে কালীতলা। বিরাট মন্দির তৈরি হচ্ছে শ্যামাকালীর। কালীমূর্তিটি কিন্তু অর্বাচীন নন। অন্তত এক শতাব্দী তো বটেই, বেশিও হতে পারে বয়স। সাত ফুটখানেক উঁচু চমৎকার মূর্তি, নিমকাঠ দিয়ে তৈরি। থলিয়া (বা থলে) গাঁয়ের ছুতোররা নাকি এই মূর্তি গড়েছিল। আর কিছু এখন কেউ বিশেষ জানে না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিতে ধুলো জমবে না? কার সময় আছে একশ দুশ তিনশ বছরের হিসেব মাথায় নিয়ে বসে থাকার? দায় পড়েছে কারও? লোকে তাই ভুলে গেছে। দোষ কারও নয় গো মা। স্বখাতসলিলের নিচে পলি পড়েছে, তার নিচে ঢাকা আছে ইতিহাস।

    পুণ্যক্ষেত্রে একখানি বাজার বসে। তার নাম কালীতলার বাজার। বছর কয়েক হল লোকে তার নাম দিয়েছে বৌবাজার। অগ্রগতির সম্পাদক তপন মণ্ডল বললেন, এই বাজারে অনেক মহিলারা আসেন কেনাবেচা করতে, সেইজন্যেই লোকের মুখে মুখে এই নাম চালু হয়েছে। টুনির ঘরেও সে ধন আছে।

    যেমন ধর, গড়ডাঙ্গা। গাঁয়ের উত্তর দিকে। জঙ্গলে ঢাকা উঁচু ঢিপি মত জায়গা। তাকে নিয়ে গল্প কত। কেউ বলে এলাকার যে সব লোক নীল চাষ করতে রাজি হত না, তাদের জীয়ন্ত কি মরন্ত অবস্থায় পুঁতে ফেলা হত গড়ডাঙ্গার ঢিপিতে। পাঁচুগোপাল রায় অবশ্য ১৯৭০-৭১ সাল নাগাদ লিখেছিলেন: ১৯৫৪ সালের অনুসন্ধানে এ গ্রামে এক প্রাচীন ঢিপির কথা জানিতে পারি। এ ঢিপি গ্রামের লোকালয়ের বাহিরে মাঠের প্রান্তে অবস্থিত এবং জঙ্গলাকীর্ণ। মূল ঢিপি প্রায় এক বিঘা পরিমিত ভূমি হইবে। স্থানটিকে "গড়ডাঙ্গা' বলা হয়। মনে হয় পূর্বে এ ঢিপির বিস্তৃতি আরও অধিক ছিল। লোকে চাষের কাজে ইহার কিছুটা সমতল করিয়া লইয়াছে। প্রাচীন ব্যক্তিদিগের নিকট শুনিয়াছিলাম মৃতবৎসা স্ত্রীলোকদিগের দোষ প্রতিকারার্থে গ্রহাচার্যগণ ও তান্ত্রিকেরা এখানে নানাবিধ ক্রিয়াকর্মের অনুষ্ঠান করিতেন। দু-একজন প্রাচীন ব্যক্তি নাকি এইরূপ অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করিয়াছিলেন। তবে বর্তমানে এরূপ ক্রিয়াকর্ম কিছুই আর হয় না। এই স্থানে শিশুদিগের করোটি মাটির ভিতর হইতে পাওয়া গিয়াছে। এই পাঁচুবাবুর বক্তব্যটিই মনে হচ্ছে বেশি বিশ্বাসযোগ্য। এই গড়ডাঙ্গার পাশেই বিশাল ফাঁকা জমি। সে জায়গাকে গড়ের মাঠ বলতেই ভালবাসে লোকে।

    বাঁধের উত্তরদিকে খানিক পতিত জলা জমি আর জঙ্গল। ওই দেখুন আমাদের শ্মশান, নিমতলা, গোবিন্দ আঙ্গুল তুলে দেখায় সে দিকে। বিশাল এক বটগাছ চারদিকে ঝুরি নামিয়ে দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের পাশে। ভারি শান্ত, নিরিবিলি। পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু কানে আসে না। শান্তিতে এক ঘুম দেওয়ার মত জায়গা বটে।
  • achintyarup | 59.93.240.231 | ১৩ নভেম্বর ২০১১ ০৫:১২504843
  • আর আছে ধর্মতলা। এ নামটা অবশ্য পুরোনো। তবে ধর্মতলার গল্পে যাওয়ার আগে একটু পাঁচুবাবুর কথা বলতে ইচ্ছে করছে। পাঁচুবাবু মানে পাঁচুগোপাল রায়। গেঁয়ো ইতিহাসের বিষয়ে ভদ্রলোকের বেশ উৎসাহ ছিল। এই কলকাতা-রসপুর এলাকারই মানুষ ছিলেন। দেখা হল না ওঁর সঙ্গে। কয়েক বছর হল ধরাধামের মায়া কাটিয়েছেন শুনলুম। পাঁচুবাবুর পূর্বপুরুষ ছিলেন রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র। কলকাতার পাশের গাঁ রসপুরে ছিল তাঁর নিবাস। শিবায়ন কাব্য প্রণয়ন করে তিনি যারপরনাই খ্যাতি লাভ করেন। ইয়া মোটা সেই কাব্যগ্রন্থের অরিজিনালটি যদ্দূর জানি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রক্ষিত আছে। গ্রন্থটি প্রকাশও করেছেন পরিষদ। রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রের পুত্র ছিলেন জগন্নাথ রায়। বর্ধমানের মহারাজা কৃষ্ণরাম রায় জগন্নাথবাবুকে তাঁদের গৃহদেবতা শ্রী শ্রী রাধাকান্ত জীউর দেবোত্তর সম্পত্তির জন্য কিছু জমি দেন। তার দরুণ একটি সনন্দপত্রও দিয়েছিলেন মহারাজা। সে হল বাংলা ১০৯১ সালের কথা। মানে ইংরিজি ১৬৮৪। মানে জোব চার্নক সাহেব পাকাপাকিভাবে সুতানুটি কলকাতায় আসারও বছর চারেক আগে। কৃষ্ণরামের দলিলে কোন মৌজায় কত জমি দেবোত্তর সম্পত্তি হিসেবে দেওয়া হয়েছিল তার বিস্তারিত উল্লেখ ছিল।

    রষপুর.... ২০
    হাবধাড়া...১০
    তালসহর..১০
    দুর্ব্বচট....৩২
    কলিকাতা..১০
    কুমারিয়া...
    -----------------
    মোট ...৮৫

    কোনো ইউনিট লেখা ছিল না অবশ্য। এই মূল দলিলটি পাঁচুবাবুর কাছে সযত্নে রক্ষিত ছিল বলে শুনেছি। কিন্তু তাঁর বংশধর যাঁরা এখন সেখানে থাকেন তাঁদের এসব বিষয়ে কোনো উৎসাহ নেই বলে শুনেছি।

    আরও সব পুরোনো দলিলে এই কলিকাতা গ্রামের কথা আছে। পাঁচুবাবুর কাছে রক্ষিত আর একটি দলিলের অংশবিশেষ:

    এতদার্থে লিখিয়া দিলাম ইতি শন ১১৬৯। ঊনশত্তর শাল ব তারিখ ১১ আশাঢ়।

    ইসাদি

    শ্রীরুদ্রেশ্বর দাষ মিত্র
    সাং -- রষপুর

    শ্রীপরমেশ্বর ঘোষ
    সাং -- পাইকপাড়া
    প: বালি

    শ্রীনিলাম্বর দাষ মিত্র
    সাং -- রমেপুরা
    হাবিধাড়া

    শ্রীপ্রভুরাম দাস বষু
    সাং -- বজারপুর

    শ্রীখুদিরাম দেয়াশী
    সাং -- কলিকাতা
  • achintyarup | 59.93.247.226 | ১৭ ডিসেম্বর ২০১১ ০৫:৩৮504844
  • পশ্চিমে যদি মুখ করে দাঁড়াও, তাহলে তোমার বাঁদিকে পড়বে নীলকুঠি, আর ডানদিকে সিপিএম-এর পার্টি অফিস। আমতা পূর্ব ৪ নং লোকাল কমিটির আঞ্চলিক কার্যালয়। কলিকাতা, রসপুর, আমতা। দোচালা টিনের ছাউনি ছোট্টখাট্ট অফিসঘর, সামনে একটুকখানি বারান্দা, লাল সিমেণ্টের মেঝে, দেয়ালেও লাল রং। দরজায় তালা।

    পশ্চিম দিকে খানিক এগিয়ে পাহাড়ের মত উঁচু রাস্তার গা বেয়ে নেমে পড়তে হবে ডানদিকে। হোঁচট যদি খেয়েছ কি পা পিছলে যদি পড়েছ, হাঁটু তো ছড়ে যাবেই, পাৎলুনেরও দফারফা হয়ে যেতে পারে। নামতে হবে সাবধানে। তারপর সোজাসুজি সরু পথ ঢুকে গেছে গাঁয়ের ভেতরে। গলায় ঝোলানো ক্যামেরা দেখে অগ্রগতি ক্লাবে কাজ সেরে ফেরা মেয়েটি যদি প্রশ্ন করে, কোথায় যাওয়া হবে গো? কার ছবি তোলা হবে? গোবিন্দ জবাব দেবে, অগ্রগতির মেয়েদের ছবি তোলার জন্য তাদের বাড়ি যাওয়া হবে। কিন্তু বোকা বানাবে কাকে? শানানো গলায় সাথে সাথে জবাব আসবে, আর মিথ্য কথা বলতে হবেনে, অগ্রগতির মেয়েদের ছবি তোলার হলে তো অগ্রগতিতেই তোলা হতো। ধর্মতলায় যাওয়া হচ্ছে সেইটাই বলো না কেন?

    সত্যি কথাই। ধর্মতলাতেই যাওয়া হচ্ছে তো। কবেকার পুরোনো ধর্মমন্দির, একবারের জন্য চোখে দেখার ইচ্ছা।

    ধর্মঠাকুর লৌকিক দেবতা। এ অঞ্চলে বেশ প্রসার ছিল তাঁর এক সময়। সেই কবে, বাংলার ১১৯৩ সালে (মোটামুটি ১৭৮৫ খ্রীষ্টাব্দে), শহর কলকাতায় তখনও হেস্টিংস যুগ চলছে, তখনই পড়শী গাঁ কুমারিয়ায় ছকুরাম পণ্ডিতকে ধর্মঠাকুরের জন্য বাস্তু এবং জমি দান করা হয়েছিল। পুরোনো দলিলে লেখা আছে এসব। এমনই ভরসা ছিল ঠাকুরের ওপর যে দলিল-টলিলে মানুষের বদলে ধর্মঠাকুরকে সাক্ষী রাখা হত। কলকাতা গাঁয়ের জগমোহন খাঁর ১২৪৫ সালের দলিলের ওপর লেখা ছিল ইসাদঁ শ্রীশ্রীধর্ম্মদেবতা। রসপুর গাঁয়ে পাওয়া ১২৫১ সালের এক কর্জপত্রেও লেখা দেখা যায় ইশাদ শ্রীশ্রীঁ ধর্ম্মদেবতা। আর যে মন্দিরখানা দেখতে যাওয়া হচ্ছে, সেইটি তৈরি হয়েছিল বাংলা ১২০৪ সালে। আটচালা গড়নের ছোট মন্দিরটির দরজার বেশ কিছুটা ওপরে পুরোনো কালের বাংলা হরফে লেখা আছে সে কথা। সে লেখা পড়া একটু কঠিন, কিন্তু গবেষক তারাপদ সাঁতরা মশাই তার পাঠোদ্ধার করেছিলেন। মন্দির সংস্কারের চেষ্টায় মাটির ফলকের লেখা খানিক ঢাকা পড়ে গেছে যদিও, তবুও জানা থাকলে পড়া যায়:
    শ্রীশ্রীঁ ধর্ম্মদেবতা মন্দির তৈয়ার হইল সন ১২০৪ সালে শ্রীগয়ারাম
    দেয়াশি মন্দির দেন সাং কলিকাতা শ্রীয়ভয়চরণ মিস্ত্রি সাং থলে।

    তার মানে এ হল অষ্টাদশ শতকের একেবারে শেষের দিকের ব্যাপার।

    শিবায়ন কাব্যের কবি রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্রের বংশধর পাঁচুগোপাল রায়ের কথা আগে লিখেছি না? ১৯৫৪ সাল নাগাদ সুকুমার সেন মশাই পাঁচুবাবুকে কলকাতা গ্রাম এবং সেখানকার ধর্মদেবতার বিষয়ে খোঁজখবর করে দেখতে বলেন। পাঁচুবাবু জানতে পারেন মন্দিরের উপরিভাগে সিংহমূর্তি এবং সংস্কৃত লিপিও ছিল। মন্দির সংস্কারের সময় তাহা নষ্ট হইয়া গিয়াছে।

    মন্দিরের দরজার ঠিক ওপরে দুপাশে দুটি সিংহের ভগ্নাবশেষ কিন্তু এখনও আছে। তাদের গায়ে পঙ্খের প্রলেপও দেখা যায়।

    আজ থেকে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি আগে, পাঁচুবাবু যখন এই মন্দির নিয়ে চর্চা করছিলেন সেই সময়ের কথা ধরা আছে তাঁর লেখায়:
    ধর্মঠাকুরের মন্দিরের মধ্যে ধর্ম, শিব, শীতলা, লক্ষ্মীনারায়ণ ও সিংহবাহিনীও আছেন। ধাতুনির্মিত চতুর্ভুজা সিংহবাহিনীর মূর্তিটি অপহৃত হইয়া গিয়াছে, তৎস্থলে ঘট স্থাপন করিয়া পূজা হইতেছে। ধর্ম কূর্মাকৃতি, ধর্মের নিত্য পূজা হয়। চৈত্র-সংক্রান্তিতে গাজন ছাড়া ধর্মের অন্য কোনও উৎসব হয় না। মন্দির মধ্যে একটি নারায়ণ শিলাও আছে। এই শিলা প্রায় দুই ইঞ্চি পরিমিত চতুষ্কোণ প্রস্তরখণ্ড। ধর্মের পূজারী উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণ এবং সেবাইতদিগের পদবি দেয়াশি। মনে হয় ডোম জাতীয় "পণ্ডিতেরাই' পূর্বে পূজাদি করিতেনকিন্তু উচ্চশ্রেণীর ব্রাহ্মণদিগের প্রভাবে তাঁহারা পূজার অধিকারে বঞ্চিত হইয়াছেন। পূজারী ব্রাহ্মণ ব্যতীত মন্দির মধ্যে কেহ প্রবেশ করিতে পান না। "বাসঘরী' অর্থাৎ যাহারা পূজার বাসন-কোশন পরিষ্কার করে তাহারা বাসনপত্রাদি পরিষ্কার করিয়া বাহিরে রাখিয়া দেয়, পূজারি ব্রাহ্মণ তাহা মন্দিরাভ্যন্তরে লইয়া যান।

    এইসব পড়া ছিল বলে গোবিন্দকে ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করি, ঢোকা যাবে মন্দিরে? সে বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন যাবে না? শুধু জুতোটা নিচে খুলে রেখে যান। দুপুরের রোদে মন্দির তখন তেতে টং। পায়ের তলায় মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে। এক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে দরজা খুলি। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে দেখি ভেতরে ঠান্ডা আঁধারে বিশ্রাম করছেন কেবল নারায়ণশিলা আর একখানা কি দুখানা ঘট। কূর্মাকৃতি ধর্মমূর্তি চোখে পড়ে না।
  • achintyarup | 59.93.241.103 | ১৮ ডিসেম্বর ২০১১ ০৪:১৩504845
  • ধর্মঠাকুরের মন্দিরে দুটি দরজা। একটি পুবে, একটি উত্তরে। কারণ বুঝতে পারি না। পুবের দরজাটি ব্যবহার হয়, উত্তরেরটি বন্ধ থাকে, সেদিকের চাতালও ভেঙ্গেচুরে গড়িয়ে পড়েছে মাটিতে। প্রতিটি দরজার দুপাশে দ্বারপাল মূর্তি। পুবের দ্বারে বাঁদিকের মূর্তিটির কোনো চিহ্ন নেই, তিনকোনা খোঁদলটুকু শুধু চোখে পড়ে। পোড়ামাটির টালিতেও সাজানো হয়নি এ মন্দির। যদিও হাওড়া-হুগলী জেলায় চমৎকার টেরাকোটার কাজওয়ালা মন্দিরের অভাব নেই। তাদের বয়স অবশ্য আরও বেশ কয়েকশ বছর বেশি।

    পুবের দরজা, অর্থাৎ প্রধান দরজার ডানদিকে যে দ্বারপাল, তার চেহারা দেখলে মহিলা বলে বোধ হয়। পীন পয়োধরা ইত্যাদি। কিন্তু কেশ তার আস্কন্ধলম্বিত। আরও অশ্চর্যের বিষয় হল, তার পরনে সাহেবি পোশাক। হাফ-হাতা ফ্রক প্যাটার্নের জামা এবং পাৎলুন। কোমরে কোমরবন্ধ, পায়ে জুতো। মুষ্টিবদ্ধ বাম হাত বুকের কাছে চেপে ধরা, ডান হাতে মুগুর জাতীয় কিছু একটা।

    উত্তরের দরজা, যেখানে সংস্কারের কাজ কম হয়েছে, তার দুই দ্বারপালই তুলনায় অক্ষতদেহ। বামদিকের্টি নারীমূর্তি, ডানদিকেরটি পুরুষ। পুরুষটির চুল লালুপ্রসাদ কাটিং, কোমরে বেল্টের মত জড়িয়ে কিছু একটা বাঁধা আছে, কিন্তু বাকি শরীরে সুতোটি নাই। বাঁ হাত সোজা ঝোলানো, ডান হাত বুকের কাছে রাখা। মহিলাটির সিঁথি করা চুল, মণিবন্ধ এবং বাহুতে গহনা, ঊর্ধ্বাঙ্গে চোলি জাতীয় পোষকের আভাস, নিম্নাঙ্গ সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত, পোষাক স্পষ্ট নয়। এদের কারও হাতেই অস্ত্রশস্ত্র কিছু দেখলাম না।
  • achintyarup | 59.93.243.15 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১১ ০৫:০৭504846
  • রোদে তাতা মন্দিরের চাতাল থেকে নেমে আসি। সামনে খানিক খোলা জায়গা। ছোট মাঠের মত। ন্যাড়া। সেখানেও নাকি বাজার বসে। তবে এখন তার কোনো চিহ্ন নেই। মাঝখানে কিছু ঘুঁটে শুকোতে দেওয়া আছে। গুটি দুই-তিন হলদে পলিথিনের বস্তা পড়ে আচে একধারে। খালি জায়গাটার অন্যদিকে, মন্দিরের ঠিক মুখোমুখি, টালি-ছাওয়া ছোট্ট ক্লাবঘর। কলিকাতা নেতাজী সংঘ। স্থাপিত ১৩৭৮। হলদে রং করা বাড়িটি, দরজা জানালার রং নীল। ক্লাবের বাঁদিকে আরেকটি ঘর। নতুন আলকাতরা-পালিশ টিনের চাল ঘরটির সামনের দিকে বিশাল দরজা, দুপাশে দুটি জানালা। কোনোটিতেই পাল্লা-টাল্লার বালাই নেই। ভেতরে একটি মোটর বাইক দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপচাপ। সামনে বসে লুঙ্গি পরা উদোম-গা একটি বয়স্ক মানুষ বাঁশ ছুলছে কাটারি দিয়ে। তাকে বির্ক্ত না করে ফেরার পথ ধরি। খাড়াই বাঁধের গা বেয়ে উঠতে হাঁপ ধরে যায়।
  • achintyarup | 59.93.195.205 | ১৯ ডিসেম্বর ২০১১ ২৩:১১504847
  • অগ্রগতির তিনতলায় পৌঁছে দেখি মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে খেতে বসেছেন সম্পাদক তপনবাবু। কিসের জানি মিটিং আছে, তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। বললেন, আমাদের ক্যাণ্টিনে দুটি মুখে দিয়ে যাবেন কিন্তু। মেনে নিই। খেতে খেতেই কলকাতা গাঁয়ের নানা গল্প বলেন তপনবাবু। কিছু পড়া, কিছু শোনা, আর কিছু ইয়ে, মানে মনে হয় মনগড়া। সে যাগ্গে। এইভাবেই তো ইতিহাস গড়ে ওঠে।

    বলছিলেন, স্থানীয় এক বামপন্থী কবির উৎসাহে কিভাবে বছর তিরিশ আগে এই এনজিও-র বীজ বপন হয়েছিল। তখনকার গ্রামীণ বুদ্ধিজীবী আড্ডার কথা বলছিলেন। মেদিনীপুর থেকে আসা এক কবির বিষয়ে এক চমৎকার গল্প বললেন। সে গল্পের সাথে এই টইয়ের বিষয়ের বিশেষ কোনো সম্পর্ক নেই যদিও, তবুও সেইটে বলেই ইতি টানব ঠিক করেছি।

    সে নাকি অনেক কাল আগের কথা। যাতায়াতের বেশ অসুবিধা। হাওড়া-আমতা মার্টিন ট্রেন চলত তখন। সে সব দিনেও নাকি আমতা-রসপুর-কলিকাতায় এক কবির সূত্রে বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতেন নানা কবি। আর কি তাদের সব কবিতা। ছিটে গুলির মত মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। বোঝা কঠিন। কিন্তু আধুনিক কবিতা ওরকম না হলে চলে না।

    একজন কবি নাকি আসতেন মেদিনীপুর থেকে। প্রচুর কবিতা লিখতেন। চাকরি-বাকরিতে বিশ্বাস ছিল না। খিটখিটে বৌয়ের কাছে অশেষ গঞ্জনা সহ্য করতে হত। কিন্তু কবিতার জন্য সবই সহ্য করতে রাজি ছিলেন ভদ্রলোক। একদিন নাকি কোনো কবি সম্মেলনের জন্য বাড়ি থেকে বেরোচ্ছেন, এমন সময় ছলোছলো চোখে স্ত্রী বললেন কেমন ছাই কবি তুমি? শোবার ঘরের কোনায় বসে রান্না করতে হয় আমাকে, আমার জন্যে একটা রান্নাঘর পর্যন্ত করে দিতে পারলে না। নোংরা রুমাল দিয়ে স্ত্রীর চোখ মুছে কবি প্রতিজ্ঞা করলেন যে করেই হোক রান্নাঘর তিনি বানিয়ে দেবেনই। বৌকে বললেন, প্রয়োজন হলে নিজের হাতে একটা একটা করে ইঁট যোগাড় করে এনে তোমার রান্নাঘর আমি গড়ে দেব।

    সেই কাল হল। তারপর থেকে যেখানেই পড়ে থাকা ইঁট দেখেন, তুলে নিয়ে কাঁধের লম্বা ঝোলায় পুরে ফেলেন কবি। বাড়ি নিয়ে জড় করে রাখেন। রান্নাঘর হবে। তো, একদিন রসপুর-কলিকাতায় সারারাত কাব্যচর্চা সেরে ভোর ভোর স্টেশনের দিকে রওয়ানা হলেন ভদ্রলোক। চারদিক কুয়াশায় মোড়া। চাদরে গা-মাথা মুড়িয়ে হনহন করে হাঁটছেন। স্টেশন চত্বরে ঢুকতে যাবেন, এমন সময় নজর পড়ল পথের পাশে দুখানা ইঁট পড়ে আছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে ইঁটদুখানা ঝোলায় পুরে ফেললেন। তারপর গুটি গুটি পায়ে প্লাটফর্মে গিয়ে ট্রেনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। টিকিট-ফিকিট কাটা সেকালে বাধ্যতামূলক ছিল না।

    শীতের ভোর। স্টেশনে মাত্র কয়েকটাই লোক। আর সময়টাও খারাপ। চারিদিকে বোমাবাজি, প্রায়ই গুলি চলার, লোক মরার খবর আসে এদিক ওদিক থেকে। পুলিশও বেশ সতর্ক। এখন হয়েছে কি, ওই ভোরেও জনা দুই সাদা পোষকের পুলিশের লোক স্টেশন চত্বরে নজরদারি করছিল। কবিকে দেখেই তাদের মনে সন্দেহের উদয় হয়েছে। উস্কোখুস্কো চুল, রাতজাগা চোখ, কাঁধে ঝোলা, আর তার মধ্যে রয়েছে বেশ ভারী কিছু জিনিস। দুই পুলিশ দুদিক থেকে আস্তে আস্তে এসে একেবারে জড়িয়ে ধরল কবিকে। কবি যত হাঁসফাঁস করেন, যতই বলেন, আরে ছাড়, ছাড়, আমাকে কেন ধরছ? আমি কবি, পুলিশের লোক তাঁর কথাই শোনে না। বলে, অনেক দেখা আছে ওরকম কবি। ঝোলায় করে বোমা নিয়ে ঘুরছে, আবার বলে আমি কবি! চল শালা থানায়, রুলের গুঁতো খেলে আসল কথা বেরোবে পেট থেকে। কবি বলেন, বোমা নয়, নয়, ওগুলো ইঁট। পুলিশ বিশ্বাস করে না। টেনে নিয়ে যায় থানায়। আরও পুলিশেরা আসে। খুব সাবধানে ভদ্রলোকের কাঁধ থেকে ঝোলা খুলে নেওয়া হয়। তারপর ঝোলার ভেতরে নজর করে পুলিশরা সব হাঁ। এই ভোরবেলা এরকম দুটো গাব্দা ইঁট ঝোলায় পুরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে লোকটা? অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে আসল কথাটা কবির পেট থেকে বের করা গেল। বৌকে রান্নাঘর গড়ে দেবেন কথা দিয়েছিলেন বলে এইভাবে ইঁট কুড়িয়ে বেড়াতে হয় ওঁকে। শুনে টুনে পুলিশের লোকগুলো বলল, যা: শালা পাগল। যা, দূর হ এখান থেকে।

    সেদিনের ফার্স্ট ট্রেনটা মিস হয়ে গেল কবির। অবশেষে পরের ট্রেনটা ধরে বাড়ি পৌঁছতে হয়।

    ভাত খেতে খেতে খুব গুছিয়ে গল্পটা বললেন অগ্রগতির সম্পাদক। তারপর বললেন, বললে বিশ্বাস করবেন না অচিন্ত্যদা, এই করে করে ইঁট যোগাড় করে শেষ পর্যন্ত বৌকে নিজের হাতে রান্নাঘরটা বানিয়ে দিয়েছিলেন সেই কবি।

    হাঁ করে শুনি। বিশ্বাস করব কি করব না বুঝে উঠতে পারি না। হলেও হতে পারে। সত্যি যে কোথায় শেষ হয় আর কল্পনা যে কোথায় শুরু হয় সে কথা বোঝা ভারী মুশকিল।

    (ইতি)
  • RATssss | 63.192.82.30 | ২০ ডিসেম্বর ২০১১ ০২:১৩504848
  • সাধু সাধু... জয় হো বাবা অচিন্ত্য... কবির নামটা বললে বেশ হত
  • achintyarup | 115.111.248.6 | ২০ ডিসেম্বর ২০১১ ১৮:০৭504849
  • না:, তার নাম জনিনে। তপনবাবু বলেন নাই।
  • Sumana chakraborty | 11.39.137.126 | ২৭ জানুয়ারি ২০১৬ ১০:৩৭504850
  • অন্য জগতের অন্য গ্রহের ক্থা বুঝি এসব। ণাকি আগের জনমে দেখা।বর চেনা লাগল
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন