এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • বেবী বিন্দিয়া সুক্রোজ 

    Suvasri Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১৯৩ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ধরা যাক, নাম তার বিন্দিয়া তবে সে মোটেই ভারতীয় নয়। খাস সাদা সাহেব আমেরিকান বাবা ও ব্রিটিশ মায়ের সন্তান। সে নেহাৎ বেবীও নয় এখন। তার বাবা-মায়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের এপ্রিলে তার জন্ম। তার সৎ দাদা, বাবার আগের পক্ষের বড় ছেলে তার থেকে পনেরো বছরের বড়।

    বাবা, মা ও সৎ দাদার সঙ্গে সে ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার দক্ষিণ দিকের একটি রাজ্যে থাকে। তবে সম্ভবত এখন তার সৎ দাদা তাদের সঙ্গে থাকে না। প্রথম বিশ্বের নিয়ম অনুযায়ী আলাদা থাকে।

    তার নাম বিন্দিয়া কারণ এমন নাম দেওয়া হ'লে তাঁদের মেয়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশের সংস্কৃতি সম্বন্ধে আগ্রহী হয়ে উঠবে। তাছাড়া এই নাম নাকি তাকে বিদেশ ভ্রমণেও উৎসুক করে তুলবে। বাচ্চাটার মা এ সব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, বিন্দিয়া বড় হয়ে যেন সমাজের সেবা করে, পরোপকার করার জন্য দিন রাত এক করে দেয়। প্রশংসার বন্যায় ভিডিওগুলো ভেসে যায়। 

    বিন্দিয়া ও তার সৎ দাদা পরস্পরকে ভীষণ ভালোবাসে। সৎ মা আগের পক্ষের ছেলেকে নিজের সন্তানের মতো দেখেন। সৎ মা ও সৎ ছেলের মতো সম্পর্ক নয় তাঁদের মধ্যে। পরিবারের প্রত্যেকে পরস্পরকে মাত্রা ছাড়া ভালোবাসে, কখনো পরস্পরের ওপর তাদের রাগ হয় না। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করে, তাঁদের পরিবার চারটে প্লাস্টিকের পুতুল দিয়ে গঠিত নাকি আসল মানুষের পরিবার!

    বেবী বিন্দিয়ার বাবা-মা নিজেরাই বলেন, তাঁদের মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শিশু। কী জানি! তার জন্মের পর থেকে এখনো অবধি শত শত ভিডিও ভিউটিউবে পোস্ট করে চলেছেন তাঁরা। গাবলুগুবলু একটা বাচ্চা মেয়ে হামাগুড়ি দিচ্ছে, টলতে টলতে হেঁটে আসছে, খেলছে, স্যান্টা ক্লজের কাছে প্রার্থনা করছে, তার ব্রি'র (একদম ছোটবেলায় ব্রাদার বলতে পারত না, এখনো আগের মতো ব্রি বলে) জন্য ফলের রস এনে দিচ্ছে, ছবি আঁকছে, ইংল্যান্ডবাসিনী দিদিমা গ্র্যানি লিজি বা গ্র্যানি এল-এর পাঠানো দামী দামী সব খেলনা, উপহার, জামাকাপড় বাক্স খুলে দুনিয়াকে দেখাচ্ছে, এমন সব ভিডিও। সেই সব ভিডিওর নিচে হাজার হাজার লাইক ও প্রশংসাসূচক মন্তব্য।

    একেক জন ভারতীয় আবার স্পষ্ট ভাষায় বেবী বিন্দিয়া'র ভিডিওর নিচে মন্তব্য করেন, "এই সব ভিডিও দেখার পর ভারতবর্ষের শিশুদের দিকে তাকাতে ইচ্ছা করে না। আমি ইউরোপিয়ান মেয়ে বিয়ে করবই করব যাতে আমার বাচ্চাগুলো এরকম ফর্সা, নীলচোখো হয়, এরকম স্বাস্থ্যবান হয়।" নিজের দেশের শিশুদের এই লোকটি কত সহজে কুৎসিত বলছে। এরা নিশ্চয় নিজেদের চেহারাগুলোকেও ঘেন্না করে। আরে আমাদের জিন যেরকম, আমাদের শিশুরা তো সেরকমই দেখতে হ'বে!

    বিন্দিয়ার মা নিজেই বলেন, তাদের ভিডিও আপলোড করার উদ্দেশ্য হ'ল তাঁদের সন্তানের বড় হয়ে ওঠার অসাধারণ মুহূর্তগুলো দুনিয়ার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। নিজেই তিনি স্বীকার করেন, ভিউটিউব তাঁদের টাকাও দেয়। 

    বিন্দিয়ার প্রতিটি ভিডিওতে তাকে খালি হাসতে, কচি কচি গলায় গান গাইতে, খেলতে এবং বাবা, মা ও সৎ দাদার সঙ্গে আনন্দ করতে দেখা যায়। অবশ্য কখনো কখনো সার্কাসে গিয়ে অদ্ভুত সব কারসাজি লক্ষ্য করতে এবং হাসিমুখে সাদা শুয়োরছানার গায়ে হাত বুলোতেও দেখা যায়। 

    কিন্তু একটি শিশু সব সময় হাসে, ফূর্তিতে লাফায় আর আনন্দে থাকে, এমন তো নয়। আনন্দ ভালোবাসার পাশাপাশি শিশুরা কখনো কখনো বিষণ্ণ হয়, এটাও বাস্তব। যে কোনো ভিডিও থেকে বিন্দিয়া'র কান্নাকাটি, রাগ করা বা ভুরু কোঁচকানোর জায়গাগুলো নিশ্চয় সুকৌশলে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। সুক্রোজ বলে কথা! পৃথিবী তাঁদের মেয়ে বিন্দিয়া'র হাসিহাসি রূপটাই দেখুক। ভিডিওগুলোর ভিউয়ারশিপ বাড়ুক। ভিউটিউব থেকে তাঁরা আরো আরো ডলার পেতে থাকুন। 

    বেবী বিন্দিয়ার ভিডিওগুলো বকলমে প্রথম বিশ্বের সুখী পরিবারের বিজ্ঞাপন, Advertisement of happiness! বিন্দিয়ার বাবা ও মা তাকে একটি হাসবার যন্ত্র বা Smiling Machine বলে প্রোজেক্ট করতে চান। উদ্দেশ্য অর্থ কামানো, হায়, অর্থ কামানো! ভিউটিউব অর্থ না দিলে তাঁরা মেয়ের অত অত ভিডিও সেখানে আপলোড করতেন কীনা সন্দেহ! অর্থ আসছে, অতএব বিক্রি হয়ে যাক একান্ত পারিবারিক মুহূর্তগুলো। 

    ধন্য মার্কিন ব্যবসাবুদ্ধি! সন্তান বিক্রি করা অনৈতিক কাজ কিন্তু তার অসংখ্য ভিডিও গোটা পৃথিবীকে দেখিয়ে প্রচুর অর্থ রোজগার করা অনৈতিক নয়। "দর্শকেরা আমাদের সন্তানের ভিডিও দেখতে পছন্দ করে, নতুন নতুন ভিডিও আপলোড করার জন্য ক্রমাগত অনুরোধ আসে। তাই নিয়ে এলাম বিন্দিয়ার আরেকটা ভিডিও। দেখুন, লাইক করুন এবং যত পারেন শেয়ার করুন। আর হ্যাঁ, আমাদের চ্যানেলটাকে সাবস্ক্রাইব ও পাশে থাকা বেল আইকনটিতে ক্লিক করতে ভুলবেন না।"

    সাদা, কালো, হলুদ কোনো শিশুর প্রতি আমার স্নেহের কোনো অভাব নেই। হ'বেও না কোনো দিন। তাদের ভিডিও দেখতেও আপত্তি নেই। কিন্তু অর্থ রোজগার করার জন্য সন্তানের অজস্র ভিডিও আপলোড করার প্রবণতা আমার ভালো লাগে না। এ সব কথা বলি, হয়তো বা অপ্রিয় হয়ে যাই। তবুও বলে ফেলি আর কী!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৯:০৪530568
  • এই কারণে ভারতেরও ডেলি ভ্লগ ইউটিউবারদের মোটে ভালো লাগে না। সবাই বাচ্চাদের কিউটনেস বেচে পয়সা কামানোর চেষ্টায় নেমেছে। এছাড়া যাদের বাচ্চা নেই বা বড় হয়ে গেছে সেইসব ইউটিউবারদের অধিকাংশও একটা প্লাস্টিক পরিবারের চিত্র তুলে ধরে পয়সা কামাচ্ছে। একেবারেই ফালতু ভিডিও সব।
  • প্রতাপ | 2409:40e0:24:89f3:8000:: | ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১১:১০530639
  • হ্যাঁ, এরকম এখন হামেশাই হচ্ছে মনে হয়
  • Rouhin Banerjee | ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৪০530664
  • ভারতীয় ভদ্রলোকটির মন্তব্য প্রসঙ্গে আমার অন্যতম প্রিয় কবি প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কবিতা মনে পড়ে গেল -
     
    গ্ল্যাক্সো বেবি
    প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় 
    ---------
    হামাগুড়ি দিয়ে এসো, টলোমলো পায়ে ছুটে এসো বেবী 
    গ্ল্যাক্সো বেবী, উড়ে এসো, আমাদের কোলে এসো 
    ফুল হয়ে এসো বেবী, মনোবাঞ্ছা হয়ে ফুটে ওঠো বেবী 
    সাহেব বাচ্চার মতো ফর্সা পোঁদ, ফর্সা নুঙ্কু দুলিয়ে হৈ হৈ করে 
    গরীবের ঘরে এসে পড়ো 
    আমাদের বাচ্চা বড়ো কালো হয়, 
    ধূপকাঠির মতো সরু হাত পা, আলুর মতো মাথা 
    নায়েগ্রাপ্রপাতের মতো নাক থেকে শুধু সিগ্নী ঝরে 
    বড় ছোটবেলা থেকে নয়া পয়সা চিনতে শিখে যায় 
    আমাদের বাচ্চারা জানো বেবী নয়, 
    কান্না ছাড়া ভাবপ্রকাশের অন্য কোনো পদ্ধতি জানেনা 
    ইচ্ছে করে, শুয়োরের বাচ্চাদের দিই পেটে পা ঢুকিয়ে 
    তারপর তোমাকে প্রার্থনা করি 
    এসো বেবী স্বপ্ন থেকে উঠে এসো 
    হাওয়া হয়ে ছুঁয়ে যাও, মেঘ হয়ে ভেসে এসো 
    বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ো বেবী 
    আমার বৌ-এর কোলে, একমাত্র হয়ে ঝরে পড়ো…
  • Subhas Ghosal | 2405:201:403a:4041:1c61:11a9:c048:3a7f | ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:১৪531049
  • সহমত আমি  তোমার মতামত  এর songe পুরোপুরি. ভালো লাগলো পরে tomar লেখা, বিষয় টা সুন্দর বেছে নিয়েছো  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ মতামত দিন