এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গল্প | নদী হারিয়ে যায়, মানুষও 

    Rahul Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১০৪ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • অত রাতে গৌতমদা-র ফোন আসতে দেখে, একটু চমকে গিয়েছিল মনসিজ। গৌতম দাশগুপ্ত ওদের সিনিয়র সাব-এডিটর। কোনো ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্টকে তাঁর সরাসরি ফোন করার কথা নয়। মনসিজের মতো রিপোর্টারদের পাঠানো কত খবরই তো বিভিন্ন জেলা থেকে পৌঁছয়। সে-সব খবরকে কাটাছেঁড়ার টেবিল পার হয়ে, তাঁর মতো লোকেদের সম্মতি নিতে হয়। তারপরে মুদ্রিত অক্ষরের স্পর্শ। আর অধিকাংশই হারিয়ে যায় বাতিল খবরের ঝুড়িতে। তবে উনি অমায়িক মানুষ। হেড-অফিসে মাঝেমধ্যেই যেতে হওয়ার সূত্রে, তাঁর সঙ্গে মনসিজের পরিচয়টা বেশ ভালোই আছে। প্রথম আলাপে 'স্যার' সম্বোধন করেছিল বলে, থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন— আরে স্যার-ট্যার না! আমাকে গৌতমদা বলে ডাকবে।
    কিন্তু এমন ওজনদার লোকের হঠাৎ মনসিজকে ফোন করার মানেটা কী? ফোনটা ধরতেই উনি বললেন— তোমাদের ওখানে শিয়ালমারি নামে কোনো গ্রাম আছে? — শিয়ালমারি? ওই নামে একটা নদীর কথা জানি, দাদা। বর্ডারের কাছাকাছি। বর্ডারে গিয়ে কিছু কাজ করলেও, ঠিক ওইদিকটায় আমাকে কখনও যেতে হয়নি। কিন্তু ওই নামে কোনো গ্রামের কথা তো জানি না!
    — নদীটার আশপাশেই কোথাও হবে তাহলে। শোনো, তুমি কালকে সকালেই ওখানে চলে যাও। দুলাল দাস নামে একটা লোক গত পরশু কলকাতায় একটা মোবাইল ফোন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তারপর শুরু হয় ব্যাপক গণধোলাই। পুলিশ এসে উদ্ধার করতে-করতেই সব শেষ! বাঁচানো যায়নি। তো, সেই দুলালের বাড়ি নাকি ওই গ্রামে। সেটা পুলিশ ঠিক খুঁজে বের করেছে। তুমি ওখানে গিয়ে ওর বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করো। একটা হিউম্যান অ্যাঙ্গেল রেখে স্টোরিটা করবে। ছবি নেবে। তোমার ওই ফটোগ্রাফার ছেলেটা, কী যেন নাম?
    — ওর নাম প্রদ্যোত।
    — হ্যাঁ, প্রদ্যোতকেও সঙ্গে নিয়ে নাও। তোমাদের সব খরচ বিল করে পাঠিয়ে দিও, অফিস পে করে দেবে।গৌতমদা-কে আশ্বস্ত করেই, প্রদ্যোতকে ফোন করলো মনসিজ। সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বেরোতে হবে। এলাকাটা যে একদম অজানা, তা নয়। সম্ভবত রানিনগর দুই নম্বর ব্লকের মধ্যে পড়ছে। জেলার সদর-শহর থেকে ৩৪-৩৫ কিলোমিটার। খুব দূরে নয়। কিন্তু ফিরে এসেই কপি রেডি করে হেড-অফিসে মেইল করতে হবে। গৌতমদা-র নির্দেশ, আগামীকাল রাতের মধ্যে লেখা ও ছবি পৌঁছনো চাই।
    ■■
    রাতে ভালো করে ঘুম হলো না মনসিজের। সত্যি বলতে কী, গৌতমদা-র ফোন পেয়ে রীতিমতো এক্সাইটেড হয়ে আছে সে। তাঁর মতো সিনিয়র র‍্যাঙ্কের লোকেদের কাছ থেকে ওদের লেভেলে সরাসরি কোনো অ্যাসাইনমেন্ট সাধারণত আসে না। তবু্ও উনি অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছেন এবং একথাও বলেছেন যে, লেখাটা 'বাই নেম' ছাপা হবে। এটাও উত্তেজনার একটা বড়ো কারণ। যারা জেলা-মফস্বল থেকে কাজ করে, তাদের নিউজ যতই কাগজে আসুক, নিজের নাম দেখতে পাওয়াটা লটারি পাওয়ার মতো ব্যাপার। প্রায় সব লেখাই তো 'জেলা সংবাদদাতা' নামে ছাপা হয়। কোনো-কোনো সময় আবার ডেটলাইন ছাড়া কিছুই থাকে না! ফটো-জার্নালিস্টদের ভাগ্যও তথৈবচ। নিজের তোলা ছবি 'নিজস্ব চিত্র' নামে ছাপা হতে দেখাটাই তাদের অভ্যাস। অনেকদিন ধরে শোনা যাচ্ছে, ওদের কাগজ নাকি আলাদা করে জেলার পাতা করবে। তখন ওদের করা সব খবর আর ছবি 'বাই নেম' ছাপা হবে। কিন্তু সে তো শোনাই যাচ্ছে শুধু; হচ্ছে আর কই! তাছাড়াও চিন্তা করে দেখলে বোঝা যায়, জেলার পাতা তো শুধু নিজের-নিজের জেলায় সার্কুলেট হবে। অর্থাৎ তোমার বাই নেম আর্টিকল শুধু তোমার জেলার লোকেরাই পড়বে। জেনারেল পেজে ছাপা হলে, সব পাঠক যেমন পড়তে পারে, তেমনটা তো হবে না! এই যেখানে অবস্থা, সেখানে এমন সুযোগ পেলে একটু এক্সাইটমেন্ট কি স্বাভাবিক নয়?
     
    সকাল-সকাল বেরোনোর ফলে, বেলা বাড়ার আগেই ওরা পৌঁছে গিয়েছে দুলাল দাসের গ্রামে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, যাকেই দুলালের বাড়ি জিজ্ঞেস করা হয়, সে-ই ওদের এড়িয়ে যায়! কেউ পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে, যেন শুনতেই পায়নি! কেউ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে, যেন প্রশ্নটা তার বোধগম্যই হয়নি! প্রদ্যোত বলে, এরা কি আমাদের পুলিশের লোক ভাবছে নাকি? এত ভয় পাওয়ার কী আছে!
    শেষমেশ রাস্তার ধারে একটা মুদিখানার দোকান দেখতে পেয়ে, তার সামনে দাঁড়ায় ওরা। রঙচঙে লজেন্স থেকে আলু-পেঁয়াজ পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই চোখে পড়ে। গ্রামের মুদিখানা যেমন হয় আর কী!
    মনসিজ সেই দোকানদারকে প্রশ্ন করে— দুলাল দাসের বাড়িটা কোনদিকে, একটু বলতে পারবেন?
    মাঝবয়সী লোকটি বেশ কিছুক্ষণ ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রদ্যোতের ক্যামেরার দিকেও। কিন্তু কোনো কথা বলে না! কিছুটা সময় এইরকম অস্বস্তিকরভাবে কেটে যাওয়ার পরে, ওরা আবার একই প্রশ্ন করে।
    অবশেষে অনেকটা যেন বাধ্য হয়েই লোকটি বাইরে আসে। সামনের পাঁচ-ছয়টি বাড়ির পরে বাঁদিকে যে-পথটা বেঁকে গিয়েছে, সেইদিকে আঙুল তুলে বলে— ওই রাস্তায়।
    ওরা সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। এবার বুঝতে পারে, আশপাশের সব লোক ওদের কৌতূহলের দৃষ্টিতে দেখছে। কয়েকটি বাচ্চা ছেলে পিছুও নিয়েছে বোধহয়। বাঁদিকের রাস্তায় বাঁক নেওয়ার মুহূর্তে তাদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বড়ো একজন একটু এগিয়ে এসে বলে— উয়াদের বাড়িতে কেউ নাই।
    কথাটা শুনে একটু থমকে যায় ওরা। আবার বাচ্চাদের কথায় কান দেওয়ার কোনো মানে হয় না ভেবে, হাঁটতে থাকে। ওদের পিছনে ছেলেগুলোও হাঁটে। আর একটু পরে একটা মাটির বাড়ির সামনে এসে জানায়— এই বাড়িটা।
    ওরা একটা ছোট্ট মাটির বাড়ি দ্যাখে। তার মাথায় টালির ঢালু ছাদ। সামনের সরু দাওয়া পেরিয়েই ঘরে ঢোকার দরজা, এবং দুইপাল্লার সেই বন্ধ দরজায় একটা জীর্ণ তালা ঝুলতে দ্যাখে। দুইপাশের ছোটো-ছোটো জানলাদুটোও ভিতর থেকে আটকানো। দেখেই যেন মনে হচ্ছে, দূরে কোথাও বেশ অনেকদিনের জন্য যাওয়ার উদ্দেশ্যেই এই বাড়ির বাসিন্দারা বেরিয়েছে। অথবা কে বলতে পারে, তারা আর কখনও এই বাড়িতে ফিরবে কিনা!

    খুব হতাশ লাগছিল মনসিজের। গণধোলাইয়ে মৃত্যুর খবরটা আরও অজস্র খবরের ভিড়েও তার নজরে পড়েছিল। যদিও খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু অ্যাসাইনমেন্ট যখন পেল, তখন থেকেই লেখাটা নিয়ে অনেক ভাবনাচিন্তা করে ফেলেছে সে। গৌতমদা লেখার মধ্যে মানবিক দিকটাকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। সত্যিই তো তাই। দুলাল দাস তো নেহাতই একটা মোবাইল ফোন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। তার জন্য মানুষ তাকে পিটিয়ে মেরেই ফেলবে! বিশ্বজুড়ে যে কত চুরি, দেশজুড়ে কত চুরি, আর আমাদের পশ্চিমবঙ্গে তো শুধু চুরি আর চুরি! চাকরি চুরি, ত্রাণ চুরি, চাল চুরি, বালি পাচার, কয়লা পাচার, গরু পাচার, একশো দিনের কাজের টাকা চুরি...এ যেন এক অন্তহীন তালিকা! মানুষ এইসব ঠেকাতে পারে না। এইসব চোর-ডাকাতদের শাস্তি দিতে পারে না। মানুষের যত আক্রোশ যেন শুধু ছিঁচকে চোরদের উপরে! কিন্তু কেন একটা মানুষ ছিঁচকে চোর হতে বাধ্য হয়? নিশ্চয়ই তার অন্য কোনো উপায় ছিল না। নিশ্চয়ই তার কোনো কাজ ছিল না। এইভাবে দুলালের আর্থিক অনটন ও সামাজিক বঞ্চনাকে প্রাধান্য দিয়ে লেখাটা সাজাবে, এমনই ভেবে রেখেছে সে। কিন্তু সবার আগে দরকার দুলালের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কথা বলা। সেটাই না-হলে, লেখাটা হবে কী করে! যা বোঝা যাচ্ছে, গ্রামের লোকদের কাছ থেকেও বিশেষ কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না। কারণ, এতক্ষণেও দুলাল দাসের বাড়িতে গতকাল থেকে কোনো লোক নেই, তারা কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না, কবে আসবে তাও কেউ জানে না—এর থেকে বেশি আর কিছুই শুনতে পায়নি ওরা! তাহলে? অনেকটা যেন অসহায় হয়েই প্রদ্যোতের দিকে প্রশ্নসূচক তাকায় মনসিজ।
    প্রদ্যোত বললো— মনসিজদা, চলো একটা চায়ের দোকান খুঁজি। আগে চা খাই। তারপরে কিছু একটা ঠিক করা যাবে।
    ★★★
    চা-দোকান অবশ্য বেশি খুঁজতে হলো না। একটু সামনে এগিয়েই পাকা রাস্তা। পাকা ঘরবাড়িও এইদিকটায় বেশি। রাস্তার দুইপাশে বাজারের মতো। বেশকিছু দোকানপাট। তাদের মধ্যে ফাঁকা দেখে একটাতে বসা গেল। দোকানদার বয়স্ক মানুষ। প্রদ্যোত তাঁকে বললো— কাকা, দুটো চা বানাবেন। ভালো বিস্কুট আছে? মনসিজের অবশ্য কিছু খাওয়ার দিকে মন নেই। লেখাটা কীভাবে নামাবে, সেই চিন্তায় ডুবে আছে সে। নেহাত অভ্যাসের বশে চা খাবে, আর নেশার বশে সিগারেট।
    দোকানদার খুব মন দিয়ে চা বানাচ্ছিল। হঠাৎ মাথা তুলে বললো— বহরমপুর থেকে আসছেন? কোন পেপার?
    এই প্রশ্ন মনসিজকে সচকিত করে তুললো। আর প্রদ্যোত ওই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পাশাপাশি নানারকম গল্প জুড়ে দিল। বিরক্ত হলো মনসিজ। ভাবলো, এত খেজুরে আলাপের দরকার কী! আমি মরছি লেখাটার চিন্তায়, আর এই ব্যাটা আড্ডা দিতে বসেছে! প্রদ্যোতের বকবকানি থামানোর জন্যই সে বৃদ্ধকে প্রশ্ন করলো— আপনাদের এখানে একটা নদী আছে না? শিয়ালমারি?
    বৃদ্ধ কিছুক্ষণ থমকালো। তারপরে মৃদু হেসে বললো— নদী তো আর নাই!
    এবার মনসিজের অবাক হওয়ার পালা— নদী আর নেই মানে?
    — মানে, আগে ছিল। এখন আর নাই।
    বয়স্ক লোকটির শহুরে ভাষায় কথা বলার চেষ্টা খেয়াল করে মনসিজ। গ্রাম্য টান আছে একটু, কিন্তু কথা বলার ধরনটা শহরের লোকেদের মতো।
    কিন্তু কী করে হলো এমন? এই প্রশ্ন করার আগেই সে দেখলো, লোকটা স্মৃতির গভীরে ডুব দিয়েছে এবং অনুচ্চস্বরে বলছে— বয়স তো আমাদের কম হলো না, বাবারা! শিয়ালমারির আসল চেহারা ছোটোকাল থেকে আমরা দেখেছি। পদ্মার জলা থেকে বের হয়ে আসা নদী। তখন কত পানি তার শরীলে! বড়ো-বড়ো নৌকা যেত, ইস্টিমার যেত এই পথে। দেশ ভেঙে যাওয়ার আগে এইদিকে কলকাতা যেত, ওইদিকে রাজশাহী। তারপর তো পদ্মা সরে গেল। নদীর পানি কমলো, তার ঢেউ কমলো। আর নদীকে দখল করলো মানুষ!
    — কেমন করে?
    — কেমন আর! মাটি ফেলে, ঘর তুলে, রাস্তা বানিয়ে!
    — বলেন কী!
    — হ্যাঁ, দেখে আসেন না। দেখলেই বুঝে যাবেন। এই তো কাছেই।
    হাত তুলে দিকনির্দেশ করে ওয়াসিম বারি। ও হ্যাঁ, বৃদ্ধের নাম ওয়াসিম বারি মণ্ডল। তাঁর সঙ্গে প্রদ্যোতের খেজুরে আলাপের মধ্যে এইটুকুই মনে রাখার মতো লেগেছিল মনসিজের! আসলে, মানুষের নাম বিষয়টাই খুব গুরুত্বপূর্ণ। হ্যাঁ, নদীটাকে দেখতে যাওয়া দরকার। দুলাল দাসের স্টোরি করতে এসে, অন্য খবরের গন্ধ তাড়া করতে থাকে মনসিজকে। সে প্রদ্যোতকে বলে— প্রদ্যোত, চল। মনে হচ্ছে, ছবি তোলার অনেক সাবজেক্ট পেয়ে যাবি।
    — ছবি আমি আগেই তুলতে শুরু করেছি, মনসিজদা। দুলালের বাড়ির তিন-চারটে স্ন্যাপ নেওয়া আছে। যদি তোমার কাজে লাগে!
    — হ্যাঁ, গৌতমদাকে অন্তত দেখানো তো যাবে যে, আমরা চেষ্টা করেছিলাম!
    বারি মণ্ডলের নির্দেশিত রাস্তায় ততক্ষণে ওরা নদীর ধারে। অবশ্য যদি তাকে এখনও একটা নদী বলা যায়! বাস্তবে এটা এখন একটা নালার মতো সংকীর্ণ। অথচ কোনোকালে নদী যে ছিল, তা বোঝা যায় তার খাত দেখে। এঁকেবেঁকে চলে যাওয়া নদীখাতে যতদূর চোখ যায়, বেশ কিছু পায়ে-চলা পথ। বাঁশ দিয়ে বেড়া তুলে, জায়গায়-জায়গায় পুকুরের মতো জল রেখে দেওয়া। দেখলেই বোঝা যায়, মাছ চাষ করা হয় সেখানে। নদীখাতের মধ্যেই মাটি ফেলে উঁচু করা জমিতে কিছু ঘরবাড়ি। পছন্দমতো অজস্র বিষয় পেয়ে প্রদ্যোত ছবি তুলতে শুরু করেছে। আর মনসিজ নদীর ফেলে যাওয়া ঢাল বেয়ে কিছুটা নেমে এইসব দেখতে-দেখতে ভাবছে, মানুষের লোভের বোধহয় সত্যিই কোনো সীমানা নেই!
    — প্রকৃতি কখনও ক্ষমা করবে ভেবেছেন? 
    একটা চেনা গলা পিছন থেকে আসতে শুনে, মুখ ঘুরিয়ে তাকায় সে। আরে, এ যে তপন সরকার! 'নদী ও জলাভূমি বাঁচাও কমিটি'-র সক্রিয় মুখ। জেলাসদরে এদের বিভিন্ন প্রোগ্রামে প্রায়ই বক্তব্য রাখতে দেখা যায়। সেই সূত্রে ভালোই পরিচিত।
    — আপনি এখানে? কোনো প্রচার বা ডেপুটেশন আছে নাকি?
    নদীখাতের দিকে নামতে-নামতে তপন বললো— নাঃ, এখানে কিছু নেই। তবে সেরকম একটা প্ল্যানিং করতেই ডোমকল গিয়েছিলাম। ওখান থেকেই এখানে।
    মনসিজ বুঝলো, তপন সরকার কাছের মহকুমা-শহরে থেকে আসছে। শিয়ালমারি তো ওইদিকেও গিয়েছে। এই নদী যে ডোমকল হয়ে গিয়ে জলঙ্গী নদীর সঙ্গে মিশেছে, এটা ডিস্ট্রিক্ট ম্যাপে কালকে রাতেই দেখেছে সে।
    তপন পাশে দাঁড়িয়ে বললো— কী অবস্থা করেছে, দেখেছেন? জানেন, এখানে এককালে ফেরিঘাট ছিল! লোকজন মাটি ফেলে-ফেলে এর উপর রাস্তা করেছে। কিন্তু পঞ্চায়েত তাদের বাধা না-দিয়ে, সেই রাস্তা আবার ইট ফেলে সেই রাস্তা বাঁধিয়ে দিয়েছে; ভাবতে পারেন! আমরা তো অনেকদিন ধরে বলে-বলে কারও হুঁশ ফেরাতে পারছি না! তবু ভালো, আপনারা নিউজ করতে এসেছেন। এবার যদি প্রশাসন একটু নড়েচড়ে বসে!
    — আমরা আসলে এসেছিলাম অন্য একটা কাজে। কিন্তু কারও সঙ্গে কথাই বলতে পারলাম না! তারপর চায়ের দোকানে বসে এই নদীটার অবস্থা জানতে পারলাম। ভাবলাম, একদম খালিহাতে ফিরে যাবো? নদীটা কভার করে যাই।
    — দুলাল দাস?
    তপনের দিকে চমকে তাকালো মনসিজ— আপনি জানেন?
    — জানবো না কেন! এখানে তো কমদিন আসছি না! এখানকার যে দু-চারটে লোককে আমরা শিয়ালমারি বাঁচানোর কাজে কনভিন্স করতে পেরেছিলাম, তাদের মধ্যে দুলাল একজন। অল্প সময়ের মধ্যে খুব অ্যাকটিভ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু খুব রগচটা ছেলে। তাই এখানকার নেতাদের চামচাবাহিনীর সঙ্গে প্রায়ই ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তো। ওরাই একটা চুরির ঘটনায় অন্যায়ভাবে জড়িয়ে দিয়ে ওকে গ্রামছাড়া করেছিল। ছেলেটা এমনিতে দিনমজুরি করতো। চাষের সময়ে লোকের জমিতেও খাটতো। গরিব পরিবার। এমন লোককেই তো ফাঁসানো সহজ, তাই না?
    — ও আচ্ছা...এইবার বোঝা গেল, এখানে কেউ ওর সম্বন্ধে কেন মুখ খুলছে না!
    — গ্রাম্য পলিটিক্স খুব নোংরা জিনিস, ভাই! বোঝেনই তো! কিন্তু দুলাল যে কী করে কলকাতায় গিয়ে চুরিচামারিতে হাত পাকালো, সেটা বুঝতে পারছি না!
    — ওর বাড়ির লোকেদের যদি পাওয়া যেত, তাহলেও একটা ধারণা করা যেত। ওরা কি দুলালের বডি আনতে কলকাতা গিয়েছে?
    — দুলালের বাড়ির লোক বলতে তো বুড়ো বাপ-মা, বউ আর দুটো বাচ্চা। একটা বছর পাঁচেকের ছেলে, একটা তিনবছরের মেয়ে। না-না, কলকাতা গিয়ে বডি আনার মতো অবস্থা ওদের নেই। লোকাল থানা থেকে খবর দেওয়ার পরেও ওরা নাকি এইকথাই বলেছিল। ওরা হয়তো কোথাও চলে গিয়েছে। পালিয়ে গিয়েছে বলাই ভালো! এমনিতেই দুলাল গ্রামছাড়া হওয়ার পরে, লোকের কটূক্তি শুনে ওরা খুব কোনঠাসা হয়ে থাকতো। সেই দুলাল শেষে চুরি করতে গিয়েই গণপ্রহারে মারা গেল; এরপরে হয়তো ওদের এখানে থাকাই মুশকিল হয়ে যেত!
    — গ্রামছাড়া হওয়ার পরে, আপনাদের সঙ্গে ওর আর যোগাযোগ হয়নি?
    — তারপরে কয়েকবার রাতের অন্ধকারে বাড়ি আসা ছাড়া, দুলাল আর এই গ্রামে ঢোকেনি। আমরা যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও, পারিনি। শুধু শুনেছি, বাড়িতে নাকি বলে গিয়েছিল, চোর বদনাম নিয়ে যখন ওকে ঘর ছাড়তে হয়েছে তখন চুরি করেই সে টাকাপয়সা কামাবে!
    ★★★
    এই কথোপকথনের ঘন্টাখানেক পরে ফিরছে প্রদ্যোত আর মনসিজ। তপন সরকার ওদের সঙ্গে ফিরলো না। ওখানে কিছু কাজ আছে বলে, তড়িঘড়ি বাজারের দিকে এগিয়ে গেল। মনসিজের মুখে আপাতত কোনো কথা আসছে না। গল্পবাগীশ প্রদ্যোত পর্যন্ত চুপ করে আছে। লেখাটা কীভাবে দাঁড় করাবে, সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না মনসিজ। দুলাল দাসের চোর হয়ে ওঠাকে হাইলাইট করবে, নাকি শিয়ালমারি নদীর মরে যাওয়াকে? সাংবাদিকতা করতে এসে, এইরকম সিদ্ধান্তহীনতায় কখনও ভোগেনি সে! ওর মাথার মধ্যে শুধু কয়েকটা শব্দ ঘুরেফিরে আসছে— নদী হারিয়ে যায়, মানুষও!
     
    ( প্রথম প্রকাশ : শব্দের মিছিল, জুন ২০২৩)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন