এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • একটি পতনের খোলনলচে

    প্যালারাম লেখকের গ্রাহক হোন
    ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ২৬৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)

  • উত্তরপাড়া সঙ্গীতচক্র থেকে ভোরের দিকে বেরিয়ে আপনার জগিং-উদ্দেশী বন্ধুকে ফোন করে হয়তো বললেন, প্রায় ঘুমন্ত আপনাকেও কেমন কৌশিকীর শেষ ভজনটা জাগিয়ে তুলেছিল। উত্তরে সে ধরুন বললো, "কেমন গাইলো রে? একটু গেয়ে শোনা তো? নিদেন একটু কথা বলে তো বোঝা?"... ব্যোমকে যাবেন না?

    বা হয়তো আপনি একা প্যারিস ঘুরে ফেরার পর ঈর্ষান্বিত বান্ধবী বললো, আইফেল টাওয়ারের একটা ময়দা দিয়ে মডেল বানিয়ে দেখাতে। কী ভয়ানক ফালতু না প্রচেষ্টাটা?

    এইজন্যেই, কেন যে সিনেমা দেখে ফিরে তার সম্পর্কে লিখতে বসে লোকে তার গল্প, পশ্চাৎপট—এইসব নিয়ে শব্দ খরচ করতে বসে—আমার মাথায় ঢোকে না।

    তাইলে লিখতে কেন বসলাম, তাই তো? বলছি। খুব ভালো কোনো আর্টফর্মের সঙ্গে অনেকদিন দেখা না হলে, আর সেই সময়জুড়ে রাজনীতি, সমাজ, কাজের জগত—সর্বত্র বেড়ে চলা শব্দে ডুবতে থাকলে, একসময় মনে হয়—শিল্পের দেবতা মৃত, আর্টের আর কোনো প্রয়োজন নেই আপনার জীবনে। কপাল ভালো আর আপনার নিজের ক্ষিদে থাকলে এইরকম এক সময় হুট করে একটা কালজয়ী কিছু আপনি পড়ে, দেখে বা শুনে ফেলেন। মেঝেয় ছড়িয়ে পড়া চোয়াল কুড়োতে যখন আপনি ব্যস্ত, মাথায় আসে, "একটা/কিছু লোক এটা ভেবেচিন্তে, ছক কষে, প্ল্যান করে বানিয়েছে? কী করে!?" 

    এই বিস্ময় থেকেই লিখতে বসা। "Anatomy of a Fall" দেখে ইস্তক জীবনে শান্তি নেই, (যদিও সবে ঘণ্টাদুয়েক পেরিয়েছে), তাই টাটকা থাকতে থাকতে রিয়্যাকশনটা লিখে ফেলি।

    অনেকগুলি ভাইবোনের বাড়িতে জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখবেন, কেউ না কেউ বেশি ভালোবাসা পায়। কেউ না কেউ বেশ বঞ্চিত হয় স্নেহ থেকে। ওই, বলে না, মাঝের ছানাদের বিশেষ দেখে না কেউ... সেইসব। তা, পরিবারেই যদি এমন হয়, কী করে আশা করেন—গল্পের চরিত্রদের সবার প্রতি সমান স্নেহ, সমান সহমর্মিতা থাকবে চিত্রনাট্যকার, পরিচালকের? কেউ না কেউ থাকবেই, যার পক্ষ আপনি কিছুতেই নিতে পারবেন না। সে চরিত্র সাধারণত গড়াই হয় অন্য পক্ষের মতকে শ্রেয় প্রতিপন্ন করতেই। 

    অ্যানাটমি... এক অদ্ভুত সিনেমা সেই দিক থেকে। এমনকি কুকুরটার পক্ষ নিয়েও কিছুক্ষণ সাময় কাটিয়েছি জানেন হলের ভেতর! চরিত্রদের মনের ভেতর ঢুকতে হলে ক্লোজ-আপ শট আর পিওভি ব্যবহার করার কায়দা সবাই জানে। এই সিনেমায়— একজনের কানের পাশ থেকে অন্য দূরে বসা চরিত্রের মুখে ফোকাস, যখন নেপথ্যে অন্য আর এক চরিত্র কথা বলে চলেছে—পাহাড়ি পথে মূল চরিত্রকে অনুসরণ করে এগোতে এগোতে হঠাৎ তারই সঙ্গে ক্যামেরা আবিষ্কার করে (জ়ুম ইন করে) দূরে ঘটে চলা অস্বস্তিকর কোনো ঘটনা—হঠাৎ অনুভব করা, যে, নেপথ্যসঙ্গীত বন্ধ হয়ে গেছে কখন যেন, আর সেই মুহূর্ত থেকে আপনার ভেতরে অস্বস্তি বেড়ে চলেছে... না, পরিচালক নতুন কিছু করেছেন বলে মনে হয়নি, কিন্তু যা করেছেন—যন্ত্রণাদায়ক প্ল্যানিং আর পরিশ্রম আছে তার পিছনে। 

    একটা লোক সিনেমার শুরুতেই মরে গেছে। চড়-থাপ্পড়, গ্লাস ভাঙাভাঙি, পেশাদার উকিল গোটা সময় জুড়ে ন্যুয়ান্সের পিন্ডি চটকে বুলি-সুলভ সওয়াল করছে... সবকিছুর পরও, কখনোই আপনার মাথায় রক্ত চড়বে না, এমনকি কুশীলবদের গলাও চড়বে না প্রায় কখনোই। কী যে এক মায়া লাগাইসে গোটা ফিলিম জুড়ে! আমার মতো পাষাণহৃদয়েরও ইচ্ছে করেছে উঠে গিয়ে সকলের মাথায় মিনিটখানেক করে অন্তত হাত বুলিয়ে আসি। 
    এক মুহূর্তও কঠোর বাস্তবের থেকে মুখ না ফিরিয়েও এই সিনেমা যা মমতার উদ্রেক করতে পারে, তা ম্যাজিকের কম কিছু না।

    আর কিছু বলে লাভ নেই। যা যা মনে আসছে তা লেখা বৃথা, সিনেমাটা দেখাই তার চেয়ে ভালো কাজ। 

    যান, আইফেল টাওয়ার চড়ে আসুন, আমার ময়দার মডেল চটকে এই ফেল্লুম আস্তাকুঁড়ে।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দীমু | 182.69.179.192 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:৫৪528413
  • এই সিনেমাটা দেখলাম। কয়েকদিন আগে ভাটে গন গার্ল নিয়ে কথা হচ্ছিল , এই ছবিটা যেন সেই মুদ্রার অপর পিঠ। ফরাসী বিচারব্যবস্থাটা মার্কিন বা ব্রিটিশ আদালতের থেকে আলাদা , এই প্রথম একটা ছবিতে বিশদে দেখলাম। ছেলেটি পিয়ানো শিখছে বলে আবহসংগীতে ধ্রুপদী পিয়ানোর ব্যবহার একেবারে অন্যরকম।
  • প্যালারাম | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:২৫528414
  • দেখেছেন! পিয়ানোর কথাটা বলতে বেমালুম ভুলে গেছিলাম। একদম। 
    আরো অনেক ছোট টুকরো আছে, কিন্তু সেসব নিয়ে গপ্পোগাছাই বেশি আরামের, লেখার চেয়ে।
    যেমন ধরুন, ছেলে মাকে বেরিয়ে যেতে বলার পরে গাড়ির মধ্যের অংশটা, রাতে আগুনের ধারে উকিলের সঙ্গে কথোপকথনে মহিলার "তুমি আমায় বিশ্বাস করছো না, না?", এমনকি সহকারী উকিল মহিলার ওইটুকু ইনভলভমেন্টও অদ্ভুত বিশ্বাসযোগ্য
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২০:৪৯528416
  • অসাধারণ সিনেমা। কি আশ্চর্য, দুদিন আগেই দেখলাম, আর আজকেই এই টইটা চোখে পড়ল।
     
    কুকুরটা অব্দি অনবদ্য অভিনয় করেছে। বাচ্ছাটাতো লা জবাব। প্রত্যেকটা অভিব্যক্তি একদম বাস্তবিক। খুব কম সময় মনে হয়েছে যে সিনেমা দেখছি। 
     
    কতটা সেক্সিজম জাস্টিস সিস্টেমের ভেতরে লুকিয়ে রয়েছে, কিভাবে একটা তথ্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে ভিন্ন ভাবে দেখছে সরকারি উকিল, কিভাবে সমস্ত দাঁত নখ বার করে মহিলাকে আক্রমণ করা হচ্ছে দেখলে শিউরে উঠতে হয়।
     
    আরেকটা অনবদ্য বিষয় শিক্ষণীয়, সংযম। কখনই দর্শককে দেখিয়ে দেওয়া হয়না, কে আসলে দোষী, শেষ পর্যন্তও আমরা কিছুটা অস্বস্তিতে থেকে যাই। এই সংযম হলিউড, বলিউড, টলিউড কেউই রাখতে পারতো বলে আমার মনে হয়না।
     
    আর কিছু কথা মনে হল, নিশ্চই খেয়াল করেছেন বাকিরা, তবু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।
    শেষে কুকুরটাকে আলিঙ্গন আসলে যেন ওনার মৃত স্বামীকেই আলিঙ্গন, যেরকম স্বামী নিজের মৃত্যুর ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন কুকুরের রূপকে।
    আর এটাও অদ্ভুত যে শেষ বিচারের ভার পড়ল, ছেলেটির উপরে, যে ঘটনাচক্রে ক্ষীণদৃষ্টি (বা দেখতে পায় ই না হয়ত), যেরকম নিরপেক্ষ বিচারকের হওয়া উচিত (বা বিচারবালার যেমন রূপ আমরা দেখে থাকি - হাতে দাঁড়ি পাল্লা আর চোখে কাপড় বাঁধা)। রূপকের খুব সুন্দর ব্যবহার সিনেমা জুড়েই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন