এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • 'আমাকে দেখুন' কিম্বা 'আমরা দেখি'

    Pradhanna Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ৪১২ বার পঠিত


  • সম্প্রতি, একটি জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কলাম নিয়ে হুলুস্থুল বেঁধে গেছে। সঙ্গে এই কলামের স্বপক্ষে এবং বিপক্ষে বহু মানুষ কথা লিখে চলেছেন। ততোধিক মানুষ সেই লেখা কথাগুলোকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে লেখক, প্রকাশক এবং পাঠক --- তিনপক্ষই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জুড়ে গেছেন। আমি লেখিকা নই, পাঠিকা। সাহিত্যের আঙ্গিনায় দর্শক হলেও কিছু কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি এ প্রসঙ্গে, সাহিত্যেরই খাতিরে।

    বইমেলার কয়েকদিন আগে থেকেই, নব্যলেখকদেরকে নিয়ে, বিশেষত, যাদের একটা অংশ ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে এসেছেন, রীতিমতো ব্যঙ্গ চলছে, মিম চলছে। এই নব্য লেখকেরা তাদের যাবতীয় সৃষ্টির বিজ্ঞাপন ফেসবুকেই করছেন। কিম্বা, অনেক ক্ষেত্রে, ব্যক্তিগত মেসেজ কিম্বা পোস্টের কমেন্টসে গিয়ে তাদের বইয়ের কথা জানাচ্ছেন। এদের অধিকাংশই তাদের বইয়ের বিজ্ঞাপন করার জন্য বছরের পর বছর ধরে ফেসবুককেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। এইভাবে আস্তে আস্তে তাদের পরিচিতমন্ডলী তৈরী হচ্ছে, ফ্যানবেস তৈরী হচ্ছে। তারা বইমেলাতে নির্দিষ্ট স্টলের সামনে (কেউ কেউ) তাদের বইপ্রকাশ উদযাপন করছেন। আর যারা এলিট এবং অভিজ্ঞ লেখক / লেখিকা, তাদের জন্য অডিটোরিয়াম আছে, বিভিন্ন জনবহুল মঞ্চ আছে, বিজ্ঞাপনের মাধ্যম হিসাবে জনপ্রিয় ম্যাগাজিন কিম্বা বৈদ্যুতিন মিডিয়া আছে, আর আছে বিপুল সংখ্যক ভক্তকূল, নিজেদের সৃষ্টি সকলের সামনে আনছেন।

    কিন্তু দুই ধরণের লেখকদেরই লক্ষ্য পাঠককূল, যাদের কারণে এই বছর ২৯ কোটি টাকার বই বিক্রী হয়েছে। যদিও, নিন্দুকেরা বলছেন, সে হিসাবে, জনপ্রতি ১০০ টাকার বই কেনা হয়েছে। মজার ব্যাপার, বইমেলাতে লিটল ম্যাগাজিন কিম্বা কতিপয় বই বাদে ১০০ টাকার বই দুর্লভ। ফলে কারা কিনছে এবং কটা বই কেনা হচ্ছে, সেটাও বিতর্কের বিষয়।

    আমার চোখে যেটা পীড়া দিচ্ছে, তা হল, এই দুই লেখক সম্প্রদায় ও তাদের পেছনের প্রকাশক ও পাঠক ভক্তসম্প্রদায়ের কোন্দল। বস্তুত, এটা পরিষ্কার, লেখকদের মধ্যেও এখন জাতিভেদপ্রথা তৈরী হয়েছে। 'উচ্চ সম্প্রদায়', অভিজ্ঞও বটে, 'নব্য সম্প্রদায়ের' লেখা নিয়ে নাক সিঁটকাচ্ছেন, এবং নব্য সম্প্রদায়ের লক্ষ্য উচ্চ সম্প্রদায়ের মতো সেলেব্রিটি হওয়া, নিদেনপক্ষে, তাদের পর্যায়ে পৌছানো। কিন্তু, দুটো সম্প্রদায়ই ভুলে যাচ্ছেন, তাদের মূল লক্ষ্য সৎ সাহিত্য সৃষ্টি করা, বাংলা সাহিত্যকে নতুন দিশা দেখানো, এবং নব্য পাঠককূলের নব্য চাহিদা পূরণ করা।

    এই জাতিভেদ প্রথা'র সঙ্গে তবে কি এবার আমাদের লড়তে হবে? খোদায় মালুম। মনে তো হচ্ছে আমরা সেইদিকেই আস্তে আস্তে এগোচ্ছি।

    মজার ব্যাপার, উচ্চ সম্প্রদায় এই নব্য সম্প্রদায়ের ফেসবুকীয় 'অসার' লেখা নিয়ে রীতিমতো নাক সিঁটকাচ্ছেন। প্রশ্ন হল, তারা কি এদের লেখা মন দিয়ে পড়ছেন? যদি পড়েন, তাহলে সুনীলের মতো, প্রকৃত অভিভাবক হিসাবে সৎ আলোচনা তাদের কাছ থেকে আমরা পাচ্ছি না কেন? শুধুমাত্রই এত এত বস্তাপচা লেখা হচ্ছে, এ পাগলেও মানবে না। আর ভালো লেখাকে সকলের সামনে তুলে ধরার, নিজে থেকে খুঁজে বের করে নিয়ে তুলে ধরার (বন্ধু কিম্বা স্তোকবাক্যের লেখক ভক্তদের কথা বাদ দিচ্ছি) পরিশ্রম থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আখেরে বাংলা সাহিত্যের কি লাভ হচ্ছে, বোঝা যাচ্ছে না। মাঝখান থেকে গালমন্দটা আস্তে আস্তে কলতলার ঝগড়ার রূপ নিয়ে ফেলছে।

    মজার ব্যাপার, আমরা, পাঠকেরা কিন্তু, দেখতে গেলে, একটা বড়ো কারণ। অনেক পাঠক বছরের শেষে দেড়শো-দুশো বই পড়ার লিস্ট দেন, কিন্তু তাদেরকে কোনরকম রিভিউ দিতে প্রায় দেখাই যায় না; 'নিরাপদ' পাঠকেরা সব বই 'ভাল' এবং মতামত ব্যক্তিগত বলে দায় সারেন; আর 'আপদ' পাঠকেরা বিশেষ লেখক / লেখিকার ভক্তকূল হয়ে যান এবং তাদের কোন কোন লেখা ভালো না লাগলেও চোখ বন্ধ করে থাকেন, ও অভক্তকূলের ওপর ঝাপিয়ে পড়েন। অবশ্য, অনেক পাঠকের বক্তব্য থাকে, তারা লিখতে পারেন না। তাদেরকে আমার সবচেয়ে বেশি হাস্যকর লাগে। চন্দন ঘষলে হাতে চন্দনের গন্ধ থাকে, শিশু আধো আধো কথাতেও নিজের ভাব স্পষ্ট প্রকাশ করতে পারে, আর এনারা এত এত সাহিত্য পড়েও সাহিত্যের ভালো-মন্দ লিখতে পারেন না! তাহলে এরা কি আদৌ মন দিয়ে পড়েন? না কি জাস্ট রিডিং দেন, এবং পরের বইটা রিডিং দেওয়ার জন্য আকুপাকু করেন। এনারাই কি তাহলে ‘হুজুগে পাঠক’? এই কারণেই কি ‘এক্সপার্ট রিভিউ’কারের জায়গায় ‘সাধারণ’ পাঠকেরা আসতেই পারছে না?

    পাঠকের 'কমফোর্ট জোন' লেখকের অতি-সাধারণ লেখার ব্রহ্মাস্ত্র। আর লেখকের ভক্তকূল অন্য লেখক ও পাঠকদের সমালোচনা ও আক্রমণ করার শক্তিশেল। বিশ্বের দরবারে বাঙালী পাঠক আতশ কাঁচ দিয়ে খুঁজলেও পাওয়া যাবে না। ফলে তারা কোনোভাবেই নিজেদের 'আপডেট' করতে সক্ষম নন। বর্তমান জেনারেশান ইংরাজী সাহিত্যের দিকে ঝুঁকে যাওয়াতে অবস্থা আরও করুণ হয়েছে। সার্থক অনুবাদ সাহিত্যের পর্যাপ্ত অ-পৃষ্ঠপোষকতায় অবস্থা অতিকরুণ। আর, সবশেষে, কিছু নির্দিষ্ট জঁরের বইকে পাঠ্য করার দরুন, আমরা কূপমন্ডুকে পরিণত হচ্ছি। যার এক সার্থক পরিণতি আজকের এই তরজা।

    পাঠকেরা সততার সঙ্গে, যথার্থ যুক্তিবুদ্ধি সহযোগে বইয়ের সমালোচনা করলে, লেখককেও যথাযথ গভীরে গিয়ে তার পরবর্তী লেখার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে বাধ্য হতে হয়। লজ্জা অতি বিষম বস্তু। লেখকেরা আজকাল লজ্জা পেতে ভুলে যাচ্ছেন। পাঠকেরাও লজ্জা দিতে ভুলে যাচ্ছেন। পাঠক কোন বই পড়ার সময় যদি লেখকের নাম ভুলে গিয়ে পড়েন এবং আবেগপ্রতুল হয়ে না পড়েন, তাহলে, আজ, হয়তো, এই তরজা লড়াই সম্ভবই হত না। আর বাংলা সাহিত্য আস্তে আস্তে ইংরাজী সাহিত্যের গ্রাসে কবলিত হত না।

    হাজার হোক, দিনের শেষে পাঠকই যদি ভগবান হন, তাহলে পাঠকদেরই কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে বৈ কি।

    ========================

    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ ইন্টারনেট কিম্বা/এবং সমর্পিতা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • π | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৩৫528343
  • এটা ইন্টারেস্টিং লাগল।
    শিশিরবাবুর লেখা নিয়ে পুরো এক্সট্রিম দুই যুযুধান পক্ষের মতামত দেখছিলাম, এই লেখাটা অনেকটাই ব্যালান্সড। বেশ কিছু অংশে সহমতও।
  • দীমু | 182.69.179.36 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৬:৩৯528351
  • "একটি জনপ্রিয় দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি কলাম নিয়ে হুলুস্থুল বেঁধে গেছে" - লিংকটা পাওয়া যাবে? 
  • দীমু | 182.69.179.36 | ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৪৮528368
  • ধন্যবাদ প্যালারাম , পড়লাম ব্যাপারটা।
  • Arindam Basu | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০১:৪০528388
  • লেখাটা পড়ে বীটলস এর পেপারব্যাক রাইটারের গানটার কথাগুলো মনে পড়ে গেল,
     
    "Dear Sir or Madam, will you read my book 
    It took me years to write, will you take a look? 
    It's based on a novel by a man named Lear 
    And I need a job so I want to be a paperback writer "
    Paperback writer,"
     
    তা সে অবিশ্যি ১৯৬৬ সালে পল ম্যাককার্টনি লিখেছিলেন, কবেকার কথা |
    সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে, :-)
     
    গানটা এখানে,
  • দীমু | 182.69.179.192 | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৪:৩৪528392
  • অরিনদা, গানটা ব্যাপক laugh
     
    কিন্তু সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে না বলেই মনে হয়। সমস্যাটা হয়ত সেখানেই। মাস মার্কেট পেপারব্যাকের বদলে এখন বাংলাবাজার মোটা বাঁধাই, জ্যাকেটযুক্ত বইতে ছেয়ে গেছে। যে বইটা একশো পাতার পেপারব্যাক হত সেটাকে হরফের সাইজ বাড়িয়ে, মোটা প্রচ্ছদ জ্যাকেট দিয়ে তিনশো টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বই এখন পড়ার থেকে অনেক বেশি কালেক্টর্স আইটেম। সেজন্য অধুনা লেখকের ফ্যান হয়, পাঠক হয় কিনা কেউ জানে না। লেখকের সই নিয়ে সেলফি তুলে বইটা বাড়িতে সাজিয়ে রাখা হয়। পড়তেই হয়ত লোকে ভুলে যায়।

    উত্তর সম্পাদকীয়তে লেখককে দোষী করা হয়েছে পুশ সেল ইত্যাদির জন্য। কিন্তু আসল দোষটা লেখকের নয়, প্রকাশকের। অবশ্যই স্মৃতিকথা, ভ্রমণ, প্রবন্ধ, কখনো কখনো থ্রিলার বা কবিতার বইও কালেক্টরস আইটেম। সেটা বইয়ের কনটেন্টের ওপর নির্ভর করছে। অধিকাংশ পাতলা ভূত তন্ত্র থ্রিলারের বা 'সামাজিক' ইত্যাদি বই কাল্কেটরস আইটেম নয়, কোনোদিন ছিলোও না। স্বপনকুমারের বই ছিল পাল্প ফিকশনের আদলে জ্যালজ্যালে কাগজে ছাপা। কিন্তু প্রকাশকরা পুরোটাই ইচ্ছাকৃত দাম বাড়িয়ে ঐরকম হার্ডব্যাক করে তুলছেন যাতে তাড়াতাড়ি অন্তত একটা সংস্করণ বেচে দেওয়া যায়। লেখকও খুশি প্রকাশকও খুশি। লেখক প্রোডাকশনের ব্যাপারটা বোঝেন না, তিনি তো সবসময়েই চান তার একটা বই হোক। সেটা লোকেরা পড়ুক, তাদের বাড়িতে থাকুক বা অন্যকে উপহার দিক। এর মধ্যে অন্যায় কিছু নেই। বরং বইয়ের দাম বেশি হলে ক্ষতিটা লেখকেরই হবে , ওই জিনিসটা তার অচেনা কেউ চট করে কিনবে না। তিনি আর কোনোদিনই স্বপনকুমারের মত জনপ্রিয়তা পাবেন না, বদলে হয়ত ফিফটিন মিনিটস অফ ফেম পাবেন।

    পূজাবার্ষিকী বা লিটিল ম্যাগগুলোও আগে এই মডেলটায় চলত। সস্তা কাগজ, দাম কম, লোকেরা কিনত, পড়ত তারপর পুরোনো কাগজের সঙ্গে বেচে দিত বা নিজেরা বাঁধিয়ে রেখে দিত। দিনে দিনে তারাও এখন পেটমোটা, দামী কালেক্টর্স আইটেম হয়ে যাচ্ছে। কদিন বাদে ওরাও হার্ডব্যাক হবে।
  • Falguni Mazumder | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২২:৫৯528399
  • দেখুন প্রধান্যা আপনার পোস্ট পড়লাম। পড়ে মনে হোল কিছু বলি। প্রথমেই বলি সাহিত্য বলতে কি বোঝায়। আমি আবার সড়ক ছাপ ব্যক্তি গুরুগম্ভীর আলোচনা তাই আমার কাছে এক ভয়ের ব্যাপার। আমি বুঝি সাহিতা বলতে বোঝায় যা আমাদের সামাজিক সমস্যা, রাজনৈতিক সমস্যা আর মানবিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে।

    আপনি বলুন ত কেন বাংলা সাহিত্যে একজন সাহা, মন্ডল, তিরকে কেন প্রধান চরিত্র হোল না? কেন উচচবর্নের মহিলা পুরুষ প্রধান চরিত্র হোল? সাহিত্য বলতেই কেন আজও বলব পুরাতন লেখক দের লেখাই সাহিত্য? আজ যদি কোন লেখক বস্তি জীবন নিয়ে লেখেন তবে কি তিনি ভদ্দনোকের ভাষা ব্যাবহার করবেন?

    নবীন লেখক কূল আজো প্রকাশকের দয়া নির্ভর। এরা দোরে দোরে ঘুরে বেড়ান কিন্তু প্রকাশক এদের খেদিয়ে দেন। লেখক টাকা চাইবেন কারন এটা তার জীবিকা। আবার প্রকাশক টাকা দেবেন লেখকের বই বিক্রিহলে। পাঠক কিনবেন তার পছন্দ হলে। আজ ও ব্যাবসা, আগেও ছিল বেওসা তাই এই ফেসবুকে প্রচার করা লেখকদের আমি কোন সময় ছোট করি না।
  • kk | 2607:fb90:eab2:c595:b588:2f45:5560:4881 | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০০:১০528401
  • সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা না থাকলে সাহিত্য হবেনা?
  • সম্পাদক সমীপেষু | 182.69.183.148 | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২৩:০৭528724
  • যশই মূল লক্ষ্য
    শিশির রায়ের ‘বই তো ছুতো, আমাকে দেখুন’ (৩-২) শীর্ষক সময়োপযোগী প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠির অবতারণা। সত্যিই সম্প্রতি বইমেলার প্রাক্কালে ও বইমেলা চলাকালীন কয়েক জন লেখকের নিয়মিত সমাজমাধ্যমে নিজেদের বিজ্ঞাপিত করার ধুম দেখলে হাসির উদ্রেক ঘটেছে বইকি। সেই কবে ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন’ প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, “যশের জন্য লিখিবেন না। তাহা হইলে যশও হইবে না, লেখাও ভাল হইবে না। লেখা ভাল হইলে যশ আপনি আসিবে।” কিন্তু আজকের নব্য লেখকের কাছে যশ প্রতিষ্ঠাই মুখ্য। তাই সকাল-সন্ধে এমনতর বিজ্ঞাপন। এ ধরনের বিজ্ঞাপনের ফাঁদে আটকে কেউ কেউ এমন স্বঘোষিত লেখকের বই কিনেও ফেলেন। আবার তার মধ্যে কেউ যদি বা কষ্ট করে বইটি পড়েও ফেলেন, তার পর অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় তিনি বইয়ের নাম-সহ লেখকের নামটিও স্বল্পসময়ের মধ্যে ভুলে গিয়েছেন। এই লেখকেরা বোঝেন না সিরিয়াস পাঠক লেখকের কাছে বালখিল্যতা নয় বরং গাম্ভীর্য প্রত্যাশা করেন। আসলে এখন বাংলায় সাহিত্যের নামে চটজলদি এমন সব বিষয় উপস্থাপন করা হচ্ছে, যার অর্থমূল্য থাকলেও সাহিত্যমূল্য বিশেষ নেই। এই লেখকরা ভুলে যান আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে বইয়ের পার্থক্য আছে। সাধে কী আর জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, “সকলেই কবি নন, কেউ কেউ কবি।”
    কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
     
    সত্যবচন
    ‘বই তো ছুতো, আমায় দেখুন’ পড়ে ভাল লাগল। বাংলা ভাষায় যে বিশ্বমানের সাহিত্য রচিত হয়েছিল, বিশেষ করে কবিতা ও ছোটগল্পে, শেষ চার দশকের বাংলা সাহিত্য তার ধারেকাছেও এল না। পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের অবলুপ্তি, লেখকের অভাব, বাংলা মিডিয়ামের প্রতি বিতৃষ্ণার কারণে নিত্যনতুন পাঠক তৈরি না হওয়া, ক্লাসিক ও পুরনো লেখার প্রতি আগ্রহ কমে যাওয়া ইত্যাদির জন্য আমরা এখন বাংলা সাহিত্যের মর্গে দাঁড়িয়ে আছি, দহনের অপেক্ষায়। তার মধ্যে সমাজমাধ্যম ঢুকে পড়ায় সোনায় সোহাগা। লেখক বুঝে নিয়েছেন ধ্যানের থেকে ঢের বেশি জরুরি বিপণন। তাই এই অনন্ত ছোটাছুটি ও জনসংযোগ ছাড়া উপায় কী? পাঠককুল বিভ্রান্ত। এখনও বুদ্ধদেব নামক দু’জন লেখকের মধ্যে গুলিয়ে ফেলা, টুনি মেম বইটি দেখে আগ্রহী বালিকার প্রতি অভিভাবকের বিরক্তি— সবই দেখছি। বাংলা সাহিত্যের হিরণ্ময় যুগ পেরিয়ে গেছে, প্রত্যাবর্তন বলে সাহিত্যের ইতিহাসে কিছু হয় না, বুদ্ধদেব বসু লিখে গেছেন। লেখক ও পাঠক উভয়েই দিশাহারা।
    সুরঞ্জন চৌধুরী, কলকাতা-৯৭
     
    আত্মবিজ্ঞাপন
    শিশির রায়ের প্রবন্ধটি পড়ে লেখকের পর্যবেক্ষণকে সাধুবাদ জানাই। বইমেলায় এই বইটি প্রকাশিত হতে চলেছে, অমুক দিন অমুক স্টলে লেখক উপস্থিত থাকবেন— ইত্যাদি খবর আমরা মেলা শুরুর প্রাক্-মুহূর্তে, বইমেলা চলাকালীন সমাজমাধ্যমের সূত্রে অহরহ পেয়েছি। কিছু লেখক আবার শুধু তাঁর বই নয়, তিনি কোন দলীয় সংবাদপত্র পড়েন পাশাপাশি রেখে বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি শুধু লেখক নন দলেরও অনুগত এক জন সৈনিক। দলের উচ্চপদে আসীন নেতা থেকে সাংসদের হাতে বই ধরিয়ে দিয়ে তার ছবি সমাজমাধ্যমে ফলাও করে দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন ‘আমাকে দেখুন’। প্রবন্ধকার যথার্থই লিখেছেন, প্রকাশককে আর ক’জন চেনেন, লেখকই তো সব। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে নামী পত্রিকায় পর্যালোচনা বার হলে অনেক লেখক পত্রিকার প্রচ্ছদের ছবি তুলে পর্যালোচনার অংশটুকু আবার টাইপ করে সমাজমাধ্যমে পাঠকারণ্যে ভাসিয়ে দেন। প্রবন্ধকার সম্ভবত এই প্রচেষ্টাকেই ‘আত্মবিজ্ঞাপন-পরাকাষ্ঠা হয়ে ওঠা’ বলেছেন।
    প্রসঙ্গত, সম্প্রতি পড়া অমল পালের ‘বাংলা ভাষা কি বিপন্ন’ প্রবন্ধ থেকে একটা উদাহরণ দিই। লেখক এক অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন— একটি সঙ্কলনে প্রকাশ করার জন্য এক বার বাংলার এক অধ্যাপকের কাছ থেকে একটি প্রবন্ধ নিয়েছিলাম। সেই লেখায় কয়েকটি ভুল বানানের দিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করি। তিনি বিন্দুমাত্র সঙ্কোচ না-করে বেশ হাসিমুখেই বলেছিলেন, ও তুমি ঠিক করে নিয়ো। আমি বানানের কথা অত ভাবি না। আমার কাছে কনটেন্ট-ই আসল। শোনার পর যে বিস্ময়ের ঘা লেগেছিল, এখনও সে ঘোর কাটেনি।
    সাগরময় অধিকারী, ফুলিয়া, নদিয়া
     
    অপারগতা
    শিশির রায় তাঁর প্রবন্ধে নব্য লেখকদের একটি অংশের বিরুদ্ধে যে অভিযোগটি এনেছেন, তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হওয়া গেল না। সমাজমাধ্যমে তরুণ লেখকদের নিজস্ব বইপত্রের প্রচার কতটা আত্মপ্রচার, আর কতটা তাঁরা বাধ্য হন, এই পরিসর আলোচিত হওয়া প্রয়োজন।
    প্রথমত, নব্য লেখকদের বইয়ের প্রচারে এক শ্রেণির প্রকাশকের চূড়ান্ত অনীহা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এই প্রকাশকরা তুলনায় ‘পরিচিত’ লেখকদের যে ভাবে বিজ্ঞাপিত করেন, নবাগতদের ক্ষেত্রে তার ছিটেফোঁটাও জোটে না। কিছু ক্ষেত্রে এই লেখকরা গাঁটের কড়ি খরচ করে বই প্রকাশ করেন। সেই বই বিক্রির দায়ও প্রকাশক ঘুরপথে লেখকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেন। যেখানে প্রকাশক নিজেই নতুন বইয়ে বিনিয়োগ করেন, সে ক্ষেত্রেও তিনি নীরব! প্রচারের দায়িত্বটিও এ ক্ষেত্রে লেখককেই নিতে বলা হয়, দৈনিক অথবা সাহিত্যপত্রে বিজ্ঞাপনের ব্যয় বহন করতে তাঁরা রাজি হন না। এমতাবস্থায় সমাজমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মটি নব্য লেখকদের আশ্রয়স্থল। এটি ‘দৈন্য’-র চেয়েও অপারগতার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, লেখক বইপ্রকাশ করেন বেশি পাঠকের কাছে নিজের লেখা পৌঁছে দিতে। সেই বইয়ের প্রচারকৌশল তিনি নিজে কেন ঠিক করতে পারেন না, তার স্পষ্ট ধারণা লেখাটিতে নেই। নিজের বই সংক্রান্ত ভাবনা নিজস্ব পাঠক, অনুগামীদের মধ্যে রাখতে চাওয়া বইবিমুখ এই সময়ের কার্যকর দিক। তাকে আত্মপ্রচারের গেরোয় ফেলার ভাবনা পুরাতন মূল্যবোধজাত। বদলের সময় এসেছে।
    কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় মনে করতেন, জঙ্গলে বসে কেউ কবিতাচর্চা করতে পারেন না, কবিকে পাঠকদের মধ্যে আসতেই হয়। ‘নির্জনতা’ কারও ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু তাকে গৌরবান্বিত করতে গিয়ে অপর অংশকে ‘আত্মবিজ্ঞাপন-পরাকাষ্ঠা’ বলে পরিহাস করাও সমীচীন নয়।
    মৃণাল শতপথী, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
     
    নেতিবাচক চিন্তা
    ‘বই তো ছুতো, আমাকে দেখুন’ প্রবন্ধ পড়ে অবাক হয়ে গেলাম। বাজার অর্থনীতির যুগে, যেখানে বিজ্ঞাপন দেওয়া অত্যন্ত স্বাভাবিক, সেখানে লেখকদের বিজ্ঞাপন দেওয়া নিয়ে এ রকম উদ্ভট নিন্দা কেন? কোনও লেখক যদি ভাবেন যে, লিখে সংসার চালাবেন, তা হলে বিজ্ঞাপন না দিলে বই বিক্রি হবে? আর বই বিক্রি না হলে জীবন চলবে? না জীবনানন্দ দাশের মতো সারা জীবন কষ্ট করে থাকতে হবে, যাতে মৃত্যুর পর হয়তো কেউ প্রশংসা করবে? এই মনোভাব এখনকার দিনে কারও থাকতে পারে? সমস্যা হল, নতুন কিছু দেখলেই একটা নেতিবাচক কথা ভাবা অনেকেরই মজ্জাগত। সারা পৃথিবীতে লেখকরা বিজ্ঞাপন দিয়ে বই বেচে ফ্ল্যাটের ইএমআই দিচ্ছেন, ছেলেকে ভাল স্কুলে পড়াচ্ছেন, সেটা সহ্য হচ্ছে না। পাঠককে বিনোদন দেওয়ার জন্য ভাল গল্প লিখতে হবে, আবার সমাজতান্ত্রিক আদর্শ পূরণ করার জন্য সেই বেচারা লেখককেই ছেঁড়া জামা পরে নন্দন চত্বরে বসে থাকতে হবে?
    রুদ্রজিৎ পাল, কলকাতা-৩৯
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন