এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ   স্মৃতিকথা

  • এল ডোরাডো

    যোষিতা লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ৩০ নভেম্বর ২০২৩ | ৮৮৭৪ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৬ জন)
  • এখানে লিখব সোনার দেশ সুইটজারল্যান্ডের নানান অভিজ্ঞতা ও মানুষের কথা।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পড়ছি  | 173.62.207.237 | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ২১:৪৬742296
  • পড়ছি  কিন্তু 
  • যোষিতা | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:০২742308
  • আজ সকাল থেকেই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাড়িটা দিয়ে দিলাম। বড়ো যত্নের, বড়ো কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে কেনা ঐ বাড়ি। আমার বাগান, গন্ধরাজ গাছ, জারুল গাছ, সারি সারি হাসনুহানা, সব ফেলে দিয়ে এলাম। এখন থেকে ফ্রেশ আনকোরা নতুন জীবন শুরু হবে। এমন সুযোগ কজন পায় গোটা জীবনে? আমি পজিটিব থিংকিং করছি।
    ফ্লাইট লেট হলো, ট্যাক্সি স্ট্রাইক, তবু আমার মন বলছে আজকের দিনটা হেলায় ফেলায় নষ্ট করা ঠিক হবে না। 
    কিন্তু ডবল ঝামেলা অটো নিয়ে। প্রথমত নাইন ইলেভেন হবার পর থেকে অ্যামেরিকান এমব্যাসীর ঐ গোটা এলাকায় সর্বক্ষণের জন্য ব্যারিকেড, গাড়ি ঢুকতে দেয় না। সুইস এমব্যাসী ঐখানেই আগেই বলেছি। দ্বিতীয়ত তবু যদিবা ট্যাক্সি থাকলে ঐ ব্লকের ভেতরে কিছুদূর অবধি যাওয়া যেত, অটোরিক্সাকে একেবারেই ঢুকতে দেবে না। প্রায় দুশো আড়াইশো মিটার দূরে মেইন রোডের ওপর অটো আমাদের ঐ কথাই জানালো। 
    জিনিসপত্র টেনে টেনে অতটা পথ হাঁটা যায় না। বাবু দাঁড়িয়ে রইল চওড়া ফুটপাথের ওপর দুটো সুটকেস, হ্যান্ড ব্যাগেজ ট্যাগেজ নিয়ে। আমরা মা মেয়ে কাগজপতর্ নিয়ে জোর পায়ে হাঁটছি সুইস এমব্যাসীর দিকে।
    এমব্যাসীর সামনে দাঁড়িয়ে হাত থেকে কাগজ বের করব, একটা নোটিস টাঙানো, মেয়েই সেটা প্রথম দেখে পড়ে নিল।
    — মা! এমব্যাসী বন্ধ হয়ে গেছে। জানুয়ারীর ছ তারিখে খুলবে!
    মাথায় বাজ পড়ার মত অবস্থা। ঘড়িতে বারোটা দশ। বারোটায় দরজা বন্ধ। দারোয়ান ঐ ঘরটার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে।
    — ভাইসাব! 
    — ম্যাডাম, অফিস বন্ধ হো গিয়া।
    আমার মাথায় হিন্দি আসছে না।
    — প্লিজ প্লিজ প্লিজ ভাই একটু যেতে দিন। নইলে কী অবস্থা হবে আমাদের বলুন দিকি! এ দেখুন টিকিট কাটা রয়েছে,.... আমার চোখে জল আসছে না, কিন্তু ভয়ে গলা শুকেচ্ছে।
    দারোয়ান দরজা খুলে দিলেন।
    ভ্তরের ঘরে অনেক লোক। প্রায় ছ সাতজন ভিসাপ্রার্থী। চেয়ার বিশেষ খালি নেই। কিন্তু প্রত্যেকের হাতে সিরিয়াল নম্বরের টিকিট। আমরা দেরি করে ঢুকেছি টিকিট পাই নি।
    এদিকে পারিজাত  ঝুঁকে পড়ে মেঝেয় কীসব করছে।
    — উঠে বোসো। চেয়ারে বোসো।
    আমি রেগে গেলে ওকে তুমি তুমি করে বলি।
    পারিজাত মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়েছে কার যেন ফেলে দেওয়া একটা টিকিট, তাতে কিছু একটা সিরিয়াল নম্বর দেওয়া। ক্রমশঃ ঘর খালি হতে থাকে। আমরা কাউন্টারে যাই। কাগজপত্র, পারিজাতের পাসপোর্ট জমা দিই। খুব সম্ভবত ভিসা ফি লাগে না। কাল ছুটি। তবুও পাসপোর্ট মালীর কাছ থ্কে নেওয়া যাবে।
    আমরা নাচতে নাচতে ফের মেন রাস্তায়। বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছে সুটকেস আগলে। 
    একজন অটোচালক জানতে চাচ্ছে আমরা কোথায় যাব।
    আমি তাকে বলে দিই কনট প্লেস, অপোজিট টু সুপার বাজার।
    আমার মেয়েটা এত বোকা, ও বলে, ও ফ্লাইট থেকে নেমে ভেবেছিল এটাই সুইটজারল্যান্ড কিনা।
    দিল্লি ওর খুব ভালো লেগেছে। কী সুন্দর শহর, কী পরিষ্কার।
    কনট প্লেস আমার যেন নিজের জায়গা। ওখানে দুটো হোটেল আমি বেশ চিনি। বহু বছর আসি নি, তবে এটুকু জানি যে বুকিং ছাড়াই আমাদের থাকার ব্যবস্থা তারা করে দেবে।
    হয়েও গেল। ঐ বিশাল যে গোল সাদা বাড়িটা, ওরই মধযে আমার চেনা হোটেল, সস্তার হোটেল। এমনকি ম্যানেজার এখনও সেই শর্মাজী।
    একটা ডবল রুম পেয়ে গেলাম। তারপর খেতে যাব গোল মার্কেটের বসু বোর্ডিং হাউসে। হেঁটেও যাওয়া যায়, কিন্তু এখন ওসব না। প্লাজা সিনেমার মোড়টায় গিজগিজ করছে অটো।
  • যোষিতা | ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:০৭742368
  • তেইশে ডিসেম্বর ২০০২ এর সেই অদ্ভূত রাত। ব্রাইট হোটেল। রাতের খাবার খেয়েছিলাম নিরুলাস এর নিরিমিষ একটা রেস্টুরেন্টে।
    হোটেলে যে ঘরটা পেয়েছিলাম অ্যাটাচড বাথরুম সহ, সেখানে দুটো সিঙ্গল বেড। একটায় বাবু শুয়েছে, অন্যটায় মেয়েকে নিয়ে আমি। কনকনে ঠান্ডা, কম্বলে শীত মানছে না। মাথার মধ্যে অসংখ্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। হোটেলটা বড্ড নোংরা লাগছে, হয়ত দেড় বছর সুইটজারল্যান্ডে থাকার কারনেই।
    আমার ঘুম আসছে না। ফিরবার টিকিট ডিসেম্বরের ঊনত্রিশে। কিন্তু এতগুলো দিন কীভাবে কাটাবো এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে?
    ভোর হতেই আমরা হুড়মুড়িয়ে চলে যাই সুইস এমব্যাসী। মালীর কাছ থেকে নিয়ে নিই মেয়ের পাসপোর্ট, তাতে ভিসার স্ট্যাম্প লেগে গেছে, আনলিমিটেড ভিসা।
    রাস্তার ধারে তোলা উনুনের ওপর কেটলি চারিয়ে চাওয়ালা চা বেচছে, সঙ্গে পাঁউরুটি, বিস্কুট। রাস্তাতেই ব্রেকফাস্ট হলো। দিল্লি তখনও কুয়াশায় ভরা। 
    ঐ সময়েই ঠিক করে ফেললাম, টিকিটের তারিখ বদলাতে হবে। সম্ভব হলে আজ রাতের ফ্লাইটেই যদি জায়গা পাই আমরা আজই রওনা দেবো।
    সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সি ধরে সোজা কনট প্লেস, জনপথে পৌঁছে দেখি তখনও দশটা বাজে নি। অতয়েব যন্তরমন্তরে ঢুকে অবজারভেটরি দেখলাম মন দিয়ে। এই আমার তৃতীয়বার এই অবজারভেটরি দর্শন। প্রথমে পাঁচ ছ বছর বয়সে, আবছা স্মৃতি আছে তার কিছুটা, দ্বিতীয়বার ১৯৮৫তে যখন প্রথমবার দেশের বাইরে গেছলাম, সেবারেও দিল্লি থেকে, তখন কনট প্লেসেই থেকেছি ওয়াইএসসিএ র হেটেলে, সম্ভবত মানসিং রোডে। সেবার মনের মধ্যে কত আনন্দ। সারা বিকেল কত ঘুরতাম। এবারে আমার মনের মধ্যে যে আনন্দটা রয়েছে, সেটাকে অনুভব করতে পারছি না। সারাটা ক্ষণ এত উদ্বেগ, এত নিখুঁত করে প্ল্যানিং, এত ভয়, এত দুশ্চিন্তা মনটাকে ভরে রেখেছে, যে ঘুরছি বেড়াচ্ছি খাচ্ছি দাচ্ছি সব যন্ত্রের মত।
    ভাগ্যক্রমে এয়ারইন্ডিয়া অফিসে যেতেই সেরাতের জন্য জায়গা পাওয়া গেল ফ্লাইটে। তবে পাশাপাশি তিনটে সীট হচ্ছে না। আলাদা আলাদা জায়গায় বসতে হবে।
    ওসব ছুটকো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই।
    আজ চব্বিশে ডিসেম্বর, গত বছর ঠিক এই দিনে বাবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ, প্রথম দেখা সাক্ষাৎ। সেদিন আমরা রাইন নদীর প্রপাত দেখতে গেছলাম। স্দিন কি ঘুণাক্ষরেও আমরা ভেবেছিলাম যে পরের বছর ঐ একই দিনে আমার বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে আনতে হবে এত ঝামেলা ঝক্কি পুইয়ে?
    এবার এয়ারপোর্টে চেক ইনে ঝামেলা হয় না। গেট নাম্বার থ্রি। বাকি সব গেটের থেকে আলাদা, একেবারে অন্যদিকে। এই এয়ারপোর্ট আমার পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেনা, এতবার যাতায়াত করেছি।
    কিন্তু ঝামেলা হবে না, সে কি হতে পারে?
    ইমিগ্রেশনের কাউন্টারে আমার মেয়েকে আটকে দিলো।
    বাবুর ইমিগ্রেশন হয়ে গেছে, সে ওপারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আমি মেয়েকে নিয়ে দুটো পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাস রাখলাম কাউন্টারে। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস দেখে আমাকে প্রশ্ন করল, ও আপনার কে হয়?
    — আমার মেয়ে।
    লোকটার বিশ্বাস হলো না। সে মাথা নেড়ে বলল, উঁহু, বাচ্চা যেতে পারবে না।
    আমি অবাক। কেন? যেতে পারবে না কেন?
    — ম্যাডাম আপনি সাইডে আসুন। আপনার পেছনে যারা লাইনে আছে তাদের আসতে দিন।
  • সমরেশ মুখার্জী | ০২ মার্চ ২০২৪ ২১:৪১742433
  • অমিতাভ‌বাবুর সাথে একমত
    ১৪/২ চলো অটো চাণক‍্যপুরী ..... ২১/২ প্লাজা সিনেমার মোড়ে গিজগিজ করছে অটোর ভীড় .... ২৮/২ ম‍্যাডাম সাইডে আসুন, পেছনের জনকে আসতে দিন ..... এসবের মাঝে আমি‌ও মাঝেমধ্যে এসে দেখে গেছি জল কোথায় কতদূর গড়াচ্ছে .... ম‍্যাডাম এখন সন্দেশখালি নিয়ে বেশ বিচলিত মনে হয় .... তাই এদিকে জল ধীরে বগড়াচ্ছে  laugh
  • যোষিতা | ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৫:২১742440
  • আর একটু পরেই মধ্যরাত হবে। গত বছরটা বাদ দিলে তার আগের কয়েক বছরের মধ্যরাত আমার কেটেছে এন্টালির গির্জাঘরে মিডনাইট মাসের উৎসবে। 
    ক্রিসমাস যে শুরু হতে চলেছে সেটা হঠাৎই এই মুহূর্তে অনুভব করলাম। কারণ অনেকক্ষণ থেকেই এই এয়ারপোর্টে বেজে চলেছে কিছু ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, মানে যেগুলো নিয়ম করে ক্রিসমাসে গাওয়া হয়ে থাকে। মূল গান জারমানে, তবে ইংরিজি অনুবাদটাই বাজছে — সায়লেন্ট নাইট, হোলি নাইট।
    সেটা শেষ হলেই — "উই উইশ ইউ আ মেরি ক্রিসমাস" গানটা চলছে, লুপে চলছে দুটো কি তিনটে গান।
    সাইড হয়ে দাঁড়ানোর পরে আর বাকি সব শব্দ ছাপিয়ে কেন জানি না "সায়লেন্ট নাইট" টা বেশ জোরে জোরে কানে এসে লাগল। দুজন অফিসার আমাদের পাসপোর্ট বোর্ডিং পাস নিয়ে ইমিগ্রেশন থেকে একটু দূরে নিয়ে গেল, আমার মেয়েকেও হাত ধরে নিয়ে গেল।
    এবার জিজ্ঞাসাবাদ হবে। আমার মনে একটা ক্ষীণ আশঙ্কা ক্ষনিকের জন্য উঁকি মেরেছিল, তবে কি আমার স্বামীর ষড়যন্ত্র? সে তো বারবার আমার মেয়েকে ভয় দেখাতো যে আমাকে সুইটজারল্যান্ড থেকে ডিপোর্ট করাবে বলে। সে ই কি কলকাঠি নেড়ে আমাদের যাওয়া টা রুখে দিচ্ছে?
    নাহ। ওর হাত অত লম্বা বলে মনে হয় না।
    আমার মেয়েকে যখন টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, সে ভয়ে ভয়ে পেছন ফিরে আমায় দেখছিল। আমি তো সঙ্গে সঙ্গেই ছুটছিলাম পেছন পেছন।
    — আপনার কে হয়?
    — আমার মেয়ে।
    — একে আপনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
    — জুরিখে, আমার কাছে।
    অফিসার দুজন পরষ্পরের দিকে তাকালো। চোখে চোখে কথা হলো তাদের।
    আমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল একজন আমাকে দেখিয়ে — এ তোমার কে হয়?
    — আমার মা।
    মেয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছে।
    চোখের ইশারায় ইমিগ্রেশনের অফিসারকে দূর থেকে গ্রীন সিগনাল দিলো একজন অফিসার, আমার হাতে পাসপোর্ট বোর্ডিং পাস ফিরিয়ে দিয়ে বলল — ওকে ইউ ক্যান গো।
    আমরা ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে যাবার সময় আমার রানে ভেসে এল একজন অফিসারের কথা, নিজ্দের মধ্যেই বলছে, "এত সিম্পল জামাকাপড়...."।
    ইমিগ্রেশনে তারপর দাম দাম করে স্ট্যাম্পিং, আমরা বাবুর কাছে দিয়ে দাঁড়ালাম।
    এই হ্যারাসমেন্টের অর্থ কিছুটা হলেও বুঝেছি।  ওরা আমাকে শিশুপাচারকারী ভেবে বসেছিল। সেই যে আমার পুরোন অফিসের কোলিগ একবার বলেছিল — তোমার মেয়ের পোশাক আশাক এত সিম্পল কেন?
    এই অফিসাররাও নিজেদের মধ্যে একই কথা বলেছে।
    সাধারণ জামাকাপড় পরা মানুষদের ন্যূনতম সম্মানটুকুও প্রাপ্য হয় না। গর্ভধারিণী মা কে শিশুপাচারকারি মনে করে হয়। তার ওপর সুইসভিসা থাকলে নির্ঘাৎ শিশুকে ব্র্যান্ডেড কাপড়জামা পরিয়ে এয়ারপোর্টে আনা নিয়ম।
    লুপে বেজে চলেছে গান। মাথা ধরে যাচ্ছে।
    সেই সময়েই আমার মেয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে সে আর কোনওদিন ভারতে যাবে না। 
    এই দেশ নিজের নাগরিকদের সম্মান করে না। পদে পদে অসম্মান করে। মানুষের অধিকার এ দেশে নেই।
    এ দেশ যে তার জন্মভূমি নয়, সে জন্যও সে খুশি।
    কথাগুলো শুনতে কঠিন, কিন্তু জীবনের কোন পরিস্থিতে মানুষ এমন কথা বলতে পারে সেটা চিন্তা করবার বিষয়।
    সাজিয়ে গুছিয়ে ছদ্ম ভদ্রতার মোড়ক মেরে মিথ্যে কথা বলতে তাকে আমি শেখাই নি। সে সত্য কথা অকপটে বলেছে।
  • kk | 172.58.240.82 | ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৫:৩৬742442
  • যেকোনো ছুতোনাতায় মানুষের জাজ করার প্রবণতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত লাগে!
  • যোষিতা | ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৬:১৭742444
  • ভোররাতে বাড়ি পৌঁছেছিলাম আমরা। সেদিন পঁচিশে ডিসেম্বর। ঘুম ভেঙেছিল একটু বেলা করেই। সকালবেলা তিনজনে মিলে চললাম জুরিখের মধ্যিখানে বুয়ের্কলিপ্লাৎসে জুরিখ লেকের ধারে। মনে হচ্ছে এ কদিনে বেশি তুষারপাত হয় নি, তবে তাপাঙ্ক শূন্যের নীচেই।
    আমরা তিনজনে মনের আনন্দে, একেবারে সত্যিকারের প্রাণভরা আনন্দে সেদিন ঘুরেছি শহরে, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছি, কথায় কথায় হেসেছি, কত কত নতুন নতুন জায়গা দেখিয়েছি মেয়েকে।
    মেয়েও মহাখুশি।
    দুদিন পরে তার জন্য নতুন জ্যাকেট জুতো জামা দস্তানা যা যা প্রয়োজন সমস্ত কেনা হলো। ইস্কুলে ভর্তির দন্য স্থানীয় অফিসে খবর দেওয়া হলো যে মেয়ে এসে গেছে, তার নতুন রেসিডেন্স পার্মিট হবে। পরের দিন বাড়িতে চিঠিও চলে এল। সম্ভবত ছ তারিখ ছিল সোমবার। সে দিনই নতুন বছরে প্রথম ইস্কুল খোলার দিন।
    আমি তখনও অফিসের ছুটিতেই ছিলাম।
    মেয়েকে নিয়ে পাড়ার প্রাইমারি ইস্কুলে গেছি আমরা। ইস্কুলের টিচার্স ইনচার্জ এম্মা হাইডেলবের্গ আমাদের নিয়ে চললেন মেয়ের  ক্লাসে। ক্লাসটিচার ডিনার এর হাতে সঁপে দিয়ে তিনি চলে গেলেন। এখন মেয়ে ভর্তি হবে।
    ফরম্যালিটি কিচ্ছু নেই। মেয়ের পাসপোর্ট আছে কি নেই, সেটাও দরকারি না। একটা জিনিসই চাই। জন্ম নিবন্ধ পুস্তিকা। সেটি সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের। সবুজ রঙের একটা ছোট্ট বই। কোনও ফর্ম ফিলাপ নেই, বাবা মায়ের নাম ধাম ইন্টারভিউ, কিচ্চু নেই।
    তবু বাবু কিছু কথা বলল শিক্ষিকাকে।
    — দেখুন, এই মেয়ের মা আমার বান্ধবী।
    — তাহলে আপনিই ওর বাবার মতো।
    — তা ধরে নিতে পারেন।
    এই ইস্কুলের একটা বিশেষ ক্লাসে আমার মেয়ে ভর্তি হলো। এই ক্লাসে নানান দেশের নানান বয়সের ছেলে মেয়ে রয়েছে। সবাই জার্মান শিখবে এখন, কেউ আফ্রিকার কোনও দেশ থেকে এসেছে, তো কেউ এসেছে ইয়োরোপ কি উত্তর বা দক্ষিণ অ্যামেরিকার কোনও দেশ থেকে। মে কিংবা জুন মাসে ঠিক করা হবে এরা পরে সাধারণ ইস্কুলে কোন ক্লাসে যাবে। কে কোন বিষয় নিয়ে পড়বে।
    আমার মেয়ে যেহেতু বেশ দেরি করে এসেছে, ও যদি ভাষা শেখাটা তাড়াতাড়ি পারে, ও ও অগস্ট সেপ্টেম্বরে নতুন ইস্কুলে চলে যাবে। যেহেতু বারো বছর বয়স, তার মানে এখন ও ক্লাস সিক্স। 
    কোনও পরীক্ষা নয়, একটা অকিরিক্ত কথা নয়, নতুন বই খাতা কিছুই কেনা নয়, ইউনিফর্মেরও বালাই নেই। সেই অতি সাধারণ পোশাক আশাকেই ওকে সাদরে ভর্তি করে নিলেন ফ্রাউ ডিনার।
    মিস্টার বোসের মেয়ে আমাকে আগে সতর্ক করে দিয়েছল যে বাচ্চা মানুষ করা বড্ড শক্ত কাজ এ দেশে। ফুল টাইম চাকরি করা মায়েদের জন্য বড্ড কঠিন কাজ।
    আমার কিন্তু মোটেই কঠিন লাগছে না এ দেশে। বিশেষ করে ভর্তি তো করে ফেলেছি কোনও সমস্যা ছাড়াই। সব ইস্কুল অবৈতনিক। প্রাইভেট ইস্কুল আছে বলে শুনেছি, তবে অধিকাংশ বাচ্চাই সরকারী ইস্কুলে পড়ে। এ ইস্কুল বাড়ি থেকে হেঁটে পাঁচ ছ মিনিট।
  • যোষিতা | ০৩ মার্চ ২০২৪ ০৬:৩৭742445
  • জারমান শেখা নিয়ে বাবু জিজ্ঞাসা করেছিল ফ্রাউ ডিনারকে — আমরা কি বাড়িতে ওর সঙ্গে জারমানে কথা বলব, যাতে ও তাড়াতাড়ি ভাষাটা শিখে নিতে পারে?
    — না না! সেকী? একদম ওরকম করবেন না। ওর সঙ্গে বাড়িতে মাতৃভাষাতেই কথা বলবেন।
    আমি একথা শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। নিজের মেয়ের সঙ্গে যদি মাতৃভাষায় কথা বলতে না পারি, তবে আমার বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যাবে।
    এ দেশে মাতৃভাষায় কথা বলবার কজন মানুষই বা রয়েছে।
    শিক্ষিকাও বলে দিয়েছেন — বাচ্চা নিজের ভাষায় নিজের ঘরে কথা বলতে না পারলে তার দম আটকে যাবে যে।
    জারমান ভাষা শেখা তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, ওরও তো মানিয়ে নেবার জন্য একটু নিজস্ব জায়গা চাই। তাই না?
    আমি বুঝতে পেরেছি। মাতৃভাষাটাই ওর নিজস্ব জায়গার একটা বড়ো অংশ। যে ভাষায় ও চিন্তা করে, স্বপ্ন দেখে, সেই ভাষাতেই ও ওর মনের ভাব সবচেয়ে প্রাঞ্জল করে বোঝাতে পারে। সেখানে চাপ দিলে ও নিজেকেই প্রকাশ ররতে পারবে না। ওর পড়াশুনো শিক্ষা সব যাবে।
    আমি নিজেও জীবনে দুবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছি। একবার সোভিয়েত দেশে, দ্বিতীয়বার এদেশে। 
    মাতৃভাষা এমন জিনিস, যা পাল্টানো ইহজীবনে সম্ভব না।
  • ভালো জায়গায় থামা | 173.62.207.237 | ০৩ মার্চ ২০২৪ ২৩:৪৪742454
  • অন্যগুলো ক্লিফহ্যাঙ্গার - রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজ। মন্দ হবে কেন। smiley
  • aranya | 2601:84:4600:5410:f54b:7c7a:b17c:79f0 | ০৪ মার্চ ২০২৪ ০৪:৫৯742460
  • পড়ছি। ভাল লাগছে। আপনার লেখার হাত দারুণ 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন