এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শুভনন্দন

    Santosh Kumar Pal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ নভেম্বর ২০২৩ | ৪৭৪ বার পঠিত
  • চট্টগ্রামের পথে পথে -১

    ২০২৩ খৃষ্টাব্দের মহালয়া। বেরিয়ে পড়লাম চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। মাস্টারদা ও প্রীতিলতাদির জন্ম ও কর্মভূমিতে। উপলক্ষ‍্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের সুবর্ণ জয়ন্তী কন্ফারেন্স। ১৬ অক্টোবর সারাদিন শুনবো অনেক বাঙালি-অবাঙালি বিদ্বজ্জনের কথা। আমার কথা ক্লোজিং সেশনে, হয়তো সকলকে শোনানোর জন্য, নয়তো বা সময়াভাবে দোহাই দিয়ে অতি সংক্ষেপে দায় সারার জন্য।

    সে যাই হোক, সব আলোচনাই হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে, যা কন্ফারেন্সের থিম "ফিলোসফি: নাও অ্যাণ্ড হিয়ার"-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রধান প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই এসেছিলেন। চট্টগ্রাম, ঢাকা, জাহাঙ্গীর নগর, রাজশাহী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়ান য়ুনিভার্সিটি ফর ওমেন সহ অনেক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বেশ কিছু অধ্যাপক-গবেষক এসেছিলেন।

    এবার পথে নামা

    শুভ বেইন্না!
    "অঁনে কে'ন আছন?
    অ দি, আবার শরে দেহা অইবু।
    আঁই চাটগাঁ যাইয়ুম।
    ন ছাইজ্জুম!"

    বুঝলেন কিছু? এ হচ্ছে বাংলার এক ডায়ালেক্ট, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক বাংলা। (উপভাষা বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না।) কক্সবাজার থেকে বাসে ফেরার পথে অস্বাভাবিক লেটে চলাকে কেন্দ্র করে বাসের যাত্রী, বাসচালক ও কণ্ডাক্টরের মধ্যে তুমুল ঝগড়া, প্রায় হাতাহাতি হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা! মিনিট পাঁচেকের ঘটনা। আমি আর সহযাত্রী তপন চেষ্টা করেও একটি বর্ণও বুঝতে পারি নাই। (তপন অবশ্য বলেছিল, ও "ব‍্যাটা" জাতীয় একটি শব্দ শুনেছে!) ভয় পেয়ে আমি যখন ড্রাইভার- ভাইয়াকে জিঞ্জেস করলাম, বাসটি শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামে পৌঁছাবে তো?, তখন কিন্তু প্রমিত বাংলায় (স্টাণ্ডার্ড বাংলা বোঝাতে শিক্ষিত বাংলাদেশী এই সুন্দর পরিভাষাটি ব‍্যবহার করেন।) উনি বললেন, "সমস‍্যা নাই। নয়ডার মধ্যে পৌঁছে যাবো।" অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে আলাপে আঞ্চলিক ভাষা বললেও অপর অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে বোঝার মতো করেই কথা বলেন ওনারা। এদিকটা সামলে উঠার আগেই কয়েক মিনিটের মধ্যেই সিকিউরিটির লোক এসে কেবল আমাদেরই তত্ত্ব-তালাশ শুরু করলো! "আপনারা?'
    বললাম "ইণ্ডিয়ান?" "পাশপোর্ট?' (হয়তো আমাদের প্রমিত উচ্চারণ শুনেই ওনারা সন্দেহ করেছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে ঘোঁট পাকাতে এসেছে কোনো সন্ত্রাসী !) তৎক্ষণাৎ মনে এল প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ব‍্যথাতুর অভিমানে -ভরা সাম্প্রতিক এই গানটি: "দুইজনাই বাঙালি ছিলাম... দেখো দেখি কাণ্ডখান...তুমি এখন বাংলাদেশী, আমারে কও ইণ্ডিয়ান!"

    যাই হোক, আমরা বেরিয়েছি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে, প্রকৃতি-মায়ের আঁচল যেখানে পাতা সকলের জন্যে। যদিও প্রকৃতি-মায়ের দেহ-মনে বার বার ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে প্রজাতিবাদের ভ্রান্ত মতাদর্শে মত্ত মনুষ্যকুল, তথাপি হৃদয়ের গভীর বেদনা ঢেকে রেখে এখনো কৃতঘ্ন পোলা-পানদের আবাহন করে চলেছে চট্টগ্রামের মা। আবার নরকুলের অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তানদ্বয় মাস্টারদা ও প্রীতিলতাদির জন্ম ও কর্ম এই পবিত্র ভূমিতে। তাঁদের পদচিহ্নে রঞ্জিত অখণ্ড বাংলা তথা ভারতের এই অঞ্চল।

    আগেই বলেছি, লক্ষ‍্য আমার স্বপ্নের চট্টগ্রাম-ভ্রমণ হলেও, উপলক্ষ‍্য ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগের সুবর্ণ জয়ন্তী কন্ফারেন্স। ১৬ ই অক্টোবর কন্ফারেন্স। তবে আগের দু'দিন শনি-রবি এবং পরের ১৮ অক্টোবর থেকে দুর্গোৎসবের ছুটি, তাই শনিবারেই বেরিয়ে পড়লাম বিদ‌্যাসাগ‍র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (আমার ছাত্রও) তপন দে-কে সঙ্গে নিয়ে। কলকাতা থেকে ডাইরেক্ট ফ্লাইট। দেড়টার মধ্যে চট্টগ্রামের এয়ারপোর্ট, যার পোষাকি নাম 'শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর'। একবারে বঙ্গোপসাগরের চরণ ছুঁয়ে থাকা এই এলাকার নাম পাতেঙ্গা। আগেই আমাদের নিমন্ত্রক অধ্যাপক মাসুম আহমেদ ভায়ের সঙ্গে আলোচনা করে রেখেছিলাম আসার পথেই পাতেঙ্গা-সন্দর্শনে। সেভাবেই তিন-চার কিলোমিটারের মধ্যে থাকা পাতেঙ্গা সী বীচ ঘুরে আমাদের সাময়িক আস্তানা চট্টগ্রাম জিলা পরিষদের রেস্ট হাউসে উঠেছিলাম। ঘণ্টা দু'য়েক ছিলাম পাতেঙ্গা সী বীচে। এই বীচটি অনেকখানি আমাদের দীঘার মতো, বালিয়াড়ি খুবই কম। তবে জনবসতি একটু দূরে থাকায় ভিড়ভাট্টাও কম। বেশ সাজানো-গোছানো, পাথর-সিমেন্ট বাঁধানো। বোধ হয়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও টেউয়ের মাতলামিকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। আর পাশেই রয়েছে বাংলাদেশ নেভি ও আন্তর্জাতিক বন্দর, যেখানে পণ্য লোডিং-আনলোডিং হয়! তাই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশের মধ্যে সমুদ্র-স্নান, স্নাকস ও ভাতমাছ/মাংস খাওয়ার ব‍্যবস্থা থাকলেও সেভাবে কোন পারমানেন্ট কংক্রিট স্ট্রাকচার বীচের কাছে নেই। শিশু-কিশোর-কিশোরীদের বিনোদনের জন্য ঘোড়ার গাড়ি, মোটর যান ইত্যাদি রয়েছে।

    আমরা তীর বরাবর বেশ কিছুক্ষণ পদচারণা করে, আশ-পাশ জরিপ করে যার সি এন জি অটো করে এয়ারপোর্ট থেকে এখানে এসেছিলাম সেই ভাই-ই আমাদের শহরের প্রাণকেন্দ্র যেখানে আমাদের থাকার ব‍্যবস্থা হয়েছে সেখানে পৌঁছে দেয়। সবটুকু মিলে ১০ কিমি রাস্তা, ৭০০ বাংলাদেশী টাকায় রফা হয়েছিল। সান-রাইজ ও সানসেট সহ সমুদ্র-সৈকতে যা যা থাকে সবই আছে, তবে মন্দারমণির মতো খুব বেশি অমিতাচারী হওয়ার সুযোগ রাখে নি এরা। মনে হয় নিরাপত্তার কারণে। বলতে ভুলে যাচ্ছিলাম, একটু দূরেই কর্ণফুলির মোহানা। মনে পড়ে গেল রবীন্দ্রনাথের "সহজ পাঠ'- এর দ্বিতীয় ভাগ, পঞ্চম পাঠ: "কর্ণফুলি নদীতে বন‍্যা দেখা দিয়েছে। সর্ষেক্ষেত ডুবিয়ে দিলে। দুর্গানাথের আঙিনায় জল উঠেছে। তার দর্মার বেড়া ভেঙ্গে গেল।'' (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের ফলকে রবিকে ভ‍্যানিশ করে দিলেই কি "সবার হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথ" নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে!) ও হাঁ, আর একটা কথা: যারা এখনও বলে যাচ্ছেন 'ও দেশটার কিস‍্যু হবে না!" তাদের মুখে ছাই দিয়ে তৈরি হয়েছে ৩.৩ কিমি দীর্ঘ নদী-সমুদ্রের তলদেশে বঙ্গবন্ধুর নামে ট‍্যানেল, মূলত পণ্য চলাচলের জন্য। এই পাতেঙ্গার কাছেই। দেড় কাপ করে চিনি-ছাড়া লিকার চা পান করে অটোতে উঠলাম জিলা পরিষদের উদ্দেশে। পৌঁছলাম যখন তখন সন্ধ্যা সমাগত।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Santosh Kumar Pal | ২২ নভেম্বর ২০২৩ ১২:০৫526373
  • চট্টগ্রামের পথে পথে ২

    পরের দিন (১৫/১০) বান্দরবান ভ্রমণের প্রস্তুতি নিতে ব‍্যবস্থাপকদের শরণ নিলাম। (অবশ‍্য বিধি বাম, ঘটনাচক্রে বান্দরবানের পরিবর্তে আমাদের সীতাকুণ্ড দর্শন হয়!) আমাদের জন্য ইমরান ভাই (চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ‍্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র) ও য়ুনিভার্সিটি অফ লিবারেল আর্টসের এক অধ্যাপক সব সময় লজিস্টিক সাপোর্ট দিয়েছেন। এদিকে এখন আমরা এক মুহুর্তের জন্য আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী-সহমর্মীদের থেকে বিছিন্ন থাকতে অভ‍্যস্ত নই। এর জন‍্য অনেককে যেমন বকাবকি করি, তেমনি পদ্মাদেবীদের দ্বারা আমরাও কম 'বকিত' হই না! কিন্তু বাস্তবতাকে কে খণ্ডাতে পারে! আমাদের ফোনে চিত্র-গ্রহণ ছাড়া সব কর্মযজ্ঞই বর্ডার অতিক্রমনের সাথে সাথেই বিদায় নিয়েছে। মনে পড়ে যাচ্ছে জন লেলনের সেই স্বপ্ন:

    ''Imagine there's no countries
    It isn't hard to do
    Nothing to kill or die for
    .................
    Imagine all the people
    Sharing all the world."

    মনে হ'ল, যাঁদের আশ্রয় নিয়েছি অন্তত তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য একটি সিমকার্ড দরকার। আমাদের ছেলে বলেছিল, এয়ারপোর্টের ভিতরে পাশপোর্ট দেখিয়ে সিম নেওয়া যায় সীমিত সময়ের জন্য।

    যাই হোক, ঢাকা এয়ারপোর্টে সে ব‍্যবস্থা থাকলেও চট্টগ্রাম বিমান বন্দরে তা ছিল না। ইমরান ভাইকে সমস্যার কথা জানাতে আমাদের আস্তানার কাছাকাছি দোকানে নিয়ে গিয়ে ইমরান ওর আইডেনটিটি ব‍্যবহার করে আমার ও তপনের যোগাযোগ-যন্ত্রটি সচল করে দিল। তারপর বান্দরবান অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে ভ্রমণের জন্য চতুর্চক্র-যানের খোঁজ করতে সন্নিহিত এলাকায় চিরুনি তল্লাশি শুরু করলাম। অনেক দামাদামি করে শেষে সারাদিনের জন্য ৪ হাজার বাংলাদেশী টাকায় রফা হল। (অবশ্য ড্রাইভার সে প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত রাখেন নি/ রাখতে পারেন নি। সূচি পরিবর্তনের দোহাই দিয়ে আমাদের কাছে আরও ১৫০০ বাংলাদেশী টাকা আদায় করেছে!)

    আগে বলা হয় নি, জিলা পরিষদের রেস্ট হাউসে এসি/ ডিসি সব আছে। কিন্তু কোনো খাবার বা চা-টায়ের ব‍্যবস্থা নেই। নীচে এ সবের দোকান/রেস্টুরেন্ট আছে। কিন্তু সাড়ে আটটার আগে তাদের আতিথ্য পাওয়া অসম্ভব! ভাগ‍্যিস আমার বিশ্ব-ভ্রমণের বিশ্বস্ত সঙ্গী ইলেকট্রিক কেটলিটিকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। গরম জল আর লোপচু টি এস্টেটের টি-ব‍্যাগ, সঙ্গে ব্রিটানিয়ার সদ‍্যোজাত পোটাজোস স্পাইসি বিস্কিটের ছোট্ট একটি ২০ টাকার প‍্যাক। টা-হিসেবে দারুণ। আরো অনেক ইণ্ডিয়ান বিস্কিট ছিল। কিন্তু পোটাজো বিস্কিটটির স্বাদ আমাদের এতই ভালো লেগেছিল যে যে চারটি প্রত‍্যুষ আমরা চট্টগ্রামে ছিলাম লিকার চায়ের সঙ্গে একটি/দুটি ঐ বিস্কিট নিয়ে প্রাত‍্যহিকী শেষ হ'ত।

    কথা মতো সাড়ে ছয়টায় সি এন জি চালিত কার নিয়ে নীচে হাজির আখতার ভাইয়া। ভালো লাগল গোটা বাংলাদেশে পরিবেশ-বান্ধব এই জ্বালানির ব‍্যবহার দেখে। তবে তার জন্য স্বাজাত‍্যাভিমানী ধৈর্যহীন হোমো সাপিয়েন্সের একটু ধৈর্যশীল হওয়া অনুশীলন করতে হবে। সারাদিন গাড়ি চালাতে আখতার ভাইকে তিনবার গ‍্যাস-ফিলিং স্টেশনে লাইন দিতে হয়েছে! যাই হোক, আমাদের সঙ্গে মুড়ির দু'টি করে হোম-ফিনিশড অথচ সীলড পাকেট সব সময় মজুদ। লণ্ডনের মিলেনিয়াম পার্ক, প‍্যারিসে আইফেল টাওয়ার বা রোমের কলোসিয়াম, মেদিনীপুরের ক্ষুদিরামপল্লী বা কোচবিহার রাজবাড়ি - সর্বত্র সে আমার আর এক অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী। ভাজা ছোলা, বাদাম, চিড়ে ভাজা, শুকনো ঝুড়ি ভাজা, এক একটি গুড়ের বাতাসা দিয়ে নিজ প্রযত্নে তৈরি মুড়ির এই ছোট্ট ছোট্ট প‍্যাক! হাঁ, যে কথা বলছিলাম, সকালে রাস্তায় ট্রাফিক কম ছিল। আস্তানা থেকে দু'কিলোমিটার গিয়েই নতুন ব্রিজের টোলপ্লাজা। উন্নয়নশীল বাংলার আরো এক অভিজ্ঞান কর্ণফুলি নদীর উপর এই ব্রিজ। শুধু পদ্মার উপর দীর্ঘ ব্রিজ বা ঢাকা মেট্রো নয়, ফিজিক্যাল ইনফ্রাস্ট্রাকচারে বাংলাদেশের ফেনোমেনাল উন্নতি হয়েছে গত বছর দশেকে। এই মুহুর্তে জিডিপি-তে ইণ্ডিয়াকে পিছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। তবু 'ওরা-আমরা' বাইনারিতে যারা নিরন্তর আটকে থাকতে ভালোবাসে তারা বলে থাকে, ও সব বিদেশি ঋণের কেরামতি! সংশয়াচ্ছন্ন চিত্তে গুগল-গুরুর শরণ নিলাম। দেখলাম, মাথা পিছু বিদেশি ঋণ এক বাংলাদেশীর ৭২ হাজার টাকা (ভারতীয় মূদ্রায় কনভারশনের পর), যেখানে আমার ছেলের মাথায় ঋণ ১,০৯,০০০ টাকা! ( তথ্য যাচাই ও এর তাৎপর্য অনুধাবনের এক ভারতীয় অধ্যাপকের সঙ্গে কথাও বলে নিলাম।) প্রসঙ্গে আসি, স্বল্প ট্রাফিকের আবহে গাড়ি ছুটছে বান্দরবানের উদ্দেশে। প্রকতির বুক চিরে চলা এই হাইওয়ে বেশ সুন্দর। দু'পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য। তৃষাতুর হৃদয় নিয়ে সেনাবাহিনী ট্রেনিং সেন্টার (পদাতিক বাহিনী যুদ্ধের মহড়া আমরা এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম), সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সংরক্ষিত এলাকা দিয়ে ষাট-সত্তর কিলোমিটার অতিক্রম করছি আমরা। তারপর সহসা সিকিউরিটি চেকিং এর সামনে! উপজাতি প্রধান পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রবেশ দ্বারা এটি। এমন হতোদ‍্যম, আশাহত খুবই কমই হয়েছি! "এই এই.. স্টপ স্টপ, দিস সাইড!" ড্রাইভারকে আইডেন্টিটি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে বলার পর "আপনারা?" ড্রাইভার জানিয়ে দিলেন আমরা পাশপোর্টধারী ইণ্ডিয়ান। "আপনাদের কোন পারমিশন?" বললাম, "না, মানে এই পাশপোর্ট!" আলাদা করে যে পারমিশন নেওয়ার ব‍্যাপার আছে সে কথা কেউ সেভাবে আমাদের জানায় নি। এ রকম প্রসঙ্গ গতকাল বুকিং এর সময় হালকা করে উঠলে ড্রাইভার বলেছিলেন, "ওরা বুঝবে না। ঠিক ঢুকে পড়বো। বাংলায় কথা বলবেন তো!" বু্ঝিনি এই শিথিলতাই আমাদের ডোবাবে! আমাদের গাড়ি আরও পাশে সরিয়ে এনে একজন বর্ডার সিকিউরিটি স্টাফ প্রমিত বাংলায় বললেন,"দেখুন, আপনারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নিমন্ত্রণে এসেছেন, তাই আমাদের মেহমান! কিন্তু এখন পরিস্থিতিগত কারণে বিদেশিদের ব‍্যাপারে এক্সটারন‍্যাল আফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টের অনুমতি অবশ্য প্রয়োজনীয়।" (হাঁ, সাম্প্রতিক ঐ এলাকায় দু একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে, মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার আমাকে জানিয়েছিল আগেই। মাসুম সাহেব অবশ্য বেশ কিছুদিন হয়ে গেছে, এখন সমস্যা নেই বলে জানিয়েছিলেন।) আপনারা চ বি স‍্যারেদের সঙ্গে কথা বলুন। উনারা যদি পার্বত্য পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে কিছু ব‍্যবস্থা করতে পারেন!" আমাদের চেয়ারে বসালেন। আমি মাসুম স‍্যারকে ফোন করলাম। উনি বললেন, "দেখছি, দেখছি!" আধ ঘন্টা পরে অনেক ফোনাফুনি করে ব‍্যর্থ-মনোরথ হয়ে আমদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করলেন, জানালেন বড্ড দেরি হয়ে গেছে, গতকালও অনলাইনে একটা অ্যাপিল করে রাখলেও হয়তো সম্ভব হতো। আমার স্বপ্নের বান্দরবান আর বাস্তবের স্পর্শ পেলো না।

    ড্রাইভার তখন বিকল্প প্রস্তাব করলেন, "আমরা তাহলে সীতাকুণ্ড ঘুরে আসতে পারি। বাকি ল‍্যোকাল সাইট সীয়িং করে নেবেন ফিরতি পথে।" সীতাকুণ্ডর প্রস্তাবে ভগ্নহৃদয়ে কিছুটা আশার সঞ্চার হ'ল। আমার স্বপ্নের শক্তিপীঠ সীতাকুণ্ড, একান্ন পীঠের এক পীঠ! পৌরাণিক কাহিনী মতে, সতীর ডান হাত এখানে পড়েছিল। আর্যাবর্তের অন্যতম পবিত্র স্থান। এর ওর কাছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শোনা আমার কাছে ছবিটি ছিল এ রকম: দুর্গম, অনেক উঁচু পাহাড়, পৈদল উঠনা পড়েগা! অত সিড়ি ভেঙ্গে ক'জন আর উপরে উঠতে পারে! আমি কি পারবো? যদিও পরজন্ম বেহেস্ত বা পুণ‍্যলাভের লোভ আমার নেই, তবু আমার প্রজাতির এক বড় সংখ্যার সদস‍্য যখন এত পরিশ্রম, ত‍্যাগ, এত ভক্তি, আবেগ নিয়ে 'ভোলে বাবা' বলে বেরিয়ে পড়ে তখন অনুভব করতে ইচ্ছে করে তাদের মনস্তত্ত্বকে, এবং তাই ফেনোমেনোলজিস্ট হিসেবে ঐ অন্বিষ্টের সাধকদের যাপিত অভিজ্ঞতারাজির (die Erlebnisse) কাছাকাছি পৌঁছানোর চেষ্টা।

    তবে সময়ের ব‍্যবধানটা মাথায় আসে নি। মনে পড়ল আগে বলা হ'ত, "সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার!" কিন্তু ঘটনা হল, কলকাতা থেকে লঞ্চে করে গঙ্গা সাগর ডেইলিপ‍্যাসেঞ্জারি করা যেতে পারে এখন!

    ফিরে আসি আমাদের সিএনজি রেন্টেড কারের ইউ-টার্নে। একই রাস্তায় ফিরে আবার শহরে ঢুকে অন্য রুটে সতীর দক্ষিণ-হস্ত-স্পর্শে ধন‍্য সীতাকুণ্ডর উদ্দেশে যাত্রা শুরু হ'ল। বেলা দশটা নাগাদ চট্টগ্রাম শহর-মূলের বুড়ি ছুঁড়ে সীতাকুণ্ডর পথ ধরা! কি সাঙ্ঘাতিক জ‍্যাম, সঙ্গে এখানে ওখানে রাস্তা-ঘাটের ফিনিশিং টাচ, সংসদীয় নির্বাচন যে এসে গেছে! ভারতীয় হিসেবে একলপ্ত রিডিং দিয়েই বুঝে নিলাম কর্মোন্মত্ততার আধিভৌতিক কারণ। এ সি চালু কারে, তবু প্রচণ্ড অস্বস্তি। এখানে বাংলাদেশের নিন্দে হয়ে গেলেও আমি অসহায়। ট্রাফিক কন্ট্রোলে বাংলার ব‍্যর্থতার কোন এক্সকিউজ হয় না। রাজশাহী, ঢাকা, চট্টগ্রাম--তিনটি ডিভিশনে ঘুরে-বেড়িয়ে মনে হয়েছে, এ ব‍্যাপারে প্রশাসনের শীতঘুম ২০২৩ সালেও ভাঙ্গে নি। ম‍্যান পাওয়ার অপর্যাপ্ত হলেও যন্ত্রের সাহায্যে বেশ ভালোভাবেই যান-নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাংলাদেশের আমার সহকর্মীদের সঙ্গে এ ব‍্যাপারে কথা বলে কেবল একটিই এক্সকিউজ পেয়েছি, যানচালক সহ মানুষগুলিকে পাল্টানো যাবে না! স‍্যরি, মানতে পারলাম না। কলকাতার ট্রাফিকের সঙ্গে পরামর্শ নিয়ে কাজে নামলে অবশ্যই সম্ভব। সদিচ্ছা না দেখালে ড্রাইভিং লাইসেন্সটা দু'দিন আটকে রাখুন। একদিনে হবে না, কিন্তু একদিন হবেই! তা না হলে উন্নয়নের এই অগ্রগতি মুখ থুবড়ে পড়বে অচিরেই।

    ক্ষমা চাইছি ধান ভানতে একটু শিবের গীত গাওয়ার জন‍্য। সাড়ে বারোটা বাজিয়ে জ‍্যাম জয় করে এগিয়ে যেতে মনের মধ্যে দক্ষরাজের যজ্ঞ, সতীর বরের অপমান, তাণ্ডব-নৃত্য ইত্যাদি আবার মনে উঁকি দিতে লাগল। দেড় ঘন্টার মধ্যে আখতার ভাই গাড়ি থামিয়ে বললেন, "এসে গেছি। এটাই চন্দ্রনাথ পাহাড়।" ভাবলাম, এত সহজে সতী-তীর্থে পৌঁছে যাওয়া যায়! আমার ছাত্র তপনের পেঠ তখন খিদেয় চিঁ চিঁ করছে। ভেতো বাঙালি খাদ্য খুঁজে বেড়াচ্ছে! ভক্তের ভাত খুঁজতে এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করছি, সীতাকুণ্ডর জলাশয়ের ছবি তুলছি, হঠাৎ দু'জন মাতৃস্বসোপম ব‍্যক্তি অনেক উপরে সিড়িতে বসে আছেন। উঠতে লাগলাম সিড়ি পেরিয়ে উপরের দিকে। আর তিন চারটি সিড়ি বাকি আছে এ রকম অবস্থায় দেবদূতের এক জন মন্দির কর্মে সহায়ক ব‍্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, "প্রসাদ লাগবে?"

    "কিন্তু আমারা তো কুপন কাটিনি!" উনি বললেন, "আসুন প্রসাদ-গ্রহণ কক্ষে। সত্তর টাকা করে বের করে রাখুন।" ছোলার পুরু ডাল, মিক্সড ভেজিটেবল, আর দাবিভর সাদা ভাত প্রসাদ। তপনকে আমি তো আর থামাতে পারছি না! গতকাল থেকে ব‍্যাটা প্রায় নিরন্ন! বৌমার দেওয়ার কয়েকটি রুটি দমদম এয়ারপোর্ট-এ চিবিয়ে খেয়েছে। রাতেও আবার তপনকে পদ্মাদির অল্প ময়ান দিয়ে তৈরি করা রুটিই খেতে হয়েছে! সহধর্মিনী আর সাদা ভাত যে কি জিনিস বিদেশের মাটিতে এই প্রথম টের পেল তপন! (স্বীকার করি, আমিও, যদিও প্রথম নয়!)

    সীতাকুণ্ড নাম নিয়ে একটি দু'টি কথা। পৌরাণিক কাহিনী ও রামায়ণ অনুসারে নির্বাসন কালে রামচন্দ্র যখন এই এলাকায় ভ্রমণ করেছিলেন তখন সীতার স্নানের জন্য ঋষি ভার্গব যে পুষ্ককরণীটি এখানে কাটিয়েছিলেন তার নাম হয় সীতাকুণ্ড। এই নাম অনুসারে এই অঞ্চলের এরকম নাম। এই সতীপীঠে বাবা বিশ্বনাথের একটি সুদৃশ্য মন্দির আছে। আর আছে শঙ্করাচার্য মঠ। এই সতীপীঠে চন্দ্রনাথ পাহাড় ১১৫২ ফুট উঁচু। এর শীর্ষে অবস্থিত বলে ঐ পবিত্র স্থানে উঠতে হ'ত অনেক দুর্গম সিড়ি পেরিয়ে। এখন অবশ্য পাকাপোক্ত সিড়ি করে দেওয়া হয়েছে। পাশে সাপোর্ট-রেলিং‌। ফলে সতীপীঠে পৌঁছনো অনেক সহজ হয়েছে। তবে এখনো শতাধিক সিড়ি উঠেই ওখানে উঠতে হয়। বয়স্ক ও অসুস্থ ভক্তদের পক্ষে তাই দর্শনের পুণ্যলাভ এখনো সহজ নয়!

    যাতায়াতের জন্য রেলের যোগাযোগ রয়েছে। আর সড়কযোগে চট্টগ্রাম থেকে ৪৪ কিমি। এই পর্ব শেষ করছি প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের লিরিক্স দিয়ে:

    "আমি বাংলায় ভালোবাসি, আমি বাংলাকে ভালোবাসি আমি তারই হাত ধরে সারা পৃথিবীর-মানুষের কাছে আসি আমি যা কিছু মহান বরণ করেছি বিনম্র শ্রদ্ধায় মিশে তেরো নদী, সাত সাগরের জল গঙ্গায়-পদ্মায় বাংলা আমার তৃষ্ণার জল, তৃপ্ত শেষ চুমুক আমি একবার দেখি, বার বার দেখি, দেখি বাংলার মুখ॥''

    (চলবে) ——
  • Santosh Kumar Pal | ২২ নভেম্বর ২০২৩ ২২:১৭526387
  •  চট্টগ্রামের পথে পথে ৩

    সীতাকুণ্ড থেকে চট্টগ্রামে ফেরার পথে শহরের কমবেশি ২০ কিমি ব‍্যসার্ধের মধ্যে থাকা প্রকৃতির মায়া-মাখা কয়েকটি দর্শনীয় স্থান কথামতো গাড়িতে ঘুরিয়ে দেখালেন আখতার ভাই। প্রথমেই বলে রাখি, চট্টগ্রাম প্রকৃতির এক অনবদ্য উপহার: একদিকে সমুদ্র, আরেক দিকে উচ্চ-নীচ নানা মাপের পাহাড়। এমন সুন্দর সহাবস্থান খুবই কম দেখা যায়। সান-রাইজ ও সান-সেট দুটোই চাক্ষুষ করতে হলে চাঁটগা-ই উপযুক্ত স্থান। পাতেঙ্গার সমুদ্র সৈকতের কথা তো আগেই বলেছি। এবার পর্বতের কোলে নিটোল, সুশীতল জলাভূমি, যার পোশাকি নাম লেক; ছায়া দানকারী বৃক্ষ-গুল্মের মিছিল ও পাখির কলতান। মূলত প্রকৃতির খেয়ালে বেড়ে ওঠা ভ‍্যাটিয়ারি লেকের দিকে সব পথটাই দৃষ্টি-নন্দন গাছপালা, জাস্ট অ্যা ওয়ে টু হেভেন! পর্যটকদের জন্য এখন বেশ কয়েকটি ভিউ-পয়েন্ট বানানো হয়েছে। তার মধ্যে ১৩১ ফুট উঁচু সানসেট পয়েন্টটি সকলেরই হৃদয়-চক্ষু স্পর্শ করবে। এতটা উপরে দাঁড়িয়ে কফিশপে কফিতে চুমুক দিয়ে নীচে সূর্যাস্ত দেখা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। চট্টগ্রাম-হাটহাজারীর এই মহাসড়কটি প্রকৃতি-মায়ের কোমল স্পর্শ গায়ে মেখে এগিয়ে চলেছে।  ২০ বর্গ কিমি এলাকায় আঁচল-পাতা এই লেকটি এদিক ওদিক করে ছড়িয়ে রয়েছে। মূল রাস্তা থেকে সবটুকু আপনার দৃশ্যগোচর হবে না। তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এই লেকে টিকিট কেটে ভিতরে আপনাকে ঢুকতেই হবে। প্রবেশ পথেই একটি এথনিসিটি ম‍্যাপ জানান দিচ্ছে বাংলাদেশের জন-বৈচিত্র্য। সকলেই বাঙালি, কিন্তু এক এক জনগোষ্ঠীর এক এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নিজস্ব পরিচয় বহন করে চলেছে।  অন‍্যান‍্য বিভিন্ন দেশে যেমন হয়, মাঝে মধ্যে উদারতা তথা সহনশীলতার অভাব সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করে। 'এক দেশ এক সংস্কৃতি'-র মতাদর্শ তথা সংকীর্ণ নেতৃত্ব ও রাজনীতি  এখনো সমস্যাদীর্ণ মানব সভ্যতাকে মাঝে মধ্যে আরও বিপদে ফেলার চেষ্টা করছে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করে এক গোষ্ঠীর সংস্কৃতি অন‍্য সকলের উপরে জোর চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে। ভারত বা বাংলা বা শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তান-কেউই তার তার থেকে মুক্ত নয়। সুস্থ মনের মানুষকে দুটি বিকল্প থেকে বেছে নিতে হয়, আপরাপর সংস্কৃতি বা পরিচিতি-সত্তাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে 'বয়েলিং বাউল'-এ ফেলবে, নাকি বহুসংস্কৃতিবাদের 'বাউল অফ স‍্যালাড'-কে মেনে নেবে (অবশ্যই সাবধানতার সঙ্গে)। আমার তো মনে হয়, সামনে পথে এগিয়ে যেতে হলে 'বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য'-কে মেনে নিতেই হবে, নইলে আরও আরও পিছিয়ে পড়তে হবে।
    হাঁ, যে কথা বলছিলাম, ভ‍্যটিয়ারি লেকের ভিতরে
    ইতিহাস চিহ্নস্বরূপ দু একটা যুদ্ধ-কামান, অসংখ্য গাছ-গুল্ম, বসে প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধানো বেঞ্চ, পদ্ম-শালুক, দামি দুষ্প্রাপ্য ফলের গাছও! সবটাই যেন ছবির মতো। বান্দরবানের নীলগিরির একটি দিক এই অঞ্চল। কিন্তু ছাত্র তপনের তাগাদায় প্রকৃতি-মায়ের আঁচলের শেষটুকু আর ঠাউর করা গেল না। 
    যাই হোক, ফেরার পথে আর একটি লেক, যার নাম ফয়েজ লেক, তার কথা বলতেই হয়। আমাদের ছাত্রী মেমের শ্বশুর, যিনিএই কর্ণফুলি উপত্যকার স্থায়ী বাসিন্দা, এই লেকটি দেখার কথা বিশেষভাবে বলেছিলেন। এ লেকের সবটাই প্রাকৃতিক বললে ইতিহাসের অপলাপ করা হয়। শুধু বর্তমানের চোখে দেখলে একবারে প্রাকৃতিক মনে হবে। শহরের মধ্যে চিড়িয়াখানার পাশে থাকা  যন্ত্র-সভ‍্যতার ক্লান্তি কাটিয়ে রিফ্রেশড করতেএই জলাশয়টির জুড়ি মেলা ভার। একটি প্রাইভেট কোম্পানি  কনকর্ড বিনোদন-পার্ক হিসাবে একে রক্ষণাবেক্ষণ ও লভ্যাংশ গণনা করে। অবশ্য এনজয়মেন্ট বা উপভোগ-এই পরিভাষাটি আমার বড্ড মোটা দাগের মনে হয়। নৌকা বিহারের ব‍্যবস্থা খুবই ভালো। কিছুটা চিড়িয়াখানার আদলে সংরক্ষণ, ইত্যাদি অনেক কিছু। এধরনের জলাভূমি বা লেকে নিবিড়ভাবে প্রকৃতিতে তন্ময় হয়ে একাকী একঘন্টা কাটানোকে বোঝাতে কি ভাষা উপযুক্ত হবে বলুন তো!
    এবার ইতিহাসে আসি: চট্টগ্রামের পাহাড়তলী এলাকায় অবস্থিত এই হ্রদটি ১৯২৪ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে উপর থেকে নেমে আসা ঝরণাগুলিকে একত্রিত করে জলসংরক্ষণের ব‍্যবস্থা থেকেই এই লেক। ইংরেজ রেল ইঞ্জিনিয়ার ফয়-ই এর মূল কারিগর। তাই তাঁর নামেই ফয়েজ লেক। বোটিংএর সুন্দর ব‍্যবস্থা, কয়েক ঘন্টা বোটটিকে মধ্যিখানে নিয়ে গিয়ে ধ‍্যানমগ্ন হলে আপনার মানস সরোবর ভ্রমণের অনুভব হবে। পাশেই বাচ্চাদের জন্য বিনোদনের নানা রকমের ব‍্যবস্থা, সঙ্গে হালকা রিফ্রেশমেন্ট পাবেন।
    আমাদের ড্রাইভার-ভাইয়া সবশেষ সন্ধ্যায় যেখানে আমাদের নিয়ে গেলেন তা আমাদের স্বপ্নের প্রীতি- লতাদির সেই অ্যাকশন স্কোয়াড! যে দুটি কারণে আমি 'আমার স্বপ্নের চট্টগ্রাম' বলছি তার একটি এই ইউরোপীয়ান ক্লাবে পরাধীন ভারতমাতাকে শৃঙ্খল মোচনে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনপন লড়াই। (অন্যটি মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্মস্থান। বেশ কিছুটা দূরে, তাই এবার হ'ল না। এশিয়ান য়ুনিভার্সিটি ফর ওমেনের তাপু ম‍্যাম অবশ্য বলেছেন, পরের বার নিয়ে যাবেন। উনাদের গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি। বয়াজিদ বোস্টামি মাজার ও কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি, জিয়া মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ইত‍্যাদি কয়েকটি স্থানও দেখা বাকি রয়ে গেল!) এই সেই ক্লাব যেখানে বোর্ডে লেখা থাকতো "Dogs and Indians not allowed!" বাঙালির তথা ভারতবাসীর এই অপমান স্বাধীনতা-সংগ্রামীদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়ছিল।  
    প্রীতিলতা  মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবী দলে যোগদান করেন। তিনি এই পাহাড়তলী ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণে নেতৃত্ব দেন। ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জনের একটি বিপ্লবী দলের তাঁর নেতৃত্বে ক্লাবে অগ্নিসংযোগ করে। গোলাগুলি চলে এবং পরে ব্রিটিশ পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে প্রীতিলতা সায়ানাইড মুখে দিয়ে মৃত্যু বরণ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের 'প্রথম মহিলা শহীদ' অন‍্যত্র সম্মান পেলেও এই স্থানে তাঁর জন্য বরাদ্দ কেবল এক 
    ছটাক জমি আর একটি ফলক! ক্লাবটি এখন রেলের একটি অফিস হয়েছে দেখলাম। এখানে তাঁর স্মৃতিতে একটি আবক্ষ মূর্তি  বা একটি সংগ্রহশালা আশা করা কি অন‍্যায়? বড্ড হতাশ হলাম। এর কারণ কি আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভঙ্গি, না বাহান্নর আগের ইতিহাসের  প্রতি প্রভাবশালী মহলের উন্নাসিকতা!  
    পরের দিনের আর একটি অভিজ্ঞতা এখানেই তুলে রাখি। আমার লোক‍্যাল গার্ডিয়ান ইমরান ছাড়া আমাদের অবস্থা ঠুঁটো জগন্নাথের মতো। কন্ফারেন্সের দিন তাপু চৌধুরী ( চ বি দর্শন বিভাগের প্রাক্তনী, এখন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক মানের বিশ্ববিদ্যালয় "এশিয়ান য়ুনিভার্সিটি ফর ওমেন" এর অ্যাসিস্টান্ট রেজিস্ট্রার) ম‍্যমের নারীবাদের উপর বক্তব্য শুনতে শুনতে কিছু প্রশ্ন মনে উদয় হয়। আমার আবার ফলমুখী দর্শন তথা মানবীবিদ‍্যা বিষয়ে কেউ কিছু মিনিংফুলি বলার চেষ্টা করলে তার সাথে যোগাযোগ করা, বা বলতে পারেন অযাচিতভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে যাওয়া আমার মূদ্রাদোষ। ফোন নং যোগাড় করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলাম, কাল সকালে তাঁদের য়ুনিভার্সিটিতে সকালে আমাদের দেখা হবে ঠিক হ'ল। কিন্তু কীভাবে? হঠাৎ মনে হল, ইমরান ভাইয়ের শরণ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। প্রস্তাব তুলতেই জানালো, সকালে জন ম‍্যাথুকে নিয়ে ওখানেই যাবে। আপনিও স্বাগত! ওখানে একটু আগে পৌঁছে যাই। মাডামের আসতে দেরি থাকায় কি করি কি করি ভাবতে ভাবতে নাইজেরিয়ান স‍্যার ড. সাইমন ক্লেয়ার্ক জেণ্ডারের উপর তাঁর ক্লাসে আমাদের ডেকে নিলেন। বি এ এর ক্লাস। সে এক বিরল অভিজ্ঞতা। খোলামেলা আলোচনা। আমি যোগ করলাম সেক্স ও জেণ্ডারের মধ্যে পার্থক্য, ডিফারেন্ট লেভেলস  অফ মিসোজিনি। ম‍্যাথু স‍্যার  হিস্ট্রি অফ সায়েন্স থেকে আলাপ করলেন। হিউম্যান জেনম প্রোজেক্ট, ইউজেনিকস বিষয়ে আলোচনায় আমিও সমৃদ্ধ হ'লাম। এশিয়ার নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, আফগানিস্তান  প্রভৃতি দেশ থেকে মেয়েরা এখানে উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হয়েছে। আফগান সহ কিছু মেয়ের জীবন-কাহিনী ও সংগ্রাম করে বেরিয়ে আসার গল্প পরে তাপু ম‍্যামের কাছে শুনেছি। আফগানিস্তান থেকে উদ্ধার হওয়া একটি মেয়ে ঘুমাতে পারে না, আধোঘুমে এখনো চীৎকার করে উঠে!  গেটস ফাউন্ডেশন সহ অনেক ফিলানথ্রোপিক ব‍্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতাই চলা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ বেশ উদার, টাইম-টেবল অবশ্যই একটা আছে। তবে প্রয়োজনে স‍্যারেরা অনেক রাত পর্যন্ত ক্লাস নেন। ছাত্রীরা যতক্ষণ পর্যন্ত না শিখছে বা বলতে পারছে ততক্ষণ ছাড় নেই! মিডিয়াম অবশ্যই ইংলিশ। মনে মনে ভাবলাম, রিটায়ারমেন্টের পর এখানে জয়েন করলে কেমন হয়! 
    (চলবে)
  • Santosh Kumar Pal | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:১৩526422
  • আমার স্বপ্নের চট্টগ্রাম ভ্রমণ ৪
    বাংলাদেশ বা চট্টগ্রাম গেলে কক্সবাজারে একবার না গেলে হয়! আমরা এপার বাংলার ঘটিবাটিরা কক্সবাজারের সঙ্গে পরিচিত অন্যভাবে এবং অনেক আগে থেকেই। আকাশবাণীর সেই সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়কে মনে পড়ে? শেষ পাতে সেই আবহাওয়ার খবর: "বঙ্গোপসাগরে উত্থিত ঘূর্ণিঝড় এখন সুন্দরবন অতিক্রম করে কক্সবাজারের দিকে..."  স্বার্থপরের মতো ভাবতাম, যাক, আমাদের তো ফাঁড়া কাটলো! এ প্রসঙ্গে পিটার সিঙ্গার ও চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের কথা তোলা খুব একটা অবান্তর হবে না। স্থানিক দূরত্ব মোরাল কনসার্নের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য সৃষ্টি করার কথা নয়। ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবনে প্রসূনদের বাড়িঘর উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, আর কক্সবাজারের রাশেদের বাড়ি-ঘর ধূলিস‍্যাৎ হয়ে যাওয়া--এই দুটি ঘটনায় নৈতিক অনুভব আলাদা হবে কেন? অথচ আমরা ৯৯% মানুষ এভাবেই ভাবি। এপার বাংলার চন্দ্রবিন্দু ব‍্যাণ্ডের খ‍্যাতনামা গীতিকার ও গায়ক চন্দ্রিল একজন সুবক্তাও বটেন। উনি একটি টক শো বলছিলেন, আমরা সাধারণ মানুষেরা যদি কাছে-দূরে, সামনে- পিছনের সব দুর্ঘটনাতে সমানভাবে দুঃখিত হই, সত্যিসত্যিই কান্নাকাটি শুরু করে দিই, তাহলে তো জগত অচল হয়ে যায়! কাছের যে কয়েকজনকে বাঁচাতে পারতাম তাও কি তখন করে উঠৈ পারবো? হক কথা! (অবশ্য পিটার সিঙ্গার যে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, ইউ এন ও-র লজিস্টিকসকে মাথায় রেখে কথা বলছেন, যে প্রসঙ্গে "ওয়ান মোরাল কমিউনিটি"-র কথা বলছেন সেখানে বিষয়টি অবশ্যই একটু আলাদা।) যাই হোক, এটুকু বোধ হয় বলা যায়, একেবারে একান্ত সমানুভূতি-হীন অসংবেদনশীল হয়ে থাকা কোন ক্ষেত্রেই কাম‍্য নয়। মনুষ‍্য প্রজাতির সদস্য হিসেবে, অন্তত চক্ষুলজ্জার খাতিরে, ঐ কঠিন অবস্থায় বলা যায় না: এমন তো কতই হয়! আমাকে বোর করো না!  
    যাই হোক,শিবের গীত ছেড়ে এবার প্রসঙ্গে আসি। ১৬ অক্টোবর কনফারেন্সের সমাপ্তিলগ্নে মান্নান স‍্যারকে যখন আমার আর তপনের মনোবাঞ্ছার কথা জানাই তখনই তিনি ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, কক্সবাজারের দিকে বাড়ি এমন কে আছো? এক ছাত্র রাশেদ জানায় তাঁর বাড়ি ওদিকেই। ব‍্যস! উনি রাশেদকে বলে দিলেন, স‍্যারদের যাওয়া ও ঘোরার সব ব‍্যবস্থা করো! স‍্যার তো বলেই খালাস! রাশেদর পরের দিনই (যেদিন আমরা যাব ভাবছি) ইন্টারন‍্যাল পরীক্ষা ভাইভা। কিন্তু বলেছি না, বাঙালদের আতিথেয়তায় খামতি থাকে না! রাশেদ সুন্দর একটা ব‍্যবস্থা করল, স‍্যার, কাল সকালে আপনাদের জিলা পরিষদের রেস্টরুম থেকে নিয়ে ঠিক বাসে তুলে দেবো। আর কক্সবাজারে আমার বন্ধু আপনারা যেমন চাইবেন ঘুরিয়ে দেখিয়ে দেবে! যেমন কথা তেমন কাজ! সকালে স্বাধীন ট্রাভেলস একটি এয়ার কণ্ডিশন বাসে তুলে দিল, সিটপিছু ৬০০ টাকা, ননস্টপ। ১৫২ কিলোমিটার রাস্তা পেরুতে ৪ ঘণ্টার সময় নিলো।  রাস্তা খুব খারাপ নয়, অবশ্য দু' লেনের। তবে নন-স্টপ বললেও মাঝে মধ্যে দু'চার জন ওঠানামা করেছে বৈকি। বাস যখন কক্সবাজারের কলাতলীতে নামিয়ে দিল তখনই ফোনে যোগাযোগ হয়ে গেল রাশেদর বন্ধুর সঙ্গে। প্রথমমেই সামনের মেইন বীচে নিয়ে গেল আমাদের। বীচের এ দিকটার নাম বোধ হয় লাবণী সৈকত।
    কয়েকটি কথা আগেই বলে নেওয়া যাক।কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সবচেয়ে বড় পর্যটন কেন্দ্র। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার সদর দপ্তরও।এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালিময় সৈকত, দৈর্ঘ‍্যে যা ১২০ কি.মি.। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন। অদূর ভবিষ্যতে যারা কক্সবাজার ভ্রমনে যাবেন তাদের জন্য সুখবর: চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার অবধি রেললাইন স্থাপনের প্রকল্পের কাজ শেষের দিকে। আশা করা যাচ্ছে এ বছর সংসদীয় নির্বাচনের আগেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে সরাসরি ট্রেন চলাচল শুরু হবে।
    আমরা সমুদ্র সৈকতে ২০/২২ কিলোমিটার দর্শন করেছি, কিছুটা হেঁটে, আর অনেকটা অটোতে। প্রাণ খুলে না, স্নান করেছি ভয়ে ভয়ে! পৈ পৈ করে উনি বলে দিয়েছেন, একদম জলে নামবে না! যদি নামো, একদম কাছাকাছি! কিন্তু সমুদ্রের ঢেউ যে আমাকে টানে! অজয়-তীরবর্তী গ্রামের ছেলে বলে জলকে ততটা ভয় পাই না যতটা ওনাকে পাই! (আসলে যার খাই, যার পড়ি তাকে তো মানতেই হয়, তাই না!) বড় ঢেউ সামনে এলে আমি ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারি। তবে একটা ঢেউ এর তাল গুনতে কালক্ষেপ করায় কানে একটু জল ঢুকেই যায়।  (অদৃশ্য) ওনার ভয়ে  তাড়াতাড়ি উঠে এসে তপনের পাশে ভাড়া করা শেডের তলায় বসি। ডীন আর্টস তপনের আবার অনলাইনে প্রোজেক্ট ফেলো সিলেকশনের ইন্টারভিউ চলছে সী বীচে বসেই! আমি বসে বসে ঢেউ গুনছি,পর্যটকের বালুকাবেলায় ঝিনুক খোঁজা দেখছি। ঢেউ এর পর ঢেউ এর আঘাত সহ‍্য করে স্নান করেই যাচ্ছে কত নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর।  ঘণ্টাখানেক এখানে কাটিয়ে রাস্তার হোটেলে একটু মাছ-ভাত খেয়ে নিয়েই আমরা সি এন জি ভাড়া করে আট-দশ কিমি দূরে গিয়ে সমুদ্র উপকূলে প্রাকৃতিক রিরাট বিরাট সাজানো পাথর সারি দেখতে গেছি। তারই উলটো দিকে  উঁচু সুদৃশ্য পাহাড়ী উপত্যকা। এ এক সুন্দর মেলবন্ধন।
    শুনলাম এখানে এক বড়ো মাপের, প্রায় ৪০ লাখ, বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী আছে। তাদের গ্রামগুলিতে হস্তশিল্প দেখার মতো। তাদের জীবন যাপন দেখতে ইচ্ছে করে, বুঝতে ইচ্ছে করে। কিন্তু শুধু সাধ করলেই তো হবে না, একটু সময় দিতে হবে তো!  এখানে আছে আদ‍্যামেদা খ‍্যায়াং নামে মনাস্ট্রি, বড় পবিত্র স্থান এটি বৌদ্ধদের কাছে। না, যাওয়া হয় নি মহেশখালীর আদিনাথ মন্দিরেও। আবার, টেকনাফ সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সৈকতের একটি অংশ। শুনলাম, জাহাজযোগে দুই- আড়াই ঘন্টার মধ্যে বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে টেকনাফ হতে সেন্ট মার্টিনে পৌঁছানো যায়। মায়ানমারের অতি সন্নিকটে এই দ্বীপে একদিন থেকে থাকতে পারলে কতই না ভালো হতো! এখানে আছে হিমছড়ি জাতীয় উদ্যান, যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গবেষণা ও শিক্ষণ, পর্যটন ও বিনোদন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ। না, একদিনের ট‍্যুরে এসব কিছু হওয়ার নয়। অন্তত দুটি রাত্রি এখানে আর এক রাত্রি সেন্ট মার্টিনের হোটেলে থাকলে তবেই সম্ভব। দেখি, কক্সসাহেব যদি আবার কখনও টানে!
    নতুন জায়গা, তাই বেশি দেরি না করে চারটে নাগাদ ফিরতি বাসে উঠে পড়লাম। লাইন দিয়ে অনেকগুলি চট্টগ্রাম-গমনেচ্ছু বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে পর পর। সাধারণত আমরা ভাবি, সামনের দিকে থাকা বাসই তো আগে যাবে। আবার দুশো দুশো চারশো টাকা কম লাগছে দেখে, রোদে আর অন্য বাস খোঁজাখুঁজি না করে সৌদিয়া ট্রাভেলস এই নন-এসি বাসে চেপে বসলাম। কণ্ডাক্টরকে জিজ্ঞেস করলে বলেন,হাঁ, আটটার মধ্যেই চট্টগ্রাম পৌঁছে যাবে! কিন্তু বাসের অস্বাভাবিক শ্লথগতি দেখে প্রথম থেকেই একটা অস্বস্তি, হালকা উদ্বেগ।  ১৫ কিমি রাস্তা পেরুতে যখন সোয়া একঘন্টা লাগিয়ে দিল তখন নিজেদেরকে প্রতারিত মনে হচ্ছিল। দু'পা এগিয়ে হঠাৎ একবারে স্টার্ট বন্ধ করে উনি দাঁড়িয়ে পড়লেন এক সুদৃশ্য মসজিদের সামনে। ড্রাইভার বাদে কণ্ডাক্টর সহ প্রায় অর্ধেক যাত্রী বাস থেকে নেমে সামনের অজুখানায় শুদ্ধ হয়ে মসজিদে নামাজে যোগ দিলেন। এবার একবারে নেমেই পড়লাম আমি আর তপন, যদিও একে একে। বাসের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি, ছোট্ট করে লেখাই আছে "নামাজের বিরতি সহ"। এবারে দেড় ঘন্টায় পনেরো কিমির অঙ্কটা মিললো। কিছু করার নেই, যস্মিন দেশে যদাচার:। আমাদের ভয় হচ্ছে, রাত নয়টা-দশটা পেরিয়ে গেলে বাসস্টাণ্ড কর্ণফুলি ব্রিজ থেকে জিলা পরিষদের বাসায় কীভাবে পৌঁছাব! যদি সি এন জি অটো না পাই! যাই হোক, সাড়ে ন'টায় নামালো ব্রিজে, যে ঘটনাটা ঘটার কথা ছিল পৌনে আট থেকে আটটার মধ্যে। রাশেদ ভাইয়ের কথার মানে তখন ঠেকে শিখলাম। ও বলেছিলো, স‍্যার, এই স্বাধীন ট্রাভেলসের বাসে ফিরবেন কিন্তু!
    আমাদের কথা উপসংহারের পথে। শেষ করার আগে দুটি কথা। এক, ইলিশ। আমাদের এদিকে অধিকাংশই ভাবেন বাংলাদেশ মানেই ইলিশ। ছাত্র ছাত্রীরা কেবলই জানতে চান, ইলিশ খেয়েছি কি না! কিন্তু এখানে এসে মনে হ'ল,  বিশেষ হোটেল-রেস্টুরেন্টে না গেলে এত মহার্ঘ‍্য আইটেম  চাইলেই পাওয়া যাবে না যখন তখন। আবার সিজিনের প্রশ্ন আছে, এখন ইলিশের সিজিন নয় বোধ হয়। চট্টগ্রামের জিলা পরিষদের আশপাশে খুঁজেছি, কক্সবাজারে খুঁজেছি (অবশ্য রাস্তার ধারে সাধারণ হোটেলে) পাই নি। আমার মনে হল, যেখানে কম পয়সায় মাংস পাওয়া যায়, এতো রেস্তো খরচ করে ইলিশ খাওয়ার শৌখিনতা দেখানো এখানকার সাধারণ মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।
    দ্বিতীয় কথাটি আমার রোহিঙ্গা শরণর্থীদের নিয়ে। কক্সবাজারে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে রাশেদের বন্ধু আমাদের সতর্ক করে দিয়ে বলল, পার্শ ও ব‍্যাগের একটু খেয়াল রাখবেন! অনাহার-অর্ধাহারক্লিষ্ট রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। ওদের ক‍্যাম্প ৪০ কিলোমিটারের মধ্যেই। আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন কাউকেই কিছু খুইয়ে কখনও দেশছাড়া হতে হয় নি। কিন্তু আমার একাধিক সহকর্মী বন্ধুদের পরিবারকে পদ্মা পেরিয়ে এপার বাংলায় একাধিক শরণার্থী শিবিরে বহুদিন কাটাতে হয়েছে। তাদের কারোর কারোর গভীর গোপন ব‍্যথার খবর আমি রাখি। কী অভিমান, ক্ষোভ ময়মনসিংহের দাদার! আবার এই অষ্টমীর সন্ধ্যায় এক সহকর্মী, যার দাদুরা সাভারের 'স্টাম্পম‍্যান' ছিলেন, আগ্নেয়গিরির মতো ফেটে পড়লেন আমার বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রসঙ্গ উঠতেই! কারোর করোর রক্তক্ষরণ যে এখনো বন্ধ হয় নি! অনেকেই বলবেন, এসব নিয়েই তো দেশভাগ, হিন্দুরা ভারতে চলে যাবে! নির্মম হলেও ইতিহাস তো আমরা খণ্ডাতে পারি না! যেভাবে বলা হয়, ব‍্যাপারটি তত সহজ নয়। বিপরীতে, এখনো বাংলাদেশই থাকেন, পুরুষানুক্রমে পদ্মা পারের নাগরিক এরকম দু'টি পরিবারে সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তারা পশ্চিম বাংলায় থাকার মতো ব‍্যবস্থা করে ফেলেছে। কিন্তু কলকাতায় আসে, মাসখানেক থেকে আবার চট্টগ্রামে ফিরে যায়। নতুন জায়গায় কোথায় কী করবে বুঝতে পারে না। আসলে বড় মাপের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া ভিন্ন দেশে সার্থক জীবন যাপন করা কি আদৌ সম্ভব? বাংলাদেশ উদ্বাস্তু তৈরি (ক্ষমা করবেন এই শব্দটি ব‍্যবহার করার জন‍্য) করেছে অগণিত। তারা এখন কেমন শরণার্থীদের সেবা করছে তা বোঝার জন্যই রোহিঙ্গা প্রসঙ্গ।
    উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৬,৫৫,০০০ থেকে ৭,০০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে সাম্প্রতিক জনসংখ্যার উপচে পড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় সাংঘাতিক চাপ সৃষ্টি করেছে।  শরণার্থীদের পরিষেবা, শিক্ষা, খাদ্য, পরিষ্কার পানীয় জল এবং নূ্ন‍্যতম  স্যানিটেশনের অভাব সৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগ সংক্রমণে তারা এখনো একবারে অসহায়, প্রায় অর্থহীন পশ্বোপম জীবনযাপন করছে।  ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশন, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এবং সামাজিক সুরক্ষা সহ বিভিন্ন খাতে আর্থিক সহায়তায় প্রায় অর্ধ বিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। তবে ১ মার্চ ২০১৯ এ বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে যে তারা আর নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না!
    আমার তেমন কিছু আর বলার নেই। আমার  প্রশ্নঃ শুধু ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ, বা দেশপরিচালনা কি কখনও মানুষের ইহজাগতিক দু:খকষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারে? (পরাজাগতিক মুক্তির কথা অনেক বলেন। কিন্তু আমার কাছে যুক্তিগ্রাহ‍্য তথ্যপ্রমাণ কিছু নেই যার ভিত্তিতে কিছু বলতে পারি!) আবার শুনি, ধর্ম মানুষকে কাছে টানে। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যা বা গাজা-সমস্যায় এমন বৈপরীত্য কেন? 
    যাই হোক, অনেক দু:খ বেদনা ক্ষোভ সত্ত্বেও ক্ষণকাল পরেই আমার মানব সত্তা, আমার বাঙালি সত্তা গভীর গহীনে গুনগুন করে উঠে:

    গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা।
    ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা-
    মেঘনা-যমুনা।
    একই আকাশ, একই বাতাস-
    এক হৃদয়ের একই তো শ্বাস।
    দোয়েল-কোয়েল পাখির ঠোঁটে-
    দোয়েল-কোয়েল পাখির ঠোঁটে একই মূর্ছনা।
    একই মূর্ছনা।
    ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা-
    মেঘনা-যমুনা।
    গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা।

    এপার-ওপার কোনপারে জানিনা
    ও আমি সব খানেতে আছি।
    গাঙের জলে ভাসিয়ে ডেঙা
    ও আমি পদ্মাতে হই মাঝি।
    এপার-ওপার কোনপারে জানিনা-
    শঙ্খচিলের ভাসিয়ে ডানা
    ও আমি দুই নদীতেই নাচি।
    এপার-ওপার কোনপারে জানিনা-

    একই আশা ভালবাসা
    কান্নাহাসির একই ভাষা
    দুঃখসুখের বুকের মাঝে-
    দুঃখসুখের বুকের মাঝে, একই যন্ত্রণা।
    একই যন্ত্রণা।
    ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা-
    মেঘনা-যমুনা।
    গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা।
    গঙ্গা আমার মা, পদ্মা আমার মা। (ভূপেন হাজারিকা)
    (সমাপ্ত)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন