বেনারস পর্ব ৩
ভোরবেলা অন্ধকার থাকতেই স্নান সেরে তৈরী হয়ে নিলাম বেরোবার জন্য। জলখাবার সেরে অদ্বৈত আশ্রমের মন্দিরে গিয়ে বসলাম। সকালের পূজো চলছে মন্দিরে। মন্দির চত্বরেই দুর্গা দালান – শ্রীশ্রীমা এবং শ্রীশ্রীঠাকুরের সন্তানদের পদধূলি ধন্য । কাশীধামে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ভিঙ্গার রাজা স্বামী বিবেকানন্দকে কিছু অর্থ প্রদান করেছিলেন। কাশীতে মূলতঃ বেদান্ত প্রচারের উদ্দেশ্যে স্বামীজীর নির্দেশে এই বেদান্ত আশ্রম স্থাপন করেন স্বামী শিবানন্দ। নাম রাখা হয় "শ্রীরামকৃষ্ণ অদ্বৈত আশ্রম"। কোনোও পুণ্যস্মৃতি বিজড়িত স্থানে গেলে তা অনুভূতিতে ধরা দেয়। গোটা বাড়িটি জুড়ে যেন কি এক আধ্যাত্মিকতার পরশ! শত বছরেরও বেশী সময় পার হয়ে গিয়েছে এই আশ্রম বাড়িটির উপর দিয়ে। দেওয়াল, থাম, দরজা, জানলা, উঠোন কত ঘটনার সাক্ষী! মহান সাধকদের পাদস্পর্শে ধন্য। একরাশ শুধুই ভালোলাগায় কেমন আবিষ্ট হয়ে গেলাম। কিছু সময় শান্তভাবে বসে থাকলাম। এই শান্তভাব ধীরে ধীরে মনের ভিতরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল। আমার 'আমি' এমন সময়ে বিলকুল চুপ মেরে যায়। আসলে সে চুপ থাকতেই পছন্দ করে। মজা নেয় আমার লম্ফঝম্ফের। অপেক্ষা করে কবে আমি অমন শান্ত হব। যাই হোক, আমি তো বেড়াতে এসেছি। বেড়াবও। চোখ দিয়ে কত কিছু দেখবার সাধ! কত কিছু দেখলাম, তবু আশ মেটে না চোখ দুটোর।
মন্দির থেকে বেরিয়ে চত্বরটিকে ভালো করে দেখলাম। হসপিটালে বেশ ভীড়। OPD তে। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব শ্রেণীর নারী পুরুষকে লাইনে দেখা গেল। USG laboratory র সামনে বেশ কয়েকজন! আর একদিকে চোখ সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার। Wheel chair এ বসিয়ে জনা দুই বৃদ্ধ মানুষ এসেছেন জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো যাপনের তাগিদে। রাস্তার আর একপাশে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে কাঠবেড়ালীদের হুটোপুটি নজর এড়াল না। নানারকম ফুল ফুটে আছে বাগানে। পাখিদের ডাকাডাকি। বসন্তের বাতাসে ভ্রমরের দলের গুনগুনানিও চলছে। ব্যস্ততার ছাপ সর্বত্রই।
এরপর বেরোলাম বেনারসের পথে। কোনো জায়গায় গিয়ে পায়ে হেঁটে না চললে আর দোকান , বাজারে না ঘুরলে জায়গাটি সম্পর্কে জানা যায় না। দেখলাম রাস্তার ধারের একটি দোকানে লাইনে অপেক্ষমান নানা বয়সের বেশ কিছু লোক – কচুরী ও জিলিপির আশায়। আশেপাশে নানা রঙের ছাগলেরও দেখা মিলল। তাদেরও দৃষ্টি ঐ একই দিকে হলেও মূল আকর্ষণ কচুরী না শালপাতায় সে ব্যাপারে একটু ধন্ধ লেগেছিল। আমিই বা বাদ যাই কেন? দাঁড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই দেখছিলাম গরম তেলে কচুরী ঝপাঝপ দেওয়া হচ্ছে, ভেজে তুলতে না তুলতেই শেষ। কিছু প্যাকেট হচ্ছে – লাইনের সামনের দিকের ভাগ্যবানেরা হাতে প্যাকেট পেয়ে (মনেহল, যেন) গর্বের সঙ্গে লাইন ছেড়ে যাচ্ছেন। দোকানের মধ্যেও পাঁচ সাতজন বেঞ্চে বসে আছেন। সকলেরই নজর মোটামুটি ঐ গরম তেলের কড়াইতে – বলা বাহুল্য আমারও নজর সেদিকেই। কিছু পরেই আমিও বিশেষ সৌভাগ্যের অধিকারিণী হতে পেরে আপ্লুত হয়ে গেলাম আনন্দে। গরম কচুরী ও জিলিপি খেয়ে খুশী মনে বেরিয়ে পড়লাম।
গোদোলিয়ার মোড়ে পৌঁছে বাঙালীর বড় আবেগের এবং বহুশ্রুত দুটি শব্দ –"মানুষের ঢল" দেখা গেল। পরের সপ্তাহে হোলি। তাছাড়াও সদ্যবিবাহিত বর, বধূ ও তাদের পরিবারের লোকেরা ভীড় করে চলেছেন শ্রীশ্রীবিশ্বনাথের মন্দিরের দিকে। বিয়ের কনেকে দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। হয়ত অনেকেরই ভালো লাগে। কিন্তু সে গুড়ে বালি! বর বাবু বেশ সেজেগুজে চলেছেন, (খুশী মনে বলেই মনে হল) মাথায় পাগড়ি, অঙ্গে ঝলমলে চুড়িদার, পাঞ্জাবি বা শেরওয়ানি , পায়ে শুঁড় তোলা নাগরা, গলায় বড় বড় কাগজের নোটের মালা পরে, কিন্তু বৌ তো একটি যেন লাল শাড়ি ঢাকা পুঁটুলি র মতো। যেন শুধু একটি অবয়বমাত্র। হেঁটেই চলছিল এই জুটি। লাজুক বৌ টি রাস্তা কেমন করে দেখছিল একথা বুঝলাম না। সঙ্গের পরিবারের আপনজনেরা, বাচ্চা, বড় মিলিয়ে হৈ হৈ করতে করতে চলেছেন।
এরপর দোকান বাজার দেখা শুরু করলাম। আমার একটি স্বভাব হল রাস্তার ধারের দোকানের নাম পড়া, কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই । একটি বন্ধ দোকানের নাম আমাকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। হোর্ডিং এ সুন্দর করে গরুর ছবি আঁকা সঙ্গে ইংরেজি তে লেখা 'Kashi Chickan Center'। কাশীতে মুরগীর দোকান আছে , তা বলে গোদোলিয়ায়? এদিকে মাংসের দোকানে গরুর ছবি ! মাথার মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন ভীড় করে এলেও এগিয়েই চললাম। এগোতেই হল – মানুষের ভীড়ের চাপে। তার উপর ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একে একে আরোও তিন জোড়া বর কনে ও তাদের পরিবারের লোকজনের সাজগোজ দেখে ঐ প্রশ্নোত্তরের হাত থেকে মাথা খানিক রেহাই পেল। বর, কনে বা তাদের পরিবারের লোকজনের পোশাকের স্বাভাবিকভাবেই উনিশ বিশ ছিল কিন্তু মোটের উপর কনেরা সকলেই পুঁটুলি রূপেই দেখা দিয়ে গেলেন।
এতকিছু দেখতে দেখতে ততক্ষণে আমরা পৌঁছে গেলাম দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছে। রাস্তার দুপাশের দোকানে পূজার উপকরণ, পিতল, তামার পূজার বাসন, গঙ্গাজল নেওয়ার জন্য বড়ছোট প্লাস্টিকের জার – সব পেরিয়ে সামনেই সুপরিচিত সেই সিঁড়ি।
সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলাম সুরধুনী তটে। যুগ যুগ ধরে কুলকুল করে বয়ে চলেছেন পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা ভারতবর্ষের প্রাচীনতম ইতিকথার সাক্ষী রূপে। ভারতবর্ষের ইতিহাসের কত পালাবদলের সাক্ষী! দর্প, গৌরব, জয় ,পরাজয় বা লজ্জার ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। রাজা, মহারাজা, সম্রাটদের বীরতা ও দীনতার সাক্ষী! সাধারণ মানুষের সুখ, দুঃখের সাক্ষী! কত সাধক, মহাসাধকের অধ্যাত্ম সাধনার সাক্ষী এই স্রোতস্বিনী – দুই তীরবর্তী ইঁট, পাথর গলিতে জমাট বেঁধে আছে কত কাহিনী, কত না বলা কথা!
একটি সিঁড়ির এক ধারে ছায়াতে গিয়ে বসলাম। বেলা বেড়েছে তখন। বেশ চড়া রোদ। নদীর বাঁধানো ঘাট থেকে ছোট, বড় অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিচ্ছেন – পরমানন্দে – মা গঙ্গার শান্ত নীরে – শান্তিনীড়ে। দামাল শিশুদের মাতৃক্রোড়ে আমোদ আহ্লাদের ছবি যেন! ঘাটে বাঁধা রয়েছে সারি সারি নৌকা। নদীর বাঁধানো পাড়ে হরেকরকম জিনিসপত্রের সম্ভার– খুব চেনা, ছবিতে দেখা , বড় বড় ছাতার নীচে। কোনও ছাতার নীচে কাচের চুড়ি, গলার হার, কানের দুল, টিপের পাতা – কোথাও বা গাছগাছড়া থেকে বানানো নানা ওষুধপত্র আবার কোনোও ছাতার মালিকানা কোনোও জ্যোতিষী মহারাজের । হরেক রকম পাথর, নানা আকারের রুদ্রাক্ষ, তাবিজ ইত্যাদির সম্ভার নিয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে আছেন ভবিষ্যত গণনায়। বেশ ভারী চেহারার একজন মহিলা ও ততোধিক ভারী চেহারার এক পুরুষ মানুষ বসে আছেন জ্যোতিষী মহারাজের ছত্রছায়ায় চেহারায় একরাশ উৎকন্ঠা নিয়ে। পাশেই ছাতার নীচে একটি সারমেয় দিব্যি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একধারে কয়েকটি ছাতার নীচে কাঠের তক্তাপোশের উপর পূজা পাঠের আয়োজন। গঙ্গাস্নান সেরে কিছু লোক সেখানে ভীড় জমাচ্ছেন। পূজারী পূজার আয়োজন করছেন। তাঁর সহকারী ( মনে হল) স্নান সেরে আসা ব্যক্তিদের কপালে শ্বেত চন্দন দিয়ে নানা চিত্র অঙ্কন করে চলেছেন। এখানেই দেখা হয়ে গেল আমাদের অতিথি নিবাসের আর এক অতিথি তমলুকের মঞ্জুলাদি ও তাঁর মেয়ে সৌমিতার সঙ্গে। মঞ্জুলাদি গঙ্গাস্নান সেরে চন্দনে চিত্রিত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সৌমিতা গঙ্গাস্নান সেরে কপালে চন্দন লাগাতে উৎসাহী নয়। কিঞ্চিৎ মনঃক্ষুণ্ণ মঞ্জুলাদির মুখে হালকা হাসি । আমাদের কে দেখতে পেয়ে বললেন 'গেস্ট হাউসে ফিরবেন তো?' এরপর একসঙ্গে ফিরে এলাম আমরা। শ্রীশ্রী বিশ্বনাথের ভালো করে দর্শন, স্পর্শ ও পূজো দেওয়া নিয়ে কিছু কথাও হল। দিদি বেশ কয়েকদিন হল এসেছেন কাশীতে। সকলের পরামর্শ অনুযায়ী মন্দিরে বিভিন্ন সময়ে গিয়েও তেমনভাবে দর্শন হয় নি। এদিকে ফেরবার সময় এসে গিয়েছে। তাই একটু অশান্ত হয়ে আছেন। আমাদের ও পূজো দেওয়া হয় নি তখনও, দূর থেকেই দর্শন হয়েছে। পরের দিন যদি কোনোওভাবে সুবিধা করে দেন ৺বিশ্বনাথ এই একমাত্র আশা।
ক্রমশঃ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।