এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সুরিনাম ঘাট, ঔপনিবেশিকতা এবং হিন্দুধর্ম

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩১ আগস্ট ২০২৩ | ৪৬৮ বার পঠিত
  • আমাদের ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা রয়েছে উপনিবেশ কথাটি। কথাটির ইংরেজি শব্দ কলোনি। অত্যন্ত সহজ, সরল, সাদাসিধে কথাটি। কিন্তু এর মধ্যে মানুষের যে হাহাকার লুকিয়ে আছে, চোখের জল লুকিয়ে আছে, লাঞ্ছনা লুকিয়ে আছে তার হিসেব ইতিহাস রাখেনি। আজও দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক কিছুই রয়ে গিয়েছে সেই উপনিবেশের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে। আমাদের কাছে সেসব নিতান্তই এক জড় পদার্থ, সেইসব সৌধ বা স্থানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা মানুষের লাঞ্ছনার খবর নেওয়ার চেষ্টা বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই আমাদের। একমনে দাঁড়িয়ে সেখানে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলার ইচ্ছেটাও বোধহয় নেই। বরং কোনো শহরের ধারে গজিয়ে ওঠা নতুন বসতির নাম দিই আম্বেদকর কলোনি, ইস্টবেঙ্গল কলোনি ইত্যাদি, ইত্যাদি। ঔপনিবেশিকতা বোধহয় আমাদের রক্তের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে।

    একটা সময় অব্দি গোটা বিশ্বেই প্রধান শক্তিগুলোর উপনিবেশ ছিল। মূলতঃ ব্রিটিশ, আমেরিকা, ফরাসি, পর্তুগিজ এবং ডাচদের উপনিবেশ ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। আশ্চর্য্য হলেও সত্যি যে এখনও বিশ্বের অনেক দেশে উপনিবেশ বিদ্যমান। এক্ষেত্রে আরও আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে আপাত শত্রুতা থাকলেও অনেকক্ষেত্রেই মিত্রতা ছিল। অর্থাৎ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সম্পদ মিলেমিশে গায়ের জোরে যা পারো লুঠপাট করে নিজের দেশে নিয়ে যাও। চোরে চোরে মাসতুতো ভাই, আর কি। আমাদের দেশে ফরাসি, ডাচ, পর্তুগিজ এমনকি ডেনিশরা উপনিবেশ তৈরী করলেও মূল উপনিবেশ ছিল ব্রিটিশদের।

    ব্রিটিশ উপনিবেশকালের শহর কলকাতার গার্ডেনরিচ অঞ্চলের গঙ্গায় একটি ঘাটের নাম "সুরিনাম ঘাট"। এ যেন ভারতবর্ষ, আমেরিকা মিলে মিশে একাকার। নিতান্ত কৃষিনির্ভর, মৌসুমী জলবায়ুর একটি এলাকায় মূল নদীর একটি ঘাটের নাম এইরকম হওয়া একটু আশ্চর্য্যের লাগে বইকি। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার একটি দেশের নাম সুরিনাম, তার সাথে শহর কলকাতার সম্পর্ক কি কোথাও থাকতে পারে? ভূগোলের পাতায় পাওয়া যাচ্ছে সুরিনামও একটি কৃষি নির্ভর দেশ।
    ইতিহাসের পাতায় যা পাওয়া যায় তা হলো, ষোড়শ শতকের শেষভাগে ওলন্দাজ, ফরাসি ও ইংরেজ বণিকেরা সুরিনামের (পূর্বতন নাম ওলন্দাজ গায়ানা) উপকূলে বাণিজ্যকেন্দ্র স্থাপন করে। আবার সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে ইংরেজ বণিকেরা দেশটিতে বসতি স্থাপন শুরু করে। ১৬৫০ সালে সুরিনাম নদীর তীরে একটি ব্রিটিশ দল প্রথম স্থায়ী ইউরোপীয় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ওলন্দাজ পশ্চিম ভারতীয় কোম্পানির একটি নৌবহর এই বসতিটি দখল করে। ১৬৬৭ সালে ব্রেডার চুক্তির মাধ্যমে ইংরেজরা উত্তর আমেরিকায় নিউ অ্যামস্টার্ডাম (বর্তমান নিউ ইয়র্ক শহরে)-এর বিনিময়ে এই উপনিবেশটির একাংশ ওলন্দাজদের দিয়ে দেয়। ফলে সুরিনাম সরকারীভাবে ওলন্দাজ নিয়ন্ত্রণে আসে। তখন থেকে ওলন্দাজরা সুরিনামকে একটি উপনিবেশ হিসেবে শাসন করতে থাকে। তবে ১৭৯৫ - ১৮০২ এবং ১৮০৪ - ১৮১৬ যুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশরা সাময়িকভাবে সুরিনামের দখল নিয়েছিল। এই হলো সুরিনামে ঔপনিবেশিক শক্তির ইতিহাস যা গত শতকের সাতের দশক অব্দি বজায় ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৫শে নভেম্বর সুরিনাম স্বাধীনতা লাভ করে ওলন্দাজদের কাছ থেকে। এরপরে আসা যাক সেখানকার কৃষি কাহিনীতে।

    সুরিনামে ওলন্দাজ উপনিবেশের অর্থনীতির প্রাথমিক ভিত্তি ছিল গাছ লাগানো, যা কৃষির একটি ধারা এবং খামারভিত্তিক। ওলন্দাজেরা সুরিনামে অনেক গাছ লাগায় এবং আফ্রিকা থেকে বিরাট সংখ্যক ক্রীতদাসকে এই খামারগুলিতে কাজ করাতে নিয়ে আসে। চাষ করা শস্যের মধ্যে প্রধান ছিল আখ। আবার অনেক জায়গায় কফি, নীল, তুলা, খাদ্যশস্য ও কাঠ উৎপাদনী বৃক্ষও উৎপাদন করা হত। ১৭৮৫ সাল পর্যন্ত সেদেশে কৃষিনির্ভর অর্থনীতির যথেষ্ঠ প্রসার লাভ করে। সেসময় এখানে ৫৯১টি কৃষি খামার ছিল, যাদের মধ্যে ৪৫২টি চিনি ও অন্যান্য বাণিজ্যিক শস্য উৎপাদন করত এবং এবং ১৩৯টি খাদ্যশস্য ও কাঠ উৎপাদন করত। ১৭৮৫ সালের পর কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেতে থাকে। খামারের মালিকেরা অন্যত্র আরও বেশি আয় করা শুরু করে, এবং দাসদের মুক্তিলাভের ফলে খামারের খরচ বেড়ে যায়। ১৮৬০ সাল নাগাদ মাত্র ৮৭টি চিনির খামার অবশিষ্ট ছিল এবং ১৯৪০ সালে এসে এই সংখ্যা দাঁড়ায় ৪।

    চিনি উৎপাদনকারী অন্যান্য দাসভিত্তিক উপনিবেশগুলির মত সুরিনামেও সমাজব্যবস্থা তিনটি স্তরে বিভক্ত ছিল। সবচেয়ে উপরের স্তরে ছিল একটি ক্ষুদ্র অভিজাত ইউরোপীয় শ্রেণী। এরা ছিল মূলত সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, খামারের মালিকেরা, যারা তাদের খামারেই বসবাস করত এবং খামারের প্রশাসকেরা, যারা মালিকের অনুপস্থিতিতে সেগুলির দেখাশোনা করত। ইউরোপীয়দের সিংহভাগই ছিল ওলন্দাজ, তবে কেউ কেউ জার্মান, ফরাসি, বা ইংরেজও ছিলেন। অভিজাত শ্রেণীর ঠিক নিচের স্তরটিতে ছিল মুক্ত নাগরিকদের নিয়ে গঠিত মধ্যস্তর। জাতিগতভাবে বিচিত্র এই দলটির সদস্য ছিল সুরিনামে জন্ম নেওয়া ইউরোপীয় বংশদ্ভূত লোক, দাসী মহিলাদের গর্ভে ইউরোপীয়দের ঔরসজাত সন্তানাদি, এবং যেসমস্ত দাসকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল বা যারা মুক্তি কিনে নিয়েছিল। সমাজের একেবারে নিম্নস্তরে ছিল দাসেরা, এবং এরাই ছিল সমাজের বৃহদংশ।

    সুরিনামের দাসপ্রথা ছিল অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রকৃতির। দাসদেরকে সম্পত্তির মত ব্যবহার করা হত, এবং তাদের কোন আইনি অধিকার ছিল না। ঔপনিবেশিক আইন অনুসারে দাসদের মালিকদের ছিল সর্বময় একচ্ছত্র ক্ষমতা। কোন কোন দাস নদীপথে পালিয়ে দেশের অভ্যন্তরভাগের অতিবৃষ্টি অরণ্যে স্বাধীন গ্রাম স্থাপন করে বিছিন্নভাবে বসবাস করত। উপনিবেশের সেনাদল দিয়ে এদের ধরে আনার অনেক চেষ্টা করা হলেও তারা তাদের স্বাধীনতা বজায় রাখে। এদের বংশধরেরা আজও সেসব এলাকায় বসবাস করে।

    ঊনবিংশ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপীয় মনোভাব দাসপ্রথা অবসানের প্রতি অনুকূল হয় এবং শতকের মধ্যভাগে ইংরেজ ও ফরাসিরা আইন করে তাদের দাসদের মুক্তির ব্যবস্থা করে। তখন ওলন্দাজেরাও তাদের উপনিবেশগুলিতে দাসদের মুক্তির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সুরিনামের খামারের মালিকদের ভীতি ছিল যে মুক্তিপ্রাপ্ত দাসেরা আর খামারের কাজ করতে চাইবে না। তাই আইন করে মুক্তির পরেও ১০ বছর ন্যূনতম ভাড়ায় সরকারী নির্দেশনায় দাসদের খামারে কাজ করা বাধ্যতামূলক করা হয়। ১৮৬৩ সালে পূর্ণ মুক্তির পর প্রাক্তন দাসেরা ভাল বেতনের চাকরি ও উন্নত শিক্ষার আশায় পারম্যারিবো (সুরিনামের রাজধানী শহর) শহরে ভিড় জমাতে থাকে।
    এই স্থানান্তরের ফলে সুরিনামের খামারগুলিতে কর্মীর যে অভাব দেখা দেয়, তা পূরণ করতে এশিয়া থেকে শ্রমিক আমদানি করে নিয়ে আসা শুরু হয়। ১৮৫৩ ও ১৮৭৩ সালের মধ্যে ২৫০২ জন চীনা শ্রমিক এবং ১৮৭৩ থেকে ১৯২২ সালের ভেতর ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে আরও প্রায় ৩৪ হাজার, এবং ১৮৯১ থেকে ১৯৩৯ সালের মধ্যে ইন্দোনেশিয়া থেকে ৩২,৯৬৫ জন শ্রমিক নিয়ে আসা হয়। এই শ্রমিকেরা নির্দিষ্ট সংখ্যক বছরের জন্য খামারে কাজ করার প্রতিশ্রুতি সংবলিত চুক্তি স্বাক্ষর করে এখানে কাজ করতে আসে। এদের অধিকাংশই কৃষিকাজে নিয়োজিত ছিল। বর্তমানে এই এশীয় শ্রমিকদের বংশোদ্ভূতরা সুরিনামের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি।

    এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে সুরিনামের খামারে শ্রমিকের অভাব দেখা দেওয়ায় ডাচেরা ব্রিটিশদের পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করে। ক্যারিবিয়ান এবং পারস্য উপসাগরীয় ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে একই সমস্যা হওয়ার পরে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষ এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক আনা শুরু করেছিল। ডাচেরা ব্রিটিশদের সাথে এই কারণে একটি চুক্তি করে ১৮৭০ সালে, চুক্তিটি হয়েছিল ৮ই সেপ্টেম্বর, ১৮৭০, স্থান নেদারল্যান্ডের হগ শহরে। এরপর থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিভিন্ন দেশ থেকে ডাচেরা চুক্তি ভিত্তিক শ্রমিক সুরিনামে নিয়ে যাওয়া শুরু করে।
    সুরিনামের উদ্দেশে প্রথম জাহাজ 'আল্লারুখ' কলকাতা বন্দর থেকে গাদাগাদি করে ৩৯৯ জন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিককে নিয়ে যাত্রা শুরু করে ২৬ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৩। ৫ জুন জাহাজটি সুরিনামে পৌঁছায় এবং ১৮৭৩ থেকে ১৯১৬ সালের মধ্যে ৬৪টি জাহাজ ৩৪,০০০-এর বেশি শ্রমিক নিয়ে পাড়ি দিয়েছিল সুরিনামের উদ্দেশে। প্রথম জাহাজ আল্লারুখ যখন সুরিনামের রাজধানী পারম্যারিবোতে পদার্পণ করে, তখন আগত শ্রমিকদের ১১ জন যাত্রার ক্লান্তি এবং ভিড়ের চাপে মারা যান। ভারত থেকে রওনা দেওয়া যে জাহাজ শেষ দ্বীপপুঞ্জ সুরিনামে পৌঁছেছিল তার নাম 'দেয়া'। তখন ১৯১৪ সাল।

    এই সময়ের মধ্যে প্রায় এক লাখ চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক অজানার উদ্দেশে ফিজি, দক্ষিণ ক্যারিবিয়ান এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি দেন। শুধুমাত্র পেটের টানে বলা ভুল হবে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে জোর জবরদস্তি করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময়ে কর আদায়ের কড়াকড়ি, অত্যাচার ভারতীয় কৃষকদের অর্থনৈতিকভাবে পুরোপুরি নিঃস্ব করে দিয়েছিল। বছরের যে সময়ে চাষবাস হত না, সেইসময় বিকল্প জীবিকা না থাকায় তাদের অর্ধাহারে, অনাহারে জীবন কাটাতে হত। এই অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে তাদের অনেকেই সরল মনে পাঁচ বছরের জন্য সুরিনাম যাওয়ার চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করে। এর পরিণাম তাদের জানা ছিল না। উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শ্রমিক সংগ্রহ করে মুজফফরপুর, বেনারস, এলাহাবাদ, পাটনা,ভাগলপুর অঞ্চলে নিয়ে আসা হত, সেখান থেকে রেলে কলকাতায়। পুরুষ শ্রমিকের জোগান দিয়ে এজেন্ট পেতেন ২৫ টাকা আর মহিলা শ্রমিকের জোগানে ধার্য ছিল ৩৫ টাকা। কাকুতি মিনতি, লোভ, ভয় দেখিয়ে দৈহিক নির্যাতন করা, জোর খাটানো – সবরকম উপায়েই তাঁরা শ্রমিক সংগ্রহ করতেন। কলকাতায় আসার পর শ্রমিকদের বরাদ্দ ছিল থালা, বাটি আর কয়েকখানা পোশাক। এই নিয়ে পুঁটুলি বেঁধে তাদের যাত্রা শুরু হত। যদিও ব্রিটিশ সরকার তাদের বোঝাত পাঁচ বছর পরে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। সেই আশাতেই তারা ঘরবাড়ি ছেড়ে যাত্রা করত, কিন্তু আসলে ওলন্দাজদের কাছে হস্তান্তরিত হত। দাস শ্রমিকের পরিচয় বদলে যেত চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকে।
    'আল্লারুখ' থেকে 'দেয়া', প্রায় ৬৪টি জাহাজ যে জেটি থেকে সুরিনামের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের আড়ালে ক্রীতদাস বানিয়ে অসংখ্য অসহায় শ্রমিকদের নিয়ে, সেই জেটির নামই 'সুরিনাম ঘাট'। মেটিয়াবুরুজের এই ঘাটেই ২০১৫ সালের ৭ই অক্টোবর ভারত ও সুরিনামের সেই চরম নির্যাতিত শ্রমিকদের স্মৃতিতে "মাই বাপ" মূর্তির আবরণ উন্মোচন করা হয়। মূর্তিটি সুরিনামের পারম্যারিবোয় স্থাপিত মূর্তির রেপ্লিকা — মা, বাবা, সন্তানের হাত ধরে, পুঁটলি নিয়ে মানুষ চলেছে অজানিতের পথে।

    ভিটেমাটি ছেড়ে যাওয়া মানুষগুলোর অক্লান্ত পরিশ্রমের জীবনে আনন্দ বলতে ছিল দিনান্তের পরিশ্রম শেষে সন্ধেবেলা পরিবার পরিজনদের সাথে তুলসীদাসী রামায়ণ অথবা কাশীরাম দাসের মহাভারত পাঠ এবং সময়ে অসময়ে ভোজপুরী গানের কলি গুনগুনিয়ে ওঠা। হোলি, ঈদ-উল-ফিতর প্রভৃতি দেশীয় উৎসব, অনুষ্ঠান দেশজ সংস্কৃতির সাথে যোগ স্মরণ করাত। অবর্ণনীয় কঠোর দাসত্বের জীবনে হঠাৎ করে সবকিছু নেই হয়ে যাওয়া জীবনে ওইটুকুই ছিল তাদের সম্বল। কথা ছিল পাঁচ বছর পরে কাজ শেষে ঘরে ফিরে আসবেন তাঁরা, কিন্তু তা হয়নি। ক্রমশ ব্যাপারটা নির্বাসন হয়ে দাঁড়ায়। ব্রিটিশ সরকার তাঁদের আর ফিরিয়ে আনেনি। এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল মানুষগুলোকে। শেষপর্যন্ত ওদেশেরই স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন সেই শ্রমিকরা। একবার সুরিনাম ছেড়ে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। তখন কেউ কেউ চলে গিয়েছিলেন, অনেকে যাননি। দেশ, আত্মীয় পরিজন শুধু স্মৃতিতে রয়ে গিয়েছিল।

    সুরিনাম ঘাট, নামটা আমাদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়, এই ঘাট আমাদের কাছে 'বালুঘাট' নামেই অধিক পরিচিত। এই ঘাটের কাছেই রয়েছে বাংলার নবাব ওয়াজিদ আলির প্রাসাদ ও ইমামবরা। ইমামবরাটি সংরক্ষিত থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে প্রাসাদ ভঙ্গুর দশা প্রাপ্ত হয়েছে। সুরিনাম ঘাট আজ পরিত্যক্ত। কোনো জাহাজ আনাগোনা করে না। অব্যক্ত যন্ত্রণার, বিশ্বাসঘাতকতার, প্রতারণার স্মৃতিভার বুকে নিয়ে রয়ে গেছে শুধু কিছু মাস্তুল।

    আর ওদিকে বাস্তুহারা, স্বদেশহারা, প্রতারিত সেই চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকের নামে ক্রীতদাসগুলো দক্ষিণ আমেরিকার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরতলীগুলোয় ধীরে ধীরে নিজেদের অস্তিত্ব গড়ে তুলেছিল। রামায়ণ গান, ভোজপুরি গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত, মহাভারত পাঠের মধ্যে নিজেদের প্রাণান্ত পরিশ্রমের পরে একটুকু শান্তি খুঁজে পেত। ক্রমে ক্রমে তারা সুরিনামকে নিজের দেশ বলে বাধ্য হয়েছিল মেনে নিতে। বর্তমানে সুরিনামের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশেরও বেশি এঁরা। সুরিনামের রাজনীতিতেও এঁদের গুরুত্ব যথেষ্ট। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিসেবে ২০২০-র জুলাই মাসে সুরিনাম-এর নবম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন চন্দ্রিকাপ্রসাদ সন্তোখি। চন্দ্রিকাপ্রসাদের দল প্রগ্রেসিভ রিফর্ম পার্টি (পিআরপি) ৫১টির মধ্যে ২০টি আসনে জয়লাভ করে ক্ষমতা দখল করে। ডাচ ভাষায় পিআরপি-কে ভুরিৎস্ত্রেবেন্দে হার্ভোরমিঙ্গস পার্তিজ অর্থাৎ ভিএইচপি বলা হয়। মূল ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের প্রতিনিধিত্ব করে এই দল। একসময় দলটির নাম ছিল ‘ইউনাইটেড হিন্দুস্তানি পার্টি’। এছাড়াও সুরিনামের উচ্চ আধিকারিক এবং রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অনেক সংখ্যায় বিদ্যমান। ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের ভাষা, যা সারনামি হিন্দুস্থানী নামে পরিচিত সেখানে, সুরিনামের সরকারী স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ভাষাগুলির মধ্যে একটি। সম্প্রতি, গত জুন মাসে পারম্যারিবোতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল সুরিনামে ভারতীয়দের আগমনের ১৫০ বছর পূর্তি উদযাপন। সুরিনামের বর্তমান রাষ্ট্রপতি চন্দ্রিকাপ্রসাদ সন্তোখির সাথে উপস্থিত ছিলেন আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি মাননীয়া দ্রৌপদী মুর্মু মহাশয়াও। এ যেন এক ভারতীয়র সাথে ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের মহামিলন।

    সুরিনামের এক চতুর্থাংশ লোকের ধর্ম সনাতনী ধর্ম। বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের পাশাপাশি ইস্কনের মন্দিরও বিরাজমান সেখানে। রাজধানী শহর পারম্যারিবোতেই রয়েছে আর্য দিবাকর মন্দির এবং শ্রীবিষ্ণু মন্দির। এছাড়াও রয়েছে ইস্কণের নমহট্ট নিকেরী, মার্কিন শ্রী মায়াপুর ধাম, হরেকৃষ্ণ মন্দির। এছাড়াও সারা দেশ জুড়েই রয়েছে সনাতন ধর্মের বিভিন্ন মন্দির বা উপাসনা স্থল। এমনকি হোলি আর দীপাবলিতে জাতীয় ছুটি দেওয়া হয় সুরিনামে। পাশের দেশ গায়ানাতেও সুরিনামের চেয়ে অনেক বেশি হিন্দু বাস করে। ফলে দক্ষিণ আমেরিকার এই অঞ্চলে ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং সনাতন ধর্মের লোকের যথেষ্ট আধিক্য। কোলকাতার এক অখ্যাত ঘাট থেকে ১৮৭৩ সালে যে যাত্রা শুরু করেছিল 'আল্লারুখ', ভারতবর্ষের মাটি থেকে সস্তায়, জোর করে ধরে হাজার হাজার লাঞ্ছিত, নিপীড়িত মানুষকে সুরিনামের ওলন্দাজ উপনিবেশে বাধ্য করা হয়েছিল চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকের আড়ালে ক্রীতদাসের মত জীবন কাটাতে, সেই মানুষগুলোই কালক্রমে সুরিনামের সমাজ ব্যবস্থায়, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে অংশ নিতে পেরেছে, বিদেশ-বিভূঁইকে আপন করে নিতে পেরেছে, এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। কিন্তু তাদের সেই সংগ্রামের ইতিহাস আমাদের অজানা। সুরিনামের ইতিহাসে নিশ্চয়ই সেই সংগ্রামের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে বা ভারতবর্ষে রয়ে যাওয়া তাদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে সেই ইতিহাসের অল্প হলেও হদিশ আছে কিন্তু আপামর ভারতবাসীর কাছে সেই সংগ্রামের ইতিহাস অজানা। ফলে "মাই বাপ" আমাদের কাছে একটি স্মৃতিসৌধের বেশী কিছু নয় এবং সেই সৌধ অবহেলা ছাড়া আর কিছুই পায়না আমাদের কাছ থেকে। পড়ে থাকা মাস্তুলগুলোর ক্রন্দনধ্বনিও আমাদের কানে পৌঁছয় না।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন