এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • এক ভীমরতিপ্রাপ্তের নিজচরিতচর্চা

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩১ মে ২০২৩ | ৩৮৪ বার পঠিত


  • এক জীবনে একটা মানুষ কটা জেনারেশান দেখতে পারে? পাঁচটা, কপাল ভালো থাকলে। ঠাকুর্দার, বাবার, তার নিজের, সন্তানের, এবং সন্তানের সন্তানের... এর বেশি হলে কপাল ভালো বলতে হবে। আমি দেখেছি, একটা সময় পরে মানুষ তার সুখস্মৃতির কাছে ফিরে যেতে চায়, সেই স্মৃতিকে বাস্তবে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা রাখে, বিশেষত বাঙালী হলে তো কথাই নেই।

    “আমি শুধুই ফিরতে চাই। যেখানেই যাই, মনে হয় ফিরে আসি। উজানের গাড়ি ধরলে ভাটার দিকে চাই। ভাটার গাড়ী ধরলে ভাসতে থাকি উজানে। উল্টোটানে আমাকে ছিঁড়েখুঁড়ে খায়।... আর তো ক’টা বছর। আমি ফিরব। ঠিক ফিরব...”

    কথাগুলো অনিমেষ বৈশ্য-র। ফেসবুকে নিজের মনের অভিপ্রকাশকে ক্রমাগত লিখে চলা এক সাংবাদিকের। পরের পর ছোট ছোট অনুভূতির অনুরণনের ডালি সাজিয়ে তৈরী তার নিজস্ব জীবন, যার কিছু স্বাদ নুন-মরিচের স্বাদ, তাই-ই আমাদের সাথে শেয়ার করেছেন। যে নুন-মরিচে কেবল বিগত দিনেরই প্রতিভাস মেলে।

    এই মানুষটি যে ছোট ছোট গদ্যে কাব্যিক সুষমায় তার নিজের অনুভূতির কথা লিখেছেন, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ বাস করেন। এবং, অতি সযতনে তিনি তার রবীন্দ্রনাথকে বারবার ফিরিয়ে আনেন। বলতে চান, তার জীবনের যে স্বাদটিকে তিনি বারবার চেটেপুটে খেতে চাইছেন, তা রবীন্দ্রনাথেরই দান। আর তাই, তিনি রবীন্দ্রনাথকে ভোলেন না, তাকে অস্বীকার করে নিজের সুষ্পষ্ট অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে পারেন না। বারবার দেখি, তিনি তার এই গোধুলীবেলাতেও রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করতে পারছেন না। তার লেখা থেকে মনে হয়, কোথাও যেন, বিশ্বাস করেন, রবীন্দ্রনাথ তার হাত ধরবেন, এবং একদিন তাকে তার আকাঙ্খিত ফেরার পথ দেখাবেন। তিনি সেই পথে হাটবেন, যে পথে রয়েছে, তার এক টুকরো শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনকালের কিছুটা। বাকিটা হারিয়ে গেছে সংসারের কোন চোরাপথের বাঁকে, যাকে তিনি ত্যজ্য করতে চান।

    “মেঘ কাটে। সেই প্রান্তরের কিশোর অনেকটা পথ ফেলে এসেছে। বারবার সে ছুতে যায়, সেই চাঁদে পাওয়া মাঠের কাছে। সেই ইঁদুরের গর্ত কি আর আছে। দুটো দুধের দাঁত সে রেখে এসেছিল সেই গর্তে। সে দাঁত খোঁজে। যেন কোন প্রাগৈতিহাসিক দাঁত। আসলে দাঁত নয়। সেই ‘ফেলে আসা অরূপ বাণী’।”

    আবেগ অতি বিষম বস্তু। ইমোশনাল বাঙালী পথে-ঘাটে দেখা যায়। এবং বেশির বেশিরভাগ এই ইমোশনাল বাঙালী হুজুগে হয়। আর সেই কারণেই, সে নিজেই নিজের আবেগের ঘরটাকে বারোয়ারি করে রাখে। বারোয়ারি লোক আসে, বেচাকেনা হয়, পরিশেষে পরে থাকে ঘরশূন্য জঞ্জাল। সেই জঞ্জালে কখন যে তার অতিপ্রিয় আবেগ ময়লায় বাসী হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে, সে টের পায় না। অনিমেশ বৈষ্য তার বাঙালপনা অবেগকে ধূলিমলিন হতে দেন নি। সেই আবেগকে তিনি পথেঘাটে সঙ্গে নিয়ে বয়ে চলেছেন, যে বাঙালপনায় আছে সবুজ মাঠের গন্ধ, তার যৌবনের স্পর্ধা।

    “বাঙালের অন্য অভাব অনেক আছে। কেবল তেজ আছে যথেষ্ট। নানাবিধ পৌরুষলাঞ্ছিত কথায় সেই তেজ ঠিকরে বেরোয়...। আজও বাঙাল না বললে মনে হয় ভাত খাইনি। ডালকে ডাইল। কালকে কাইল। হালা, পুঙ্গির ভাই। আহা আমার বাঙাল বর্ণমালা!”

    হাহাকার আছে। যে প্রৌঢ়ত্বে দাঁড়িয়ে হাহাকার সান্ত্বনা দেয়, সেই হাহাকার। ম্যান্টেলের হাহাকার, পোড়া পাউরুটির হাহাকার, খাসির মাংসের হাহাকার, সমাধান নাটকের জন্য হাহাকার, বটুরামদা, কমলদার জন্য হাহাকার, ভূপর্যটনের জন্য হাহাকার। 

    আমি হাহাকার করেছি দুইবার, এক, বইয়ের শুরুতেই ফেরার টানে যে লেখক আছড়ে পড়ছেন বোধের আবেগে বারংবার, তারই অলংকরণে একটি অর্ধনগ্ন নারীকে এঁকে সেই বোধের দফারফা হওয়ার কারণে। আর ‘শব্দকল্পদ্রুম’-র আনারসের বনকে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যায় ঢুকিয়ে পেজ সেট-আপ করতে চাওয়া প্রকাশকের চালাকীর ব্যর্থতায়। এ দুটো জায়গা বাদ দিয়ে এত উচ্চমানের অলংকরণ খুব কম বইতে আমি দেখেছি। অলংকরণে এবং প্রচ্ছদে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ছাপ স্পষ্ট। যা মনে দাগ কেটে যায়।
    অনিমেশ বৈষ্য বারবার পিছু ফিরতে চেয়েছেন --- “কত নরম অপরাহ্ন চলে গেল সুরকির পথ ধরে। শোনা তো হল না।” দু-এক জায়গায় চড় মেরেছেন আমাদের --- 
    “ক্লাবঘরে চামচিকে, শেষযাত্রায় বন্ধু নেই, ঝুলন নেই, রামযাত্রা নেই, পীরের মেলা নেই। ... গলায় কাঁটা বিঁধছে। জল দেওয়ার কেউ নেই।” কখনও সাবধান করে দিয়েছেন, “ওই জেলে গিয়ে বুঝলাম, আমি একটা আস্ত ভন্ড। আমি দিনভর নিজেকেই তা দিচ্ছি। রোজ ডিম ফুটছে। উঠোনে গিজগিজ করছে আমারই পুঁজ-রক্ত। বিক্ষোভে-বিপ্লবে, প্রেমে-অপ্রেমে আমি আসলে আমাকেই চাই। ‘তোমাকে চাই?’ কে বলল?” কখনও বা স্নেহের আবিলতায় ভেসে গেছেন --- “দু’জনে দু’জনের হাত ধরে ঝাঁকুনি দেয়। এক মেয়ে নেমে যায়। আর এক জন হাত নাড়ে। কেউ কাউকে চেনে না। বিকেলের রোদে হাসির গুঁড়ো উড়তে থাকে।”

    সব মিলিয়ে তার এই নুন-মরিচের জীবনের টুকরো টুকরো আকাঙ্ক্ষাগুলো রবীন্দ্র স্নেহধারা বেয়ে যে পথে চলেছে, স্মৃতিমেদুর এক বর্ষণসন্ধ্যায় তা এক পল্লীবালার কিম্বা একাকী লাইব্রেরীতে বসে থাকে কোন প্রৌঢ় মানুষের কাছে হঠাৎ হারানিধি হয়ে ওঠে বটে, কিন্ত সেটা সমুদ্রের ঢেউয়ে উঠে আসা মুক্তোর মতন, যা কিনা পরের ঢেউতেই জলরাশির গভীরে হারিয়ে যাবে...  

    ===============

    নুন-মরিচের জীবন
    অনিমেষ বৈশ্য
    খোয়াবনামা, প্রান্তজনের কথা
    মুদ্রিত মূল্যঃ ১৭৫ টাকা
    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 2601:14a:502:e060:e579:8421:3633:6602 | ৩১ মে ২০২৩ ২০:৫৪520160
  • ছবিটা বেশ ভালো লাগলো
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন