এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শাজাহানের সিংহাসন আরোহন : ইয়া তখ্ত ইয়া তাবুত, হয় সিংহাসনে নয় কবরে - মোঘল রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের বিবর্তন

    upal mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ মে ২০২৩ | ৩৯৫ বার পঠিত
  • ষোলোশো আটাশের উনিশে জানুয়ারি লাহোরের দরবার কক্ষে শাজাহানের নামে শুত্রুবারের নামাজের আগে খুতবা পাঠ করলেন আসফ খান। পুতুল বাদশাহ দাওয়ার বক্সকে কয়েদ করা হচ্ছে। দোসরা ফেব্রুয়ারি শাজাহানের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মী রাজা বাহাদুর ময়দানে নামে। একে একে খুন করে শাহরিয়ার, দাওয়ার বক্স আর ছোট ভাই গার্শপকে, দানিয়ালের দুই ছেলে  তাহমুরাস আর হোশাংকে। খুনের লহরের  সাক্ষী থাকে লাহোরের কেল্লা। ঠিক তার পরদিনই তেসরা ফেব্রুয়ারি আগ্রায় সিংহাসন আরোহন করছেন শাজাহান। 
    ---- সবই তো বুঝলাম কিন্তু....
    ---- কিসের কিন্তু ?
    ---- না এত রক্তপাত ....
    ---- সেতো হবেই। জান না -ইয়া তখ্ত ইয়া তাবুত ?
    ---- জানি কিন্তু সেটাও সাধারণ ধর্ম ছিল কি ?
    ---- কীরকম ?
    ---- হুমায়ুন কী করলেন ?
    ---- কী করলেন হুমায়ুন ?
    ---- তখ্তে বসতে মামা মাহদি খাওয়াজার বিরোধিতা করতে হয় হুমায়ুনকে। উপেক্ষা করা হল তাঁর বৈরিতার । চার বছরের মাথায় সৎ ভাই মির্জা হিন্দালের প্রথম নিকাহ হয় ওনার বোনের সঙ্গেই। পরবর্তী সময়েও মামা ভাগ্নের সম্পর্ক অটুট রয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পনেরোশো তিপান্নতে বিদ্রোহী ভাই মির্জা কামরানকে অন্ধ করে দিলেন হুমায়ুন।
    ---- তবে ?
    ---- এই নির্মম সিদ্ধান্ত নিতে যথেষ্ট দ্বিধাগ্রস্ত হুমায়ুনের মনোবেদনার কথাও লিখছেন তাঁর বোন গুলবদন বেগম অনেকদিন পরে পনেরোশো আশির শেষ দিকে ভাইপো আকবরের অনুরোধে। তবে দরবারের অভিজাতরা চরম শাস্তির পক্ষে দাঁড়িয়ে গেল।

    গুলবদন বেগমের বই আহবল-ই হুমায়ুন বাদশাহের ফারুকির ইংরিজি তর্জমার বাংলা:

    শেষে, সব খান আর সুলতানরা, সে অভিজাত বা আমজনতা, বাচ্চা বা বুড়ো, ফৌজি বা সাধারণ প্রজা যাঁরাই মির্জা কামরানের হাতে ভোগা খেয়েছে সবাই এক সঙ্গে জড়ো হয়ে শাহেনশাকে বলে, ''পাদশা হলে আর হুকুমতের মালিক হলে, কেউ শুধু ভাই থাকতে পারে না। ভাইকে ছাড়লে তখ্ত ছাড়তে হবে, শাহেনশাহ যদি হুকুমত চালাতে চান, ভুলে যান ভাই হবার কথা"। উত্তরে শাহেনশাহ বলেন, ''কী বলেন বুঝি, তবু করতে মন চায় না"। সকলেই গলা চড়ায়, বলে, ''দরবার যা বলে সেটাই সঠিক রাস্তা শাহেনশাহের"।' এভাবে বাদশাহের হাত বাঁধা পড়ে।


    ---- তবে হুমায়ুন সব দরবারী অভিজাতকে হস্তখত করিয়ে নিলেন যে মির্জা কামরানকে অন্ধ করার ফরমানে সায় আছে সবার। আসলে মোঘল শাসন মতাদর্শে পরবর্তী সপ্তদশ শতকে অনেক পরিবর্তন দেখা গেল ।
    ---- কেমন ?
    ---- হুকুমত আর ভ্রাতৃবন্ধনের দোলাচল উবে গিয়ে তথাকথিত  ন্যায়বিধানের নির্মম রথের চাকায় গুঁড়িয়ে গেল রক্তের টানও। রথ যদি থাকে তবে রশি থাকবে না এ আবার হয় নাকি ?
    ----- কোনটা রথ আর রশিই বা কেডা ?
    ----- বিজয়ী বাদশাহ যদি হন রথ তবে রশি হল রাষ্ট্রীয় মতাদর্শের হুক্কাহুয়া আমলা শাহী, কাজী, উজির আর তারিখ রচনাকারা। বাদশাহ শাজাহানের কোতলকারী ভূমিকা দু হাত তুলে সমর্থন জানিয়েছেন তেনারাই। পরবর্তী কালে ঔরঙ্গজেবের যাবতীয় ভাই-ভাইপো কোতলের কাণ্ডও যেন জলভাত হয়ে গিয়েছিল সমসময়ে। তবে এরও একটা শুরু আছে আর তা হল জাহাঙ্গীরের আমলে।

    মোঘল দরবারের গুরুত্বপূর্ণ অভিজাত মুহাম্মদ বাকিরের মাউইজাহ-ই জাহাঙ্গীররির (১৬১২) ফারুকির ইংরিজি তর্জমার বাংলা:

    বিজয়ী বাদশাহরা অনাঘ্রাতা কুমারী ক্ষমতাকে ভোগ করবেন যখন ঝলসানো তলোয়ার জীবনের ফলক থেকে মুছে দেবে ঘৃণ্য শত্রুর নাম । শত্রুর লোলুপ ভাণ্ড বিজয়ের পাথরাঘাতে ভেঙেই জগতখ্যাত বাদশাহরা কামনাঘন পাত্র আবেশে ঠোঁটে তুলবেন।


    তিরিশ বছরের ব্যবধানে গুলবদন বেগমের বর্ণিত মতাদর্শগত অবস্থানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরের আমলের মতাদর্শগত অবস্থানের আশমান জমিন ফারাক লক্ষণীয়। প্রথমটি যদি বাদশাহের মানবিক গুণাবলিকে সামাজিক চুক্তিতে বাঁধার কথা বলে তো দ্বিতীয়টি চূড়ান্ত সম্প্রসারণকামী ধর্ষকামী  মনোবৃত্তির পরিচায়ক।  রাজ করার ইচ্ছেকে নানা অনুষঙ্গে যৌন লালসার সমার্থক করে তবেই না খুন- খারাবার ধর্ষকাম  চরিতার্থ হয় !এই মতাদর্শের দেউলিয়া দশা প্রকট হয়েছিল শেষ শক্তিশালী মোঘল বাদশাহ ঔরঙ্গজেব আলমগীরের মৃত্যুর পরপরই। বিশেষ করে সতেরোশো বারোয়  তাঁর ছেলে বাহাদুর শাহ -এক মারা যাবার পরের পর্যায়ে।ফলাফলের দিক থেকে দেখলে - দরবারের আদব কায়দা আর প্যাঁচ পয়জারে ব্যস্ত, অনভিজ্ঞ, যুদ্ধে আনাড়ি, শাহাজাদারা, একসময়ের মোঘল ঐতিহ্যের সহমতের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে, নিজেরাই  নিজেদেরই শেষ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে, শক্তিশালী কেন্দ্রের পতন ডেকে আনল। তবে এর পেছনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কারণও অবশ্যই ছিল। 

    উপল মুখোপাধ্যায়ের আলমগীর উপন্যাসের অংশ
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন