এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রিয়াং বিদ্রোহ ও রতনমণি সাধু //ত নি মা হা জ রা 

    Tanima Hazra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ মে ২০২৩ | ৪২২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • আচাই-খালাই ওয়াইসা থুই-নাই 
    তা কারিসিদি 
    কিরি-অই পাইগালাক প্রাণ, 
    হরি মুংন লাছিদি। 
    হুনা বুনা লুমা লুতি 
    বলাই ন-বার-তই ওরি জাওক নাইদি,
    সব থুইন সব হাম-ন ভাবে নাইসিদি। 
    বাখা যদি হামছক-খালাই 
    হাম-ইয়া চাইয়া বন নুংখালাই, 
    মাখালান ইয়াকছি ইয়াগ্রা সব তর নাইদি। 
    রতন-নি ইয়াকংন নাই নাই,
    বড় থাঙ্গই নুংজাক-ছিনাই 
    যেফুং ওথুঁং খুসী কৃষ্ণ তা ছারেছিদি। 

    রিয়াং ভাষায় লিখিত এই গানটির বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায় :- 

    জন্মিলে তো মরিতেই হবে একদিন, তাই 
    ভয় পেয়ো না, 
    প্রাণ হে, ভয়'কে করো জয়, 
    হরিনাম স্মরণ করে। 
    বন্য হাতি পালে পালে 
    ধেয়ে আসছে, 
    বনের লতা পাতার ঝাপটায়
    বাতাসে উড়ছে দেখো তার বিপদসংকেত, 
    মন যদি সত্যিকারের পরিস্কার হয়, 
    আপদে বিপদে যদি তাকে স্মরণ করো, 
    অশুভ করাল সব দূরীভূত হবে, 
    ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। 
    রতনের চলার পথটি দেখে দেখে চলো, ঠিক পেয়ে যাবে জয়ের হদিশ, 
    খুসীকৃষ্ণ বলে, কপালে যাই থাকুক, 
    তুমি হাল ছেড়ে দিও না।।

    বি. এল.  প্রেস আগরতলা থেকে ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত "ত্রিপুরা রাচামুং খাকচাং খুম্বার বাই" নামক বইটিতে এই রকমই ৩৩ টি গান আছে গুরু রতনমণির প্রতি বন্দনাগীত হিসেবে, যেগুলির রচয়িতা ও গায়ক তার শিষ্য খুসীকৃষ্ণ। 

    রতনমনি সাধু আনুমানিক ১৯৩২ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের অমরপুর অঞ্চলে গিয়ে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাঁর গলায় ছিল রুদ্রাক্ষ ও মালা। তিনি শিষ্যদেরকেও রুদ্রাক্ষ ধারণ করার পরামর্শ দিতেন। তিনি হরিনামের মন্ত্র দিতেন “ওঁ প্রাণ: রাম” বলে। প্রেমের অবতার চৈতন্যের বিষয়ে উপদেশ দিতেন। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ থেকে গল্প বলে উপদেশ দিতেন। বিভিন্ন তথ্যের আলোকে জানা যায়, সাধু রতনমনি ১৯৩২ সালে খুসীকৃষ্ণ ত্রিপুরা, গোলাকৃষ্ণ চৈত্রসেন ও অন্যান্য শিষ্যসহ অমরপুরের(চলাগং নতুন বাজারের মাঝামাঝি) একছড়ি মৌজায় ‘তাওফম’ এ প্রথম আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে ডম্বুরে প্রেমতলী আশ্রম, সামখুমছড়া আশ্রম ও উদয়পুরের দক্ষিণ মহারাণীসহ বিভিন্ন স্থানে আশ্রম তৈরি করেন। তখন সাধু রতনমনির অমায়িক আচার-আচরণ, পরোপকার, ধ্যান-সাধনা ইত্যাদি কার্যকলাপের প্রতি মুগ্ধ হয়ে রিয়াংগণ দলে দলে তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে।

    স্বাধীন ত্রিপুরার ইতিহাসে মহারাজা বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মা বাহাদুরের রাজত্বকালের একটি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল ১৯৪৩ সালের রিয়াং বিদ্রোহ। রতনমনির নেতৃত্বে সংঘটিত এই বিদ্রোহ ছিল তৎকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ধুম্রজাল থেকে সাধারণ প্রজা রিয়াং জনগোষ্ঠীর মুক্তির আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্যই ছিল সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটানো। মূলত সমাজপতি ও ঠকবাজ ব্রাহ্মণদের অত্যচার নিপীড়ন ও শোষণের হাত থেকে সাধারণ রিয়াং প্রজাদেরকে রক্ষা করার জন্য রতনমনি রোয়াজা সাধু তার শিষ্য খুসী কৃষ্ণ ত্রিপুরা (বলংরায়) ও চৈত্রসেন সাধুসহ আরো অনেক সাধু/সন্ন্যাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে সামন্তপ্রথা বিরোধী তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।
    এমনই এক প্রবল অত্যাচারী সামন্ত হলেন খগেন চৌধুরী। 

    আরও আরও গানের কথায় খুসীকৃষ্ণ বলছেন, 
    তুমি হরিনাম নাও না, তোমার হৃদয় শূন্য, হাতে ঘড়ি বেঁধেছ, পায়ে জুতা পরেছ, মাথায় সুগন্ধী তেল মেখে কী আনন্দ পেলে? হাতি ঘোড়া চড়ে আর সুন্দর হতে চেয়োনা, হরিনাম নাও ইত্যাদি। 

    এমন অপূর্ব হৃদয়গ্রাহী ধর্ম সংগীত ইতিপূর্বে সেসব হাবাগোবা নিপীড়িত মানুষ আর শোনেনি। এই গানটিগুলো সকল সাংসারিক চিন্তাশীল ধার্মিক ব্যক্তির মনের কথা। কিন্তু গানগুলির যেমন ধর্মীয় ব্যাখ্যা আছে, তেমন অন্যান্য অর্থও আছে। এই গানগুলি প্রকৃতপক্ষে খগেন চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে লেখা। এমন আরও অনেক গান আছে যার এমন দু’টি অর্থ আছে। গুরুদেব সেই গানগুলি গাওয়ার পর ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতেন। সংগে সংগে এই গানটির আরও যে অর্থ হয় তাহা মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠতো। 

    খগেন বাবু লেখাপড়া জানা অবস্থাপন্ন রিয়াং সর্দার চৌধুরী, অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ দেহী স্বাস্থ্যবান সুশ্রী যুবক। রাজ দরবারে প্রভাব প্রতিপত্তি হতে শুরু করেছে। ঐ সময়ে ত্রিপুরার দক্ষিণাঞ্চলে যেসব হাতি ধরার খেদা তৈরী হত, তার সংগে খগেন বাবুর যোগাযোগ ছিল । অংশীদার হিসাবে না হলেও ঠিকাদার হিসাবে তার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল, হাতি ধরার খেদাতে হাতি ডাকিয়ে আনতে বহু শ্রমিকের প্রয়োজন।  খগেন বাবুর মারফত এইসব লোক সংগ্রহ করা হত। এইসব নানা কারণে পোষা হাতি চড়ে তিনি সেকালে ঘোরাফেরা করতেন। 

    ঘড়ি বাঁধা হাত, হরিনাম হীন শূণ্য হৃদয়ের ইঙ্গিত যুক্ত রতনমণির গানের ব্যঙ্গের উত্তর  ধূর্ত খগেনও দিয়ে ছিলেন তবে গান বেঁধে নয়, ক্ষমতাবান দাম্ভিক শাসক যেভাবে কূটনৈতিক চালে উত্তর দেয় সেইভাবেই উত্তর দিয়ে ছিলেন তিনি।

    গুরু রতনমণি নোয়াতিয়া  বিচ্ছিন্ন, বিভ্রান্ত, ভীত ও অত্যাচারিত রিয়াং উপজাতির মধ্যে সন্ধ্যেবেলায় সম্মিলিতভাবে প্রার্থনা সঙ্গীত গাওয়া ও উপদেশ শোনার একটি দৈনিক নিয়ম চালু করেছিলেন। যে সময়টা তারা সারাদিন অমানুষিক খাটুনির পরে মদ খেয়ে কাটাতো। এই মদ তৈরি করতে নষ্ট হতো অনেকটা পরিমাণ ভাত। সেই ভাত রক্ষা করতে তিনি পার্বত্য বনে জাত গাঁজা গাছ থেকে তৈরি ভাঙ যোগাতেন শিষ্যদের মধ্যে। এই গাঁজা কিন্তু বেআইনি বিক্রির জন্য নয়, সাধারণ খেটে খাওয়া, সামন্তের হাতে অত্যাচারিত, বোকাসোকা দুখী মানুষকে নেশার লোভ দেখিয়ে ডেকে এনে তাদের উপদেশ ও ভরসা যুগিয়ে  ঐক্যবদ্ধ করার একটা  অজুহাত। প্রার্থনা গান শেষ হলে তার ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দেওয়া হতো, মধুর ভাষার ও সুরের অন্তরালে লুকিয়ে রাখা একাধিক ব্যাখ্যা ও ভাবযুক্ত আরো গান রতনমনির শিষ্য মহলে জমে ছিল।

    সেই সব সঙ্গীতের প্রহারে জর্জরিত হয়ে খগেন চৌধুরী বোধ হয় ক্ষিপ্ত হয়ে শিষ্যদের কণ্ঠ রোধ করতে চেয়েছিলেন সামাজিক বিচার মাধ্যমে। রতনমনির বন্দনা গানটিও অপূর্ব ভক্তির নিদর্শন। সব হিন্দু ভক্ত গুরুকে ভগবত দৃষ্টিতে দেখেন। হিন্দু শিষ্যগন গুরুকে ব্রহ্মা বিষ্ণুর প্রতিভূরূপে পূজা করেন। রিয়াং ভক্তগনও রতনমনিকে সেইভাবে পূজা করেছিলেন। সেই অর্থে নির্দোষ গুরু বন্দনা। কিন্তু খগেন চৌধুরীর কান দিয়ে গানটি শুনলে এর ভাবার্থ অন্যরূপ দাঁড়াবে। প্রার্থনা গানের ভাষায় রতনমনি কে? রতনমনি জগতের গুরু। তিনি মানুষের আইন মানেন না। যে মানুষের আইন মানে না সে রাজার আইন ও মানেনা। কি সাংঘাতিক প্রচার। তিনিই রিয়াংদের মা বাবা এবং ভগবান। সমাজের জয় এবং বিজয় তাহার ইচ্ছাতে নিরূপিত হয়। তিনিই বংশের অর্থাৎ রিয়াং সমাজের উদ্ধার করেন। রতনমনি রিয়াংদের হৃদয়ের রাজা, ভগবান। এমন বন্দনা গান ও প্রচার শুনার পর খগেন চৌধুরীর পক্ষে চুপচাপ বসে থাকা সম্ভব নয়। শিষ্যগন একদিকে নানাভাবে গান বেঁধে খগেন চৌধুরীকে ব্যঙ্গ করছে। অন্যদিকে তারা রতনমনিকে ভগবানের আসনে বসিয়ে দলের জয় লাভের আশা করছে। সংঘাত যে বাঁধবে তা ছিল অবধারিত।

    খুসীকৃষ্ণের এই গানগুলি একদিকে যেমন রতনমনির ধর্মীয় আন্দোলনের রূপরেখাটি ফুটিয়ে তুলেছে অন্যদিকে ত্রিপুরী ভাষায় মাধুর্যপূর্ণ ধর্মীয় সংগীতের নিদর্শন হয়ে আছে। রতনমণির আন্দোলনের সাথে রিয়াং সমাজের উত্থান ও পতনের ইতিহাস যেমন জড়িয়ে আছে ঠিক সেই ভাবে এই গানগুলির মধ্যেও রিয়াংদের ধর্মীয় চিন্তা ও অগ্রগতির ইতিহাস লুকিয়ে আছে। বাংলা তর্জমা থেকেও খুসীকৃষ্ণের রচিত গানের ভক্তি রস ও মাধুৰ্য্য অতি সুন্দরভাবে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। গুরুর কৃপায় তিনি হিন্দু ধর্মের মূল তত্ত্বকে অতি সহজ ও সরল ত্রিপুরী ভাষায় প্রকাশ করেছেন, অথবা বলা যায় তাহার কাব্য প্রতিভা ধর্মকে আশ্রয় করেই প্রকাশ পেয়েছে। তাহার ভগবৎ চরণে নিজেকে নিবেদন করার গভীর আকাঙ্খা এবং নিজের দৈন্য ও অক্ষমতা অপনোদনের জন্য কাতর প্রার্থনা গানের শেষে যুক্ত হয়ে গানগুলিকে ভক্তি ও ধর্মরসের মধুভান্ডে পূর্ণ করেছে। অন্যদিকে এই গানগুলি সুরে, তালে, লয়ে সমবেতভাবে গীত হয়ে রতনমণির শিষ্য সংখ্যা বৃদ্ধি করেছিল। রতনমণির গান নির্ভর ব্যাখ্যার প্রভাবে রিয়াংগণ সংগঠিত হয়েছিল এবং গুরুকে অসীম ভগবৎ ক্ষমতার অধিকারী কল্পনা করে রিয়াং সমাজকে পুনর্গঠন করার সংকল্প রিয়াং শিষ্যগণ গ্রহণ করেছিল। গুরুর সাহায্যে অসাধ্য সাধন তারা করতে পারবে সেই বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল। ত্রিপুরী নোয়াতিয়া সমাজের রতনমনির প্রভাবের ফলে রিয়াং সমাজে ত্রিপুরা ভাষার প্রভাব বৃদ্ধি হয়েছিল।

    রিয়াংদের সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবার মালাটি গেঁথেছিলেন রতননণি  খুসীকৃষ্ণরচিত প্রার্থনা গানের সুতোটি দিয়ে।  

    রিয়াং বিদ্রোহের নেতা রতনমনি রোয়াজা পার্বত্য চট্টগ্রামের তৎকালীন রামগড় মহকুমা এবং বর্তমান খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা উপজেলার অযোধ্যা নগরস্থ দেওয়ান বাজার এলাকার রামসিরা নামক ত্রিপুরা গ্রামে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের বৈশাখ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম নীল কমল রোয়াজা এবং মাতার নাম সিলাই লক্ষী ত্রিপুরা । তাঁর পিতামহের নাম রামদয়াল রোয়াজা । রতনমনি রোয়াজার পিতা ছিলেন গ্রামের একজন অচাইরিউং(ওঝা)। গ্রামবাসীর নিকট তিনি সাধু নামেও পরিচিত। রতনমনিরা চার ভাই চার বোন। পিতার ন্যায় রতন মনি রোয়াজাও একজন শিব সাধক ছিলেন। তিনি ত্রিপুরা সমাজের বিভিন্ন মাঙ্গলিক পূজা-পার্বন করতেন। একসময় তিনি তান্ত্রিক বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন।

    যখন রিয়াং শিষ্যরা বুঝতে সক্ষম হলেন যে , খগেন্দ্র রিয়াং তাদের রিয়াং সমাজের মঙ্গল কামনা করেনা। তখন ধীরে ধীরে সাধু রতনমনির নেতৃত্বে রিয়াংগণ একত্রিত হতে থাকেন। সাধু রতনমনি শিষ্যদের নিয়ে সাধুসঙ্গ করতেন এবং রিয়াং প্রজাদেরকে বিভিন্ন প্রকার সুপরামর্শ প্রদান করে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বোদ্ধ করে সচেতন করে তোলেন । জানা যায় সাধু রতনমনি ভারতীয় জনগণের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি স্বদেশী দলও গঠন করেছিলেন। শিষ্যদের কোন অনুষ্ঠানে কোন কিছু বলার আগে “বন্দে মমাতরম ত্রিপুরেশ্বরী” উচ্চারণ করতেন। ত্রিপুরা রাজ্যকে ত্রিপুরেশ্বরী জ্ঞানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে একথা উচ্চারণ করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। তিনি ১৩৫৩ ত্রিপুরাব্দে শিষ্যদের নিয়ে বিদ্রোহের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। তিনি তৈছারুবুহা তুইনানিছড়ায় ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেন। সাধু রতনমনি তার সংগঠন পরিচালনার জন্য মন্ত্রী পরিষদ গঠন করেছিলেন। তবে তিনি নিজ কক্ষে মহারাজার ছবি টাঙ্গিয়ে রাখতেন। অর্থাৎ তিনি মহারাজাকে মান্য করতেন। কিন্তু খগেন চৌধুরীর দুষ্ট চালে বিভিন্নজনের কুমন্ত্রণায় ক্ষুব্ধ মহারাজা শ্রীযুত বীর বিক্রম কিশোর মাণিক্য দেববর্মা বাহাদুর সাধু রতনমনি ও তাঁর শিষ্যদের দমন করার জন্য ১৪/০৪/১৩৫৩ ত্রিং (১৯৪৩ ইং) একটি রাজ আজ্ঞা জারি করেন। বিদ্রোহীদের দমন করার জন্য উদয়পুর বিলোনিয়া ও অমরপুরে তিনটি বাহিনী প্রেরণ করেন। উদয়পুরে মনোরঞ্জন দেববর্মা, বিলোনিয়ায় ল্যাফটেনেন্ট হরেন্দ্র কিশোর দেববর্মা এবং অমরপুরে ল্যাফটেনেন্ট নগেন্দ্র দেববর্মা বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদান করেন। মহারাজার এই রাজ্যরক্ষী বাহিনীরা সাধু রতনমনির দলকে কখনো ডাকাত দল, কখনো দস্যু দল আবার কখনো স্বদেশী দল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই রাজ্যরক্ষী বাহিনীরা নিরীহ রিয়াং প্রজাদের উপর চালায় অত্যাচার ও অমানুষিক নির্যাতন। রিয়াং প্রজাদের ঘর বাড়িয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। লুট করা হয়। অনেকজনকে দেখামাত্র গুলি করে হত্যা করা হয়। রতনমনির শিষ্যরা প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার চেষ্টা করে। রাজ্য রক্ষী বাহিনী বগাফা ও লক্ষীছড়া দখলে করে ফেললে বিদ্রোহীরা পিছু হটতে থাকে। রিয়াং প্রজারা এক এক জন এক এক দিকে অথবা দলবদ্ধ হয়ে জীবন রক্ষার তাগিদে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে।

    দীনেশ চন্দ্র সাহা তাঁর ‘ত্রিপুরায় গণ আন্দেলনের বিচিত্র ধারা’ (প্রকাশকাল: রাইটার্স পাবলিকেশন্স, বইমেলা-২০০৫) গ্রন্থের ৩৪ নং পৃষ্ঠায় রিয়াং বিদ্রোহের বর্ণনায় লিখেছেন -
    “আকস্মিক আক্রমনে লাঠি, বল্লম ও টাক্কাল ইত্যাদি অস্ত্রধারী রিয়াং বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল । অমরপুর ও বিলোনিয়ায় খন্ডযুদ্ধ হল। কিন্তু আধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে আদিম জাতির বিদ্রোহীরা বেশিক্ষণ প্রতিরোধ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারল না। বহু বিদ্রোহী গুলিতে নিহত হন। ২ মহিলা এবং ১২ জন শিশুসহ তিন হাজার বিদ্রোহী বন্দী হল। ৫০ টি গ্রাম পুড়িয়ে দেওয়া হল।”

    ১ আগস্ট ১৯৪৩ তারিখে রতন মনির ভাই সকামলা ত্রিপুরাসহ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বগাফা ও লক্ষীছড়ায় রাজ্যরক্ষী বাহিনীর আক্রমনের খবর তুইছারুবুহা ক্যাম্পে অবস্থানরত রতন মনির নিকট এসে পৌঁছালে রতন মনি সাধু রাজ্যরক্ষী বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা না দেখে আত্মরক্ষার জন্য তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রামগড় মহকুমার রামসিরা নামক স্থানে আসার সিদ্ধান্ত নেন এবং শিষ্যগণকে অন্যস্থানে গিয়ে আত্মরক্ষা করার নির্দেশ দেন। ঐদিন শেষ রাতে সর্পজয়, কৃষ্ণরাম, চন্দ্রমনি, বিচিত্র প্রভৃতি শিষ্যগণ গুরু রতনমনির সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য যাত্র করেন। তারা সাধু রতন মনিকে সীমানা পর্যন্ত পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে রতনমনির সঙ্গে মিলিত হন বালাফা, চৈত্রসেন, দাবারায়, বিচিত্র মুকুন্দ, কান্ত রায় ও তবিয়াসহ অনেককে গুলি করা হয় এবং ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু খুশীকৃষ্ণ পালিয়ে যান পূর্ব দিকে। আর রতন মনি পালিয়ে যান দীঘিনালায়। তিনি দীঘিনালার পোমাং পাড়ায় অশনি কুমার ত্রিপুরার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং  ৬ মাস পর দীঘিনালা থেকে ধৃত হন। ১৯৪৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আগরতলা রাজ্যরক্ষী বাহিনীর হাতে নির্মম শারীরিক নির্যাতনে মৃত্যবরণ করেন। এভাবে সাধু রতনমনি ও তাঁর দলের বিদ্রোহ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। রতন মনি সাধুসহ অনেকের মৃত্যু ও ফাঁসি হয়। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। কেউবা অন্যত্র পালিয়ে গিয়ে নতুন করে বাঁচবার স্বপ্ন দেখে। যদিও পরাজিত স্বদেশী দলের সদস্য হিসেবে লেখা হয়ে যায় রতনমনি, খুসীকৃষ্ণ, তাইন্দা রায়, শিলারাম, কানাই চন্দ্র, নিধিরাম, বিশমনি, মান্তিরায়, কৃষ্ণরাম, রামপ্রসাদ, কান্তরায়, বাহাদুর রায়, স্বর্পজয়, হান্দাই সিং প্রভৃতি নাম।

    রিয়াং বিদ্রোহ কি রাজার বিরুদ্ধে নাকি সমাজপতিদের বিরুদ্ধে?

    সাধু রতনমনি অথবা সাধু খুসীকৃষ্ণ কেউই রিয়াং দফার লোক ছিলেন না। তাঁরা তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার রামগড় মহকুমার নাইতং দফার লোক ছিলেন। কিন্তু নিরীহ, পশ্চাৎপদ ও রাজভক্ত রিয়াং সম্প্রদায়ের প্রতি রিয়াং সমাজপতি ও ব্রাহ্মণদের প্রতিনিয়ত শোষণ, নির্যাতন, অত্যাচার দেখে সাধু রতনমনি ও তাঁর শিষ্যগণ ব্যথিত হন এবং পরবর্তীতে ঐ সমাজপতিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাই অনেক ঐতিহাসিক এই বিদ্রোহকে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলতে নারাজ । কেননা তাঁদের মতে এই বিদ্রোহ ছিল সম্পূর্ণ শুধুমাত্র রিয়াং অসৎ অত্যাচারী সমাজপতিদের বিরুদ্ধে, কোন মহারাজ বা রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়।

    তাই দীনেশ চন্দ্র সাহা তাঁর “ত্রিপুরা গণ আন্দোলনের বিচিত্র ধারা” নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন -
    “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রিয়াং বিদ্রোহের উপর এক তদন্ত রিপোর্টের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, রিয়াং বিদ্রোহের পেছনে কোন রাজনৈতিক কারণ ছিল না। এই বিদ্রোহ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেও ছিল না। চরম দারিদ্র্য এবং সর্দারদের অত্যচারই বিদ্রোহের প্রধান কারণ।”

    তথ্যসূত্র:-

    ১. তড়িৎ মোহন দাশগগুপ্ত কর্তৃক রচিত ‘বিদ্রোহী রিয়াং নেতা রতনমণি’ গ্রন্থ হতে সংকলিত। বইটির প্রকাশকাল - ১৯৯৩, প্রকাশক - উপজাতি গবেষণা অধিকার, ত্রিপুরা সরকার।
    ২. দীনেশ চন্দ্র সাহা লিখিত  ‘ত্রিপুরায় গণ আন্দেলনের বিচিত্র ধারা’ (প্রকাশকাল: রাইটার্স পাবলিকেশন্স, বইমেলা-২০০৫)।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • jsl | 192.139.20.199 | ২১ জুলাই ২০২৩ ১৭:৫৩521497
  • এই লেখাটা মিস হয়েছিল। রতনমনি, রিয়াং বিদ্রোহ, বিদ্রোহ দমন - এই অধ্যায়গুলি, কালের নিরিখে খুব পুরনো না হলেও অনালোচিত। পরাজিতের ইতিহাস কেমন করে অন্ধকারে চলে যায় তার হাতে গরম উদাহরন বলা যায়।

    এই লেখাটার জন্যে লেখিকাকে ধন্যবাদ জানাই।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন