এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • কথার কথকতা

    Surajit Dasgupta লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ মে ২০২৩ | ২০১ বার পঠিত
  • আমাদের কোনো কথাই কিন্তু সম্পূর্ণ নয়, পরবর্তীতেও সেই কথার রেশ থেকে যায়। যেকোনো কথার পরে আরও বেশ কিছু কথা বলা যায়, কিন্তু আমরা বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই বলি না। একে "না বলা কথা" বলা যেতে পারে। কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, আপনি কেমন আছেন? উত্তরে তিনি ভালো বা মন্দ কিছু একটা বললেন। মন্দ বললে পরবর্তী কথা বললেও, ভালো বললে আর কোনো কথা আমরা বলি না। কিন্তু তিনি কি ধরনের ভালো আছেন সেটা আর জিজ্ঞেস করি না। তিনি ভালো বলতে যে মানে করতে চাইছেন বা যে ভালো স্তরের কথা বলতে চাইছেন তার সাথে আমার ভালো সম্পর্কে যে ধারণা বিদ্যমান তা মিলছে কিনা, সেই অব্দি আর এগোই না। হয়তো বা নিতান্তই ভদ্রতার খাতিরে তাঁর সাথে কুশল বিনিময় করেছিলাম, তাই আর এগোই নি।

    কথা অসম্পূর্ণ রাখা আমাদের অভ্যাস, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বদভ্যাসও বলা যেতে পারে। হাতে বাজারের থলি দেখেও জিজ্ঞেস করি, কোথায় গিয়েছিলেন? উত্তরে বাজারে গিয়েছিলাম শুনলেও পরবর্তী প্রশ্ন বা কথা না বলে একটু মিচকে হাসি দিয়ে চলে যাই নিজের গন্তব্যে। এটাই মানবজাতির বদভ্যাস, আর এই কারণেই যে কোনো ঘটনার একাধিক স্তর তৈরী হয় এবং সংসারে, সমাজে জটিলতা তৈরী হয়। 

    ষাট, বাষট্টি বছরের এক ভদ্রলোক এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলেন, "জ্যেঠু, কেমন আছেন?"
    বয়স্ক ব্যক্তির উত্তর - কেমন আছেন না বলে বলো, কেন আছেন?

    বয়স্ক লোক অনেক ক্ষেত্রেই কেমন আছেন শুনলে ভাবেন তাকে কেউ রসিকতা করছে। কারণ প্রতিদিন জীবন ধারণের ক্ষেত্রে তাদের অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়, সেটা সর্বজনবিদিত। ফলে সেই বয়স্ক ব্যক্তির ক্ষোভ বা রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার উত্তরে। প্রথম ব্যক্তি কিন্তু দ্বিতীয় প্রশ্ন না করে বা কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। এক্ষেত্রে তাই বয়স্ক ব্যক্তির মনের কোণে ক্ষোভই জমে থাকলে প্রথম ব্যক্তির প্রতি।

    প্রথম ব্যক্তি - রবিবারের বাজারে সেরা মাছটা কিনলেন, আজ তো জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হবে বাড়ীতে।
    দ্বিতীয় ব্যক্তি - সেরা মাছের দোকানের সামনে দাঁড়ালেই কি আর সেরা মাছ কেনা যায়? বাড়ীতে চার চারটে পেট, ভরসা শুধু আমার পেনশনটুকু। আপনার রসিকতার জবাব নেই।

    প্রথম ব্যক্তি এখানে জেনেবুঝে রসিকতা করেছেন না, না জেনে প্রশ্ন করেছেন সেটাই মূল প্রশ্ন। যাই করে থাকুন না কেন, ঘটনার ফলশ্রুতি দুই ব্যক্তির সম্পর্কে চিড়, কারণ দ্বিতীয় ক্ষেত্রেও প্রথম ব্যক্তির রসিকতা দ্বিতীয় ব্যক্তির সন্মানহানির কারণ।

    আসলে আমরা কেউই অন্যের প্রতি সহানুভূতি বা সন্মান দেখাই না, নিতান্ত ভদ্রতা বা ন্যূনতম সৌজন্য দেখানোর জন্য অন্যের সাথে যেটুকু কথা বলার প্রয়োজন সেইটুকুই বলি। পরিস্থিতি অন্য রকমের হয়ে গেলেও কথা বাড়াই না। হয়তো কথা বাড়ালে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হতো, কিন্তু আমরা সেই পথে পা বাড়াই না। প্রতিবেশী বা সমাজে এইরকম ঘটনা চেনাজানা মানুষের সংখ্যা কমাবে ঠিকই কিন্তু সংসারে হলে নিত্য অশান্তি ডেকে আনবে।

    কিছু ক্ষেত্রে হয়তো কথার রেশ না টেনে নিয়ে যাওয়া পরিস্থিতি লঘু হতে সাহায্য করে আবার রঙ্গরসের সৃষ্টি করে কিছু ক্ষেত্রে। কিন্তু একই ওষুধ সব রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশী। মোল্লা নাসিরুদ্দিনের সেই গল্পটা বলা যায় এখানে, মোল্লাকে মসজিদ থেকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য ডাকলে মোল্লা সেখানে গিয়ে দর্শকদের জিজ্ঞেস করে যে, তিনি যে ব্যাপারে কথা বলবেন সেই সম্পর্কে দর্শকেরা কিছু জানে কিনা। দর্শক যখন উত্তর দেয় যে তারা কিছু জানে না তখন মোল্লা বলে, না জানা দর্শকদের কিছু বলা মানে উলুবনে মুক্তো ছড়ানো। তাই কিছু না বলেই মোল্লা চলে আসে। পরের বার একইভাবে দর্শকেরা যখন বলে, তারা জানে তখন মোল্লা বলে, আপনারা যখন জানেন তখন আমি দ্বিতীয়বার একই কথা বলে সময় নষ্ট করবো কেনো এবং আবার চলে আসে। তৃতীয়বার ও একইভাবে যখন অর্ধেক দর্শক বলে তারা জানে আর বাকী অর্ধেক দর্শক বলে তারা কিছু জানে না, তখন মোল্লা বলে, যারা জানেন তারা, যারা জানেন না তাদেরকে বলে দিন, আমি বাড়ী গেলাম।

    গল্পের এই কথাগুলোতে প্রচুর রঙ্গরসের সৃষ্টি হয়, কিন্তু বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে ঝামেলা বা অশান্তি অবশ্যম্ভাবী। আসলে আমরা বড়ই রোমান্টিক, কল্পনাপ্রবন, আবেগপ্রবণ। খুব কম সময়েই আমরা বাস্তবের কাছাকাছি বিচরণ করি। এই কারণেই আমার সামনে যিনি দাঁড়িয়ে তার কথা বিবেচনা করি না, স্থান, কাল, পাত্রের কথা বিবেচনা না করেই কথা শুরু করি এবং শেষও করি। কোথায় শেষ করলে পরিস্থিতি কি হতে পারে, আবেগ বা কল্পনার তাড়নায় মনে থাকে না। ফলস্বরূপ বিচ্ছিরি পরিস্থিতি তৈরী হয়।

    সুনীল আকাশে পেঁজা তুলোর আনাগোনা, বিস্তীর্ণ পথের ধারে কাশ ফুলের শুভ্রতা কিংবা বর্ষাকালের কুচকুচে কালো মেঘরাশি বা কালবৈশাখীর দিগন্ত জোড়া বিদ্যুতের ঝলকানি, সবই আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়, মনের পেলবকোণে হিল্লোল তোলে রোমান্টিকতার। এই ইতিহাস আজকের নয়, মানব সভ্যতার আদিকাল থেকেই রোমান্টিকতা আমাদের শরীরের প্রতিটি রোমে, রক্তের প্রতিটি বিন্দুতে। আবেগের পাশের প্রকোষ্ঠেই আবার কল্পনার বসবাস। আমরা যেমন ভাবপ্রবন বা আবেগপ্রবণ তেমনিই আবার কল্পনাপ্রবণ। মানবজাতির মধ্যে আবার বাঙালি জাতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশী আবেগপ্রবণ এবং কল্পনাপ্রবণ। বিজ্ঞান অনেককিছুই আবিষ্কার করার কয়েকশত বছর আগে আমরা কল্পনায় সেসব আবিষ্কার করে ফেলেছি। কত যুগ আগেই আমরা কল্পনায় হাঁসের পিঠে চেপে সূর্য অব্দি পৌঁছে গেছি, যদিও বিজ্ঞান আজ অব্দি সূর্যে পৌঁছতে পারেনি (যন্ত্র শুধু এতদিনে সূর্যের কাছাকাছি যেতে পেরেছে)। আমরা দিনের বেশিরভাগটাই আবেগের দ্বারা পরিচালিত হই। সুখেই হোক বা দুঃখে, শান্তিতেই হোক বা অশান্তিতে, রাগেই হোক বা ভালোবাসায়, সবেতেই আমরা আবেগ আর কল্পনার আশ্রয় নিই, সেখানেই জীবনের রসদ খুঁজে পাই। সেসব ঘটনা যেমন অনেক সুন্দর মুহূর্ত তৈরী করে মাঝে মাঝে আবার তেমনি অনেক সময়ে অপ্রস্তুত অবস্থাতেও পড়তে হয়। অনেক লেখা ও কবিতা তৈরী হয়েছে এযাবৎ সেইসমস্ত ঘটনা নিয়ে। রসিক বাঙালির রক্তে আবেগ আর কল্পনা একটু বেশী মাত্রায় থাকে, ফলে বাঙালির জীবনে সুন্দর আর অপ্রস্তুত মুহূর্তের সংখ্যা বড্ড বেশী। এরপরে রয়েছে পরিবেশ, পরিস্থিতি অনুযায়ী বাক্যে শব্দের প্রয়োগ। এখানেও ভুল করলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়ে।

    আমি একবার স্ত্রীর সাথে গল্প করতে গিয়ে বলেছিলাম, আমার কল্পনা আছে, কল্পনা আমাকে ভাবপ্রবন বা উত্তেজিত হতে সাহায্য করে, এই রুক্ষ জীবনে কল্পনাই আমায় প্রতিদিন বাঁচিয়ে রাখে। স্ত্রী উত্তরে বলেছিল, ওঃ আমি তাহলে তোমার দ্বিতীয় পক্ষ! কল্পনাকে বিয়ে করে তোমার মন ভরেনি? আমার জীবনটা নষ্ট করলে কোন অধিকারে? পরেরটুকু আর না বললেও খুব সহজেই বোঝা যায় কি ঘটেছিলো। এরপরে বুঝেছিলাম, বাঙালির বাংলা ভাষায় দক্ষতা খুব বেশী নেই (আমি নিজেও এই দলেই পড়ি) আর শব্দ নিয়ে বা শব্দের অর্থ নিয়ে খুব বেশী খেলা করাও উচিত নয়। এখন স্মৃতিপটকে উল্টো দিকে ঘোরালে এইরকম অনেক স্মৃতিই মনে পড়ে যেখানে স্মৃতি মেদুর না হয়ে বরং তিক্ত। কারণ যেমন বাংলা ভাষা তেমনি সত্য বলা। ছোটবেলাতেই গুরুজনদের কাছে শিখেছিলাম, শতং বদ মা লিখ, অর্থাৎ শতবার কোনকথা বললেও সেই কথা একবারের জন্যেও লিখবে না। মানে লেখার ক্ষেত্রে প্রমান থেকে যায়, কিন্তু মুখে বললে কোনো প্রমাণ থাকে না। কথাটিকে আমি ধ্রুবসত্য বলে ধরে নিয়েই জীবনের পথে চলেছি সেই ছোটবেলা থেকে। ফলে বহুবার নানান তিক্ত অভিজ্ঞতার সামনাসামনি হতে হয়েছে। পরে ভেবে দেখেছি, প্রমান থাকার ভয় নেই বলে বড্ড বেশী কথা বলে ফেলি মাঝেমাঝেই, আর সেটার মানে ভিন্নরকম হয়ে যায় বলেই যত সমস্যা। হাসির খোরাকও হতে হয়েছে অনেক সময়। 

    আমি ছোটবেলা থেকেই আবেগপ্রবণ, অন্যদের চেয়ে একটু বোধহয় বেশীই। বিয়ের সময় পৈতৃক বাড়ীতেই থাকতাম। এই নিয়ে শ্বশুরবাড়ীতে মাঝেমাঝে একটু ফিসফিস ব্যাপার স্যাপার ছিল। জামাই চাকরী করে তারপরে আবার ভালো চাকরী, কিন্তু নিজের বাড়ী বা ফ্ল্যাট নেই, তারমানে খুব কিপ্টে। যাইহোক, বিয়ের বেশ কিছু বছর পরে কোলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনলাম। খুব বড় নয়, মাত্র ৮৫০ স্কোয়ার ফিটের। নিজের ভেতরে তখন আবেগ পরিপূর্ণরূপে বিরাজ করছে, নিজেকে বেশ একজন কেউকেটা বলে মনে হচ্ছে। ওদিকে শ্বশুরবাড়ী যাকে বলে আলিশান বাংলো, বিরাট দোতলা বাড়ী, চাকর বাকর সহ বিরাট ব্যাপার। আসলে শ্বশুর আমার বিরাট বড়লোক। তা সেই ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশে সবাই এসেছিল, আমার বাবা-মা, বউয়ের বাবা-মা, অন্যান্য আত্মীয় স্বজন। ওইটুকু ছোট ফ্ল্যাট দেখে কি আর তাদের মন ভরে? কিন্তু আমার তো সব সঞ্চয় বেরিয়ে গেছে আবার বিরাট অংকের ব্যাংক লোনও নিতে হয়েছে ওইটুকু ফ্ল্যাট করতেই। শ্বাশুড়ী আমার বেশ নাক উঁচু, তিনি কথায় কথায় বলে ফেললেন তার মেয়েকে, এত ছোট ফ্ল্যাটে থাকবি কি করে? এ তো পায়রার খোপ, জামাই এখানেও পয়সা খরচ করতে চায়না নাকি? দুর্ভাগ্য আমার, সেইসময়ে আমি সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলাম, শ্বাশুড়ী বোধহয় খেয়াল করেননি তাই বলে ফেলেছেন। কিন্তু আমার কানে তো চলে এলো সেই কথা। মুখ দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ভেতরের আবেগ বেরিয়ে এলো, বলে ফেললাম, বাথরুম থেকে ন্যাকরাটা এনে একবার সমস্ত মেঝেটা মুছে দেখুন, বুঝবেন কত বড় ফ্ল্যাট এটা। সেইদিন গৃহপ্রবেশের পুজো ছিল বলে তিনি থেকে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন কিন্তু পরেরদিনই কোলকাতা ছেড়ে সোজা নিজের বাড়ীতে। এখনও অব্দি আমার সাথে ঠিকভাবে কথা বলেননা।

    কলকাতা থেকে নিজের বাড়ীতে ফিরে যাবার কিছুদিন পরেই শ্বাশুড়ী আমার অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখনও আমার মধ্যে কেউকেটা ভাবটা যথেষ্ট পরিমাণে রয়ে গেছে। আমার বাবা-মা আর কিছু আত্মীয়-স্বজন রয়ে গেছে। অফিসেও যাচ্ছিনা তখনও, ছুটি চলছে। বউয়ের বাবা, মানে স্বশুরমশাই ফোনে তাকে জানায়, তার মায়ের অসুস্থতার খবর। শোনার পর থেকে বউ আমার মন খারাপ করে বসে আছে বিছানার ওপরে। স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি তখনও জানতে পারিনি, শ্বাশুড়ীর শরীর খারাপের খবর। বাইরে বেরিয়েছিলাম কাজে, ফিরে আসার পর বউ আমাকে প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, "মা এখান থেকে ফিরে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। প্রচন্ড জ্বর, কমছে না কিছুতেই। এখানে তো মশারির ব্যবস্থা করোনি তুমি, মশা কামড়েছে সেদিন রাত্রে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে, রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে, ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। আমি মায়ের কাছে যাবো"। আমি বললাম, সে যাবে ঠিক আছে। আমি তোমাকে স্টেশনে গিয়ে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবো। কিন্তু আগে বলো, মশাটা এখন কেমন আছে? বলেই বুঝতে পারলাম, কি বলতে গিয়ে কি বলে ফেললাম, আবেগের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। বউ হাতের কাছে বালিশটা তুলে আমার দিকে সঙ্গে সঙ্গে ছুড়ে দিলো। এরপরের ঘটনা যা যা হতে পারে মানে,কান্নাকাটি, কথা কাটাকাটি বা তর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি সবকিছুই ঘটেছিল। ঘোর দুপুরেই বউ তার মায়ের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার জন্য রওনা দেয়। এরপরে, দিন দুয়েকের মধ্যে, যারা এসেছিল গৃহপ্রবেশ উপলক্ষ্যে সবাই যে যার মতো ফিরে যায়। আমি একা হয়ে পড়ি। নিজে হাতে রান্না করে অফিস যাওয়া, ফিরে এসে আবার রাত্রের রান্না সবই চলতে থাকে। শ্বাশুড়ী সুস্থ হয়ে গেলেও বউ ফিরে আসার কথা উচ্চারণ করেনা। নিজে থেকে আমাকে ফোন করেনা, আমি ফোন করলে দুএকটার বেশী কথা বলেনা। একমাস ... দেড়মাস ... দুমাস হয়ে গেল এইরকমভাবে, তবুও সে ফিরে এলোনা।

    বাধ্য হয়ে অফিস থেকে ছুটি নেওয়ার কথা চিন্তা করতে হলো। দরখাস্ত পেয়েই বড়সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কিছুদিন আগেই তো গৃহপ্রবেশের জন্য দিন পনেরো ছুটি নিয়েছি, তাহলে আবার ছুটির দরকার পড়লো কেনো? সত্যি কথা বলতে পারলাম না, বললাম শ্বাশুড়ী অসুস্থ হয়েছেন গৃহপ্রবেশের পরে ফিরে গিয়ে, তাই তাঁকে দেখতে একটু শ্বশুরবাড়ী যেতে হবে। শুনেই তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, একা যাবো নাকি দুজনে মিলে? উত্তরে বললাম দুজনে মিলে, আবার সেই সত্যি কথাটা এড়িয়ে যেতে চাইলাম। কিন্তু তিনি ধরে ফেললেন আমার মিথ্যে কথাটা। বললেন, এই কদিন ধরে তো আমি রোজ নিজে রান্নাবান্না করে খেয়ে অফিসে আসছি, ফলে রোজ অফিসে আসতে দেরী হচ্ছে, এমনকি আজকেও দেরী হয়েছে, তাহলে মিসেস ফিরে এলেন কবে? আমার মিথ্যে কথা বলার ভান্ডার শেষ হয়ে গেল সঙ্গেসঙ্গেই। বললাম, না মানে একা যাবো, কিন্তু ফিরবো দুজনে। যাইহোক তিনি আর কথা না বাড়িয়ে ছুটি মঞ্জুর করে দিলেন। ছুটি নিয়ে আমি যথারীতি স্ত্রীকে কিছু না জানিয়েই শ্বশুরবাড়ীতে হাজির হলাম। শ্বশুর, শাশুড়ী বা বউ কেউই চমকে গেল, আহ্লাদিত হলো বা প্রীত হলো এমন কিছু নয়। বরং চোখে, মুখে বিরক্তির ছাপই দেখতে পেলাম। নিজের শ্বশুর বাড়ীতেই নিজেকে রবাহুত বলে মনে হচ্ছিল। যাইহোক, শাশুড়ী মাতাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছেন এখন? তিনি উত্তর দিলেন, "তোমার বাড়ীর সেই মশাটা কেমন আছে এখন"? আমি উত্তর পেয়ে গেলাম বউয়ের দুমাস ধরে আমার কাছে না ফেরার। বুঝলাম, এখন আবেগকে কোনোভাবেই বাইরে বেরোতে দিলে চলবে না, নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। নিজের দোষ সম্পূর্ণ স্বীকার করে নেওয়াটাই এখন আমাকে একমাত্র বাঁচাতে পারে, নইলে বউ আর বোধহয় তার বাপেরবাড়ী ছেড়ে নড়বে না। তাই যতটা নরম স্বর করা যায়, ততটা নরম স্বরে বললাম, আসলে আমি কিন্তু মশা বলতে চাইনি। আপনার মেয়ে যখন ডেঙ্গু বলেছিলো তখন আমার মাথায় খেলেছিল জলাতঙ্ক। আর আপনার মেয়ে বলেছিল, সেদিন রাত্রে আপনাকে খুব মশা কামড়েছিলো। সবমিলিয়ে তাই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল, মশাটা কেমন আছে। জলাতঙ্ক হলে তো কুকুরটাকে নজরে রাখতে হয়, সেই চিন্তা থেকেই এরকম বলে ফেলেছিলাম। বলার পরে মাথায় এসেছিল, জলাতঙ্ক নয়, ওটা ডেঙ্গু। কিন্তু ততক্ষনে আপনার মেয়ে রাগ করে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেছে। শ্বাশুড়ী মাতার রাগ কমলো কিনা বুঝতে পারলাম না কিন্তু কথা আর এগোয় নি। কিছু পরেই কাজের লোকে মন্ডা, মিঠাই দিয়ে গেল। রাত্রে বউকে বললাম পরশুদিন ফিরে যাব। পরেরদিন দেখলাম, বউ নিজের গোছগাছ শুরু করলো, তখন বুঝলাম এই যাত্রায় বেঁচে গেছি।

    এইরকম উদাহরণ আমাদের সকলের জীবনেই হাজারো আছে। তবুও আমরা সতর্ক হই না, ফলে আবার একই ধরনের ঘটনা ঘটে যায় জীবনে। যার সাথে কথা বলছি তাকে গুরুত্ব দিলে অর্থাৎ তার সাথে আমার সম্পর্ক কি ধরনের, তার বয়স, পদমর্যাদা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে কথা বললেই সমস্যা কম হয়। আমার চেয়ে বয়সে ছোট হলেও তাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। বাবার হাত ধরে যে অনিচ্ছুক বাচ্চা স্কুলে যাচ্ছে তাকে যদি আমি জিজ্ঞেস করি, স্কুলে যাচ্ছ বাবা? তাহলে তার দিক থেকে বাক্যবাণ ধেয়ে আসতেই পারে, আমার সম্মানহানি হতেই পারে। একটু সতর্ক হলেই এতে নিজের সন্মান বাঁচবে, অন্যেরও ভালো লাগবে, সংসারে শান্তি বজায় থাকবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন