এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গাজন

    Manab Mondal লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ এপ্রিল ২০২৩ | ২৫২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • গ্রামবাংলায় শিবের ভক্তেরা চৈত্র মাসের শেষ সপ্তাহ জুড়ে সন্ন্যাস নেন এবং চৈত্র সংক্রান্তিতে চড়ক পূজার সঙ্গে গাজন উৎসবে তার সমাপ্তি হয়।

    গাজনের ভক্তরা বা সন্ন্যাসীরা নিজেদের শরীরকে বিভিন্ন উপায়ে যন্ত্রণা দিয়ে কৃচ্ছসাধনের মধ্যে দিয়ে ইষ্টদেবতাকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। গাজনের সময় শোভাযাত্রা করে দেবতার মন্দিরে যান। বাংলায় তিনটি গাজন চালু আছে। শিবের গাজনে দু'জন প্রধান সন্ন্যাসী শিব ও পার্বতী সেজে আর অন্যান্যরা নন্দী, ভৃঙ্গী, ভূতপ্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। এই শোভাযাত্রায় শিবের নানা লৌকিক ছড়া আবৃত্তি ও গান করা হয়, তার সঙ্গে তালে তালে চলে নাচ। চৈত্রসংক্রান্তির গাজনে কালী নাচ একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান। ধর্মের গাজনের বিশেষ অঙ্গ হল নরমুণ্ড বা গলিত শব নিয়ে নৃত্য বা মড়াখেলা বা কালিকা পাতারি নাচ। জ্যৈষ্ঠমাসে মনসার গাজনে মহিলা সন্ন্যাসী বা ভক্তরা অংশ নেন, তারা চড়কের সন্ন্যাসীদের মতোই অনুষ্ঠান পালন করেন।

    এই শোভাযাত্রায় সন্ন্যাসীরা প্রচণ্ড গর্জন করেন বলে উৎসবের নাম গাজন। তবে গাজন শব্দটিকে ভাঙলে গ্রাম বা গা, এবং জন বলতে জনসাধারণ; গ্রামীণ জনসাধারণের উৎসব হওয়ায় এই উৎসবের নাম গাজন হতে পারে।

    লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, হরকালীর সঙ্গে শিবের বিবাহ হয় গাজন উৎসবের দিনে। আগেই বলেছি গাজন তিন প্রকার, নানা পৌরাণিক ও লৌকিক দেবতার নামে, শিবের গাজন, নীলের গাজন, ধর্মের গাজন, আদ্যের গাজন, বীর বলাই গাজন (বীর বলাই বিষ্ণুর অবতার)।

    ভালো করে লক্ষ্য করুন এই উৎসবের লক্ষ্য সূর্য। তার পত্নী হিসেবে পৃথিবীকে কল্পনা করা হচ্ছে। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর বিবাহ দেওয়াই অনুষ্ঠান এই উৎসব। চৈত্র মাসে সূর্য যখন প্রচণ্ড অগ্নিময় রূপ ধারণ করে তখন সূর্যের তেজ প্রশমনের আশায় কৃষিজীবী সমাজ এই অনুষ্ঠানের সূচনা করেছিল। আসলে হিন্দুদের ত্রিদেবের আবির্ভাব ঘটে সূর্য থেকেই। 

    এই লৌকিক উৎসবের সাথে অনেক পৌরাণিক কাহিনী যুক্ত হয়ে আছে। যেমন এই উৎসবে যে বানফোড়া হয় তার পিছনে একটি কাহিনী আছে। শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধের ও বাণরাজের মেয়ে ঊষার প্রেম কাহিনী। দৈত্যরাজ বাণরাজ মানতেন পারেন নি তাদের প্রেম। অনিরুদ্ধ বন্দি হলেন তার হাতে। কৃষ্ণ তাই বাণগড় আক্রমণ করলেন। যুদ্ধে পরাজিত হল বাণরাজ। পরাজিত ক্ষতবিক্ষত বাণরাজ মৃত্যু আসন্ন জেনে নিজেকে উৎসর্গ করলেন আরাধ্য ভগবান শিবের চরণে। সেই থেকে এই বানফোড়া প্রচলন।

    কৃচ্ছসাধন, পুনর্জন্মবাদ আর মুক্তির আস্বাদ সম্পন্ন বাণরাজেরই দেখানো পথ ধরে চড়ক উৎসবে অংশগ্রহণ করেন ভক্তরা। লোহার হুড়কো দিয়ে চাকার সঙ্গে বাঁধা ভক্তরা চড়কগাছে ঘোরেন।  ভক্তদের শরীরে, পায়ে, হাতে, পিঠে, জিভে বাণশলাকা বিদ্ধ করে। কেউ কেউ নিজের শরীরে জ্বলন্ত শলাকা ফুঁরে দেয়।

    ক্ষেত্র সমীক্ষক সঞ্জয় ঘোষ বলছেন -

    "ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত গাজন। না, টাকা বা ভালো খাবার এর লোভ, বা কোনো প্রচার দরকার হয় না, লাউডস্পিকার বা আড়ম্বরপূর্ণ মন্ডপ কিছুই লাগে না। লাগে না চোখ ঝলসানো দামী গাড়ি, বা, লরি করে ভাড়াটে লোকও আনতে হয় না। কারণ শ্রমজীবি এই মানুষগুলি নিজেদের শ্রমের ওপর আস্থাশীল, মাইলের পর মাইল হাঁটতে কোনো অসুবিধা হয় না এদের। এতে হাজার হাজার বছরের পরম্পরা প্রতিটি মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সমাজের সবচেয়ে নিচুতলার মানুষটিও স্বতস্ফুর্তভাবে অংশ নেন। স্ত্রী-পুরুষ, ছোট-বড় ভেদ থাকে না গাজনে। থাকে না ধর্ম ভাষা জাতির ভেদাভেদ। যে কেউ অংশ নিতে পারেন। আদিবাসী ও তথাকথিত নিম্নবর্ণের বাঙ্গালি সবাই একসাথে অংশ নেন। না, এই বাঙ্গালিদের  কাছে আদিবাসীরা ব্রাত্য নন। এই বাঙ্গালিদের কাছে উচ্চবর্ণের চেয়ে এরাই বেশী আপন। কারন এদের পূর্বপুরুষ এদের মতই আদিবাসী ছিলেন। তাই ব্রাহ্মণের পৌরোহিত্য ছাড়াই কোরামুদিদের থাকে নিজস্ব পুরোহিত বা লায়া। এখানে লায়া রুহিত মুদি। ওর কাছে উত্তরীয় নিতে এদের দ্বিধা নেই। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কংকণ দিঘির কোরা মুদি আদিবাসী পাড়ার এক আদিবাসী পরিবারের শিব থানে গতকাল ২৮শে চৈত্র ১৪২৯ অনুষ্ঠান থেকে জানা গেল যে এখানে ৯০ জন সন্ন্যাসীর মধ্যে প্রায় ১০ জন বাঙ্গালি ও ৮০ জন আদিবাসী। গায়ে গা লাগিয়ে বসে আছেন, আদেশ কাড়ার/ফুল পড়ার। কারণ, তারপরেই অস্থায়ী শিব ঘরে পূজা সেরে তারা দল বেঁধে যাবেন বাবুজান সিপাই স্কুলের মাঠে ঝাঁপে অংশ নিতে। শুধু পুরুষরা ঝাঁপ দেবেন। এদের গায়ের রঙ কালো, বহু যুগ ধরে সূর্যের তাপ এদের গায়ের চামড়ায় প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু মন সূর্যের আলোর মতই সাদা ধবধবে। সেখানে কলংক নেই। এদের ঠোট মোটা নাক বিস্তৃত, কিন্তু ঠোঁট থেকে নিসৃত ভাষায় মানবতা, আন্তরিকতা, আত্মীয়তা ঝরে পড়ে, মনে হয় পৃথিবীটা কত সুন্দর মানুষের বসবাসের যোগ্য।

    কত হাজার বছরের পরম্পরা বহন করে চলেছেন বৃদ্ধ আদিবাসী। তাঁর মুখের চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে কত শীত বসন্ত গ্রীষ্ম বর্ষার অভিজ্ঞতা সঞ্চিত হয়ে আছে কে জানে। লাঠি হাতে আজও চলেছেন এই বৃদ্ধ তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্য সঞ্চারিত করতে। তাঁর উপস্থিতিই সম্ভ্রম জাগায়। নিজ পাড়ায় সূর্য হিন্দুদের শিব পূজা করার পর (আদিবাসীদের সিং বোঙ্গা /ধর্ম ), ( মুসলিমদের গাজী), গাজনের সন্ন্যাসীদের নিয়ে চলেছেন - একসাথে ৯ পাড়ার ঝাঁপের আয়োজন হয়েছে সেখানে। আদিবাসী বাঙ্গালী একসাথে ঝাঁপ দেখবেন অংশ নেবেন। এ যে গাজন গাঁ, সর্বজনের পূজা।" 

    বাণরাজা মৃত্যু সময় শ্রীকৃষ্ণর কাছে বর চেয়েছিলেন তাঁর মৃত্যুদিনে যেন কোন জাতপাতের ভেদাভেদ থাকে না। গাজন উৎসব ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে নিম্নবর্ণ মানুষের হুংকার। তবে বাংলা সাহিত্যের পাতা অন্য কথা বলে। গাজন-উৎসব নিয়ে কলকাতার বাবুরা মাতামাতি করতেন। উনিশ শতকে হুতোম কিংবা প্রাণকৃষ্ণ দত্তের কথা, কলকাতার মাদকাসক্ত বা বেশ্যাসক্ত বাবুদের, কলকাতার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা গন্ধবেনেরা শিবের কৃপা লাভের আশায় কৌম ‘গাজুনে বামুন’দের পায়ে লুটিয়ে পড়েছেন। চড়কের রাতে বাবুরা আহিরিটোলার চৌমাথা, মেছোবাজারের হাঁড়িহাটা, জোড়াসাঁকোর পোদ্দারের দোকান, চোরবাগানের মোড়, সোনাগাছি বটতলায় ভিড় জমাতেন। প্রাণকৃষ্ণ দত্ত কালীঘাট বা হুগলকুড়িয়ার বাবু শিবচন্দ্র গুহর কালীবাড়িতে বাণফোঁড়ার ঘটনা বা চিৎপুর রোডের সং বা জেলে পাড়ার সং এর কথা বলেছেন। 

    কোন আদিম যুগ থেকে আমাদের সূর্য তাপ ও আলো দিয়ে যাচ্ছে। পরে চাষবাস আরও সূর্যের ওপর নির্ভরশীল হল। সূর্যকে দেবতা রূপে পুজা শুরু করল। এবং সেখানে থেকেই নানা প্রথা আচার শুরু হয়েছিল। তার অন্যতম এই ঝাঁপ। হাজার কোটি বছরের পুরোনো সূর্যকে পিছনে রেখে এই তথাকথিত আধুনিক যুগে বাংলার লক্ষ লক্ষ সাধারণ, একেবারে নীচের তলার মানুষ স্বতস্ফুর্ত ভাবে এই পূজা উৎসবে অংশ নেন।

    ছবি+ সঞ্জয় ঘোষ ও অন্যান্য
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন