এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • আএলিতা, অপার্থিব প্রেম, ও তার অভিঘাত

    Pradhanna Mitra লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৫ মার্চ ২০২৩ | ২৭৯ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)


  • "চারিদিকে মরচে ধরা লোহালক্কড় আর সিমেন্টের ফাঁকা পিপে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত। তারের তালগোল পাকানো কুন্ডলী, ভাঙা কলকব্জা, তার মধ্যে আবর্জনার স্তুপের ওপর ঘাসের রুগ্ন শীষ গজিয়েছে।"

    লাইনদুটোর মধ্যে কাব্যের ছোঁয়া পেতেই আমি নড়েচড়ে বসলাম। যারা 'গারিনের মারনরশ্মি' পড়েছেন, তারা জানেন আলেক্সেই নিকোলিওভিচ তলস্তয়ের মধ্যে যতটা মার্ক্সিজম আছে, কাব্যিক ব্যাপার স্যাপার তার ছিঁটেফোঁটাও নেই। যদিও একটা উপন্যাস দিয়ে একজন লেখককে যাচাই করা উচিৎ নয়, তবুও, একটা ধারণা তো করা যায়। কিন্তু এক্ষেত্রে হঠাৎ করে এমন একটা কাব্যিক বাক্যের জন্যে সত্যিই আমি প্রস্তুত ছিলাম না।

    'বিনিদ্র রাত্রি' নামক পর্বে এসে আবার চমকালাম। কি লাইন বেরিয়ে এসেছে ওনার হাত ধরে! তলস্তয় লিখছেন,

    "প্রেমের বিষ কেন খেয়েছিলাম? অসাড় থাকলে আরো ভালো হত। প্রাণের হিমজমাট বীজ, ইথারে ভাসমান সব স্ফটিক বিন্দু, তারা কি গভীর নিদ্রায় মগ্ন নয়? কিন্তু আমাকে ধরণীতলে পড়তে হল, অঙ্কুরিত হতে হল -- জানা যে চাই প্রেমের সেই ভয়ঙ্কর তৃষ্ণার অর্থ কি, অন্যতে বিলীন হওয়ার, নিজেকে হারানোর, নিঃসঙ্গ বীজ হয়ে না থাকার মানেটা কি। আর সবকিছু কীসের জন্য? ভঙ্গুর এই স্বপ্নের পর আবার মৃত্যুর সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া, আবার বিচ্ছেদ, আবার সেই শূন্যে ভাসা হিম কঠিন স্ফটিক।"

    আমি পড়া থামিয়ে একবার চোখ রগড়ে নিলাম। ভাবছি এটা কি সত্যিই সাই-ফাই উপন্যাস? নিজের মনকে বোঝালাম, কেন? কল্পবিজ্ঞানে কি বিরহ বেদনা থাকতে পারে না? মন বলল, পারেই তো। এমন তো কত্তো গল্প আছে। মন একটু শান্ত হল। আমি আবার পড়তে শুরু করলাম। মূল চরিত্র দুইজন --- মস্তিলাভ সের্গেয়েভিচ ওরফে লস এবং আলেক্সেই ইভানভিচ গুসেভ। লসের পত্নীবিয়োগ হয়েছে, এবং এই বিয়োগান্তক বিরহ বেদনাতুর হৃদয়ের হাহাকার এক পর্যায়ে কাব্যিক সুষমায় লেখা হয়েছে, যার কিয়দংশ লিখলাম। গুসেভের পত্নী আছে, মাসা, দুজন দুজনকে বেজায় ভালোবাসে, কিন্তু, গুসেভের ঘরের চালে মাথা ঠেকে না। ফলে গুসেভ লসের সাথে যেতে চায়।
     
    কোথায়?

    ইঞ্জিনিয়ার লস একটি রকেট আবিষ্কার করেছেন, যার সাহায্যে নয়-দশ ঘন্টার মধ্যে মঙ্গল গ্রহে পৌছানো যাবে। সময়ের যে হিসাব লেখক দেখিয়েছেন, সেই ব্যাপারে আমি বিস্তারিত যেতে চাই না। মোট কথা, এই রকেটের সাহায্যে দুজনে মিলে পাড়ি দেয় মঙ্গলগ্রহে। কেন মঙ্গলগ্রহ? কারণ সেখান থেকে এক শক্তিশালী তরঙ্গ রেডিওতে ধরা পড়ছে, যে ভাষা অজানা। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, ওখানকার অধিবাসীরা খুব উন্নত প্রজাতির।

    তো গল্পটা যেহেতু কল্পবিজ্ঞান গোত্রের, দেখা যায়, মঙ্গলগ্রহে জল আছে, ফণিমনসার ঝোপ আছে, দৈত্যাকার মাকড়সা টাইপ জীব আছে, মঙ্গলগ্রহের অধিবাসীরা আছে, যারা মানুষ মানুষ টাইপ কিন্তু মানুষ নয়, তাদের সমাজ আছে, আর আছে আএলিতা।

    উপন্যাসে লস আএলিতার প্রেমে পড়ল, গুসেভ ইখশকার প্রেমে পড়ল। দেখা গেল, তারা হল আকাশ সন্তান, যারা মঙ্গলের অধিবাসীদের ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করবে, যে গ্রহটা আস্তে আস্তে অনিবার্য বিনাশের দিকে চলে যাচ্ছে।

    তলস্তয় গল্পটাকে সাজিয়েছেন খুব সুন্দরভাবে। 'আএলিতার প্রথম গল্প' নামক পর্ব থেকে অসাধারণভাবে মঙ্গলের ইতিহাস মোটামুটিভাবে দুই পর্বে বিস্তৃত হয়েছে। পড়তে পড়তে বোঝা যায়, বাইবেল কিম্বা মিথোলজিকাল গল্পগুলোর ধারা মঙ্গলের অধিবাসীদের ইতিহাসেও বিদ্যমান। মানে লেখক এর বাইরে কিছু ভাবতে পারেন নি।

    এখন কথায় আছে না, 'ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে', তলস্তয়ও তাই। মঙ্গলে গেলেও শ্রমিক অভ্যুত্থানের বেশি ভাবতে পারেন না। ফলে, মঙ্গলগ্রহে গুসেভের নেতৃত্বে শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়। বাকিটা সেই 'থোড় বড়ি খাড়া' আর 'খাড়া বড়ি থোর'। এক্ষেত্রে অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়, তারা দুজনে কোনরকমে প্রাণ নিয়ে আবার রকেটে চেপে ফিরে আসে পৃথিবীতে।

    এক পর্যায়ের রাশিয়ান লেখকদের নিয়ে আমার একটা ভয় কাজ করে, যা অমূলক নয়, এবং আমি কোনবারই ভুল হই নি। তা হল, কোন না কোনভাবে শ্রমিক অভ্যুত্থান এরা আনবেই আনবে, নচেৎ, অন্তত শ্রমিকদের নিয়ে, তাদের দুর্দশা নিয়ে, কিম্বা সেই সময়কার পার্টি পলিটিক্স নিয়ে লেখা হবেই হবে। নিদেনপক্ষে একটা প্যারা হলেও, কিম্বা একটা চরিত্র হলেও।

    রাজনৈতিক মতাদর্শের মনে হয় এই একটাই সমস্যা। কোন না কোনভাবে শিল্পে তার প্রভাব রেখেই যেতে চায়। খুব কম শিল্পীই আছেন, যিনি কোন একটা রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, কিন্তু তার শিল্পসত্ত্বায় সে প্রভাব নেই। এখানেও তাই। তলস্তয় একটা প্রেমের সাই-ফাই গল্প লিখলেন বটে, কিন্তু সেখানেও মার্ক্সিজমকে হঠাতে পারলেন না। বরং অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে এল। গল্পের আঙ্গিকে এটা একটা হাস্যকরই বটে। একটা অপার্থিব সভ্যতাতেও শ্রমিক অভ্যুত্থান হয়, তাও আবার 'আকাশ সন্তান' আসার কয়েকদিনের মধ্যে, তাদেরই হাত ধরে। আচ্ছা, আমাদের এখানে মঙ্গলের দুজন অধিবাসী এসে একমাসের মধ্যে শ্রমিক অভ্যুত্থান ঘটাতে পারবে? সম্ভব? জনসমাজে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কি কোন মা-বাপ নেই?

    যাই হোক, এসবের বাইরে থেকে যদি দেখা যায়, তাহলে বলা যায়, এ গল্প আএলিতার আনন্দ-বেদনার গল্প, যে এক পৃথিবীবাসীর প্রেমে পড়ে মৃত্যুকেও গ্রহণ করতে চেয়েছে। মরণ আসেনি, এসেছে বিরহ। পৃথিবীবাসীটিও তার প্রেমে পড়েছে। দুজন দুজনকে নিবিড়ভাবে চেয়েছে। গ্রহন করেছে। আএলিতা সমাজের বিরুদ্ধে গিয়েছে। তার পিতার বিরুদ্ধে গিয়েছে। সে লসের বুকের মাঝে নিজের প্রণয়বার্তার বীজ প্রোথিত করেছে। অবশেষে তাদের বিচ্ছেদ হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে।

    জীবন্মৃত আএলিতা খুঁজে বেড়ায় তার দয়িতকে। যে এক পৃথিবী সন্তান। দুজনে এখন দুই গ্রহের অধিবাসী। তার জন্যেই বার্তা পাঠায় আএলিতা। যে বার্তায় আছে তাদের ভাষায় বলা এক বেদনার্ত আবেদন, যে আবেদনে আছে এক অপার্থিব বিষন্ন সুর, যে আবেদন প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়ে বেতার তরঙ্গ বেয়ে আছড়ে পড়ে পৃথিবীতে, বলে,
    "কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, কোথায় তুমি, আকাশ সন্তান?

    আএলিতার কন্ঠস্বর, প্রেম আর মহাকালের কন্ঠস্বর, ব্যাকুল বিরহের সে কন্ঠস্বর মহাশূন্য পার হয়ে এসেছে তার কাছে, ডাকছে তাকে, অনুনয় করছে, মিনতি করে বলছে, কোথায় তুমি, তুমি কোথায়, প্রিয়তম..."

    ======================

    আএলিতা
    আলেক্সেই তলস্তয়
    অনুবাদকঃ সমর সেন
    ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন