![](https://i.imgur.com/12oVEU8.jpg)
জঁ-র ব্যাপারটা আমার কোনকালেই পছন্দের ছিল না। এইভাবে সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মে ভেঙেচুরে ‘ট্যাগ’ করাটা শপিং মলে কিম্বা ওষুধের দোকানেই শোভা পায়। সেখানকার যারা কর্মচারী তাদের সহজ হয় বিক্রীবাট্টার ক্ষেত্রে। তেমনই জঁ-র ব্যাপারটা স্কলার বা রিসার্চারদের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক মনে হলেও পাঠক মহলে এটা বর্জনীয় হলে আত্মিক দৃষ্টি সুদূরপ্রসারিত হয়। নাহলে যে সমস্ত পাঠক শুধু ‘গোয়েন্দা’ কিম্বা ‘তন্ত্র’ ইত্যাদি (উদাহরণস্বরূপ) নিয়েই শুধু থাকতে চাইছেন, তাদের অবস্থা খানিকটা একদৃষ্টি হরিণের মতো হয়ে যায়। লাভের লাভ খুব একটা কিছু হয় না। যারা নিজেদেরকে জঁ-র-এর জটাজালের থেকে বাইরে নিয়ে আসতে চান তাদের লাভ বেশি। এর একটা বড়ো উদাহরণ ‘গারিনের মারনরশ্মি’ নামক উপন্যাসটি।
আলেক্সেই তলস্তয় উপন্যাসটা লিখছেন সায়েন্স ফিকশনের আশ্রয়ে, এটা একপক্ষের মত। সম্প্রতি এর বঙ্গানুবাদ কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান পুণর্মুদ্রণ ঘটিয়েছে, যারা কল্পবিজ্ঞান টাইপেরই একমাত্র উপন্যাস প্রকাশ করে। আবার, যদি পুরোনো বইয়ের প্রচ্ছদ দেখা যায়, সেখানে লেখা আছে ‘রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস’, একদম জটায়ু স্টাইলে, যদিও, ‘তামসিকতার রশ্মি’ অংশে লেখা আছে --- এটি একটি কল্প-উপন্যাস। অর্থাৎ, শুধুমাত্র একটা জঁ-রে সীমাবদ্ধ একে কোনমতেই বলতে পারি না। পড়তে গিয়ে দেখি অনেক কিছুই আছে এই উপন্যাসটিতে।
এখানে, বলশেভিক তথা শ্রমিক বিপ্লবের চেনা ছক; বুর্জোয়া তথা ক্যাপিটালিস্টের বিরুদ্ধে তান্ডব নেত্য; রাশিয়া-আমেরিকা ধুমধাড়াক্কা, সেইসাথে জার্মান ইনভেশানও জুড়ে গেছে; একটু আধটু গোয়েন্দা গোয়েন্দা টাইপে হত্যারহস্য উন্মোচন; টুকুটুকু চতুষ্কোণ প্রেম, যার এক কোণে এক অপূর্ব সুন্দরী রমণী; আর সেই সাথে দেশপ্রেম দেশপ্রেম চাটনি --- এইসব মিশিয়ে সুবৃহৎ চারশোরও অধিক পাতার ঘুম পাড়ানিয়া উপন্যাস। জানি না, সায়েন্স ফিকশান জঁ-রে ফেলে দেওয়া অরুণ সোমের সার্থক অনুবাদকৃত এই উপন্যাসটি কল্পবিশ্ব কতটা বিক্রী করে উঠতে পেরেছে। আমার অন্তত সন্দেহ আছে।
আমার মনে হয়, এটাও একটা ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। এ উপন্যাসকে চট্ করে ভালো-খারাপ পর্যায়ে দাগিয়ে দেওয়া যাবে না। এখানে তলস্তয় অনেকগুলো স্তরকে সমান্তরালে ধরতে চেয়েছেন, অনেকখানিই পেরেওছেন। কিন্তু আকার আয়তনে বাড়াতে গিয়ে কোথাও কোথাও ব্যাপারটা বোরিং করে ফেলেছেন। মানে, সেই সময়ে আপনাকে উপন্যাসটা ধৈর্য ধরে পড়তে হবে, উপন্যাস আপনাকে ঘাড় ধরে পড়াবে না। এই ডিস্টোপিয়ান উপন্যাসটি কল্পবিজ্ঞানাশ্রিত বলা চলে, ‘ডিস্টোপিয়ানাশ্রিত কল্পবিজ্ঞান’ বলাটা যথেষ্ট বিতর্কের জায়গা রাখে।
‘বিজ্ঞান’ আছে কোথায়? যথাক্রমে ৩৫, ৪০ ইত্যাদি পর্বগুলোতে। পৃথিবীর ভূমিত্বকের ব্যাবচ্ছেদ করে সুবর্ণ বলয়ের যুক্তিপূর্ণ কনসেপ্ট আছে, কিম্বা মেন্ডেলিভের পিরিওডিক টেবিলে;
‘কল্পনা’ আছে কোথায়? এক এক করে বলি---
গারিন বানালেন তার ‘মারনরশ্মি’ – এখনকার লেসার টেকনিক আর কি; ‘এনার্কিজম’ আছে কোথায়? গারিন ভাবলেন, তিনি পৃথিবীর অধীশ্বর হবেন। ‘মার্ক্সিজম’ আছে কোথায়? গারিনের আন্ডারে যে সব শ্রমিক কাজ করত তারা বিদ্রোহ করল। ‘ক্যাপিটালিজম’ আছে কোথায়? গারিনকে যে স্পনসর করছে, সে পেটমোটা লোভী মার্কিন ক্যাপিটালিস্ট। ‘বুর্জোয়া’ আছে কোথায়? ছোট্ট মিস্টি ভয়ঙ্কর সুন্দরী টাইপ ভয়ানক মহিলা, যে কি না থাকতে চায় রসেবশে। ‘দেশপ্রেম’ আছে কোথায়? গারিনকে মারতে গিয়ে কিম্বা আটকাতে চেয়ে একজন মারা যায়, একজন শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহ করে সফল হয়। হতেই হবে। শ্রমিক না জিতলে রাশিয়ান ক্লাসিক হয় না। অন্তত, যিনি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস লিখছেন, বিশেষত ১৯২৭ সালে, তার ক্ষেত্রে তো একথা নিশ্চিত।
যারা কল্পবিজ্ঞান পড়তে চান, তারা অবশ্যই পড়ুন, তবে পড়ার সময় মাথায় রাখতে হবে ---
এক) লিখছেন একজন রাশিয়ান লেখক, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ‘war correspondent’ হিসাবে কাজ করেছিলেন।
দুই) এটা কল্পবিজ্ঞানাশ্রিত একটি ডিস্টোপিয়ান উপন্যাস। যেহেতু, তিনি কল্পবিজ্ঞান আশ্রিত এবং ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস বেশি লিখেছেন, সেহেতু এই উপন্যাসটিও পাঠককুল কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক উপন্যাস বলেই মানে।
কল্পবিশ্বের প্রকাশকবর্গের কাছে আমার এই লেখা পৌছবে কি না জানি না। যদি পৌছয়, তাদের কাছে দুটি প্রশ্ন ---
এক) প্রচ্ছদটা নিয়ে কি আরেকটু ভাবা যেত না? উপন্যাসের সম্পূর্ণ উপজীব্যতা এই প্রচ্ছদ ধরতে পারে নি বলেই আমার মনে হয়।
দুই) তলস্তয়ের ‘আত্রলিতা’ উপন্যাসটা থাকতে সবার প্রথমে এই উপন্যাসটাই কেন? আপনারা জানেন, ‘আত্রলিতা’ বিশ্বের নিরিখে সত্যিকারের তলস্তয়ের সার্থক কল্পবিজ্ঞানাশ্রিত উপন্যাস। যদিও, আমি বইটা পড়িনি, এবারে পড়ব।
==============================
গারিনের মারণরশ্মি
আলেক্সেই নিকোলাইভিচ তলস্তয়
অনুবাদকঃ অরুণ সোম
কল্পবিশ্ব পাবলিকেশান
মুদ্রিত মূল্যঃ ৬০০ টাকা
ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সমর্পিতা
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।