এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভন্ডামি : সম্পাদকীয় কিছু বোধ ও ভাবনা 

    Kajal Sen লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৩ মার্চ ২০২৩ | ৪৫৩ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • আমার সম্পাদিত ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০৮তম সংখ্যাটি প্রকাশিত হয়েছিল বিগত ২০২২ সালে। এই সংখ্যার বিষয় ছিল ভন্ডামি । সঠিক জানা নেই, এর আগে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে বাংলায় কোনো পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল কিনা!  তবে বিষয়টি যে নিতান্তই প্রাচীন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

    অনুমান করা যেতে পারে, মানবসভ্যতার সূত্রপাতের সঙ্গে সঙ্গেই সভ্যতার পাশাপাশি অংকুরিত হয়েছিল ভন্ডামির ভাবনা। তারপর সভ্যতা বিকাশের ক্রমধারায় ভন্ডামিরও ক্রমবিকাশ ঘটেছে। এবং আজ এই একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পৌঁছে একথা বলা সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমান মানবসভ্যতা এবং মানবজীবনে ভন্ডামি ছড়িয়ে ও জড়িয়ে আছে সংপৃক্তভাবে। ব্যতিক্রমী কিছু মানুষের কথা অবশ্যই শ্রদ্ধায় স্মরণে রাখা আমাদের কর্তব্য, নতুবা প্রায় প্রতিটি মানুষই এই দোষে দুষ্ট। বিশেষত এই দুষ্টতা ক্রিয়াশীল থাকে মানুষের চেতনে, অচেতনে অথবা অবচেতনে। অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ ওয়াকিবহালও থাকে না যে, তারা তাদের ব্যক্তি পরিচয়ে, অস্তিত্বে, আচরণে ও ব্যবহারে কীভাবে লালন করে চলেছে ভন্ডামিকে। আর যারা সচেতনভাবে ভন্ডামিকে লালন করে তাদের লোভ, স্বার্থপরতা, উদ্দেশ্যসিদ্ধি বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য, তাদেরকে চিনে নিতে এবং চিহ্নিত করতে খুব একটা অসুবিধে হবার কোনো কারণ নেই ইদানীং।

    যেহেতু আমি সম্পাদকীয় প্রতিবেদন লিখতে বসেছি, কোনো তত্ত্বমূলক প্রবন্ধ   নয়, তাই নিতান্তই সাদামাটা ভাবে কিছু ব্যক্তিগত বোধ ও ভাবনার কথা এখানে  লিপিবদ্ধ করছি। একটা ব্যাপার প্রথমেই উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। আমাদের কারও কারও ধারণা আছে যে, অসৎ মানুষ মানে ভন্ড মানুষ। এ ধারণা কিন্তু ঠিক নয়। প্রকৃত যারা অসৎ, পুরোপুরি অসৎ, তারা কিন্ত ভন্ড নয়, কেননা তারা সততার ভাণ করে না। বরং যারা নিজেদের সৎ রূপে উপস্থাপিত করে অথচ অনেক ক্ষেত্রে অসততার আশ্রয় নেয় বা প্রশ্রয় দেয়, তারাই ভন্ড।   বস্তুতপক্ষে, এই শ্রেণীর মানুষই সংখ্যাগরিষ্ঠ। যারা আগমার্কা অসৎ, তারা কখনও সততার তোয়াক্কা করে না, আর তাই তাদের ভন্ডামি করারও কোনো প্রয়োজন হয় না। বরং তথাকথিত সৎ মানুষের ভিড়ে আগমার্কা সৎ মানুষ খুঁজে পেতে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যায়, কেননা তারা প্রত্যেকেই কম-বেশি ভন্ডামির ভাইরাসে সংক্রমিত।

    আমার উদ্ভিন্ন যৌবনকালের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। সে বছর হায়ার সেকান্ডারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছি। স্কুলের কয়েকজন  সহপাঠীর পাশাপাশি অন্যান্য স্কুলের কয়েকজনকে কলেজের একই ক্লাসের বন্ধু  হিসেবে পেয়েছি। সেই সময়টা ছিল নতুন এক রাজনৈতিক চেতনায় উদ্দীপ্ত এক সময়। উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গে তখন নকশালবাড়ির আন্দোলন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছে। তার উত্তাপ এসে পৌছেছে আমাদের শহর জামশেদপুরেও। কিছু কিছু কৌশলগত রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়েছে। আমাদের মতো আনকোরা যুবকদের চিন্তা চেতনাতেও লেগেছে তার আঁচ। ভাবনাতেও বইতে শুরু করেছে ঝোড়ো হাওয়া। যারা অবহেলিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত সেইসব মানুষদের প্রতি অনুভূত হচ্ছে সহানুভূতি ও সহমর্মিতা। ঠিক এই পরিবেশ ও প্রেক্ষাপটে আমরা কয়েকজন সহপাঠী বন্ধু সিদ্ধান্ত নিলাম, আসন্ন দুর্গাপুজোর চারটি দিন সকালে আমরা শহরের বিভিন্ন পুজোপ্যান্ডেল পরিক্রমা করব বাই-সাইকেলে। তখন অবশ্য একমাত্র বাই-সাইকেলই ছিল আমাদের বাহন। আর এই চারদিন সকালে আমরা নতুন কেনা জামা-কাপড় পরব না, বরং পুরনো ছেঁড়া ফাটা রঙওঠা জামা-কাপড় পরব। যেসব দরিদ্র মানুষদের পুজো উপলক্ষ্যে নতুন জামা-কাপড়  কেনার সামর্থ নেই, তাদের দুঃখকে ভাগ করে নেবার জন্যই আমাদের এই সিদ্ধান্ত। বলা বাহুল্য, আমরা তাই করেছিলাম এবং আত্মতৃপ্ত হয়েছিলাম। তখন সেই কম বয়সের আবেগের কাছে ঘেঁষতে পারেনি কোনো যুক্তি-তর্ক। কিন্তু আজ এই পরিণত বয়সে পৌঁছে মনে হয়, এটা ছিল আমাদের নিতান্তই ছেলেমানুষী রোমান্টিকতা, যার সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে মিশে গেছিল কিছুটা ভন্ডামিও। আমাদের  অজান্তেই।

    এই প্রসঙ্গে ছেলেবেলার আরও কিছু স্মৃতি মনে পড়ছে। বয়স তখন নিতান্তই  কম। বোঝার ক্ষমতা আরও কম। কিন্তু কারও মুখে-শোনা একটি গল্প ও একটি  ঘটনা যেভাবেই হোক মনের ক্যনভাসে আজও যেন লেখা আছে। তবে গল্প ও ঘটনাটার রূপরেখা মনে আছে, সম্পূর্ণ গল্প বা ঘটনা নয়, তাই নিজের মতো করেই আমি সেই গল্প ও ঘটনা বিবৃত করছি। যাঁরা পড়েছেন এবং জানেন, তাঁদের কাছে আমি আগেভাগেই মার্জনাপ্রার্থী।

    গল্পটা ছিল ভারতের, আর ঘটনাটা তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার। সঠিক মনে নেই গল্পের লেখকের নাম বা পত্রিকার নাম। তবে পত্রিকাটি যে বামপন্থী ছিল, তা অনুমান করতে পারি। গল্পটি যে বছর লেখা হয়েছিল, লেখক উল্লেখ করেছিলেন, গল্পটি তিনি আগামী পঁচিশ বছর পরের পাঠকদের জন্য লিখেছেন। গল্পের রূপরেখা মোটামুটি এইরকম ছিল, নতুন প্রজন্মের কম্যুনিস্ট দলের কিছু সদস্য সিদ্ধান্ত নিলেন, দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করার জন্য তাঁরা এমন কিছু কর্মসূচি নেবেন, যাতে তাঁরা শ্রমদান করে অর্থসংগ্রহ করবেন এবং দরিদ্র মানুষদের অর্থদান করবেন। সুতরাং সেই কর্মসূচি অনুযায়ী তাঁরা একদিন কর্মব্যস্ত সময়ে একটি বাজারের প্রধান রাস্তায় এসে বসলেন। তাঁদের সবার কাছে জুতো পালিশ করার বাক্স এবং তার ভেতর যাবতীয় জুতো রঙ ও পালিশ করার সরঞ্জাম। তাঁরা ব্যানার টাঙিয়ে তাঁদের উদ্দেশ্যর কথা সবাইকে জানালেন।  সাধারণ মানুষেরা ব্যাপারটা জেনে মুগ্ধ ও আপ্লুত হয়ে গেলেন। কেননা এমন একটা মহৎ কাজের জন্য রীতিমতো ভদ্র পোশাক পরিহিত বাবুরা জনসাধারণের জুতো পালিশের মতো শ্রমে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন, যে পরিশ্রম করে থাকে তথাকথিত নিচু জাতের মুচিরা! স্বাভাবিক আবেগের বশেই একে একে  সবাই তাঁদের পরিহিত জুতো চটি সমেত পদযুগল সানন্দে রাখলেন পালিশবক্সের ওপর। একদিকে কম্যুনিস্ট দলের সদস্যরা এই মহৎ কর্ম রূপদান করার জন্য যেমন মানুষের দুই পা সমেত জুতো চটিকে সাদরে কাছে টেনে নিতান্তই অপটু হাতে রঙ লাগাতে ও পালিশ করতে লাগলেন, অন্যদিকে তেমনি সেই মহৎ কর্মকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য জনসাধারণ তাঁদের সহযোগিতার পা বাড়িয়ে দিলেন। বলা বাহুল্য, কোনো নির্ধারিত দরে জুতো পালিশ করা হচ্ছিল না, বরং যে যার নিজেদের সাধ্যমতো এবং সাধ্যের অতিরিক্ত অর্থদান করতে লাগলেন সাহায্যবাক্সে। দেখতে দেখতে সেই বাক্স টাকায় টাকায় ভরে উঠল। বাধ্য হয়ে আবার ব্যবস্থা করতে হলো আরও কয়েকটি বাক্সের। এইভাবে চলল সারাদিন। প্রচুর অর্থের আমদানিতে কম্যুনিস্ট দলের সদস্যদের মনে ও মুখে হাসির ফোয়ার ছুটতে লাগল।

    আঞ্চলিক কম্যুনিস্ট দলের যিনি সাধারণ সম্পাদক, তিনি দলের কর্মসূত্রে বাইরে থাকার দরুন এই কর্মসূচির কথা জানতেন না। খবরটা তিনি জানতে পারলেন বিকেল নাগাদ। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ছুটে এলেন বাজারে। দলের কান্ড কারখানা দেখে তিনি তো হতবাক। একী হচ্ছে! এটা কী ধরনের মহৎ কর্মের নমুনা! তিনি চলে এলেন পাশের গলিতে যেখানে প্রতিদিন সার বেঁধে বসে থাকে মুচিরা রুজি-রোজগারের তাগিদে। এই গলি তাদের কাজের জন্যই নির্দিষ্ট করা আছে।  কম্যুনিস্ট দলের নেতাকে দেখে তারা দৌড়ে এলো তাঁর কাছে। কাঁদো কাঁদো মুখে তারা অভিযোগ জানালো, বাবু, এভাবে আমাদের পেটে মারছেন কেন? জানেন,  ঐ কম্যুনিস্ট বাবুদের জন্য আমরা কেউ একজনও গ্রাহক পাইনি সারাদিনে? কোনো উপার্জন হয়নি আমাদের আজ। পকেট একদম খালি। আমাদের সংসার চলবে কেমন করে? আপনি আমাদের বাঁচান বাবু!
    মুহূর্তে সাধারণ সম্পাদক হামলে পড়লেন তাঁর দলের সদস্যদের ওপর। এসব কী করছেন আপনারা? এটা কেমন ধরনের জনসেবা? একদল মানুষের উপার্জন ও আহার কেড়ে নিয়ে মানুষের সেবা করা যায় নাকি? এ তো আপনাদের নিতান্তই একটা সৌখিন কর্মসূচি! যে কর্মসূচিতে আছে রীতিমতো ভন্ডামির মহড়া।  অবিলম্বে বন্ধ করুন এই মস্করা। আমাকে কিছু না জানিয়ে এসব করা উচিৎ হয়নি একেবারেই!

    তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার যে ঘটনাটার কথা শুনেছিলাম, তা মোটেই গল্প  নয়, বরং লেখকের নিজস্ব সোভিয়েত ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। লেখকের নাম আমার মনে নেই। শুধুমাত্র তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনা মনে আছে, যদিও তা আমি নিজের মতো করে বর্ণনা করছি।

    তিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় কোনো কর্মসূত্রে গেছিলেন। একদিন তিনি কোনো এক শহরের বড় রাস্তা ধরে হাঁটছিলেন। তিনি ঠিক খেয়াল করেননি, তাঁর আগে আগেই একটি রাশিয়ান বাচ্চা একই রাস্তায় হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন, পথ চলতি এক ব্যক্তি বাচ্চাটিকে থামিয়ে নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে বাচ্চাটির নাক-মুখ মুছিয়ে দিলেন। বাচ্চাটির নাক থেকে সর্দি গড়িয়ে পড়ছিল। নাক মোছানোর পর সেই ব্যক্তি নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। বাচ্চাটিও আগের মতোই রাস্তায় চলতে লাগল। বেশ কিছুটা দূর যাবার পর লেখক দেখলেন, সেই বাচ্চাটির নাক থেকে আবার সর্দি গড়িয়ে পড়ছে। এবং আরও অবাক হলেন, যখন দেখলেন পথ চলতি আবার এক ব্যক্তি এগিয়ে এসে নিজের পকেটের রুমাল বের করে বাচ্চাটির গড়িয়ে পড়া সর্দি সযত্নে মুছে দিলেন। লেখক পর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে এবার সেই দ্বিতীয় ব্যক্তির মুখোমুখি হয়ে বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে আপনাকে  একটা প্রশ্ন করতে চাই। সেই ব্যক্তি জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ বলুন, কী জানতে চান! লেখক বললেন, এই যে আপনি বাচ্চাটার নাকের সর্দি মুছিয়ে দিলেন নিজের রুমালে, বাচ্চাটা কি আপনার চেনা-জানা বা আত্মীয়? তিনি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে বললেন, না তো! আমার চেনা-জানা নয়। কিন্তু হঠাৎ এ এই প্রশ্ন করছেন কেন? লেখক বললেন, আসলে কিছুক্ষণ আগে অন্য একজনকেও দেখলাম নিজের রুমালে বাচ্চাটার সর্দি মুছিয়ে দিতে। তিনিও সম্ভবত বাচ্চাটাকে চেনেন না বা জানেন না। তাহলে একটা অচেনা-অজানা  বাচ্চাকে এভাবে আপনারা সন্তানস্নেহে নাকের সর্দি মুছিয়ে দিচ্ছেন কেন? সেই ব্যক্তি এবার হাসতে হাসতে বললেন, এক্ষেত্রে চেনা-জানার তো কোনো প্রয়োজন নেই! আমরা সমাজতান্ত্রিক দেশে বসবাস করি। আর তাই এই দেশের সব ছেলে-মেয়েই আমাদের ছেলে-মেয়ে। আমাদের সন্তান।
    এবং সত্যিই তাই। এক্ষেত্রে জনসেবায় ভন্ডামির লেশ মাত্র ছিল না। কেননা, কোনো সমাজতান্ত্রিক দেশের চিন্তা ভাবনাটাই এমন। রাজনৈতিক ভাবাদর্শ এতটাই প্রবল।  

    জামশেদপুরের সিনে ক্লাব ‘সেলুলয়েড চ্যাপ্টার’এর একটি অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মৃণাল সেন। নিয়ে আসা হয়েছিল তাঁর পরিচালিত ‘জেনেসিস’ চলচ্চিত্রটি। সারাদিনের অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের পরে ছিল তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতা। খুব সহজ ভাবে ও ভাষায় তিনি আমাদের চলচ্চিত্র সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন। তাঁর ছবি তৈরির ব্যাপারেও বিভিন্ন গল্প  করছিলেন। এরই মাঝে কেউ একজন প্রশ্ন করেছিলেন, আচ্ছা মৃণালদা, আপনি চলচ্চিত্র কাদের জন্য নির্মাণ করেন? বলা বাহুল্য, প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক ও  প্রাসঙ্গিক। এবং প্রত্যাশিত উত্তরটিও আমরা মোটামুটি জানতাম বলে মনে করেছিলাম। বিশেষত মৃণাল সেন সারা জীবন সাম্যবাদী ভাবনার শরিক ছিলেন। তাঁর প্রতিটি ছবিতেই উঠে আসত শ্রেণী বিভাজন ও শ্রেণী সংগ্রামের বিভিন্ন অনুষঙ্গ। সুতরাং আমরা নিশ্চিত ছিলাম, তিনি উত্তরে বলবেন, আমি শোষিত-নির্যাতিত ও সর্বহারা মানুষদের জন্য ছবি করি। এবং যদি তিনি তা বলতেন, তাহলে তিনি নিঃসন্দেহে ভন্ডামির অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারতেন। কিন্তু মৃণাল সেন আক্ষরিক অর্থেই কখনও ভন্ড ছিলেন না, আর তাই সেদিন, আপনি চলচ্চিত্র কাদের জন্য নির্মাণ করেন, এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, আমি চলচ্চিত্র নির্মাণ করি তাঁদের জন্য, যাঁরা চলচ্চিত্র বোঝেন। ব্যাস এইটুকুই ছিল  তাঁর উত্তর। নিপাট সত্য কথা। উত্তরটা শুনে আমরা মুগ্ধ ও আপ্লুত হয়েছিলাম।  

    আর একটি প্রাসঙ্গিক বক্তব্য উপস্থাপন করে আমি এই সম্পাদকীয় লেখার ইতি টানব। একসময় রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন অধ্যাপক (ড.) চিত্তরঞ্জন লাহা। পরবর্তী সময়ে তিনি রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলারের পদও অলঙ্কৃত করেছেন। যাইহোক, আমি চিত্তদার সুপারভাইজেশনে ও গাইডেন্সে বাংলাসাহিত্যে পি এইচ ডি করেছিলাম সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। একদিন সকালে চিত্তদার রাঁচির বাসভবনে বসে বিভিন্ন আলাপ আলোচনার সূত্রে উঠে এলো সততা সম্পর্কিত আলোচনাও। কথা প্রসঙ্গে আমি বলেছিলাম, আমি সততায় বিশ্বাস করি এবং যথাসম্ভব সৎ থাকার চেষ্টা করি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসততার পথে যেতেও হয়, না হলে কোনো কার্যোদ্ধার হয় না। আসলে এমন একটা দেশ ও সমাজে বাস করি, যেখানে অসততাই যেন স্বাভাবিক ব্যাপার বা ঘটনা। আমি অবশ্য একান্ত নিরুপায় না হলে কখনই অসৎ হব না, এটাই আমার পণ। চিত্তদা সেদিন আমার কথায় হেসে বলেছিলেন, তুমি কি আদৌ জানো তুমি কখন কতটা সৎ থাকতে পারবে? আমি তাঁর কথাটা বুঝতে পারিনি। তিনি ব্যাখ্যা করে বললেন, ধর তুমি আমার কাছে একশ টাকা ধার নিয়েছ। যথাসময়ে তুমি সে টাকা ফিরিয়ে দিলে। এরপর ধর একহাজার টাকা ধার নিয়েছ। সে টাকাও নির্দিষ্ট সময়ে ফেরত দিলে। এমন কি দশহাজার, একলাখ বা দশলাখ টাকাও সততার সঙ্গে ফিরিয়ে দিলে। কিন্তু টাকাটা যদি আরও বড় অঙ্কের হয়, এককোটি বা পাঁচকোটি বা দশকোটি, তখন কে বলতে পারে, তুমি সৎ থাকবে, আমার টাকা ফিরিয়ে দেবে? আসলে কী জানো, এই সমাজব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য, টাকা দিয়ে সবকিছুই কেনা যায়, তুমি যে সততার কথা বলছ, তাও কেনা যায়। সুতরাং নিজেদের সৎ বলে দাবি করার মধ্যে কোনো কৃতিত্ব নেই, বরং সেটা নিছকই ভন্ডামি।   

    কাজল সেন

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Biman Kumar Maitra | ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৩:৪২516937
  • চমৎকার লেখা।
  • প্রশান্ত গুহমজুমদার | 2405:201:900c:8874:9d3d:d361:b25c:eeff | ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৫:০৪516942
  •  এই সম্পাদকীয় পড়ার পর মনে হচ্ছে 'ভন্ডামি' সংখ্যাটির খুব প্রয়োজন ছিল। এর পরেও যদি ভন্ডামির বাইরে আসা যায়।
  • মৌ চক্রবর্ত্তী | 202.78.232.182 | ০৩ মার্চ ২০২৩ ১৬:৪৩516945
  • কাজল সেন সমীপেষু ___ ঘটনার ব্যবহার নিছক ঝোঁকে নয় _ ঋদ্ধ এক যাপনে উঠে আসা অভিজ্ঞতা। সম্পাদক হিসেবে তাঁকে চিনি বছরখানেক। আর তাঁর লেখক প্রকৃতি চমৎকৃত করল। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন