এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • রুখা-মাটির আদরিণী কন্যা, টুসু

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৩ জানুয়ারি ২০২৩ | ২৬৮ বার পঠিত
  • “টুসু, কি শাড়ি চাই গো দকানে। যেটি লাগে তর মনে। / হরেক রকম সায়া শাড়ি / বেলাউজ নাই দকানে। / কলকাতা গেলে ইবার দিব গ বেলাউজ কিনে। / পয়সা দিতে হবে নাই গ দিব গ অন্যে দিনে।“
    সুরের মূর্ছনায় জাগিয়ে রাখে রুখা-মাটির পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম, সিংভুম অঞ্চলের গ্রামগুলোকে পৌষ মাসের প্রতিদিন সন্ধ্যায়, শীতল রাতে। পৌষালী শীতে টুসুদেবী বাড়ির জীবন্ত কন্যা আদরিণী 'টুসুমনি' হিসেবে পরিচিত। টুসু দেবী কুমারী দেবী, তাই এই পূজার প্রধান উদ্যোক্তা ও ব্রতী হন  রুখামাটির অঞ্চলের নারীরা। টুসু দেবীর পূজা মূলত মহিলা কেন্দ্রীক। তাই নেই কোনও পুরোহিতের বালাই। আচার উপাচারও নামমাত্র। কৃপণ প্রকৃতি, বিস্তীর্ণ ঊষরতা, শীত ও তাপের সঙ্গে সংগ্রামে নিরত কুড়মি, মাহাতো, মুন্ডা, ভূমিজ, লোধা, বাগাল, কোড়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সব বয়সের রমণীরা যোগদান করেন এই টুসু উৎসবে। অগ্রহায়ণ সংক্রান্তিতে বাড়ির আঙিনায় আলপনা এঁকে সেখানে করা হয় স্থাপন টুসুকে। এই সমাজে সর্বাপেক্ষা তাদের প্রিয় দেবী 'টুসুদেবী’কে তারা বাড়ির কন্যা আদরিণী 'টুসুমনি' হিসেবে দেখেন। অগ্রহায়ণ মাসে ধানের খেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির দিন মেয়েরা একটি মাটির সরায় চালের গুঁড়ো লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। তারপর তুষের উপর ধান, গোবর মন্ড, দূর্বা ঘাস, আতপ চাল, আকন্দ ফুল, বাসক ফুল, গাঁদা ফুলের মালা প্রভৃতি রেখে সরাটির গায়ে হলুদের টিপ লাগিয়ে সরাটিকে পিড়ি বা কুলুঙ্গির উপর রেখে স্থাপন করেন। সরার চারপাশে জ্বালানো হয় মাটির প্রদীপ। দেবীর উদ্দেশে চিঁড়ে, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা নিবেদন করা হয়।
    দিনের শেষে গোরু-ছাগল গোহালে ঢুকিয়ে কিম্বা মাথা থেকে কাঠের পাহাড় উঠোনের এককোনায় নামিয়ে তাদের মরদ কিম্বা বাপ-খুড়া’রা হাত-পা ধুয়ে দড়ির খাটিয়া পেতে বসে পড়ে ‘টুসু’ গীতের  আসরে। শুনতে থাকে সামনে বসা রমণীদের সমবেত কণ্ঠ ‘তোদের টুসুর চোখদুটো পেঁয়াজ ভাজা – তোর যতই সাজা।‘ উপর-বাগালের তারা নাকি এবছর হারাবেই হারাবে কুড়মিদের সুলু, জবা, পুতুল, ফুলতা, দোপাটি’দের।   
    “উঠ উঠ উঠ তুষু, উট করাতে আস্যেছি / তোমার সব সখি মোরা পা তলাতে বস্যেছি / চাঁদকে যেমন তারায় ঘেরে তেমন ঘেরণ ঘেরেছি।“ একটানা গানের কলিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয় টুসু দেবীর।
    অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে চলে একমাস ধরে এই টুসু গানের উৎসব। প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী পূজিত হন। টুসু পরব এর প্রধান আকর্ষণ টুসু গান। সারা পৌষ মাস জুড়ে, প্রতি সন্ধ্যায় মেয়েরা কাজকর্ম সেরে দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীকে ফুল দিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে গান শুরু করেন, এ গানের কোন নির্দিষ্টতা নেই। যার যা গান মনে পড়ে  আরম্ভ করেন, বাকি সবাই গলা মেলান। গান শুনিয়ে শুনিয়ে টুসু কে ঘুম পাড়িয়ে তারপর ঘুমোতে যান ব্রতীরা। একদল মাতে গানে, আরেক দল – কতই বা বয়স তাদের – ন্যাংটা খুকু-খুকিদের থেকে হয়তো বছর চারেক উপরে – মেতে ওঠে অন্ধকারে, অলিতে গলিতে লুকিছাপা খেলায়। এই এক মাস তো অনাবিল আনন্দের মাস, নেই কোনো শাসন, নেই কোনো চড়-থাপ্পড় খাওয়ার ভয়।
    এই ‘টুসু’ গান যেন গায়িকার কল্পনা, দুঃখ, আনন্দ ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে ব্যক্ত করে। গানের মাধ্যমে মেয়েলি কলহ, ঈর্ষা, দ্বেষ ইত্যাদি সহজ সরল গ্রাম্য ভাষায় ব্যক্ত করা হয়। যেমন  – “আমার টুসু মুড়ি ভাজে, চুড়ি ঝলমল করে গো / ওর টুসু এত হ্যাংলা আঁচল পেতে বসে গো” বা “মকর পরবে / নদীতে মকর সিনান হবে / জলেতে নেমো না টুসু / নদীতে ভেসে যাবে / মকর সিনান করে টুসু / তিল, নাড়ু, পিঠে খাবে” অথবা “আমার টুসু রাগ করেছে / বরকে দিয়েছে আড়ি / বাপের ঘরে রইবেক টুসু / যাবেক না শ্বশুরবাড়ি”। শুধু তাই নয়, টুসু গানে সামাজিক আন্দোলন, অবস্থার কথাও বারবার উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে মানভূম ভাষা আন্দোলনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, এবং শ্রী ভজহরি মাহাতোর এই টুসু গানটির উল্লেখ করা যেতে পারে –“বাংলা ভাষার দাবিতে ভাই / কোন ভেদের কথা নাই। / এক ভারতে ভাইয়ে ভাইয়ে মাতৃভাষায় রাজ্য চাই… / জন শাসন চাও যদিরে বাংলা বই আর গতি নাই / মোদের ভূমি মানভূমেতে / গড়িব রাম রাজ্যটাই।” 
    বাঙালির দুর্গাপুজোর ন্যায় মানভূম অঞ্চলের জাতীয় উৎসব টুসুপুজো। লাখ লাখ আদিবাসী মানুষের প্রাণের স্বতোৎসারিত আনন্দের প্রকাশ পায় এই টুসু পরবে। “মাগো হামার মন কেমন করে / যেমন শোল মাছে উফাল মারে। / এত বড় পৌষ পরবে, রইলি মা পরের ঘরে / মাগো হামার মন কেমন করে।“ টুসু পরবের সময় মা মেয়েকে শ্বশুরঘর থেকে আনতে না পারার যন্ত্রণা পাওয়া যায় এই গানে। তাই বলা হয় টুসুগানের মাধ্যমে প্রকাশ পায় সহজ সরল আদিবাসীদের অভিব্যক্তি – তাদের দুঃখ, আনন্দ, কলহ।
    টুসুর নামকরণ সম্বন্ধে মতান্তর আছে। কিছু প্রচলিত লোককথাও আছে। কিন্তু গবেষকরা সেগুলোকে সেরকমভাবে আমল দিতে চাননি। বলা হয় তুষ থেকে টুসু শব্দটি এসেছে, এর কারণ দেবীর সরা সাজানোর একটি প্রধান উপকরণ ধানের তুষ। কারও মতে পৌষ মাসের সাথে যুক্ত 'পুষ্যা' নক্ষত্র’র অপর নাম 'তিষ্য'। এই তিষ্য থেকেই এসেছে তুষু বা টুসু।
     টুসু উৎসব পালনের সময় পৌষ মাসের শেষ চারদিন চাঁউরি, বাঁউরি, মকর এবং আখান নামে পরিচিত। চাঁউরির দিন গৃহস্থের বাড়িতে উঠোনে গোবর মাটি দেওয়া হয়। তারপর চালের গুঁড়ো তৈরি করা হয়। বাঁউরির দিন পিঠে তৈরি করে চাঁছি, তিল, নারকেল ইত্যাদি পুর দিয়ে ভর্তি করা হয়। বাঁউরির দিন সারা রাত জেগে টুসু গানের মাধ্যমে টুসু জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়। এই বাঁউড়ির রাত হল টুসু দেবীর 'জাগরণ'। সারারাত একটানা চলতে থাকে গানের লহরা। যেন তাদের আদরিণী কন্যা 'টুসুমনি' পরের দিন শ্বশুর বাড়ি চলে যাবে। মকর সংক্রান্তির আনন্দ হিল্লোলের মাঝেও যেন তাদের মন কেঁদে ওঠে, বিদায় ব্যথা জেগে ওঠে তাদের গানে। “শুশনি শাক বড় বড় শিমুলতলাতে / বড় দিদির খুঁটে ধরে কত তুষু কেঁদেছে / কেঁদো না কেঁদো না তুষু আবার আসবে পৌষ মাসে।“
    পৌষ সংক্রান্তির দিন ভোরবেলায় রমণীরা দলবদ্ধভাবে গান গাইতে গাইতে টুসু দেবীকে রঙিন কাগজে সজ্জিত বাঁশের চতুর্দোলায় বসিয়ে নদী বা পুকুরে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেক টুসু দল একে অপরের টুসুর প্রতি নিন্দে ও নিজের টুসুর সুনাম করে গান গাইতে গাইতে দেবী বিসর্জন করেন। টুসু বিসর্জনের পর রমণীরা স্নান করে নতুন বস্ত্র পরেন। বিসর্জনের দিন বসে মেলা নদীর পারে। শিলাই, কাঁসাই ও সুবর্ণরেখা ঘাটগুলোয় মেলা বসে। মেলা ঘিরে থাকে উন্মাদনা। রাঢ় বাংলার এক বিরাট অংশের মানুষের মন জুড়ে এই উৎসব। টুসু গানের মূল উপজীব্য গ্রামবাংলার সহজ, সরল জীবনের গল্প, আশা, নিরাশা, রঙ্গ তামাশার কথা। টুসু গান প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা। তাই এভাবেই বেঁচে থাকুক টুসু পরব। টুসু গানে জমে উঠুক পৌষের সন্ধ্যা।       

    ঋণস্বীকার : তুষু ব্রত ও গীতি সমীক্ষা - রবীন্দ্রনাথ সামন্ত; জঙ্গল মহলের লৌকিক দেবী টুসু – অরুণ মাহাতো।

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন