এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ১৪

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ ডিসেম্বর ২০২২ | ২২৮ বার পঠিত
  • প্রথম দিকে যখন আমি ছোট ছিলাম, আমাকে নিতো না দাদারা এবং বেশির ভাগ সময়েই মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে খেলা দেখতাম। পঞ্চম শ্রেণী থেকে, বড়রা (সুখেন-দা, সুধীর-দা এবং অন্যান্যরা) আমাকে দলে নেয়।
    প্রাথমিকভাবে তাদের দিক থেকে অনিচ্ছা ছিল, কারণ এটি সিনিয়রদের একটি দল ছিল। সবাই সপ্তম, অষ্টম অথবা নবম শ্রেণীতে পড়ত। আমার পীড়াপীড়িতে একদিন তারা আমাকে একটি চলমান ক্রিকেট ম্যাচে বল করতে বলে এবং আমার বল করা দেখে তারপরে আমাকে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
    আমাদের বাড়ির পিছনে একটি আমার বয়সী ছোটদের গ্রুপ ছিল। আমি তাদের সাথে প্রথমে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। কিন্তু আমার ইচ্ছা ছিল, সামনের মাঠে বড়দের সাথে খেলার। কারণ বাড়ির পিছনের ছোটদের গ্রুপটাতে বেশিজন ছিল না, রোজ খেলতো না, প্রায়ই বল থাকত না। আর সামনের মাঠের বড়দের গ্রুপটা ছিল একটি সংঘটিত গ্রুপ। দুই'দল করে রোজ খেলা হত। 
    আমরা তখন ব্যাডমিন্টনও খেলতাম, এবং আমাদের কোয়ার্টারের ঠিক সামনে একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট তৈরি করেছিলাম। রাতে বাল্ব লাগিয়ে খেলা হত।
    একবার আমি আমার খেলার সাথীদের সাথে শোভাপুর গ্রামে, আমাদের জায়গা থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে, বেড়াতে গিয়েছিলাম। ওখানে প্রচুর জংলী টক কুলের গাছ ছিল। প্রায়ই যেতাম আমরা কুলের জন্য ওখানে। 
    সেই সময় আমরা দুর্গাপুর ব্যারেজ, মাইথনে বেড়াতে গিয়েছিলাম।  কিন্তু আমার সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল জয়দেব কেন্দুলি মেলা, যা অজয় ​​নদীর তীরে মকর সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে ৩ দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়। কবি জয়দেব মিশ্র, যিনি সংস্কৃত কাব্যে গীত গোবিন্দ লিখেছেন, কেন্দুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বলে মনে করা হয়। বিকেলের বাসে মেলা থেকে ফেরার সময় পথে দেখি আমাদের আগের বাসটি ব্রেক ডাউন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। যেহেতু আমাদের বাসটি দুর্গাপুর যাওয়ার শেষ বাস ছিল, তাই সমস্ত যাত্রীকে আমাদের বাসে নিয়ে নেওয়া হয়। অতিরিক্ত লোডের কারণে, বাসটি চলতে থাকে শম্বুক গতিতে। বাসটি একদিকে হেলে গিয়েছিল অনেকটা। মাটির রাস্তা। আমরাও সবাই ভয় পাচ্ছিলাম বাড়ি ঠিকমত পৌঁছতে পারব কীনা। ড্রাইভার ভয় পেয়ে যায় বাস চালাতে। সেই সময় কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে বাস চালককে উৎসাহ দিতে থাকে বাস থেকে নেমে, এবং বাসের সাথে সাথে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বাসকে নিয়ে আসে পিচের বড় রাস্তায়। শেষপর্যন্ত গভীর রাতে আমরা বেনাচিতি'তে পৌছালাম। একটি হোটেলে আমাদের রাতের খাবার (তরকা রোটি, প্রথমবার তাই আজও মনে আছে) খেয়ে, বাসে করে বাড়িতে পৌঁছলাম।
    আমার বাবা ঠান্ডা প্রকৃতির হলেও, আমরা কোনো দুষ্টুমি করার কথা জানতে পারলে প্রচন্ড রেগে গিয়ে একটি লাঠি দিয়ে মারতেন। আমি অনেকবার লাঠির মার খেয়েছি বাবার কাছে। দুষ্টুমি তো ছিলই, তাছাড়াও আমি কয়েকবার একটি টিনের কৌটো থেকে যেখানে খুচরো পয়সা রাখতেন মা - অনেকবার না বলে পয়সা চুরি করেছি। আলুকাবলি, কুল, আইসক্রিম, ইত্যাদি খাওয়ার খুব ইচ্ছা হতো। যখন পাড়ার কেউ দেখে ফেলত আমাকে আলুকাবলি খেতে, বাবাকে জানিয়ে দিতেন। অথবা কারুর বাগান থেকে পেয়ারা চুরি করেছি প্রাচীর বেয়ে, বাবার কাছে অভিযোগ এসেছে। বাবা প্রচন্ড রেগে লাঠিটি দিয়ে পেটাতেন। হাত কেটে রক্ত বেরিয়ে যেত। আমি মুখ গোঁজ করে পিছনের খিড়কির দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। দিদি তখন এসে বলত, 'যা - বাবার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নে। আর কোনোদিন করবি না।' কিন্তু আমি ছিলাম খুব জেদি ছোটবেলায়, সাথে ছিল রাগও। মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে থাকতাম। তখন দিদি চোখের জল ফেলতে ফেলতে ভিতর থেকে মলম তুলো নিয়ে এসে হাতে লাগিয়ে দিত। আর বলতে থাকত, 'কেন করিস এইসব দুষ্টুমি ? এত রক্ত বেরিয়েছে !' যেন 'পথের পাঁচালি'র সেই দৃশ্য ! কিন্তু পাত্র-পাত্রী উল্টো। সর্বজয়ার হাতে বেধড়ক পিটুনি খেয়ে দুর্গা যখন বাইরের গাছের নীচে এসে গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর অপু এসে জিজ্ঞেস করছে, 'খুব লেগেছে, নারে দিদি ?'     
    ****
    আমি আর ই কলেজ মডেল স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই, যেখানে আমার দিদি সেই সময়ে দশম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত ছিল। আবার আমি পাবলিক বাসে স্কুলে যেতে শুরু করি, কিন্তু এবার একা নই - দিদির সাথে।
    যেহেতু দিদি ইতিমধ্যেই সেই স্কুলে অধ্যয়নরত ছিল, প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য দিদি ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত কবিতার কাছ থেকে পঞ্চম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার গণিত এবং ইংরেজি প্রশ্নপত্র সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। পরে জানতে পেরেছিলাম, কবিতা এবং সুপর্ণা ক্লাসের প্রথম স্থান'দুটি ঘুরেফিরে অর্জন করত। ওই প্রশ্নপত্র থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংকের কয়েকটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এবং আমি পেয়েছিলাম উভয় পত্রে পূর্ণ নম্বর। কবিতা পঞ্চম শ্রেণী থেকে ষষ্ট শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় প্রথম হয়, আর সুপর্ণা দ্বিতীয়। স্কুলে যোগদানের পর দেখতে পাই প্রথম থেকেই কবিতা আমাকে ওর প্রতিযোগী হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে এবং কোনো কিছু শেয়ার করতে অপারগ। কিন্তু সুপর্ণা সেরকম ছিল না। এই কারণে কবিতার সাথে আমার বন্ধুত্বটা ঠিক গাঢ় হতে পারেনি।
    স্কুলটি একটি সুন্দর মনোরম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ক্যাম্পাসে অবস্থিত ছিল এবং বাসস্ট্যান্ড থেকে স্কুলের দিকে যাওয়ার রাস্তাটির দুপাশে ছিল শাল, সেগুন গাছে ভর্তি। প্রায় অন্ধকার রাস্তাটি, মাঝেমাঝে ডালপালার ফাঁক দিয়ে রাস্তায় এসে পড়ত রুপালি সূর্যের ঝিকিমিকি কিরণ। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু এগোলেই বাম পাশে ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রিন্সিপালের বিশাল দোতলা বাংলো। পুরো অন্ধকারে ছেয়ে থাকত বাংলোটি, ভাবতাম এখানে কেউ থাকে কী করে ! ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং স্কুলের স্টাফ- কর্মচারীদের কোয়ার্টারগুলি সুন্দরভাবে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কিন্তু সুন্দর সারি বদ্ধভাবে অবস্থিত। ক্যাম্পাসের মধ্যেই খেলার মাঠ, বাজার ইত্যাদি দিয়ে পরিকল্পিতভাবে একটি স্বপ্নের ছোট শহর যেন বানানো হয়েছে। ক্যাম্পাসের মধ্যে অবস্থিত স্টাফ-কর্মচারীদের সন্তান-সন্ততিরা ছাড়াও, দুর্গাপুরের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে অন্যরা এই স্কুলে পড়তে আসত।     ( ক্রমশ )

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন