এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • জীবন চক্র - প্রথম অধ্যায় 

    Himadrisekhar Datta লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ৩১৭ বার পঠিত
  • আমাদের হিন্দুদের মধ্যে যুগ কাল আর সময় নিয়ে, শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত আর একেবারেই লিখতে পড়তে জানে না - এমন মিশ্র সামাজিক অবস্থানের সাধারণ মানুষদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভ্রামিক এক ধারনা আছে। পুরাণ মতে, যে চার যুগের কথা, নানা উপাখ্যান আর মহাকাব্যের মধ্যে বর্ণিত, তার কোন ইতিহাস নির্ভর ঠোস প্রমাণ এখনকার কোন ঐতিহাসিকের কাছে নেই। তাই কল্পনায় মহাকাব্য পড়তে যতটা ভাল লাগে, যুক্তি এবং তর্কের মাপকাঠিতে তাকে যখন ফেলা যায়, তখন তা পাশ মার্কই পায় না। যারা বেশি উচ্চ শিক্ষিতদের মধ্যে পড়েন না, তারা অতটা তলিয়ে দেখার বা খোঁজার এবং ভাবার কোন প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন না, কারণ তারা গতানুগতিকতায় বিশ্বাসী। এই গতানুগতিক ভাবে চলা আর ট্র‍্যাডিশনাল হওয়া কিন্তু এক জিনিস নয়। আর যারা শেষ ক্যাটিগরিতে, তাদের কাছে যদি, সাধারণ ভাবেই প্রশ্ন করেন, যেমন, আপনার বয়স কত হল? সে বলবে অত শত তো হিসেব জানি না, তবে মা বলত, যে বছর বন্যায় আমাদের বুধুয়া ভেসে গেছিল,সেই ভরা বন্যায় আমি জম্মেছিলাম।বুধুয়া হল, বাড়ির গরু।
    এতে সমাজ বা সাধারণ ভাবে মনুষ্য কুলের কোন লোকশান নেই নিশ্চয়, সে কথা স্বীকার করি। আমি শিক্ষার লেভেলটা কেবল, সামাজিক স্তরে মানুষ হিসেবে আমাদের মধ্যে ইন্টেলিজেন্ট কোশিয়েন্টের একটা পরিসংখ্যান জনিত, তুলনাত্মক আলোচনা করতে চেয়েছি। কাউকে অবমাননা করার উদ্দেশ্যে একেবারেই নয়।
    এখন আমাদের জীবনের পরিমিতি খুব বেশি করে ধরা হলে, এখনকার পৃথিবীতে গড়ে ৬০-৭৫ বছর। জাপান বা আভ্যন্তরীণ চিন দেশে, অনেক নারী পুরুষ আছেন যারা ১০০+. তাদের জীবন শৈলী খাওয়া দাওয়া এবং অতি অবশ্যই সেখানকার  জলবায়ু তার জন্য দায়ী। তাদের নিয়ে জেনারালাইজেশন করে, আয়ুর সীমানা বাড়িয়ে দেওয়াটা উচিত হবে না। ভারতীয় উপমহাদেশে তো নয়ই।
    অবিভক্ত বাংলায়, আমার ঠাকুরদা তার বিরাট পরিবার নিয়ে সিলেটে থাকতেন। নিজের জমি জমা বড় বাড়ি ঠাকুর দালান,দোলমঞ্চ, দুর্গা মণ্ডপ,পাঁঠা রাখার খোঁয়াড় ছাড়াও, তার কাছে হাঁস মুরগী, পাখী, গরু বাছুরের সাথে, একটা করে ঘোড়া এবং হরিণ ছিল। এ সবই আমার বাবার কাছে শোণা। ঠাকুরদাই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দু'বার বিবাহও করেছিলেন, প্রথম পত্নী গত হবার পরে। সেটা খানিকটা বড় সংসার সামলানোর জন্যই আমার ধারণা। আমার বাবারা ন-ভাই আর পাঁচ বোন ছিলেন। তিনিই আমার পরিবারের সবচেয়ে নিকটবর্ত্তী ঐতিহাসিক পাত্র, যার স্বভাব,খাওয়া দাওয়া,কাজকর্ম ইত্যাদির কথা বাবার মুখে শুণেছি। তিনি বেঁচেছিলেন আশি বছর পর্যন্ত। তিনি কখনও নিজের ভিটে ছেড়ে বেরোন নি। কিন্তু আমার বাবা বেরিয়ে গেছিলেন, তার স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার পরই। তখনও দেশ স্বাধীন হয় নি - সীমানার ভেদাভেদ ছিল না। তাই উদ্বাস্তু নামক তকমাও বাবার গায়ে লাগে নি। বাবা তার পরবর্ত্তী শিক্ষা, কলকাতা থেকেই গ্র‍্যাজুয়েশন পুরো করেন। অল ইন্ডিয়া কাস্টমস সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়ে, পরে চাকরিতেও জয়েন করেন। এটা সিলেটে, ঠাকুরদার জন্যে শুধু নয়, পুরো গ্রামের জন্যই একটা বিরাট পরিবর্তনের সূচনা ছিল। জমিদারির নিশ্চিন্ত আরাম ছেড়ে, অল্প বয়সেই আমার পিতৃদেব, কেন সিলেট ছেড়ে একাই কোন সহায় সম্বলহীন অবস্থায় কলকাতা চলে এসেছিলেন, সেইটে আমার জানা হয়ে ওঠে নি। ভাসা ভাসা টুকরো আলোচনা বড়দের মধ্যে যা হত, তার থেকে কেবল একটা স্কেচ বানানো যেতে পারে, পুরো ছবিটা হয় না। আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগেকার অবস্থা আর ঘটনাপঞ্জী ঠিক মত করে বলার আজ কেউ নেই। তাই বাবা নিজের পায়ে নিজের বিদ্যে বুদ্ধির জোরে বাঁচতে চেয়েছিলেন, এইটে মেনে নেওয়াটা আমার জন্যে সবচেয়ে সম্ভাব্য চয়েস। বাবার সারা জীবন ধরে যে জীবন যাপন আমি দেখেছি, তাতে সেটা আরো বেশি করেই বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তিনি মাত্র ৬৪-বছর বয়েসে, সামান্য অসুস্থতা ভোগ করে, আমায় ছেড়ে চলে যান। আমার জীবনে প্রথম সবচেয়ে বড় আঘাত প্রাপ্তি। বাবার অসুখটা যখন ঠিক মত ধরা পড়ে, তারপরে তিনি মাত্র সাতদিনই ছিলেন। আমার ঠাকুরদা আর বাবা দুজনেই কর্কট রোগগ্রস্ত হয়ে মারা যান।
    আমি বর্তমানে বাবার আয়ু পার করে এসেছি, ঠাকুরদার আয়ু পৌঁছাতে কিছুটা সময় এখনও বাকি। দুজনের আয়ুর গড় হিসেব যদি আমার আয়ু বলে ধরে নিই, যেটা কেবলমাত্র একটা হাইপোথেসিস, তাহলে আরোও বছর ৫-৬ আমার এই গ্রহে থাকার কথা। তবে এর কোনও যুক্তি নির্ভর অকাট্যতা নেই। আমার চরিত্র এবং স্বভাব দুটোর একটাও আমার বাবার কঠোর চরিত্র এবং ডিসিপ্লিন্ড স্বভাবের সাথে মেলে না। তার জীবনটা চালিত হত কর্তব্য এবং নিয়ম নীতির শৃঙখলাবদ্ধ একটা উপকারী মেশিনের মত। তার ভেতরে মনের ভাব, সুখ দুঃখ ব্যাথা আনন্দের কখনও তেমন বহিঃপ্রকাশ দেখি নি। তাই তাকে মেনে চললেও, তার মনের নাগাল কখনও পাই নি। তাই তার শারিরীক বা মানসিক কষ্ট বা খেদ সম্বন্ধে কোন কিছুই আইডিয়া ছিল না। একটা সুপার স্মুদ, কার্য্যশীল যন্ত্রের মত, তিনি আমাদের সংসারের মূল এবং একমাত্র চালিকা শক্তি ছিলেন। আমি ছোটবেলা থেকেই কল্পনার জগতে বাস করতাম, আজকের ভাষায় রোমান্টিক স্বভাবের ছিলাম। আমি আমার সময়ের চেয়ে চিন্তায় সব সময়ই এগিয়ে ভাবতে পারতাম। আর রোমান্টিক স্বভাবের মানুষেরা নিজের খেয়াল খুশির নিজেই মালিক হয়ে থাকে। তাদের নিয়মের বন্ধনে বাঁধা যায় না। আমার ভাই (আমার চেয়ে দেড় বছরের ছোট), সে বরঞ্চ, বাবার কাজের ধারা, খুঁটিনাটি নজর করা আর রুটিন মাফিক জীবনকে চালনা করার সব ক'টি গুণ জিনগত ভাবে অর্জন করেছিল। মেনে চলা এবং বাধ্য থাকার জন্মগত সংস্কার আমার মধ্যে প্রবল ভাবে থাকলেও, পরবর্তী জীবনে, আমি এমন অনেক কাজ করেছি, যা অল্পের জন্য হঠকারিতার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল। তখন পিতৃদেব আর নেই, কিন্তু আমার স্ত্রী, অর্দ্ধাঙ্গিনী আমাকে প্রায় সময়ই (৯৯%) উদ্ধার করে এনেছেন।
    বাবার মৃত্যু আমাকে নানা ভাবে গভীর নাড়া দিয়ে যায়। অনেক প্রশ্নের আর কিছু উত্তর আর কখনই পাব না জেনে, আরোও অস্থির হয়েছি। হয়ে থাকি। কিন্তু মুখ ফুটে বলার জায়গা আজ সত্যিই নেই। হয়ত, আমার মত করে নিজেকে ঘিরে এত কেউ ভাবে না, কিন্তু আমি আপারগ। এই দুনিয়ায়, অত্যন্ত তুচ্ছতম ঘটনা ঘটার পেছনেও, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী, অবশ্য অবশ্যই একটা না একটা যোগ্য কারণ থাকে। কোন কার্য্য, কারণ ছাড়া উদভুত হয় না। 
    নিজের এই পাঁচ যুগ পার করে আসা জীবনের একটা বার্ডস আই ভিউ নেবার কথাটা হঠাৎই মাথায় নড়ে চড়ে উঠল। ব্যক্তিগত জীবনে, ১২ বছর পার করলেই, এক যুগ হয়। পুরাণ অনুযায়ী কলি যুগের ব্যাপ্তি ৪,৩২,০০০ বছর - যার মধ্যে মাত্র ৫০০০ বছর পার হয়েছে। আমার জীবন এই ৫০০০ বছরের কলিযুগের অন্তর্গত। আর সেটা কেবল এক হাজার ভাগের এক ভাগ মাত্র। সেই এক ভাগের মধ্যেই জন্ম থেকে আসন্ন মৃত্যু পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা আমিকে একটু গুছিয়ে তোলা যায় কি'না চেষ্টা করি। আমার বংশানুক্রমিক জন্মগত সত্তার বহমানতা দেশ কাল আর অবস্থানের বিচারে কোথা হতে কোথায় নিয়ে চলেছে, তা ফিরে দেখতে আর বুঝতে বাধা কোথায়? 
    ( ক্রমশ....)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে প্রতিক্রিয়া দিন