এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • শৈশবের স্মৃতিমালা এবং তাহাদের কথা - পর্ব ৭

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১২ ডিসেম্বর ২০২২ | ২৩৪ বার পঠিত
  • আমি যখন ১০ / ১১ বছর বয়সে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ প্রথম পড়ি কিংবা দ্বিতীয় / তৃতীয় বার তারও কিছুদিন পরে, আমি দৃশ্যায়ন করতাম উপলব্ধি করতাম সাদৃশ্য খুঁজে পেতাম ভিতর থেকে কোনো এক অদৃশ্য কারণে - আমার কয়েকমাসের বসবাস গেদে মফস্বল শহরটির সাথে নিশ্চিন্দিপুর গ্রামটির যার উপর ভিত্তি করে 'পথের পাঁচালি' রচিত। সঠিক কারণটি আমি সত্যিই জানি না - হতে পারে অপুর প্রতি সর্বজয়ার স্নেহ-মমতা যেটা আমাকে আমার প্রতি আমার মায়ের স্নেহ-ভালোবাসার উপলব্ধির সাথে সংযুক্ত করেছে, বা দুর্গা এবং অপুর মধ্যে বন্ধন যেটা আমাকে আমার দিদির সাথে যে একই বন্ধনের সূচনা শুরু হয়েছিল গেদেতে তার অনুভূতি তৈরি করেছে, কিংবা 'পথের পাঁচালী' উপন্যাসে উল্লিখিত মুদি দোকান এবং পার্শ্ববর্তী পাঠশালা (যেখানে অপু তার স্কুলে পড়া শুরু করেছিল) আমাকে গেদেতে বটগাছের তলায় একটি মুদি দোকান এবং তার পাশে অবস্থিত একটি প্রাথমিক স্কুলের শারীরিক উপস্থিতির সাথে সাদৃশ্য আঙুল তুলে দেখিয়েছে। অথবা উক্ত সবকটির সাথেই আমার গেদের বসবাসের সুর-তাল মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে 'পথের পাঁচালি'র সাথে।
    গেদেতে আমাদের একটি ছোট দুই রুমের রেলওয়ে কোয়ার্টারে থাকতাম একটি ছোট রান্নাঘরসহ, যা রেলওয়ে স্টেশনের খুব কাছে ছিল। এক ঘরে খাট-বিছানা ছিল, আর অন্য ঘরটির মেঝেতে একসঙ্গে খাবারের জন্য ব্যবহার করা হত। সে সময় রাতে মায়ের সাথে মেঝেতে বিছানো বিছানায় ঘুমাতাম আমি। আর আমি প্রতি রাতে আমার মাকে বলতাম নেকড়ে, শেয়াল আর চালকুমড়োর সেই একই গল্প শোনাতে, যেটা তিনি আমার কপালে বাম হাত রেখে কপালে হাত বুলাতে বুলাতে বলতেন  এবং গল্প শেষ হওয়ার অনেক আগেই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম।
    গেদে রেলস্টেশন সংলগ্ন একটি বটগাছের নীচে একটি ছোট মুদির দোকান ছিল, যেখান থেকে প্রত্যেকে তাদের দৈনন্দিন প্রয়োজনের সামগ্রীগুলি পেতেন। এর পাশেই ছিল একটি স্কুল ও চণ্ডীমণ্ডপ, যেখানে অনেকেই সারাদিন বসে গল্প করত। কাছাকাছি একটি মা কালী এবং মনসা মন্দিরও ছিল, এবং মাঝে মাঝে আমরা ট্রেনে চড়ার অ্যাডভেঞ্চারের পরে বিকেলে বেড়াতে যেতাম।
    বাবলুমামা (মায়ের মামাতো ভাই) তখন কলকাতার মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ছিলেন এবং সপ্তাহান্তে মাঝে মাঝে আমাদের বাড়িতে আসতেন। বড়মামা ব্যাংকে কাজ করতেন রানাঘাটে, উনিও প্রায়ই আসতেন।
    আমার বড়মামিকে আমার মা গেদেতে নির্বাচিত করেছিলেন, যখন তিনি সেখানে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। তার আত্মীয়রা আমাদের কোয়ার্টারের ঠিক বিপরীতে থাকতেন। বড়মামি দেখতে খুব সুন্দর, কমনীয় এবং সহজ সরল মহিলা ছিলেন, আমাদের সবার খুব পছন্দের। তিনি তার তিন বোন এবং এক ভাইয়ের সাথে ব্যারাকপুরে একটি খোলামেলা পরিবেশে বড় হয়েছেন। মাঝে মাঝে আমি আজ ভাবি কিভাবে উনি তার পুরো জীবন তার পরিবারকে উৎসর্গ করে কাটিয়েছেন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন আমি আমার বড়মামার বাড়িতে এক সপ্তাহ ছিলাম। সুন্দরদাদু, ছোটদাদু, বড়মামা, বড়মামি এবং তাদের দুই মেয়েকে নিয়ে একসাথে সবাই থাকতেন। ছোটদাদু তখন কাজ করতেন, সকাল আট'টার মধ্যে অফিসে চলে যেতেন, তারপর বড়মামা। দুই ছোট মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে পড়ত তখন  এবং এগারোটা নাগাদ কাছের একটি স্কুলে যেত এবং বিকাল পাঁচটায়  ফিরে আসত। সুন্দরদাদু দুপুর বারোটা নাগাদ দুপুরের খাবার খেতেন, তারপর ঘুমাতেন। পরিবারের সমস্ত কাজ শেষ করে, তারপর বড়মামি প্রতিবেশীর বাড়িতে গল্প করতে যেতেন এবং বিকেল চার'টার মধ্যে ফিরে এসে সুন্দরদাদুর জন্য চা তৈরি করতেন। একদিন দুপুরের খাবার খেয়ে বড়মামি আমাকে বললেন – পলাশ, চল একটা সিনেমা দেখতে যাই (তখন সিনেমার সময় ছিল দুপুর একটা থেকে চারটে)। সিনেমা দেখছি দুজনে, প্রায় শেষের দিকে - বোধহয় আর ১০ / ১৫ মিনিট বাকি, আমাকে অবাক করে বড়মামি সিনেমাহল থেকে আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসেন। এবং একটা রিক্সাতে চড়ে বসেন। আমি জিজ্ঞেস করি, কী হলো বড়মামি, হঠাৎ করে বেরিয়ে এলে কেন ?  উত্তর দেন, তোমার সুন্দরদাদুকে বিকেল চারটের সময় চা দিতে হবে। যখন আমরা ফিরে এলাম, সুন্দরদাদু বাইরের বারান্দায় বসে চায়ের অপেক্ষায়। মুখটা একটু গম্ভীর। বড়মামির নিজস্ব চাহিদা নিজের বিনোদনের জন্য খুবই কম ছিল। মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যেতেন, যা খুব কমই তিনি সম্পূর্ণ উপভোগ করতে পারতেন এবং যদি কেউ সন্ধ্যায় তার জন্য কিছু সিঙ্গারা, চানাচুর নিয়ে আসতেন - মুখটা খুশিতে ঝলমল করে উঠতো। যদিও এটি আমার শৈশবকাল সময়ের পরবর্তী ঘটনা, কিন্তু প্রাসঙ্গিক মনে হলো, তাই উল্লেখ করলাম।
    যাইহোক, মাস  চারেক পর গেদেতে আমার থাকা প্রায় শেষ - কারণ আমার বাবা দমদমে বদলি হয়ে গেলেন। এবং আমি আবার বারাসাতে দাদুভাইয়ের সাথে যোগ দিলাম। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হওয়ায় দিদি তার আগেই বারাসতের উদ্দেশ্যে গেদে ছেড়ে চলে যায়। গেদে'তে অল্প সময়ের জন্য থাকলেও আমি গেদের ঐ ছোট্ট রেল কোয়ার্টার, রেল কলোনি, স্টেশন, বাজার, বটতলা কখনই ভুলতে পারিনি। মাঝে মাঝেই উঁকি মেরেছে আমার স্মৃতির দুয়ারে, হয়তো কারণটা আমার প্রথম বসবাস আমার নিজের কাছের পুরো পরিবারের সাথে, হয়তো একটা বন্ধন মায়ের সাথে যেটা শুরু হয়েছিল সেখান থেকেই।
    ****
    ছোট বেলায় আমি খুব দুষ্টু ছিলাম, আজ আমাকে দেখলে কেউ সেটা বিশ্বাস করবে না। আগেই জানিয়েছি আমি তখন দাদুভাইয়ের সাথে নীচতলায় মাঝখানের ঘরে শুতাম এবং বিছানায় শুয়ে শুয়েই  বারান্দা দিয়ে বাইরের উঠোন দেখতে পেতাম। সেদিন আমার জ্বর হয়েছিল, দাদুভাই কোনো একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলেন, ফুলপিসি ছোটকাকু কলেজে, কাকুমণি অফিসে। উনি বারাসাতেই একটি অফিসে কাজ করতেন। দুপুরে আমি বিছানায় একা উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলাম এবং আমার বিছানা থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম বাইরের উঠোন। হঠাৎ দেখি কাউকে চালাতে আমার সাইকেলটা, যেটা কাকুমণি আমাকে কিনে দিয়েছিলেন। আমি তাকে থামতে বলছি, কিন্তু আমার কথা তোয়াক্কা না করে চালিয়ে যাচ্ছে সাইকেলটা। আমি চেঁচাতে চেঁচাতে কখন যে বিছানার ধারে এসে গেছি নিজেই জানি না।     ( ক্রমশ )
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে মতামত দিন