এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • গরবিনী - পর্ব ২

    Supriya Debroy লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৭ অক্টোবর ২০২২ | ৩৮১ বার পঠিত
  • বকুলের মনে পড়ে, যখন কলেজে পড়ত - ওর এক সহপাঠী ছিল, নাম রিনি। ও বলেছিল ওর এক পিসতুতো কাকার গল্প, থাকতেন বারাসাতে। উনি যখন ডেলি প্যাসেঞ্জারি করে অফিস করতেন, তখন বলতেন - পৃথিবীর অর্ধেক লোক থাকে বারাসাতে, আর অর্ধেক লোক কলকাতায়। ঠেলে-ঠুলে, গুঁতিয়ে-গাঁতিয়ে যখন ট্রেনের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছেন বারাসাত স্টেশনে নামার জন্য - ও হরি, নেমে দেখেন ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে বারাসাতের পরের স্টেশন বামুনগাছি'তে। তখন রিনি বলতো, কাকাই তুমি একটা কী ! তাহলে আমরা এতগুলো লোক কোথায় থাকি ! তুমি একটা যাতা। রিনির কাকার কথাগুলো অদ্ভুত আজব ধরনের। থেকেও নেই। আজ বকুল বুঝতে পারে রিনির কাকার কথাগুলো। এই থেকেও না থাকার মধ্যেই লুকিয়ে আছে অস্তিত্বের সংকটের ব্যাপারটা। যেটা আজ বকুলের মায়ের মধ্যে হয়তো প্রকট হয়েছে। বকুল বোঝে মায়ের উপর দিয়ে কী গেছে একদিন ! এতদিন সংসার, মেয়ে, দেশ বাঁচানোর জন্য যে সংগ্রাম করে গেছেন - আজ বোধহয় সত্যিই ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। যে দহনে ভিতরে ভিতরে এতদিন দগ্ধ হয়েছেন ভিতরে ভিতরে, সেটা বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এখন। এখন আর নিজেকে সামলানোর জোর পাচ্ছেন না। নিজের অস্তিত্বটাকেই আর স্বীকার করতে পারছেন না। কাহিল হয়ে পড়েছেন জীবনের সংগ্রাম লড়তে লড়তে।   
                      
    অভিরূপকে বলার পর, ও নিজেই জোর করে বকুলকে পাঠিয়ে দিয়েছে মায়ের কাছে। অনেকদিন থাকার জন্য মায়ের সাথে।

    রেলগাড়ি যখন একটি একটি করে স্টেশন পেরিয়ে এগিয়ে চলে রেখে যায় স্টেশনগুলির ছাপ মনের গহীনে এক একটি স্থিরচিত্রের মতো, হয়তো কিছুটা মনের অগোচরে। আবার হতে পারে মনের গোচরেই। কিছু স্পষ্ট, কিছু অস্পষ্ট। জীবনের চলার পথে এরকমই অনেক স্থিরচিত্র আটকে থেকে যায় স্মৃতিতে, হৃদয়ে। পারিপার্শ্বিক ভুলে যেতে বললেও, ভোলা যায় না। হয়তো অনেকসময় এই স্থিরচিত্রগুলিই দেয় ঐশ্বরিক শক্তি জীবন সংগ্রামে এগিয়ে চলার জন্য। বকুলের মায়ের জীবনের স্থিরচিত্রগুলির হদিশ বকুল পেয়েছে তার মায়ের লেখা কিছু পুরোনো খাতায়। বিবর্ণ, হলদেটে পাতায়।  খাপছাড়া, এলোমেলো। কিছু শুনেছে পুতুল কাকির থেকে, কিছু রতন মামার থেকে। যখন বেড়াতে আসত মায়ের সাথে ছোটবেলায় মামারবাড়ি কেরানীগঞ্জে।        

    (তিন)

    হলুদ্রাভ গায়ের বর্ণ। একটা সতেজ আভা শরীর থেকে বিকীর্ণ হয়। সুশ্রী চেহারা। ঢলঢলে আহ্লাদী মুখ মনে হলেও, একটা থমথমে ব্যক্তিত্ব আছে শরীরে সমীহ করার মতো। কুসুম খাতুন ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্মরতা। হাসপাতালের ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিলেন। সালটা ১৯৭১। শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকা অসহযোগ আন্দোলনে ২ রা মার্চ অংশ নেন তিনি। ঐ একইদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনে সবুজ-লাল পতাকা উত্তোলন করা হয়। বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় দেখতে পান অসংখ্য লোককে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। স্লোগান দিচ্ছেন 'বীর বাঙালি লাঠি ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।' বাসায় ঢুকে রেডিও চালু করতেই শুনতে পান খবরে বলছে, জাতীয় পরিষদ বাতিল। মহিলা পরিষদের সবাই ঠিক করেন ৫ ই মার্চ প্রতিবাদ মিছিলের। কুসুম খাতুন তখন ছিলেন সন্তান সম্ভবা। তাও তিনি মিছিলে অংশ নেন। মিছিলের পর সবাই ওনাকে বারণ করেন, এখন আর যেন মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণ না করেন। পাকিস্তানিরা সৈন্য নামিয়েছে, যখন তখন যা কিছু হয়ে যেতে পারে। এরমধ্যে মহিলা গণসংগ্রাম গঠিত হয়েছে। প্রশিক্ষণ চলছে তাদের ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায়।

    ৭ ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, 'এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, যার যা হাতে আছে তা নিয়ে যুদ্ধ করো' - প্রেস ক্লাব ছাড়িয়ে শোনা যায়। কুসুম খাতুন মৎস ভবনের কোনায় দাঁড়িয়ে শুনছিলেন এই ভাষণ। শরীরের ভিতরে উদ্দীপনা আর উত্তেজনায় ভরপুর। কিন্তু সরাসরি কোনো কিছুতে অংশগ্রহণ করতে পারছেন না, কোনো কিছুতে যুক্ত হতে পারছেন না। আফসোস হচ্ছে ভিতরে ভিতরে। আবার মনের ভিতরে অনেক দুশ্চিন্তা স্বামী মানিকের জন্য। অনেকদিন ওনার কোনো খবর পান না। শ্বশুরমশাই, খুড়শ্বশুর, খুড়শাশুড়ি, দেওর বিবেক, ছোট জা পুতুল, ননদ রানী - বাড়িভর্তি লোকজন।  পুতুল কুসুমের খুড়তুতো বোন। কুসুম বিয়ের পর নিজেই প্রস্তাব দেন খুড়শ্বশুর, শাশুড়িমাকে - দেওর বিবেকের সাথে বিয়ে দেওয়ার জন্য। কুসুমের বিয়ের সময় পুতুল দেখেছিলো বিবেককে এবং বিবেক'রও পছন্দ হয় পুতুলকে। কুসুমের বিয়ের পাঁচ মাস পরেই বিবেকের বৌ হয়ে পুতুল প্রবেশ করে এই বাড়িতে কুসুমের ছোট জা হিসেবে। পুতুল এবং কুসুম বড় হয়েছে একসাথে কেরানীগঞ্জে। সেই ছোটবেলা থেকে যখন ওরা খেলত রান্নাবাটি, বর-বৌ খেলা। পুতুল একবছরের ছোট কুসুমের থেকে। দু'জনে হাত ধরাধরি করে যেত স্কুলে, দাদা রতনের সাথে যেত বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে। পুতুল'ও স্নাতক হয়েছে ঢাকা ভার্সিটি থেকে, বাংলায়। কুসুম তখন পড়ে মেডিকেল কলেজে। পুতুল খুব হাসি-খুশি থাকতে ভালোবাসে, সবসময় মুখে হাসি লেগে থাকে। যে যতই বকুক, ভর্ৎসনা, তিরস্কার করুক - সব কিছু এক গাল হাসি মুখে শুনবে। খুব চঞ্চল, এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সবসময় যেন দৌড়োচ্ছে। রংচঙে শাড়ি, জামা-কাপড় পড়তে ভালোবাসে। কপালে বড় গোল করে সিঁদুরের টিপ পড়ে। ওকে দেখেই মনে হবে রংচঙে এক উড়ন্ত প্রজাপতি। কুসুমকে সবসময় খুশি, আনন্দে রাখার চেষ্টা করে নিজেকে এবং সবাইকে।   

    (ক্রমশ)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। হাত মক্সো করতে মতামত দিন