এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • অনুগল্প : অস্ত্রোপচার

    Sankar Tutu Speaking লেখকের গ্রাহক হোন
    ২৯ জুন ২০২১ | ৬৯৩ বার পঠিত
  • বহুকাল, আক্ষরিক অর্থেই বহুকাল পর নিজের শহরে ফিরছে দু ভাই আর তিন বোন। পাঁচজনই অবশ্য সহোদর নয়। আগের প্রজন্মের দুই ভাইয়ের ছেলেমেয়ে। একদিকে সনাতন বাবুর এক ছেলে কল্যাণ এবং দুই মেয়ে কল্যাণী ও শিবানী আর আর এক দিকে বঙ্কুবিহারীর এক ছেলে ইমন আর এক মেয়ে দূর্গা। পাঁচ ভাইবোন আজ বহুদিন পর ফিরছে নিজেদের জন্ম ভিটেয়। ভিটে বলতে অবশ্য আর বাকী কিছুই নেই। পোড়ো বাড়ি হয়ে গেছে।

    একসময় কোলাহলে ভরে থাকত বাড়িটা। যদিও দুটো পরিবার আলাদা থাকত। প্রকান্ড বাড়িটার ঠিক মাঝখানের উঠোনে আড়াআড়ি ছিল একটা পাঁচিল। বেশি না। পাঁচ ইঞ্চির পাঁচিল। বাড়ির বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। কিন্তু দরজা পেরোলেই দু ভাগ। সনাতন এবং বঙ্কুবিহারী দুই ভাই ও তাদের বউরা এ পাঁচিল তৈরী করান নি। তারও আগের প্রজন্ম হয়ত বানিয়েছিলেন। কিন্তু ঐ পাঁচিলটাই ছিল দুটো পরিবারের বিরোধ। কবে থেকে, কোন প্রজন্ম থেকে এই বিরোধের জের ধরে চলে আসছে বিরোধিতা, কেউই জানে না। কিন্তু সকলেই এটুকু শিখেই বড় হয়েছে যে পাঁচিল ডিঙোতে নেই। মাঝে মাঝেই ধুন্ধুমার অশান্তি বাধে। আবার জুড়িয়ে যায়। কিন্তু প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বিরোধিতা মেটে না। এই নিয়েই সনাতন এবং বঙ্কুবিহারী ও তাদের বউরা জীবন কাটিয়ে দিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তারা মনেপ্রাণে চাইতেন তাদের ছেলেমেয়েরা যেন এই শহরে, এই বাড়িতে না থাকে। এখানে এমনভাবে অশান্তির মাঝে তাদের জীবন কাটুক, এটা কেউই চাইতেন না।

    না, ছেলেমেয়েরা কেউই নিরাশ করে নি তাদের বাপ মায়েদের। সবগুলিই লেখাপড়ায় ও চাকরিবাকরিতে উন্নতি করে রাজ্য ছেড়েছিল। আর মেয়েরাও চাকরি করে, তথাপি বিয়ে করে তারাও রাজ্যত্যাগ তথা দেশত্যাগও করেছে। সে আজ বহুদিন হলো। সনাতন এবং বঙ্কুবিহারী তো কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। তাঁদের স্ত্রী অর্থাৎ এই ছেলেমেয়েদের মায়েরাও আর নেই।

    "একেবারে শেষের দিকে এই ভিটে আগলে ছিল হারু কাকা। তার ভালো নাম কেউ জানত না। সম্ভবত হারাধন হতে পারে। সে ঠাকুর দার কোন এক দুর সম্পর্কের বোনের ছেলে। এখানে থেকে লেখাপড়া করত। তারপর তার লেখাপড়া কতদূর হয়েছিল জানা নেই। কিন্তু বাড়ি আগলে থেকে গেছিল সে। সব পাখিই যখন ভিটে ছেড়ে ফুড়ুৎ হলো, হারুকাকা রয়ে গেল। একাই থাকত, বিয়ে শাদী করে নি। একটা ঘরে থাকত। ইমন আর কল্যাণ যেটুকু টাকা পাঠাত, তাতেই হেসেখেলে চলে যেত তার। তবে হারুকাকার আর একটা ভুমিকা ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল দুটো পরিবারেই। আজীবন চাইত দুটো পরিবার এক হয়ে যাক। সে ছিল দুটো পরিবারের সেতু। বরাবরই চাইত পাঁচিলটা ভেঙে যাক। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না। সময় নিজের মত চলে। আজ এতকাল পরে সেই হারু কাকা আছে কিনা জানা নেই", এই কথাগুলোই বলছিলেন পরমা তার মেয়ে আইভিকে। পরমা ইমনের স্ত্রী। একটিই মেয়ে তাদের, আইভি।

    হোটেলেই উঠেছে দুই পরিবারের সকলেই। মেয়েদের সাথে জামাইরাও আছে। মিলিত হবার কারনটা অবশ্য এক প্রোমোটার। অমিত সেন। গগনচুম্বী ইমারত গড়তে চান তিনি। কথা বেশ কিছুদিন ধরেই চলছিল ফোনে। এবার সামনাসামনি বসে হিসেবনিকেশ সব মিটিয়ে নেওয়া আর কি। এখন আর সে বৈরিতা নেই। সকলেই নিজ নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত ও ব্যস্ত। বরং সকলেরই সে সব ঝগড়ার দিনগুলো মনে পড়লে হাসিই পায়। কি সব ছেলেমানুষি ঝগড়া ছিল বাবা কাকাদের, মা কাকীমাদের। ঝগড়া করতে হয় বলে করা। দু পক্ষের কেউই সঠিক কারনটাই জানে না, কি নিয়ে ঝগড়া। তবু পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তির সঙ্গে উপরি পাওনা ঝগড়া। ছোট থেকেই ওরাও শিখে গেছিল, পাঁচিল ডিঙোতে নেই।

    সেই বিকেলেই ঠিক হলো একবার শেষ বারের মত স্মৃতিচারণ করা যাক। আর কবে আসা হয় না হয়। কেননা কেউই এখানে ফ্ল্যাট নিতে চায় না। কথা হয়ে গেছে, ক্যাশ টাকাই নেওয়া ভালো। বাড়িটা তো থাকবেই না। একবার দেখে আসা যাক।

    একটু যে মনখারাপ হচ্ছে না, তা নয়। বিশেষ করে ইমন, কল্যাণ আর শিবানীর। ওরাই দু পক্ষের বড় ছেলেমেয়ে। বেশি স্মৃতি ওদেরই আছে। গেটটায় আগাছা। অমিত বাবু সঙ্গে একজন লোক দিয়েছেন। সেই-ই গেট খুলে দিল। হারুকাকা যাবার পর চাবি অমিত বাবুর কাছেই থাকত। খবর পাওয়া গেছে হারুকাকা এখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। দরজা খুলে বাগানের ভিতর ঢুকল ওরা সবাই। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে বাড়িটা অনেক পুরনো দিনের হলেও তুলনামূলকভাবে এখনও বেশ ঠিকঠাকই আছে।

    বাগান পেরিয়ে মূল বাড়িতে ঢুকল ওরা। ঢুকেই থমকে গেল সবাই। সবচেয়ে বেশি চমক লাগলো ইমন আর কল্যাণের। গোটা বাড়িটা যেখানে যেমন ছিল, হুবহু একই অবস্থায় আছে। শুধু আরও একটু পুরোনো হয়েছে আর ধুলো জমেছে, এই যা। কিন্তু জন্ম থেকে চোখ সয়ে যাওয়া, এই বাড়িটার মূল একটা জিনিষ উধাও হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, কোন দক্ষ শল্যচিকিৎসক ছুরি দিয়ে নিপুন হাতে অ্যাম্পুটেট করেছেন এই বাড়ির জন্য অপ্রয়োজনীয় বিলুপ্তপ্রায় একটি অঙ্গ।

    উঠোনের মাঝখানের আড়াআড়ি পাঁচিলটা নেই। শুধু একটা দাগ থেকে গেছে। অস্ত্রোপচারের পর সেলাইয়ের দাগ যেমন থাকে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন