আমাদের বাড়িটা কলকাতা লাগোয়া হয়েও এখনও গ্রাম। ছোটবেলায় ধান চাষ দেখেছি। কলাই চাষ হত আমাদের বাড়ির পেছনের মাঠে। বিকেলের নরম রোদে মায়ের সাথে বসে কলাই তুলে ঝুড়িতে ভরে রাখতাম। তারপর সেটা থেকে ডাল হত। মুগ ডাল। কিভাবে কলাই থেকে ডাল হত সেটা এখন আর মনে পরেনা। সে অনেকদিন আগের কথা। তখন আমরা দুই ভাই ছোট। আমার বয়স দশ-এগারো হবে, আর ভাই আমার থেকে চার বছরের ছোট।
আমাদের বাড়ির পাশেই মণ্ডলদের পুকুর। তার পাশে অনেক খেঁজুর গাছ। একসময় সেই গাছের নিচে লাল পাকা খেঁজুর বিছিয়ে থাকত। মাছি ভনভন করে উড়ে বেরাত। তার পাশে একটা ডেঁফল গাছ ছিল। জানিনা সেটার অন্য কোন নাম আছে কিনা। তবে আমাদের এদিকে ওই ফলটাকে ডেঁফল বলা হত। বিভিন্ন আকারের হত ফলটা। কাঁচা অবস্থায় সবুজ, পাকলে গাড় হলুদ হয়ে যেত। ভেতরে দানা থাকত চার-পাচটা। তার মধ্যেই কিন্ডার জয়ের মত মাখন টাইপের একটা খুব সুস্বাদু খাবার থাকত। প্রায় গাছ থেকে পেড়ে খেতাম।
ওই গাছটার নিচের দিকে নুইয়ে পরা একটা ডালে বাসা করেছিল একটা টুনটুনি পাখি। এই গাছের পাতাগুলো বেশ বড় বড় হত। দুটো পাতাকে একসাথে মুড়ে সেলাই করে নিজের একটা সংসার গড়েছিল সেই টুনটুনি। আমি আর ভাই প্রায় যেতাম ওই বাসাটার কাছে। কখনও তাঁকে একা দেখতাম আবার কখনও দেখতাম দুজনে বসে আছে। আমাদের দেখে প্রথম দিকে উড়ে গেলেও পরের দিকে আর পালাত না। বসে থাকত। কারণটা ঠিক জানতাম না তখন সে কেন পালাত না।
বেশ কিছুদিন যাওয়ার পর একদিন শুনলাম বাসাটার ভেতর থেকে চিঁ চিঁ একটা আওয়াজ আসছে। বাইরে বসে মা টুনটুনি। ভাবলাম একবার উঁকি মেরে দেখি। কিন্তু বাসার পুরো দরজাটা জুড়ে আছে মা টুন্টুনি। আমার দিকে তাকিয়ে দেখছে। মাথা নাড়ছে। যেন কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে।
আরও এক-সপ্তাহ কেটে গেল। বিকেলের দিকে মা মাঠে কলাই তুলতে গেল। ভাই টিউশনি। আমি ধীরে ধীরে গেলাম সেই বাসাটার কাছে। দেখলাম মা টুনটুনি নেই। বাসাটার আরও কাছে গেলাম। দেখলাম ভেতরে ছোট্ট ছোট্ট দুটো ছানা বসে আছে মুখটা হাঁ করে। তখনও ভালোভাবে চোখ ফোটেনি। গায়ে সাদা চামড়া দেখা যাচ্ছে। পালক গজায়নি তখনও। মুখটা উপর দিকে করে হাঁ করে আছে। হঠাৎ মাথায় একটা কু-বুদ্ধি খেলে গেল। কিছু না ভেবেই একটা ছানাকে হাতে তুলে নিলাম। তারপর সেখান থেকে পোপাই দৌড় দিলাম একেবারে বাড়ি।
কাজটা করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না, এতে মায়ের প্রতিক্রিয়াটা ঠিক কেমন হবে! সত্যি বলতে মা’কে প্রচুর ভয় পেতাম আমি। ভাইও। আমাদের বাড়ির দাওয়াটা তখন বাঁশের খুটি দিয়ে দাঁড় করানো। মেঝেতে মাটি। মা গোবর দিয়ে ন্যাতা দিয়ে সবসময় পরিস্কার করে রাখত। উঠোনের পাশে একটা আমড়া গাছ ছিল। তার পাশে একটা তুলশী মঞ্চ। তুলশী মঞ্চের পাশে আমাদের বাড়ির টালির ছাউনিটা এসে শেষ হয়েছিল। আর সেখানে বন-তুলশী গাছের একটা ঝোপ হয়েছিল। আমার একটা জুতোর বাক্সয় প্যান্ট ছেঁড়ার বিছানা করে রেখেছিলাম টুন্টুনির ছানাটাকে। মা টের পায়নি। ছাতুর গুলি করে খাইয়েছিলাম সেই রাতে।
পরদিন সকাল থেকে মা’কে মাঝে মাঝেই হেই হেই করে চিৎকার করে উঠতে শুনলাম। মানে একেবারে ভোরবেলা থেকে। ঘুম থেকে উঠে চুপি চুপি গিয়ে দেখে এলাম । ছানাটা নিজের জায়গায় ঠিক আছে। আর বাড়ির উঠোনে, দাওয়ায় সেই মা টুনটুনি ঘোরা-ঘুরি করছে। মা চেঁচিয়ে বলল “ এটাকে তাড়া কর তো। একটা বিস্কুট ভেঙ্গে দিলাম, খেল না। খালি ঘরে ঢুকে যাচ্ছে।“ সেই দিনটা সারাদিন মা টুন্টুনিটা আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে নড়ল না। একবার দুবার হয়ত বাসায় গেছিল। বাকি সারা দিনটা আমাদের বাড়িতে ধর্না দিয়ে পরে থাকল।
আসলে তখন বুঝিনি কেন সে সারাদিন আমাদের বাড়িতে ধর্না দিয়ে পড়েছিল। খুব রাগ হয়েছিল ওঁর উপর। একবার একটা কাঠের টুকরো ছুঁড়ে মেরেও ছিলাম। লাগে নি। তার জন্য ভগবানের কাছে অনেক বেশি কৃতজ্ঞ আমি। উড়ে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বসল সে। সন্ধের দিকে চিঁ চিঁ ডাকটা শুনে মায়ের কাছে ধরা পরে গেলাম। মা টুনটুনি তখনও আমাদের উঠোন ছাড়েনি। সেই সন্ধেতেঁই মা হাতে করে দিয়ে এসেছিল ছানা টুনটুনি টাকে তার নিজের বাসায়। আর বুঝেছিল কেন মা টুনটুনি সারাদিনটা আমাদের ঘরে পড়েছিল। খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল “ কাউকে তার মা-বাবার থেকে আলাদা করতে নেই সোনা। তোকে যদি আমাদের থেকে কেউ আলাদা করে দেয়। নিয়ে চলে যায় তার বাড়ি। তোর কষ্ট হবেনা? আমার কষ্ট হবেনা?” উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। কিন্তু আজ বুঝি সেদিনের সেই কথাটার মানে। কারণ, আজ আমি একজনকে নিয়ে এসেছি তার মা-বাবার থেকে আলাদা করে। আর কিছুদিন পর আরও একজনকে আমার থেকে আলাদা করে নিয়ে যাবে অন্য কেউ। কিছুই করতে পারবনা আমি।
আমার লেখা ভালো লাগলে আমার ব্লগ থেকে ঘুরে আসবেন।
ছত্রাক রাজকুমার লিখে সার্চ করলেই পাবেন।