এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • ভাঙনের জয়গান গাও

    Abhishek Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ১৯ মার্চ ২০২১ | ১২২৫ বার পঠিত
  • নচিকেতা অনেকক্ষণ ধরেই খেয়াল করছিল ব্যাপারটা। ছোট ছেলে, কিন্ত কী টনটনে জ্ঞান তার। অনুভূতির সূক্ষতায় বুঝে নিয়েছিল, এটা ভাল দেখায় না। ঋগ্বেদে দানের প্রশংসা করে এত কথা বলেছে, আর এখানে কী না এই! কী অন্যায় কথা। বুড়ো-হাবড়া কিছু বলদ আর গরু জুটিয়ে এনে দান করা হচ্ছে। ভিখারীকে অচল টাকা দেওয়ার মত। অথচ দেখ, এই গরু কেনার জন্য তো একটা অর্থের সংস্থান আছে। সেখান থেকে পয়সা বাঁচিয়ে শীর্ণকায় হাড় জিরজিরে তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা পশুগুলোকে দান করার অসহ্য একটা নাটক হবে এর পরে। গাছতলায় ঐ যে দরিদ্র ব্রাহ্মণ দূর থেকে এসেছেন একটা দুগ্ধবতী গাভীর আশায়, এরকম আরো তো অনেকে আছেন। এটা তাদের সঙ্গে তঞ্চকতা ছাড়া আর কি? ঐ ব্রাহ্মণ তাঁর অসুস্থ পুত্রের পথ্যের জন্য এই দান স্বীকার করতে এসেছেন। কবিরাজ বলে গেছেন, যক্ষ্মা। মন্ত্র পড়ে বিশেষ কিছু হবে না। দুবেলা খাঁটি দুধ খাওয়াতে হবে। ছেলেটা হয়ত তারই বয়সী বা....

    বাজশ্রবা সেদিন খুব ব্যস্ত। রাশভারী লোক। সকলে তাঁর কথায় তটস্থ। শুধু ঠ্যাঁটা ছেলেটার কোনও ভয়ডর নেই। জ্বালিয়ে খেল আর কী। শিশু মনস্তত্ত্ব তিনিও খানিক বোঝেন। একেই আজ বিশ্বজিৎ যাগের শেষে দানানুষ্ঠান সম্পন্ন করার তাড়া, তার ওপর হতচ্ছাড়া ছেলেটা বলে কি, "আমায় কাকে দিচ্ছ?" ইচ্ছা করে দিই দু'ঘা, ইয়ার্কি হচ্ছে। আজকালকার ছেলেদের গুরুলঘু জ্ঞান নেই, এত বিরাট যজ্ঞ আর দান সম্পন্ন হচ্ছে, কে কী করছে কখন তার খেয়াল রাখতেই প্রাণ ওষ্ঠাগত, আশ্রমের সকলে তাঁর কথা শোনে না সে তিনি বেশ বোঝেন। কলিযুগ আসন্ন আর কী। তার ওপর এই নচিকেতা সকাল থেকে ঘ্যানঘ্যান করেই যাচ্ছে। এর মধ্যেই দু দুবার বলেছে... "আমায় তবে কাকে দিচ্ছ গো?"

    একটা শীর্ণ গাভীর দড়ি খুলে হাতছানি দিয়ে ব্রাহ্মণকে ডাকা হল। বয়স হয়েছে মানুষটার। বিশ্বজিৎ যাগে ইনি প্রচুর পরিশ্রম করেছেন। আশ্রমের সব ঋষি এসব করতে জানেন না। তাই আউটসোর্সিং করতে হয়। না হলে দানসামগ্রী আশ্রমেই থেকে যেত। এখন ঠ্যালা সামলাও। এতগুলো লোক বাইরে থেকে ডেকে এনে গচ্চা দেওয়া। বাজশ্রবা মুখে হাসি ধরে রেখে ব্রাহ্মণকে বললেন... "ভোঃ ব্রাহ্মণ! স্বীয় দান পরিগ্রহ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।" বাজশ্রবা ঋষিসুলভ প্রশান্তি আর মুখে মিষ্টি হাসি ধরে রেখেছেন। হঠাত্ কোথা থেকে হতভাগা নচিকেতা এসে বলল.... "পিতা! আমাকে তাহলে কাকে দিচ্ছেন?" ঐটুকু ছোট ছেলের গলায় শ্লেষের সুরটুকু ধরতে পারলেন না প্রবাদপ্রতিম ঋষি। আবার? বারবার তিনবার। মাথায় আগুন জ্বলে উঠল তাঁর। বলে উঠলেন, "হতভাগা! তোকে যম কে দিলাম।"

    সূর্য কি নিবে এল? হাওয়ার গতি বাড়ল বুঝি খুব। প্রলয় আসবে নাকি? কখন মরণ আসে কে জানে, কালিদহের আকস্মিক ঝড়ের মত...

    সিদ্ধার্থ তাড়াতাড়ি পা চালালেন। বেলা ফুরিয়ে গিয়ে রাত নেমেছে অনেকক্ষণ, রাত্রির দ্বিতীয় প্রহর এখন। দিনগুলো যেন জন্মের পর মরণ, পুনর্জন্ম, নিরবচ্ছিন্ন একেকটা দিবারাত্রির কাব্য। বেদ-বেদাঙ্গ দর্শন আর শাস্ত্র তিনি বহু পড়লেন এই বয়সেই। এই যজ্ঞকেন্দ্রিকতা আর নিঃশ্রেয়সের, আত্মসমর্পণের দার্শনিক উদ্ভাস মানুষকে কোন্ আত্মাহূতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে? কঠোপনিষদের নচিকেতার কাহিনী তো যজ্ঞের বিরুদ্ধেই যেন এক প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ। দান পূর্ণ, যথার্থ ও সফল না হলে তো যজ্ঞের ফল অধরা থেকে যায়? এই আড়ম্বরপূর্ণতার বাইরে বেরোতেই হবে, বাহ্যিক ও আন্তরিকভাবে। জীবনবোধকে করতে হবে সরল, জীবনাচরণ হবে আড়ম্বরবিহীন। পিতা শুদ্ধোদন এই সেদিনই এক বহুব্যয়সাধ্য যজ্ঞ সম্পাদন করলেন। এই অর্থ যদি মানবকল্যাণে ব্যয়িত হয় তা কি যথার্থ হয় না?

    সিদ্ধার্থের চোখে ঘোর লাগে। তাকে গৃহপাশে আর মোহে বদ্ধ করতে পিতা কী আপ্রাণ প্রয়াস করেছেন। জননী অষ্টপ্রহর শঙ্কিত থাকেন। কিন্তু এ ছেলে তো সংসারী নয় মোটেই। সিদ্ধার্থ বুঝতে পারেন না কেন জরাগ্রস্ত মানুষ আর মৃতদেহ তার চোখে সেদিন অলৌকিকভাবে ধরা দিল। তিনি তো জানেন পিতা কী তৎপরতায় তাঁর উপবনে যাওয়ার পথকে নিষ্কণ্টক করেছিলেন সেদিন। কিন্তু এভাবে কি জরা, ব্যাধি আর মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে? এমন কোনও গৃহ আছে যেখানে কোনোদিন মৃত্যুর পদপাত ঘটেনি?

    সিদ্ধার্থ একবার ফিরে চাইলেন। ছন্দক, প্রাণপ্রিয় ছন্দক দৃষ্টিপথের বাইরে বিন্দুবত্ হতে হতে দিকচক্রবালে মিশে গেছে। যশোধরা.... রাহুল... সিদ্ধার্থ মন শক্ত করলেন। একটা সত্যবোধ কিছুদিন তাঁর সত্তা ও ভবিষ্যৎকে গ্রাস করছে। অনিবার্য হয়ে উঠছে ক্রমে ক্রমে। জগত্ চিরদুঃখময়। জগৎ জুড়ে আনন্দপ্রবাহ অনুভূত হয় বটে, উপনিষদ বার্তা বহন করছে চির আনন্দের, কিন্তু জন্ম-মরণের নিরন্তর চক্রকে ছিন্ন করতে পারছে সাধারণ মানুষ? মুমুক্ষার বোধ কি এতই অনায়াসবোধ্য? বাস্তবের দুঃখরাজি, অন্নের প্রয়োজন, অন্নাভাবের হাহাকার, শোক ব্যাধি জরাই তো সারসত্য হয়ে ওঠে। বেদের ছত্রে ছত্রে তো অন্নের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা, জাগতিক ধনলাভের অভিপ্রায়, তাকে তুচ্ছ করে কোন্ পরমধনের ব্যঞ্জনা? জগত দুঃখময়, দুঃখের কারণ আছে.... কামনা আর মোহপাশ। দুঃখ থেকে মুক্তিলাভের উপায়? আছে। তার জন্য কিছু অনুশাসন অনুসরণ করতে হবে, করতে হবে অনুশীলন।

    সিদ্ধার্থ অনন্তে পা বাড়ালেন। জগতের আনন্দযজ্ঞে তাঁর ডাক এসেছে। যখন বৃহতের আহ্বান আসে, ক্ষুদ্র খড়কুটোর মত ভেসে যায়।

    মৃত্যুঞ্জয়ী নচিকেতা অন্ধ তমিস্রা ভেদ করে আলোকবৃত্তে এসে দাঁড়ালেন। পশ্চাতে দূরবিসারী দিগন্ত, পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্রালোক জগত্কে আপ্লুত করছে। অমিতাভের অমিতবিত্ত নির্মল জ্যোতিতে জগত্ আজ প্লাবিত। নচিকেতা অস্ফুটে বললেন.... "বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহার/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও" ... বুদ্ধদেব সস্মিতে দূরের সাগরপানে স্বপ্নাচ্ছন্ন দৃষ্টি বিস্তার করে স্বগতস্বরে বলে উঠলেন... "কালসমুদ্রে আলোর যাত্রী, শূন্যে যে ধায় দিবস-রাত্রি/... বাঁধন ছেঁড়ার সাধন হবে,/ছেড়ে যাব তীর মাভৈঃ-রবে"।

    ©️অভিষেক ঘোষ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন