এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • দ্বীপের খোঁজে

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ০৯ মার্চ ২০২০ | ১৪৮৬ বার পঠিত
  • মাঝনদীর ভরাট জলে দুলছে নৌকো। মেয়ে পুরুষ কাচ্চা বাচ্চায় ঠাসাঠাসি নৌকো।চৈত্রের দুপুর। উবু হয়ে বসে আছে সব। শুধু দুধের শিশুরা মায়ের কোলে। কোনটা আঁচলের তলায় হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। কোন কোন ক্ষুদে মায়ের কোলে সেঁটে থেকে কুততুত করে তাকিয়ে দেখছে প্রবল জলরাশির অনর্গল বয়ে চলা। ওকূল থেকে তাড়া খেয়ে কোনরকমে মাঝরাতে ডিঙি বোঝাই করে ভেসে পড়েছে দল বেঁধে আর এক কূলে গিয়ে ভেড়ার আশায়। আপন প্রাণ বড় প্রিয় জিনিস। কজনা খুবলে খাওয়া শরীর নিয়ে পড়ে রইল ওপারে, কয়জনা বা বেপাত্তা, বেমালুম গায়েব, হিসেব রাখার ফুরসৎ নেই। বুড়ো থেকে বাচ্চারা কি খাবে, কোথায় গিয়ে ভিড়বে কিছু জানা নেই কারো। খাবার জল পর্যন্ত তোলার সময় হয়নি নৌকোয়। শুধু ওই সাতবুড়োর এক বুড়ো একমুখ সাদা দাড়ি ভরা মামুটি বুড়ো নাকি ও..ই সেদেশে কোন এক ডাঙার হদিশ জানে। সেখানে নাকি বন্দুক ধরে বিবি বেটির ইজ্জত নেয় না, চরে নৌকো ঠেকনা দিলেই গুলি করে মারে না পাগলা কুত্তার মতো।
    রাত পেরিয়ে সকাল হল। সকাল বয়ে গিয়ে দুপুরবেলা এল। সূয্যির আলো গাঙের জলে পড়ে ঝিকমিক করতে লাগল। জলের পিঠের ওপর এলেমেলো তাপ বয়ে বেড়াতে লাগল চৈত্রের হাওয়া। নৌকোর মরদ জেনানা বেশ কজন চোখের ওপর হাত দিয়ে রোদ্দুর আড়াল করে অনেক দূরে ডাঙা ঠাওর করতে লাগল । কালচে সবুজ মতো গাছপালা দেখা যায় যেন।
    মামুটি বুড়ো খ্যানখেনে গলায় হঠাৎ হাঁক দিয়ে উঠল, থেম না বাবাসকল থেম না মোটে। বরাবর টেনে যাও..... আর মেলা বাকি নেই... এই এসে পড়লাম বলে....
    দুটো কোলের বাচ্চা হঠাৎ ঘ্যানঘ্যান করতে শুরু করল।ক্ষিদের জ্বালায় বোধহয়। রোদের তাপেও হতে পারে।মায়েরা আঁচল আড়াল করে স্তনের বোঁটা গুঁজে দিল ওদের মুখে।
    একটা সতের আঠের বছরের মেয়ে হঠাৎ খুনখুন করে কাঁদতে আরম্ভ করল হাঁটুতে মুখ গুঁজে।পরিবারের সবাই সাফ হয়ে গেছে ওর।বাবা মা ভাই বোন সবাই। নিজের বলতে কেউ নেই এখন আর।সে যে বেঁচে গেল কিভাবে তা ওপরওয়ালাই জানে। সে নিজেকে অভিশাপ দিচ্ছে দিনভর। বুকের মধ্যে মাঝেমাঝেই ছোবল মারছে যন্ত্রনা। নৌকো বোঝাই লোকের অবশ্য এ সব ঘ্যানঘ্যানানিতে নজর দেবার সময় নেই। তারা শুধু দল বেঁধে পা রাখার একটা ডাঙা খুঁজছে। শুধু বুড়ো মামুটি একবার বলল, ‘কাঁদ না...কাঁদ না....আমরা সকলে আছি’। পাশ থেকে কে একটা বলল, ‘ হ ...হ..’।
    খালি গায়ে দরদর করে ঘামতে ঘামতে দুটো কালোকোলো জোয়ান ছেলে দাঁড় টেনে চলেছে।পালা করে দুজন দুজন করে একটানা টেনে যাচ্ছে সারাক্ষণ।

    সন্ধের ঝোঁকে নৌকো গিয়ে ঠেকল ডাঙার ধারে। ঘুমন্ত আলো হেলে পড়ছে আকাশ জুড়ে। নদীতে ভরা জোয়ার এখন।জনমানবশূন্য নদীর পাড়। ঝিঁঝির ডাকে ভরা বাতাসে কেমন ছমছমে আশপাশ।
    বছর তিরিশের একজন অন্তসত্ত্বা রয়েছে। তাকে ধরাধরি করে ডাঙায় তুলল কজনে মিলে।আজ কালই প্রসব হবে বোধহয়। মুখে বড় কষ্টের ছাপ। পরিবার বলতে কেউ নেই। স্বামী গুলি খেয়ে মরেছে।
    টুপ করে আঁধার পারে ডুব দিল সূয্যি। ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে ঢেকে গেল দ্বীপ।
    মামুটি বুড়ো বলল, ‘ যার যা আছে তা দিয়ে আলো জ্বাল... আলো জ্বাল .... এত আঁধার সহ্যি হয় না মোটে...’
    প্রকৃতির নিয়ম মেনে একসময়ে আঁধার কেটে গিয়ে আলোর কুসুম ফুটল আবার। নদীর জল চিকচিক করতে লাগল।ত্রিসীমানায় লোকজন নজরে পড়ছে না। আকাশে চক্কর মারছে চিল। গাছগাছালিতে কিচিরমিচির করছে কত পাখি। ওই দূরে দুটো নৌকো দেখা যাচ্ছে। স্রোতের টানে তরতরিয়ে ভেসে আসছে এদিক পানে।
    পোয়াতি মেয়েটার প্রসব কষ্ট উঠল। ছটফট করছে। তিনজন মহিলা ওকে ধরাধরি করে একটা বট গাছের আড়ালে নিয়ে গেল।
    মামুটি ভাবে তার জীবন তো শেষ হয়ে এল। এই তরতাজা লোকগুলো কি বাঁচার মতো কূল পেল একটা ? কে জানে ! এখন পর্যন্ত তো এ দ্বীপে বন্দুকধারি পাহারাদার কাউকে দেখা গেল না। এখানেও বন্দুকের নলের মুখে পড়তে হবে নাতো তাদের ! বুড়ো
    মামুটি আনমনে তাকিয়ে থাকে নদীর ঘোলাটে স্রোতের দিকে।
    নৌকো দুটো ক্রমেই কাছে চলে আসছে। এখানে ভিড়বে না মনে হচ্ছে। ওই দূর কোন গাঁমুখো ওরা।

    মিনিট দশেক পরে বটগাছের আড়াল থেকে পাখির কাকলি পারা ভূমিষ্ঠ শিশুর বুকের হাওয়া মেশানো কান্না বয়ে এল বাতাসে....চমকে উঠল সবাই।
    নৌকো দুটো খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে। ওদের একটা নৌকোয় একটা বাউল দোতারা বাগিয়ে গলা ছেড়েছে ....
    মুর্শিদ যার সহায় তার কিসের ভাবনা.....আমার হৃদয় মাঝে কাবা আর... নয়নে মদিনা....
    মামুটির চোখ জলে ভেসে যায়। ভাবে, মুর্শিদ কি কোনদিনও তাদের সহায় হবে !
    চিলেরা আকাশে চক্কর মেরেই যাচ্ছে ।
    ****************************
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে প্রতিক্রিয়া দিন