এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • এলেবেলে চাট্টি কথা

    Anjan Banerjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ | ১৩৮৬ বার পঠিত
  • শহীদ মিনার
    ************

    বাবুমশায়দের পেন্নাম । মা জননীদের গড় করি।আজ্ঞে আমার নাম গণেশ হাঁসদা। মাঠের ওপারে ওই কুঁড়েটায় আমি থাকি । ছিটবেড়ায় মাটি লেপা । পচা খড়ের ছাউনি। তেমন বরষা হলে জল বাঁধে না। ঘর ভেসে যায়। আর ঘরে আমার কি বা আছে। একটা ছেঁড়া চাটাই – খেজুর পাতার, আমি নিজেই বুনেছিলাম। একটা মাটির হাঁড়ি। খুব সাবধানে নাড়াচাড়া করি। ভেঙে গেলে মুশকিল। ওটাতেই ভাত রাঁধি কিনা। যেদিন চাল জোটে আর কি। রোজ তো আর জোটে না। আর একটা টিনে র শানকি আছে। ভাত জুটলে ওটায় ঢেলে খাই। কখানা ইঁট জোগাড় করে রেখেছি। ওগুলো দিয়ে ঘেরো করে মধ্যিখানে শুকনো ডালপালা জ্বেলে ভাত আর শাকপাতা ফোটাই । মাঠঘাট ঘুরে শাকপাতা উপড়ে আনি। রাত্তিরবেলায় পুকুরে গলা জল তক নেমে শাপলা তুলি। নুন জোটে না। নুন কেনার খ্যামতা নেই গ বাবু। একটা দেশলাই বাস্কের দাম একটাকা। অনেক দিন ধরে চালাতে হয় একটা বাস্ক। সাবধানে কাঠি খরচা করতে হয়। কাঠি নষ্ট হলে বড় জ্বালা। ওই ওদিকে – অ-ই পশ্চিম দিকে বামুন পাড়া কায়েত পাড়া । ওনাদের ক্ষেতে মুনিশ খাটি । ওনাদের মধ্যে একজন মাসে একটা করে দেশলাই বাক্স দেয় । আলগোছে হাতে ফেলে দেয় বাড়ির গিন্নী । দয়ার শরীর ওনার। খানিক নুনও দেয় মাঝে মাঝে । ওনারা কেউ ছোঁন না। ছায়াও মাড়ান না। আমিও খুব সতক্ক থাকি। নিচু মনিষ্যি আমরা। কত জম্মের পাপী। আমাকে ছোঁয়া ছুঁয়ি করলে ওনাদের পাপ লাগতে পারে বইকি। তা যাকগে…।

    ও , হ্যাঁ । আমার সঙ্গে আরও দুটো প্রাণী আছে। আমার ছেলে শম্ভুনাথ। পাঁচ বছর বয়স। খুব এস্পারট বুঝলেন না ! এই বয়সেই সাঁতারে দড়। গাছে উঠতেও ওস্তাদ। আম জাম তো ওই পাড়ে। সেটাও অবশ্য খুব সাবধানে । বাবুরা দেখতে পেলে ধরে আড়ং ধোলাই দিয়ে হাত পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলে রাখবে চড়চড়ে রোদ্দুরে সারাদিন। হাতে পায়ে ধরে কান্নাকাটি করলে , নাকখত দিলেও রেহাই নেই। সত্যিই তো ওনারা গেরামের প্রভু । আমরা হলাম গিয়ে ভগমানের উচ্ছিষ্ট ।

    আর একজনও আছে আমার- ছোটু । ছোটু হল একটা টাট্টু ঘোড়া । বাদামি রঙ, চকচকে গা – মদ্দা ঘোড়া । ঘাড়ে চামরের মত কেশর। মালিক বোধ হয় ছেড়ে দিয়েছে খোরাকিতে আর পোষাচ্ছে না বলে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার কুঁড়ের সামনে একেবারে ছবির মত থির হয়ে দাঁড়িয়ে । কাছে যেতে একেবারে বাধ্য ছেলেটির মত বুকের কাছে ঘেঁষে এল। বড় মায়া হল। সেই থেকে এখানেই থেকে গেল। ওর তো খোরাকি কিছু নেই। মাঠে ঘাটে চরে খায়। ওর মালিক ওকে ছাড়ল কেন কে জানে। সুয্যি ডুবলেই ফিরে আসে। সারারাত ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে আমার কুঁড়ের মধ্যে । বাইরে রাখতে ভরসা পাইনা। হায়েনা আছে, শেয়াল আছে, মাঝে সাঝে বাঘের ডাকও শোনা যায়। ঘোড়াটা শম্ভুর বড় ন্যাওটা। শম্ভুও ঠি ক তাই। ছোটুকে দেখে মনে হয় দুটো হাত থাকলে শম্ভুকে কোলে নিয়ে ঘুরত। মাঝে মাঝে ছোটু শম্ভুর গাল চেটে দেয়। মুখের ওপর নাক ঘষে। নাক দিয়ে একরকম নিঃশ্বাস বেরয় ওর । ওটা মনে হয় ভালবাসার নিশ্বেস প্রশ্বেস। শম্ভু কখনও ওর পিঠে চাপে না। বনে বাদাড়ে পায়ে পায়ে ঘোরে ছোটুর সাথে সাথে। ছোট মত দেখতে বলে ওর নাম রেখেচি ছোটু ।

    মুরারি আর বরন্তি দুই পাহাড়ের মাঝে বরন্তি নদীতে বাঁধ পড়েছে। উঠেছে বরন্তি ড্যাম। জেগে আছে শাল শিশু সেগুন আর পলাশে ঘেরা আমাদের এই আদিবাসী গ্রাম। ফাগুন চোত মাসে রুখা বরন্তি রেঙে ওঠে পলাশের আবীরে। লাল মাটির পাশে সবুজ ধানখেত। ধানখেতের ওপারে চার্চের জমি । সেন্ট টমাস চার্চ । বেশ বড় সড় ইমারত বাবুমশায়েরা। জমির চারপাশে দেড় মানুষ সমান লোহার রেলিং। গেট খুলে ভেতরে গেলে বেশ শান্তির পরশ লাগে যেন। পুব দিকে শাল সেগুনের বনের মাথা টপকে সুয্যির আলো পড়ে চার্চের দুধসাদা দেয়ালের গায়ে।

    ওখানে লটকানো ঈশাই বাবার ছবি। ছবির নীচে লেখা, ‘হে ভারাক্রান্ত ও পরিশ্রান্ত পথিকেরা আমার নিকট আইস , আমি তোমাদিগকে বিশ্রাম দিব। ‘ এটা ভবানীবাবুর কাছে শোনা। ভবানীবাবু হলেন কালেক্টর সাহেব। গুনী মনিষ্যি। তার কথা আজ থাক।

    এ একেবারে গন্ডগ্রাম বাবু। এখানে আপনাদের মোবিল বাজবে না বাবু। টাওয়ার নেই। ওই নদীটা পেরিয়ে নিদেন আরও দু ক্রোশ গেলে ওই বাস রাস্তার ওপর উঠলে তবেই টাওয়ার পাবেন ছ্যার। আগ্যা , কি বললেন , শম্ভুর মা কোথায় ? আগ্যা, মা ছিল ছ্যার- নাম ধিরা। একজনের সঙ্গে ভেগে গেল। ছেলের তখন মাত্তর তিন বছর। লোকটা সকাল সন্ধে এই আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকত। আমি বোকা গবেট। বুদ্ধি সুদ্ধি তেমন নেই । একদিন পরেশ ঘোষের খেতে সারাদিন মাটি কুপিয়ে সন্ধেবেলায় ঘরে এসে দেখি ধিরা আর নেই। সেদিন থেকে ওই আমগাছতলাতেও কোন মনিষ্যি নেই। ছেলেটা তো অবোধ শিশু। কদিন মাকে না পেয়ে খুব কাঁদত। তারপর থেকে আমিই ওর মা আমিই ওর বাবা। এইভাবে আরও বছর দুই কাটল। সময় তো আর বসে থাকে না বাবু। দিন গড়িয়েই যায়। মুখ্যু মানুষ, আমি আর কি বলব আপনাদের মতো গুণীজনেরে।

    ওই যে বাস রাস্তার কথা বললাম, ওর ধার ঘেঁষে অনেক দোকান বাজার আছে। তিনটে পার্টি অফিসও আছে। মানে এক এক পার্টির এক একটা। ওখান থেকে লোক আসে গেরামের ভেতরে। কত কাজ থাকে ওনাদের। ভোটের কার্ড , রেশন কার্ড, বি পি এল কারড... আরো কত কি। আমাদের কেউ ছোঁয় নি এখন পর্যন্ত । আমাদের ছুঁলে যে জাত যাবে বাবু।

    তবে ধরুন, এই দিন পনের আগে ওরা জনা দুয়েক আমার কুঁড়ের সামনে এসে ডাকাডাকি করতে লাগল। আমি ওদের দেখে চিনতে পারলাম । বামুন পাড়া কায়েত পাড়ার ছেলে। কি সুভাগ্যি আমার । এ গেরামে আমার চোদ্দ পুরুষের এ ভাগ্যি হয় নি বাবুমশায়েরা , এই যে বামুন কায়েতের ছেলেরা আমার মতো অজাত কুজাতের লোকের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার ঠাকুরদাকে এরা জ্যান্ত পুড়িয়ে মেরে ফেলেছিল। তা, তেনার দোষ তো কিছু কম হয়নি। ভবানীপ্রসাদ মুখুজ্যের বাগানে জামরুল গাছে উঠে চাড্ডি জামরুল তুলেছিল। বড় খিদে পেয়েছিল অনুমান করি। বুঝতে পারি, কারণ এমন খিদে তো আমারও পায়।

    সে যাই হোক, একটা রোগাপানা গুঁফো ছেলে বলল , ‘ তোরা ক’ জন ?’
    - ‘ আগ্যা , তিনজন ‘
    - ‘ নামগুলো বল ‘
    - ‘ আমি গণেশ ... ‘
    - ‘ আরে দূর... পুরো নাম বল ...’
    - ‘ আগ্যা, আমি গণেশ হাঁসদা । আমার দুই ছেলে শম্ভুনাথ আর ছোটু । ওই যে ওখানে খেলছে একজন। ও-ই যে আমগাছের পেছনে... আর একজন।‘
    - ‘ কই ...ওখানে তো কেউ নেই...’
    - ‘ আগ্যা, আছে বাবু। ওই যে, ঘাস খাচ্ছে ঘোড়াটা... ও হল ছোটু।‘
    - ‘ আ...রে ধুসস , ফালতু কথা যত... এই জন্যি তোদের কিস্যু হয় না। ‘
    - ‘ শোন তোদের ভোটের কাট, বি পি এল কাট সব হবে।‘
    - আগ্যা, কি হবে বললেন ?’
    - ‘আ-রে , ভোটের কাট, বি পি এল কাট। তোদের দুজনেরি হবে। ‘
    - ‘ কিন্তু বাবু আমাদের তো কেউ ছোঁয় না গেরামে। বউ চলে যাবার দোষে আমরা প্রায় একঘরে। তাছাড়া, ছেলের বয়স তো মোটে পাঁচ। ও কি করে ভোট...।‘
    - ‘ ওসব তোকে চিন্তা করতে হবে না। ওসব আমরা বুঝে নেব...’

    মাঝপথে ওর কথা থামিয়ে দেয় গুঁফোর সঙ্গে কালোমতো মোটা সোটা যে ছেলেটা ছিল সে। বলে, ‘ আর হ্যাঁ, শোন । কাল তোদের কলকাতায় যেতে হবে... রেলি, মানে, কি বলে মিটিং ... ওই সভা ... সভা আছে। সবাই যাবে। তোরাও যাবি। বাস ঠি ক করা আছে। সবাই যাবে , কেউ বাদ নেই। সব যাবে, ঠি ক দশটায় বাসে উঠবি।

    আগ্যা বাবুরা, এসব শুনে আমি খুব আতান্তরে পড়ে যাই। শম্ভু একরত্তি ছেলে। এসব দেখেনি কোনদিন। আমি তবু একবার কলকাতা দেখেচি। আমার তখন বছর দশেক বয়েস। কিন্তু শম্ভু কলকাতার ধুন্ধুমার দেখে বড় ঘেবড়ে যাবে যে। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে তো কেউ মেশে না। ছোঁয় না।

    ‘ বললাম তো ‘ , গুঁফো লম্বা ছোকরা আবার বলে- ‘ওসব চিন্তা করিস না। আমরা সব দেখব...’ । আর কথা না বাড়িয়ে তড়িঘড়ি হাঁটা দেয় দুজনে বাসরাস্তার দিকে।

    বিপদের কথা কি বলব বাবু, সেদিন রাতেই বড় জ্বর এল শম্ভুর। একটা ছেঁড়া খোঁড়া কম্বল ছিল। বছর দশেক আগে পুজোর সময় দীন দুখিদের বিলিয়েছিল মুখুজ্জেরা। আমিও পেয়েছিলাম একখানা। সেটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিলাম। ছেলেটা জ্বরের ধকে গোঙাতে লাগল। পুকুর থেকে তুলে আনা জল – যেটা হাঁড়িতে রাখি, সেটা ঢালতে লাগলাম শম্ভুর মাথায়। কুপির তেল কেনার পয়সা নেই বাবু। সুয্যি ডুবে গেলে ঘর একেবারে ঘুটঘুটি আঁধার। আঁধার ঘরে ছোটু খাড়া হয়ে আছে । পটপট করে আওয়াজ উঠছে। গা ঝাড়া দিচ্ছে বোধ হয় মশার জ্বালায়।

    শম্ভুর মাথায় ঢালা জলে মাটির মেঝে গলে যাচ্ছে। কি করা যাবে। কোনরকমে হেথায় হোথায় হাতড়ে একটা ধুলোমাখা মোমবাতি খুঁজে পেলাম। দেশলাই বাস্কোয় পাঁচটা কাঠি আছে আর। একটা দিয়ে বাতিটা জ্বালাই। জল ঢালতে ঢালতে শম্ভুর গোঙানিটা কমে কমে আসে । চোখ বুজে আছে অচেতন হয়ে। খুব ভয় করছিল আমার। ওর যদি মা থাকত এখন ,ওর কি এমন দশা হত ! কষ্টে বুক আমার ভেঙে যাচ্ছিল বাবু ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে । আমি ওর পাশে উবু হয়ে বসে ভগমানকে ডাকতে লাগলাম। ভগমান ছাড়া আর আমাদের কে আছে ! শম্ভুর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম। তাপ একটু কমেছে মনে হল। খুব ঘুম ঘুমোচ্ছে। ওর এরকম হর মাসে নিদেন একবার করে হয়। আপনাআপনি কমে যায়। কমে যায় মা শেতলার দয়ায়। না কমলে আমি কি করতাম বাবুমশায়েরা ! ডাক্তার, ওষুধ ওসব কি আমার কম্ম বাবু। জানিনা এভাবে কতদিন বাঁচাতে পারব ছেলেটাকে। যখন ভাল থাকে বনে বাদাড়ে কত ছুটে ছুটে বেড়ায় একা একা। ওর তো কোন সাথী নেই ছোটু ছাড়া। মাথা ভরা চুল। হাসি হাসি চোখমুখ। এত কষ্টেও কেমন হাসি হাসি। ওপরের পাটির দুটো দাঁত পড়েছে। এখনও যায়গাটা ফাঁকা। এখান থেকে সেখান থেকে রঙ বেরঙের বুনো ফুল তুলে এনে বলে – এই দেখ বাবা কি এনেছি । ফোকলা দাঁতে দেবতার মতো হাসে। কষ্টে আমার বুক চিন চিন করে। যদি ওর মা থাকত ও আরও কত আনন্দে থাকত। নাইয়ে খাইয়ে, আঁচিয়ে ,কাপড়ের খুঁট দিয়ে মুখ মুছিয়ে আমিই ওর মার কাজ করি।

    পরদিন সকালে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । দেখলাম শম্ভু উঠে বসেছে। এখন আর তাপ নেই মনে হয়। মনে শঙ্কা হতে লাগল আবার বিকেলে না ফিরে আসে জ্বরটা। এভাবে আমি কতদিন বাঁচাতে পারব ছেলেটাকে ! শেষমেষ রাত পুইয়ে ভোর হয়ে গেল। আজ আবার কলকাতায় মিটিং, মানে রেলিতে যাবার দিন। ছেলেটা অঘোরে ঘুমোচ্ছে। ছোটু ওই বাবলা গাছটার নীচে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে মাঝে মুখ নীচু করে ঘাস খাচ্ছে।

    বেলা দশটা হতে চলল। মিটিং –এর লোক তোলার বাস দাঁড়িয়ে আছে মাঠের ওধারে। শম্ভুর গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম তাপ নেই। বুকে হাত রেখে বললাম, শম্ভু... ও শম্ভু... বাবা, বাপধন আমার। শম্ভু উঁ উঁ ... করে আধবোজা চোখে আমার কোলের কাছে গড়িয়ে এল। আমার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজে শুয়ে রইল। তবে হ্যাঁ, স্বস্তি এই যে গায়ে আর তাপ নেই। কি স্বস্তি যে হল বাবুমশায়েরা, মা জননীরা। যার কেউ নেই তার ভগমান আছে , তাই না ছ্যার ?

    ************ **************** ***************

    শম্ভুকে হাঁটাতে ভরসা পেলাম না। কাল রাতে অত জ্বর গেল । কোলে করে নিয়ে ওই মাঠ পেরিয়ে কাঁচা রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা বাসে গিয়ে উঠলাম। পাঁচ ছটা বাস দাঁড়িয়ে আছে লাইন দিয়ে।পাটির লোকজন তদারকি করছে। ওদেরই একজন বলল , ‘ এই যে এদিকে ওই তিন নম্বরটায় ওঠ।‘

    একটা সুবিধে হল যে, এই বাসটায় জেলেপাড়ার, বাগদী পাড়ার লোকজনে ভরতি। হাড়ি আর মোছলমান পাড়ারও অনেকে রয়েছে দেখলাম। এট্টু সুবিধে হল তাতে। ভদ্দরলোকের পাড়ার কেউ নেই। ওরা থাকলে ছিটে বসতে দিত না। শম্ভুকে কোলে শুইয়ে কোনরকমে বাসের এক কোনে ঠাঁই পেলাম। তা, ধরুন বাস চলল আন্দাজ সাড়ে তিন ঘন্টার মতো।

    এখন বেলা দুটো। গড়ের মাঠ। আমার পাশে উবু হয়ে বসা একজন ভিনগাঁয়ের লোক বোধহয়, ডানদিকে তাকিয়ে বলল, ‘ এই যে, এরে বলে শহিদ মিনার। শম্ভু আমার গায়ে হেলান দিয়ে মাটিতে থেবড়ে বসে আছে । সে মুখ ঘুরিয়ে চোখ তুলে তাকাল ডানদিকে। ফোকলা দাঁতে হেসে বলল, ‘ কত উঁচু , দেখ, বাবা দেখ । কচি হাত দিয়ে আমার মুখ ঘুরিয়ে দিল ডানদিকে। উ-উ, কি লোক , কি লোক ! কেউ আমার মতো থেবড়ে বসে আছে , কেউ বা দাঁড়িয়ে আছে দূরে দূরে ।

    এক এক একজন ওঠে , প্রথমে নীচু গলায় তারপর ক্রমে ক্রমে গলা তুলে চেঁচিয়ে কি সব বলতে লাগল। একজন মহিলাও এসটেজে উঠে কি সব বলতে লাগল ভীষণ চিৎকার করে। হাজার হাজার লোক হো হো করে চেঁচাতে লাগল, হাত তালি দিতে লাগল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। মুখ্যু মানুষ। আমিও ওদের দেখাদেখি হাত তালি দিতে লাগলাম। আমার দেখাদেখি শম্ভুও হাততালি দিতে লাগল। খুব মজা পেয়ে হাসতে লাগল ফোকলা দাঁতে। মহিলার কথার মাঝে মাঝে কালবোশেখীর গর্জনের মতো আওয়াজ উঠতে লাগল মাঠে । আমার আচমকা ছোটুর কথা মনে পড়ে গিয়ে প্রাণটা আনচান করতে লাগল। অবোলা প্রাণী একা একা কি করছে কে জানে। আমাদের বাপ ব্যাটাকে ছেড়ে এক দিনও তো থাকেনি । শম্ভুকে কোলে নিয়ে আমি যখন মাঠ পেরিয়ে আসছি কেমন উদাস চোখে তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে। কিছুটা হেঁটে এসে তারপর দাঁড়িয়ে গেল ছোটু। ওর বোধ হয় খুব দুখ্যু হল। আগ্যা, কি বললেন- এসব আমার ভ্রম ? ওদের এসব হয় না। তা হবে হয় তো। আমি নির্বোধ মনিষ্যি। আমি আর কি বুঝি । ওর দুখ্যু না হলেই ভাল।

    পাশের মাঠে সাদা জামা প্যান্ট পরা ছেলেরা ব্যাটবল খেলছে। তারা খেলায় ডুবে আছে। এদিকে তাকিয়েও দেখছে না। মাঠের পাশ দিয়ে যেতে যেতে কিছু মানুষ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। ওই দূরের এসটেজের দিকে তাকিয়ে ঠাওর করার চেষ্টা দিচ্ছে। মাইকে কান পেতে কথা শুনছে খানিকক্ষন । তারপর চলে যাচ্ছে যে যার রাস্তায়। ওদের বোধ হয় বি পি এল কাটের গরজ নেই। বড় বড় পরদা দেখতে পাচ্ছি এখান থেকে । লোকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে গম্ভীর মুখে।

    বিকেল চারটে নাগাদ গেরামের লোকজনেদের আবার বাসে তোলা হল। আবার ঘন্টা চারেকের পথ।
    ছেলে কোলে নিয়ে ফের গেরামের কাঁচা রাস্তায় এসে নামলাম। আঁধার নেমে এসেছে তখন। চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে।

    ************ **************** ***************

    বাসরাস্তা থেকে বেশ খানিক হেঁটে মাঠের ওপর উঠলাম। শম্ভুকে কোল থেকে নামিয়ে বললাম- এবার এট্টু হাঁট বাবা... বড্ড কষ্ট হচ্ছে। শম্ভুর জ্বরে ভোগা দুবলা শরীর । নামতে চায় না। গলা আঁকড়ে ধরে দু হাত দিয়ে। বলে- না বাবা, হাঁটব না। আমারও কষ্ট হচ্ছে। যাই হোক , ঘেমে নেয়ে হাঁফিয়ে টাফিয়ে কোনরকমে অত বড় মাঠটা পেরিয়ে আমার কুঁড়েতে গিয়ে পৌঁছলাম । ওই ওপাশে খুব বড় জঙ্গল। হোথায় হায়েনা আছে , শেয়াল আছে। বাঘও আছে লোকে বলে।

    চাঁদ উঠেছে খুব বড় হয়ে । আলোয় বেশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে চারপাশ। কুঁড়ের সামনে এসে শম্ভুকে কোল থেকে নামালাম। আশেপাশে তাকিয়ে ঘুরে ফিরে দেখলাম ছোটু নেই কোথাও। আমার বুকটা ধক করে উঠল। নিশুত আঁধার। কোথাও জনমনিষ্যি নেই। জঙ্গলে হায়েনা আছে, শেয়াল আছে ... । শম্ভু কোল থেকে নেমেই বলল, ‘ছোটু কোথায় বাবা ?’
    আমাদের পৃথিবীতে আমরা শুধু তিনটি প্রাণী। আমরা দুই বাপ ব্যাটায় ছোটু ... ছোটু বলে চেঁচাতে লাগলাম। দূরের জঙ্গলে উড়ে উড়ে মিলিয়ে যেতে লাগল আমাদের আওয়াজ। কটা পাখি চ্যাঁ চ্যাঁ করে চেঁচাচ্ছে কোন গাছের ডালে । বুকে খুব যন্তন্না হতে লাগল বাবু।

    কেটে গেল এক হপ্তার মতো।

    আমরা এখন আবার দুজন আমাদের সংসারে। শম্ভু এদিক সেদিক ঘুরে ঘুরে এখনও ছোটুকে খুঁজে বেড়ায়। আর কি কখনও ঘোড়াটার দেখা পাব! এ ক’দিনে বুকের যন্তন্নাটা একটু যেন হাল্কা হয়েছে। মনকে বোঝাই, বেকার মায়া বাঁচিয়ে রেখে লাভই বা কি হ্যাঃ। আমরা হলাম গিয়ে বেসাকিন মনিষ্যি । কখন কোথায় থাকি তারই নেই ঠি ক। ও তো এমনিই একা হয়ে যেত । কেই বা দেখত ওকে ! জঙ্গলে হায়েনা আছে, শেয়াল আছে.........। তার চেয়ে নিজেই গেছে, ভালোই হল।

    আরও দিন পনের কেটে গেল। বেলা এগারোটা নাগাদ আমি আর শম্ভু দখিন দিকের হাড়ি পাড়ার একটা ঝিঙে খেতের আলের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম। শম্ভু হঠাৎ বলে উঠল- ওই দেখ বাবা………। আঙুল তুলে কালিতলার মেঠো রাস্তার দিকে দেখাল।

    মেঠো রাস্তার ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছে ছোটু। তার পিঠে কালো মোটামতো সেই যে ছেলেটা এসেছিল মিটিং-এ যাবার জন্য বলতে সে গ্যাঁট হয়ে বসে আছে। হ্যাট হ্যাট করতে করতে ছোটুর পেটের কাছে লাথি মারছে। ওইটুকু একরত্তি ঘোড়া, ও কি পারে অত চাপ সহ্য করতে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে। এক্কেবারেই পারছে না। বেঁকে যাচ্ছে ব্যথায়। তিরতির করে কাঁপছে । আবার পেটের কাছে হাঁটু দিয়ে গোত্তা। রোদ্দুর জমজম করছে। মুনিশরা জমিতে জল মারছে। খোঁটায় বাঁধা চারটে গোরু একমনে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে।

    শম্ভু দুহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে কান্না ধরা গলায় বলল- বা-বা......। কান্নায় ওর গলা বুজে এসেছে। আমি নীচু হয়ে ওর মাথার চুলে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেললাম বাবু। বললাম – হ্যাঁ বাবা...... বাপধন আমার.......।

    কালকে আর একটা পাটি এল বাবু আমাদের কুঁড়েতে। সামনে শুক্রবার আর একটা রেলি আছে কলকেতায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন